0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in

ধারাবাহিক

প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত

।।২৬।।

॥ গোরাচাঁদ ।।

অপার অথৈ সমুদ্র মাঝে কম্পাসহীন উদ্ভ্রান্ত নাবিকের মতো
গভীর জঙ্গলের ভিতরে বনচারীকে দিকহীনতার ভ্রান্তি চেপে বসে।

বড়ো ময়দানের একপাশে আদিবাসীদের ছোটো ঘন বসতি। বিস্তীর্ণ মাঠের রঙ মঙ্গল গ্রহের মতো সপাট লাল। কিনারায় উঁচু উঁচু দেবদারু গাম্হার। বস্তির পাশেই একটা স্বল্প নিচু খাদ। সেখানে উল্টে পড়ে আছে তিনটি মিলিটারী সাঁজোয়া গাড়ি ও একটা ট্যাংক । ক্ষতিগ্রস্ত । বস্তির ঘরগুলো সব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে স্তুপিকৃত। মাটিতে মর্টার ও কামানের গভীর গর্ত। রাশিয়ান মেজর জেনারেল সারগেই এর মাঠে অস্থির পায়চারি। গ্রামের মানুষেরা গেল কোথায়? মৃত আহত জীবিত এখানেই তো জমায়েত হয়ে থাকার কথা। বেলা ডুবু ডুবু।এই সময় জঙ্গলে হুড়মুড় করে আঁধার নামে। তারপর ঢালু সঙ্কীর্ণ খাঁড়ি বেয়ে পথ তৈরি করে অত্যন্তগভীর জঙ্গলের ভিতরে কেউই যেতে সাহস করে না । অবশ্য তা সেখানেহিংস্র বন্যপশুর জন্যে নয়,একবার ভুলভুলাইয়ায় ধরলে তার আর রক্ষে নেই। পালিয়ে যাওয়া মানেই আত্মহত্যা। তা সে বনচারীই হোক না কেন। দুধঝর্ণার পাশে বড় ময়দান অব্দি পথ নির্দেশ জনজাতির প্রত্যেকে জানে, প্রথমবার ঢাকের সংকেত যেখানে সবাইকে ঘর ছেড়ে জমায়েত হতে বলা হয়েছিল। এই বড় ময়দানেই তো অঞ্চলবাসীদের বলা হয়েছিল ঘর ছেড়ে জমায়েত হতে। সারগেই অস্থির। মাঝে মাঝেই গোরাচাঁদের কাছে এসে কিছু কিছু উদ্বিগ্ন প্রকাশ করছে। এমন তো নয় যে সৌমজিতের বাহিনী ওদের ট্রাকে ট্রাকে ভরে গভীর খাতে ফেলে দিয়ে এসেছে? গভীর জঙ্গলে মৃত্যুর মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে? গোরাচাঁদ শান্ত। চুপচাপ। মাঠের একদিকে সাদা চাদর বিছানো লোহার বেঞ্চে তিনি বসে । সামনে সেইরকম একটা লম্বা টেবিল। গোরাচাঁদের দুইপাশে দুই দেশীয় মিলিটারি পার্সোনাল। একটি ওপেন এয়ার কোর্ট অফ জাজমেন্ট। সারা মাঠ জুড়ে থিকথিক করছে দুই দেশের সৈনিক। মিলিটারি জজদের ট্রাইব্যুনাল বসেছে ।মহড়াতে উপস্থিত সৈন্যবাহিনীর যারা উচ্চপদস্থ তারা সৌমজিতের অজান্তেই মিলিটারি ক্যুপ গঠন করে কেন্দ্র থেকে ট্রায়াল কাউন্সিল ডিফেন্স কাউন্সিল ও পাঁচজন উচ্চপদস্থ মিলিটারি কর্মকর্তার ব্যবস্থা করে সারগেইকে খবর দিয়েছেন। কিন্ত গোরাচাঁদ হয়রান হয়ে গেলেন। এতো দ্রুত এসব কিভাবে সম্ভব? তবে কি অনেক আগে থেকেই ওর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ধিকিধিকি জ্বলছিল? তবে একটা ব্যাপারে দুই সৈন্য পক্ষ এমনকি গোরাচাঁদ ছাড়া এখানের আর কেউই জানেনা। প্রায় শ তিনেক জনজাতির জমায়েত এই ময়দানে থাকার কথা তারা এই ভর সন্ধ্যায় কোথায় উবে গেল? তাদের সাথে সৌমজিতের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স ওই মর্টার ট্যাংক চালানোর সৈন্য আর স্নাইপার টিম? কোথায়? গোরাচাঁদের কাছে এর উত্তর আছে। আর পেরোর বিচক্ষণতার কথা মনে আসতেই বারবার উদ্গত অশ্রু মুখ নিচু করে রোধ করছেন। দূর থেকে জিপগাড়ির অস্পষ্ট শব্দ শুনে চোখ তুলে দেখেন তিনটে ভারি জিপ ময়দানে ঢুকছে। একটু পরে হেভি লোডেড আগ্নেয়াস্ত্র ঘেরা সৌমজিত জিপ থেকে নামল। সঙ্গে সঙ্গে সারা ময়দান উজ্জ্বল দিনের আলোর মত আলোকিত হয়ে উঠল। জেনারেটরের আওয়াজ। সৌমজিত নিজস্ব পদমর্যাদায় উন্নত মস্তকে সোজা। সৈনিকেরা সাবধান পজিশনে হাতে অস্ত্র লাইনে দাঁড়িয়ে। সৌমজিত আরো একটু সামনে এসে বীরদর্পে দাঁড়ায় । একজন প্যানেল জজ মুখ খুললেন। —ওয়েলকাম মেজর জেনারেল সৌমজিত দাস। 
_দিস ইজ রিডিক্যুলাস। আমাকে বোঝানো হয়েছে এখানে একটা মিলিটারি ক্যুপ হয়েছে। আমরা এ্যারেস্টেড। কিন্ত দেখছি নাতো সেনা বিদ্রোহ না সিভিলিয়ান বা মিলিটারি কোর্ট ।এখানে একটা সিভিলিয়ান কয়েকজন রাশিয়ান মিলিটারি ও কয়েকজন সিভিল ড্রেসে উচ্চপদস্থ সেনাধক্ষ। উইল এনিবডি টেল মি এখানে কি হচ্ছে? আমার উপরে এত অস্ত্র উঁচিয়ে রাখা কেন? 
--মিঃ মেজর জেনারেল। আপনি একজন ক্রিমিনাল। আপনি এখন কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর ট্রাইব্যুনালের সামনে দাঁড়িয়ে । সাবধানে কথা বলুন রেসপেক্ট করুন। বহুবার মিলিটারি কোড অফ কন্ডাক্ট ভায়োলেট করেছেন। আপনার স্টাবর্ন বিহেভিয়ার আপনাকে এখানে টেনে এনেছে। নাও লিসন। আপনি হুইমজিক্যালি এখানে একটা গণহত্যা করেছেন জনজাতিদের বাস্তুভিটা ধ্বংস করেছেন। কেন? কেন এই জঘন্য কাজ করেছেন? 
--কে বলেছে আমি কোনো অন্যায় করেছি? দেশের সুরক্ষার জন্য সরকারের আদেশ পালন করেছি। কেন্দ্রীয় সুরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি নির্ণয় আমাকে যেমন যেমন পাঠানো হয়েছে আমি সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। সমস্ত ডকুমেন্টারি প্রুফ আমার আছে। 
--মিঃ মেজর জেনারেল দাস।সকাল ঠিক দশটায় কেন্দ্র থেকে আপনার কাছে যে ম্যাসেজ এসেছিল আপনি রিসিভ করেছেন। তাতে বলা হয়েছে প্রতিটি অপারেশন ইমিডিয়েটলি বন্ধ কর। আপনি সেটা অমান্য করে এই ম্যাসাকার করলেন? কেন? 
সৌমজিত কিছুক্ষন চুপ থেকে বলতে শুরু করল। --সকালে ম্যাসেজ পাওয়ার আগেই আমার ট্রুপ তাদের নিয়ম ও সময় অনুযায়ী ফিফথ ও ফাইনাল মহড়া ক্লিয়ার করার জন্যে বেরিয়ে পড়ে। গত মিটিঙে হেড কোয়ার্টারের অনুমতি বলবত্ রেখে রাতেই সুবেদারদের আদেশ দেওয়া ছিল শেষ এবং ফাইনাল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হবে উগ্রবাদীদের উপর। শেষ মহড়া ও চিরুনি তল্লাশি। 
--সেটাকি রাশিয়ানদের সাথে যৌথ উদ্যোগে ছিল না কি মিঃ মেজর জেনারেল? এমনটাই তো আদেশ ছিল আপনার ওপর তাই না? 
--ডেফিনিটলি।স্যার। কিন্ত ঠিক দশটার সময় রাশিয়ান মেজর জেনারেল মিঃ সারগেই আমাদের দেশের একজনকে ডেলিগেট বানিয়ে একটা এমারজেন্সি মিটিংএর তলব করলেন। তাতে তিনি আনইউজফুল কিছু কথা উঠিয়ে সিন ক্রিয়েট করে সেন্সলেস হয়ে পড়লেন। মিঃ সারগেই এর এই অপারেশনের ব্যাপারে কোনও গরজ দেখলাম না। 
--শুনলাম ওই সিভিলিয়ানটি এন্টায়ার এরিয়ার জনজাতির প্রতিনিধি। প্রতিষ্ঠিত সরকারের মান্যতাপ্রাপ্ত জনজাতি নেতা। এবং আশ্চর্য! ইয়োর ফাদার! অথেন্টিক! আচ্ছা তারপরও কি আপনার মনে হয়নি সেন্ট্রালের জরুরি আদেশটি পালন করা উচিত? 
--স্যার । তাইতো করেছি। তারপর সংগে সংগে আমার ইমিডিয়েট হ্যান্ড সুবেদার ইকবাল ও কয়েকজন ল্যান্সনায়েকদের সাথে মিটিংএ সিদ্ধান্ত নিয়ে তবে এখানে দৌড়ে আসছিলাম। পথে আমাকে ওরা বন্দী করে। 
লাইন থেকে মিলিটারি কায়দায় পারমিশন নিয়ে সুবেদার ইকবাল বেরিয়ে এল। স্যালুট করে বলতে লাগল। --স্যার উনি আজ আমাদের সাথে কোনো মিটিঙ করেননি। মিটিঙ কয়েকজন মাইনস ওনারের সাথে করেছেন। তার ভিডিও রেকর্ড আমাদের কাছে আছে। 
সৌমজিত হতবাক হয়ে গেল। একদৃষ্টে তাকিয়েই রয়েগেল ইকবালের দিকে। হঠাৎ এমন বিশ্বাসঘাতকতা একেবারেই আশা করেনি সে। 
সারগেই মাথা নিচুকরে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে ছিলেন। এবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন। চারপাশে আলো ভেদ করে যেন অন্ধকার নিশ্চুপে সবাইকে গ্রাস করতে আসছে। এখন সারগেই এর গমগমে গম্ভীর গলা ছাড়া ছুঁচ পড়ারও শব্দ নেই।

0 comments: