0

গল্প - সৈকত ভট্টাচার্য

Posted in


গল্প


দিনরাত্রির গল্প
সৈকত ভট্টাচার্য 



১।। 

মাথার উপর দিয়ে হাতটা ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়ে জামার তলা দিয়ে পিঠটা চুলকোতে চুলকোতে বিরিঞ্চিদার চোখটা আরামে প্রায় আধবোজা হয়ে এসেছিলো। সেই অবস্থাতেই বলে উঠলেন, “বুঝলি, এ বছরও কেচকীটা যাওয়া হলো না! তবে সামনের বছর যাবোই।” অপূর্ব ‘যাবোই’ কথাটাকে অনুকরণ করে বিরিঞ্চিদার চোখ বন্ধ থাকার সুবিধা নিয়ে একটু ভেঙচি কাটলো। সুমন নিঃশব্দে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগলো। চায়ের দোকানের হরিপদদা একটু মুচকি হেসে গ্লাসের চায়ে চিনি দেবেন কি না, সেটা ইশারাতে জানতে চাইলেন আমার কাছে। আমি তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের মধ্যের ফাঁকটা যথাসম্ভব কমিয়ে এবং তার সাথে চোখটাও যথাসম্ভব ছোটো করে বোঝালাম যে অল্প চিনি দিও। হরিপদদা মাথা নেড়ে চামচের ডগায় করে চিনির মুণ্ডহীন প্লাস্টিকের কৌট থেকে অল্প চিনি বের করে গ্লাসে দিয়ে নেড়ে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। 

বিরিঞ্চিদা ততক্ষণে হাতটিকে যথাস্থানে ফেরত এনেছেন। জামার উপরের দুটো বোতাম খোলা থাকায় পিঠ চুলকনোর সময় কলারের অংশটা পিঠের দিকে নেমে গেছিলো খানিকটা। সেটাকে টেনে সামনে এনে ফেললেন বিরিঞ্চিদা। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, “তোদের ওখানে কেচকীর মতো জায়গা আছে?” 

আমি চাতে চুমুক দিয়ে বললাম, “হ্যাঁ। বান্দীপুর আছে। বিশাল বড়ো জঙ্গল। তিনটে রাজ্য জুড়ে আছে। ওখানেই তো সেই বীরাপ্পন…” 

“ধুর। কেচকীর মতো কোয়েল নদী আছে? সবুজ সবুজ পাহাড়… ওখানে সেই বইটার শ্যুটিং হয়েছিলো। আরে ওই যে… কী যেন?” বিরিঞ্চিদা হাতড়াতে থাকেন। পাশ থেকে অপূর্ব বলে ওঠে, “অরণ্যের দিনরাত্রি।” 

“হ্যাঁ। সত্যজিৎ রায়ের বই।” বিরিঞ্চিদা খেই পেলেন যেন কথায়। তারপর দুহাত দিয়ে নিজের দুই হাঁটুতে চাপড় মেরে বললেন, “না রে, কেচকীটা একবার যেতেই হবে। এবারও ভাবললাম। কিন্তু এই ছেলেটার ক্লাস টেন হলো। তোদের বৌদি বললো একটা ফিজিক্যাল সায়েন্সের টিচার লাগবে নাকি। এত খরচা করে হয়, বল?” একটু সমর্থনের আশায় আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমি মাথা নেড়ে বললাম, “সেই তো…”।

“তুই যদি এখানে থাকতিস, তোকেই পড়াতে বলতাম রে শুভ। তুই এত ভাল ছেলে। চাকরি করতে ব্যাঙ্গালোর চলে গেলি। পারলে একবার আসিস না! ওর কোথায় কীসব আটকাচ্ছে না কি! একটু দেখিয়ে দিস… তোরা হলি পাড়ার গৌরব।” বিরিঞ্চিদা কারোর প্রশংসা করতে শুরু করলে সহজে থামেন না। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা রেকারিং ডেসিম্যালের দিকে এগোনোর আগেই আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, “নিশ্চয়ই বিরিঞ্চিদা। আমি তো আছিই এই সপ্তাহটা। চলে আসবো কাল পরশু।” 

“আসিস। আসিস।” বলে মাথা নাড়লেন। 


পাড়ায় ফিরলে আমাদের পুরনো আড্ডার জায়গাটায় এসে একবার বসতেই হয়। এমনিতে ব্যাঙ্গালোরে যাওয়ার পর থেকে বাড়ি ফেরা বলতে ছয়মাসে একবার। সাধারণতঃ মা বাবাই চলে আসে ওখানে। আমার ফেরা ওই নলেন গুড়ের গন্ধে বছরশেষের ছুটিতে আর আমের লোভে আমার জন্মদিনের সময়টায়, মানে, মে মাস নাগাদ। এমনিতে এখন ফেসবুক, হোয়্যাটস্যাপ হয়ে 'দূর' বলে তো কিছু নেই। সব বন্ধুদের সাথেই সামনা সামনি না হোক, ভার্চুয়ালি যোগাযোগটা সবসময় আছে। তবু এই হরিপদদার চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে আড্ডা দেওয়ার মধ্যে সেই যে মজাটা আছে, সেটা ফেসবুক হোয়্যাটস্যাপে নেই। তার অবিশ্যি দুটো মূল কারণ। এক হলো হরিপদদার এক্সপোর্ট কোয়ালিটির চা। গোটা পৃথিবীতে এমন চা কেউ বানাতে পারে কি না, সে ব্যাপারে আমাদের সকলের মনেই একটা সন্দেহ আছে। সুমনাকে একবার নিয়ে এসে হরিপদদার চা খাইয়েছিলাম। তার আর্ল গ্রে, উলঙ, ক্যামোমাইল টি খাওয়া মুখ। অমন ফোটানো দুধ চা দেখে নাক শিঁটকেছিলো। কিন্তু দুচুমুক খেয়ে তারিফও করেছিলো। অবশ্য সেটা ভদ্রতাবশতঃ কি না, জানিনা। তার অল্পদিন পরেই আমাদের ব্রেক আপ হয়ে যায়। ফলে জানাটা আর হয়ে ওঠেনি। 

হরিপদদার চা ছাড়া অন্য কারণটা অবশ্যই ওই ভদ্রলোক, যার কথা শুরুতেই বললাম। বিরিঞ্চিদা। বিরিঞ্চিদার বয়েস প্রায় পঁয়তাল্লিশ। অর্থাৎ আমাদের থেকে প্রায় বছর পনের-ষোলর বড়ো। সাধা-সিধা ভালো মানুষ। কর্পোরেশনে একটা চাকরি করেন। সেরকম বড়োসড়ো কিছু নয়। তবে চলে যায়, মধ্যবিত্ত জীবন যেমন চলে। ছেলের টিউশনি অতিরিক্ত নিতে হলে অন্য দিক দিয়ে সেটা ম্যানেজ করতে হয়। তবে পাড়ার কারোর কিছু হলে সবার আগে তাকে দেখা যায়। এমনকি নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে অনেককে বিপদে আপদে সাহায্য করতেও পিছপা হন না। হয়ত সে মাসে দু রবিবার মাংস হয়নি বিরিঞ্চিদার বাড়িতে। কিন্তু কেই বা সেসব কথা জানতে পারে! 

বিরিঞ্চিদার শুধুমাত্র শখ একবার কেচকী বেড়াতে যাওয়ার। এমন নয় যে বাকি ভারতবর্ষ ঘুরে ফেলেছেন! আমাদের কলকাতা শহরের উত্তর দক্ষিণ বাদ দিয়ে কোথাও খুব একটা গেছেন কি না সন্দেহ আছে। এমনকি দীঘা বা পুরীও যাননি কখনো। ব্যারাকপুরে নিজের মামাবাড়ি ছিলো। ওর নিজের মুখেই শোনা। সেখানে হয়তো দুএকবার গিয়ে থাকতে পারেন। তা বাদে এই গুলু ওস্তাগর লেনের তিনের চার নম্বর বাড়িতেই আজন্ম প্রতি রাত তিনি কাটিয়েছেন। তবু কাশ্মীর, কেরালা ছেড়ে কেন কেচকী যাওয়ার এত শখ সেটা আজ অবধি আমরা কেউ বুঝে উঠতে পারিনি। প্রতি বছরের শুরুতেই ছুটির লিস্ট দেখে বিরিঞ্চিদা কেচকী যাওয়ার প্ল্যান বানাতে থাকেন। আমি যতদিন অপূর্বদের এই হরিপদদার চায়ের দোকানে আসছি, প্রতি শীতেই শুনি বিরিঞ্চিদা এবার কেচকী যাবেনই। কিন্তু কিছু না কিছু কারণে কেচকী আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। মাঝে তো মাওবাদীদের সন্ত্রাসে ওখানে যাওয়া আসা বন্ধই হয়ে গেছিলো। এখন আবার একটু একটু করে মানুষ যাচ্ছে। কিন্তু বিরিঞ্চিদার এখনও যেয়ে ওঠা হলো না। 

২।। 

এই পুজোর সময়টাতে ব্যাঙ্গালোরের আবহাওয়াটা দুর্দান্ত থাকে। এমনিতে যতই এয়ারকন্ডিশন সিটি বলা হোক, পলিউশন আর জনসংখ্যার চাপে এ শহরের গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে অনেক। কিন্তু এই সময়টাতে বেশ একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব আমাদের ছেলেবেলার সেই হেমন্তকালের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ছোটোবেলায় পড়েছিলাম হেমন্তকালের ইংরিজি নাকি ডিউই সিজন। ওই সময় শিশির পড়া শুরু হয়। রাত অবধি বাইরে থাকলে মা বকাবকি করতো, “এই মাথায় হিম পড়ে ঠাণ্ডা লাগাবি এবার। জ্বর হলে কিচ্ছু দেখবো না! ফেলে রেখে দেবো!” বলা বাহুল্য জ্বর হলে রাত জেগে মাথায় জল-পট্টি দেওয়ার কাজটা ওই একজনই অমন যত্ন নিয়ে করে এসেছে। এখন অনিয়ম করলে ওই একই ডায়লগ আমি বলে শোধ নিই। মা হাসে। 

গাড়ির জানলা দিয়ে যানজটে রুদ্ধ একটা শহরের চেহারা দেখতে দেখতে এইসব সাত-পাঁচ ভাবছিলাম। শেয়ার ক্যাবে পাশের লোকটা মোবাইলে শব্দ করে গেম খেলে যাচ্ছে। দু একবার অস্বস্তি প্রকাশ করেছি। কিন্তু তার সেরকম ভ্রূক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। শব্দটা আর সহ্য হচ্ছে না। ব্যাগ থেকে হেড ফোনটা বের করে কানে লাগিয়ে ইউটিউব খুলি। প্লে-লিস্ট থেকে মহম্মদ রফিকে বেছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে হেড রেস্টে মাথা ঠেকাই। আজ ষষ্ঠী। আরও একটা পুজো যানজটে আটকেই কেটে যাবে যা মনে হচ্ছে। কতদিন বাড়ি যাই না পুজোতে। অপূর্বরা প্রতিবারই বলে। কিন্তু এইসময়টাই আমাদের এখানে কাজ দেখানোর সময়। অ্যাপ্রাইজাল সাইকেল ক্লোজ হওয়ার আগে বসের মন ভালো রাখাটা একটা অবশ্য কর্তব্য। যদিও তারপরেও অ্যাভারেজ রেটিং পাবো, ঠিক জানি। কিন্তু আশাতেই বাঁচে চাষা। যদি এবার সেরা রেটিং পেয়ে প্রোমোশনটা হয়ে যায়… গতবার অবশ্য একটা কাজ হয়েছে। মার্কিন মুলুকে যাওয়ার ভিসাটা অ্যাপ্লাই করা হয়েছে। লটারিতে নাম উঠে এখন অপেক্ষা করছি কবে হাতে পাওয়া যাবে তার। ওই দেশে গিয়ে একটু পা রাখার জন্যই সবাই লড়ে যাচ্ছি সকাল থেকে সন্ধ্যে। রোজ।

হঠাৎ ইউটিউবটা থেমে যাওয়ায় সম্বিৎ ফেরে। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি মহেশ ফোন করছে। মহেশ আমার বস। বুঝলাম, দেরী হয়ে যাচ্ছে। সোয়াইপ করে কলটা কানেক্ট করি। 
- “ইয়েস মহেশ?” 
“হোয়্যার আর ইউ, ম্যান?” 
“অন্য দ্য ওয়ে। প্রোব্যাবলি অ্যানাদার ফিফটিন মিনিটস।” 
“নো প্রবলেম। আই কল্ড ইয়ু টু গিভ আ নিউজ।” 
“হোয়্যাটস দ্যাট?” আমি কৌতূহলী হই। 
“আই গট অ্যান অ্যাপ্রুভাল ফর দ্য পজিশন ইন ইউএস ফর ইয়ু। নাউ জাস্ট ইয়ু হ্যাভ টু গেট দ্য ভিসা।”
“ওহ, গ্রেট! থ্যাংকস।” 
“নো প্রবস। কাম। উইল টক ইন ডিটেইলস।” বলে কলটা কেটে দেয়। পেটের মধ্যে থেকে এক রাশ আনন্দ যে ফুরফুর করে উড়ে বেড়িয়ে গেলো, তার বলার অপেক্ষা রাখে না। ট্রাফিকে আটকে থাকাটাও হঠাৎ বড়ো সুখপ্রদ মনে হতে শুরু করে দিলো। 

সোনালির জন্য অপেক্ষা করতে করতে একটা ক্যাপুচ্চিনো অর্ডার করে দিলাম। সোনালি বেরিয়েছে বললো অফিস থেকে। এখানে পৌঁছতে আরও মিনিট পনের। তার মধ্যে বিনা অর্ডারে বসে থাকাটা একটু বাজে দেখায়। তাই ওয়েটারকে ডেকে বললাম একটা ক্যাপুচ্চিনো দিতে। সোনালি কুলকার্ণি। নাগপুরের মেয়ে। ব্যাঙ্গালোরে আছে। আমার মতো। চাকরি করছে। সোনালি ছিলো আমার রুমমেট অক্ষয়ের বন্ধু। সেই সূত্রে পরিচয়। তারপর গত দুবছর ধরে সে আমার গার্লফ্রেন্ড। সোনালিকে বলিনি এখনো সকালের খবরটা। আমার ইউ এস যাওয়ার খবরটার জন্য যে ও অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে, সেটা আমি জানি। তাই ভাবলাম খবরটা সামনা সামনিই বলবো। তাই অফিসের পর আমাদের অফিস পাড়ার এই কফিশপটায় আসতে বলেছিলাম ওকে। 

ওয়েটার কফিটা দিয়ে যাচ্ছে না এখনো। একবার হাত নেড়ে মনে করালাম। ওও ইশারায় একটু সময় চেয়ে নিয়ে কোথায় পালিয়ে গেলো। যাই হোক, আমার সময় কাটানো নিয়ে কথা। সকালের পর থেকে হঠাৎ করে অফিসটাকে খুব ভালো লাগতে শুরু করে দিয়েছে। মহেশকে সকাল থেকে একবারও রক্তলোলুপ পিশাচ মনে হয়নি। অবন্তিকা ডাইনি মনে হয়নি আজ। বরং ও হাসলে যে সাইড প্রোফাইলটা বেশ ফোটোজেনিক হয়ে ওঠে সেই ব্যাপারটা আবিষ্কার করে ফেললাম লাঞ্চ টেবিলে। আর অক্ষয়ের জন্য ডিনার নিয়ে যাবো বলেছি। ও তো খুব খুশি।

হোয়্যাটস্যাপ খুলে এদিক সেদিক করছিলাম। সোনালিকে পিং করে ‘কাহাঁ হো?’ বলে একটু খোঁচা দিলাম। জবাব দিলো না। ড্রাইভ করছে বোধহয়। হঠাৎ একটা অজানা নম্বর থেকে কল ঢুকলো। সোয়াইপ করে কানে তুললাম। 
“হ্যালো?" 
“শুভ?"
“ইয়েস, হু ইজ দিস?”
“শুভ? শুভ বলছিস?” এতক্ষণে গলা বুঝতে পারলাম। 
“হ্যাঁ, বিরিঞ্চিদা বলো।” 
“কেমন আছিস?” 
“ভালো। তুমি কেমন আছো?” 
“ভাল রে। অপূর্ব তোর নম্বরটা দিলো আমায়।”
“ওহ, আচ্ছা।” সোনালিকে দেখতে পেলাম কাছের দরজার ওপারে। আমি হাত দেখলাম। এবার বিরিঞ্চিদাকে কাটাতে হবে। বললাম, “আচ্ছা, শোন আমি তোমায় ঘরে ফিরে ফোন…”  কিন্তু আমায় কথা শেষ করতে না দিয়েই ওপাশ থেকে খুশির স্বর, “আরে, ছেলেটার ফিজিক্যাল সায়েন্সের নম্বর বেরিয়েছে। ভালোই পেয়েছে। ভাগ্যিস তুই দেখিয়ে দিয়ে গেলি একটু।” 
“বাহ খুব ভালো।” খুশি হওয়ার চেষ্টা করি। সোনালি এসে বসেছে উল্টো দিকের চেয়ারে। প্রশ্ন বোধক মুখে বসলো। হাত নাড়িয়ে ইশারাতে জিজ্ঞেস করলো, “কে?" আমি হাত নাড়িয়ে “বলছি" বললাম। ওয়েটার এসে মেনু কার্ডটা দিয়ে গেলো। আমি তাকে ইশারাতে জিজ্ঞেস করলাম ‘ক্যাপুচ্চিনোটা কই?” সে একই ভাবে দু আঙুল দিয়ে দুমিনিট বুঝিয়ে পালিয়ে গেলো। আমি বিরিঞ্চিদাকে আবার বলার চেষ্টা করলাম, “আচ্ছা, বিরিঞ্চিদা…” 
“আর শোন না, ডিসেম্বরে কেচকী যাবো ভাবছি রে। অফিস থেকে ছুটি ম্যানেজ করছি। টিকিট কেটে নিলাম। বছরশেষে কেচকী। ভালো হবে তো, বল?” 
“সে তো হবেই। তোমার এত দিনের প্ল্যান।” 
“এবার কেচকী যাবই। যাই হয়ে যাক। কী বলিস?” বিরিঞ্চিদার উচ্ছ্বাস চাপা থাকে না। 
“নিশ্চয়ই। আচ্ছা। আমি একটু বাইরে আছি। তোমায় পরে ফোন করবো।” এবার বলেই ফেলি। 
“হ্যাঁ রে। ভালো আছিস তো?” 
“হ্যাঁ ভালো আছি।” মনে মনে বল্লাম, ‘কতবার বলবো?” 
ফোনটা রাখতেই সোনালি প্রশ্ন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। "কিসকে সাথ বক রহা থা? কেয়া হুয়া? অচানক ইতনা জরুরী তলব?” 

৩।। 

এয়ারপোর্টে নামতেই কোলকাতার ঠাণ্ডা বেশ গায়ে লাগলো। এবার ডিসেম্বরের শেষেই দেখছি তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডাটা জাঁকিয়ে পড়ে গেছে! হাড় অবধি কাঁপিয়ে দিলো। মা বলছিলো বটে। আজকাল কোথায় আর এমন ঠাণ্ডা থাকে? 

ঠিক করেছি, এবার প্রাণ ভরে মিষ্টি খেয়ে যাবো। ইউ এস পাড়ি দেওয়ার আগে এই হয়তো শেষ আসা। ওখানে কতদিন থাকতে হবে, কে জানে! ওখানে আমাদের অফিস থেকে মাইলখানেকের মধ্যে একটা ইন্ডিয়ান রেস্ট্যুর‍্যান্ট আছে বলে শুনেছি। কিন্তু সেখানে তো আর এমন নলেনগুড়ের সন্দেশ পাওয়া যাবে না! তাই এই সাতদিনে ভালো করে পছন্দের খাবারগুলো খেয়ে যেতেই হবে। 

টার্মিনাল থেকে বের হয়ে একটা ক্যাব নিলাম। এই সময়টায় পার্ক স্ট্রীট বড়ো সুন্দর লাগে। বড়োদিনের সাজে সেজে ওঠা পার্ক স্ট্রীট। আলোর মালায় কলোনিয়াল গন্ধমাখা কেক আর কুকিজের পার্ক স্ট্রীট। ছোটোবেলায় বাবার সাথে কেক কিনতে যেতাম। না, কোনও নাহুম বা ফ্লুরিজ নয়। পার্ক স্ট্রীট থেকে ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে ঢুকে একটু এগিয়ে মোকাম্বো টোকাম্বো পার হয়ে বাঁ দিকে একটা ছোট্ট দোকান ছিলো। সেখান থেকে পাম কেক নিয়ে বাড়ী ফিরতাম বাবার সাথে। সে দোকান আজ প্রায় পনের বছর হয়ে গেছে যাওয়া হয়নি। পাড়ায় পাড়ায় এত কেকের দোকান, সেই পার্ক স্ট্রীট যাওয়ার আর দরকার পড়ে না। কিন্তু ওই দোকানে গেলে কেকের সাথে একটা অ্যাপেল পাই কিনে দিতো বাবা। আমি কলকাতা ব্যাঙ্গালোরে এত জায়গায় এত ক্যাফেতে এত খাবার খেয়েছি তারপর, কিন্তু সত্যি বলতে অমন অ্যাপেল পাই কোথাও পাইনি। এই ক্যাবের জানলা দিয়ে আস্তে আস্তে সাজতে থাকা কোলকাতার দিকে তাকিয়ে সেই দোকানটার সেই অ্যাপেল পাইটা খেতে বড়ো ইচ্ছে করলো। জানিনা সেই দোকানটা আছে কি না। তবে সময় করে যাব একবার এবার। খুঁজে দেখবো নিশ্চয়ই। 

ফোনের শব্দে চমকে উঠি। এখন কে? এয়ারপোর্টে নেমেই মা আর সোনালিকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছি। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখি অপূর্ব। হঠাৎ? 
- “হ্যালো?" 
“শুভ। কোথায় তুই?” 
“এই তো কোলকাতায় নেমেছি। বাড়ি যাচ্ছি।”
“শুভ। একটা বিপদ হয়েছে।” 
“কী হলো?”
“বিরিঞ্চিদা।” 
“বিরিঞ্চিদার কি হলো আবার?”
“আরে নিউজে দ্যাখ। ট্রেন এক্সিডেন্ট হয়েছে। বিরিঞ্চিদা কেচকী যাচ্ছিলো। পালামৌ এক্সপ্রেসে। ডিরেইলড হয়ে বড়ো ধরণের এক্সিডেন্ট।” 
“মানে, বিরিঞ্চিদা কেমন… মানে, কই… ?” 
“ইঞ্জিওর্ড। আমরা গাড়ি নিয়ে রাঁচি যাচ্ছি। ওখানের হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তুই কি আসবি?”

আমরা যখন রাঁচিতে পৌঁছলাম, তখন ভোর হয়ে গেছে। সেই ক্যাফেতে বিরিঞ্চিদা ফোন করার পর, আমার আর বিরিঞ্চিদাকে ফোন করা হয়নি। ভুলেই গেছিলাম রোজকার কাজের চাপে। তার উপর নতুন ভবিষ্যতের আনন্দ। নিজেকে একটু হলেও অপরাধী মনে হচ্ছিলো।

হাসপাতালে সারি সারি আহতের মধ্যে বিরিঞ্চিদা শুয়ে এক কোনায়। বৌ আর ছেলেকে না নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়েছিলো এবার। এতদিনের অপেক্ষার পর। বাইরে ডাক্তারের সাথে কথা হলো। পায়ের ফিমারটা গেছে। অপারেশন করতে হবে। তাতেও ঠিক হবে কি না, বলা যাচ্ছে না। হয়তো বরাবরের মতো পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন মানুষটা।  

বিরিঞ্চিদাকে ঘুমোতে দেখে আমরা বাইরে একটা দোকানে একটু ব্রেকফাস্ট সেরে নেয়ার জন্য ঢুকলাম। গরম গরম পুরি সবজি অর্ডার দিয়ে একটা টেবিলে বসা হল। ছোট্ট দোকান। এক কোনায় একটা আদ্যিকালের টিভিতে খবর চলছে। পুরি এলো। মুখে তুলতে গিয়ে চোখটা টিভির পর্দায় আটকে গেলো। মার্কিন সরকার ঘোষণা করেছে যে এ বছর কয়েকটি কম্পানিকে তারা ব্ল্যাকলিস্টেড করেছে, তাদের কোনও এমপ্লয়ির ওয়ার্ক ভিসা দেওয়া হবে না। সেই কম্পানির লিস্টে তিন নম্বরে আমাদের কম্পানির নামটা লেখা।

অপূর্ব হসপিটালের ভিতরে ছিলো। দৌড়ে এসে বললো যে বিরিঞ্চিদা উঠেছে। উঠে নাকি আমার নাম করেছে। তাড়াতাড়ি খাওয়া ফেলে দৌড়ে গেলাম। ডান পা, ডান হাত আর মাথায় বড়ো ব্যান্ডেজ। কোনও রকমে মিট মিট করে তাকাচ্ছে। আমায় দেখতে পেয়ে আলতো হাসার চেষ্টা করে। ফিসফিস করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। 

“কী বলছ? বেশী কথা বোলো না। ডাক্তার বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা নেই।”

ডান হাতটা তুলে আমায় কাছে ডাকে। মাথা নিচু করি। বিরিঞ্চিদা খুব ধীরে ধীরে কথা বলছে। এবার শুনতে পাই। 

“শুভ। ভালো আছিস তো? দ্যাখ এবারো কেচকী যাওয়া হলো না। পরের বার ঠিক যাবোই দেখিস… কোয়েল নদীর ধারে… সবুজ পাহাড়… সব দেখবো… “ 

ফোনটা একটানা ভাইব্রেট করে যাচ্ছে। অফিসের নাম্বার...

0 comments: