2

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in


ভৌতবাক


ভবানী বুড়ি
দীপারুণ ভট্টাচার্য


সন্ধের পর জায়গাটা একটু শান্ত হয়ে আসে। আজ অবশ্য বেশ রাতই হয়ে গেছে। সুকান্ত যেখানে বাস থেকে নামে সেই জায়গাটার নাম তেঁতুলতলা। বুড়ি গঙ্গা নদী পেরিয়ে ঢাকার এপারের জনবসতি। আগে সে ঢাকাতেই বাসা ভাড়া করে থাকতো। মা মারা গেছেন বছর তিনেক হলো। বাবাও চলে গেলেন গতবছরের শীতে। মৃত্যুর আগে বাবা তার শেষ সম্বলটুকু দিয়ে তেঁতুলতলার এই জমি কিনেছিলেন। বাবার ইচ্ছা ছিল গ্রামের মতোই একটা ছোট বাড়ি হোক। ছোট পরিচ্ছন্ন উঠান, তুলসী মঞ্চ, পাতকুয়ো থাকুক। থাকুক একফালি বাগানে বেল, করবী, জবা, উচ্ছের চারাটা। কিন্তু বাড়িটা শেষ হওয়ার আগেই বাবা চলে গেলেন। তাই বাড়ি শেষ হওয়ার পর সুকান্ত আর ঢাকার ভাড়া বাড়িতে থাকেনি। স্ত্রী ছন্দাকে নিয়ে চলে এসেছে এই তেঁতুল তলায়। কিছুদিন হলো ছন্দা গেছে বাপের বাড়ি রংপুরে। সুকান্ত এখন একা। তাই অফিস থেকেও দেরীতে বাড়ি ফিরছে আজকাল। হোটেলে দুটো খেয়ে বাড়ির খাটে পিঠটান দিয়ে আরামের ঘুম। 

বাস থেকে নেমে চারদিকটা কেমন অন্ধকার লাগে সুকান্তর। এখানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঢাকা থেকে অনেক বেশি। রাস্তার পাশের চায়ের দোকান গুলোও বন্ধ। সন্ধের দিকে বেশ খানিকটা বৃষ্টি হয়েছে। সোজা পথে যেতে সুকান্তর প্রায় দশ মিনিট হাঁটতে হবে। মাঠের মধ্যে দিয়ে কোনাকুনি গেলে অবশ্য পাঁচ মিনিট। তবে এপথে একটা পুরনো কবরখানা পড়ে।

সুকান্ত আজ মাঠের রাস্তা নিলো। তাড়াতাড়ি গিয়ে শুতে পারলে সে বাঁচে। বড়ই ক্লান্ত লাগছে। মাঠের পথে মিনিট খানেক যাওয়ার পরই বুঝলো সে ভুল করেছে। একে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার উপর পথে বেশ কাদা হয়েছে। ধীরে ধীরে চলতে লাগল সে। মোবাইলের আলোয় খুব ভাল ঠাহর হচ্ছে না। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, ব্যাঙের ডাক আর দূরে কুকুরের আওয়াজ। সুকান্ত এক হাতে ব্যাগটা শক্ত করে ধরে। অন্যহাতে মোবাইলের আলোতে পথ দেখার চেষ্টা করে। এই কাদা রাস্তায় সাপের দংশন খুব বিচিত্র নয়। কোন রকমে কবরখানার কাছে পৌঁছে যায় সুকান্ত। এমন সময় হঠাৎ দপ দপ করতে করতে বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল টা। এবার সম্পূর্ণ অন্ধকার। মরা চাঁদের আলোয় যতটুকু যা ঠাহর হচ্ছে। হঠাৎ কলার খোসা গোছের কিছুতে পিছলে যায় সুকান্ত। পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে মনে হয় কে যেন তার হাতটা ধরে ফেলল। অবলম্বন পেয়ে সুকান্ত সামলে নেয়। কিন্তু আশেপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কেউ পাশে আছে বলেও মনে হচ্ছেনা। কেমন একটা ভয় এক মুহূর্তে গ্রাস করে তাকে। হৃদকম্পন বেড়ে যায় দু-গুণ। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। মনকে প্রস্তুত করে আবার চলতে শুরু করে সুকান্ত। দুপা যেতেই অন্ধকারে কার সঙ্গে যেন ধাক্কা খায় এবারে। কিন্তু শব্দ করতে পারেনা। চাঁদের আলোয় দেখে এক বিরাট কালো মূর্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। হাতে লাঠি। চোখ দুটো যেন জ্বলছে। ভয়ে কুঁকড়ে যায় সুকান্ত। লোকটির লোমশ কালো হাতের বরফ শীতল স্পর্শ সুকান্তকে প্রায় জ্ঞান শূন্য করে দেয়। হঠাৎ লোকটি বলে ওঠে, "আপনাকেই খুঁজতে এসেছিলাম। না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম। এই চিঠিটা আপনার তুলোরামপুরের ঠাকুমা দিয়েছেন। খুব তাড়াতাড়ি আসবেন। নইলে সব জলে যাবে…আমি এখন চললাম।" চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই লোকটি কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। ঠিক বুঝতে পারে না সুকান্ত। কুকুরের ডাক দূর থেকে দূরে ঘুরতে থাকে। 

ঘরে এসে চিঠিটা পড়ে সুকান্ত। একটা হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজে পেন্সিল দিয়ে লেখা, "শিগগিরি আয় দাদুভাই। আশির্বাদ নিস, ভবানী ঠাকুমা"। বাবার বিধবা নিঃসন্তান পিসিমা থাকতেন তুলোরামপুরে। সুকান্ত সেখানে কয়েকবার গেছে বাবার সঙ্গে কিন্তু সে তো প্রায় পঁচিশ ত্রিশ বছর আগের কথা। "সেই ঠাকুমা কি এখনও বেঁচে থাকতে পারে!" মনে মনে ভাবে সুকান্ত। শুয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে । কিন্তু ঘুম আসতে চায় না। বার বার ভবানী ঠাকুমার মুখটা তার মনে পড়ে। মনে হয় বিছানার পাশে যেন ডাকছে হাজার হাজার ঝিঁঝিঁ পোকা। 

সকালে হতেই প্রস্তুতি নেয় সুকান্ত। কাল সারারাত ঘুম হয়নি তার। তেঁতুলতলা থেকে বাসে ঢাকা। সেখান থেকে বাস বদলে মাওয়া ঘাট। তারপর পদ্মা নদী পেরোনো। ওপারে গিয়ে একটা বাস নিলো সে। সেই বাস তাকে নামলো ভাঙা নামে একটা জায়গাতে। সেখান থেকে আবার বাস বদলে সুকান্ত এলো মধুমতি নদীর পাড়ে। খেয়াতে নদী পেরিয়ে কালনাঘাট আসতে আসতেই হয়ে গেল বিকাল। সেখান থেকে সাইকেল ভ্যান ধরে বাসস্ট্যান্ড। খুলনা যাওয়ার বাস ধরে লক্ষীবাসা, নড়াইল পেরিয়ে সে যখন তুলোরামপুরের ব্রিজের উপর বাস থেকে নামল তখন ঘড়িতে রাত আটটা বাজে। বড় রাস্তা থেকে গলিতে নামতেই সব অন্ধকার। 

ছোটবেলার স্মৃতি থেকে মনে পড়ছে এই পথ ধরে চলতে চলতে নদীর পাড়েই ছিল ভবানী বুড়ির ভিটা। তবু যে একটু জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হবে…পথে কোনো জন মানব নেই। ভৈরব নদ আর চিত্রা নদীর শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে আছে এই অঞ্চলে। যেন দুই নদ-নদীর সংসার। রাস্তার দুই দিকে ঝোপ জঙ্গল। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা টিনের বাড়ি। ঝোপের পাশে থোকায় থোকায় জ্বলছে জোনাকি। সুকান্ত পথ চলতে চলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। "না, একটু জেনে নিশ্চিত হয়েই যাওয়া উচিৎ।" পথ ছেড়ে পাশের বাড়িটির দিকে যাবে এমন সময়, "কি হল, দাঁড়ালেন যে"। সেই অলৌকিক ছায়া মূর্তি এসে দাঁড়াল সুকান্তর পাশে। সে কি তবে পিছনেই আসছিল! মুহূর্তে একটা ভয় যেন লাফ দিয়ে পড়ে সুকান্তর উপর। শরীরটা ভারী মনে হয় তার। এবার ছায়ামূর্তি বলে ওঠে, "আমি হারান, কাল চিঠি দিলাম না। বাসস্ট্যান্ডেই ছিলাম। আপনি ঠিক পথে আছেন দেখে, পিছন পিছন আসছিলাম। আসেন আমার সঙ্গে। "

সুকান্ত হারানের পিছু নেয়। অন্ধকার পথ আরও যেন অন্ধকার হয়ে আসে। তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে হারান, সে জানে না। ছোটবেলায় সে হারানকে দেখেছে। ভবানী বুড়ির চাকর। কিন্তু সে তেঁতুলতলার ঠিকানাটা কিভাবে জানলো। জানতে ইচ্ছা করে কিন্তু প্রশ্নটা করতে পারেনা সুকান্ত। কেমন একটা ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে সে। একবার মনে হয় উল্টোদিকে দৌড় দেবে … পারে না। এক অদ্ভুত যাদুবলে সে হারানের পিছু পিছু চলতে থাকে। দুই তিন বার চোখ ঘষে সুকান্ত। সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তবে কি হারান তার চোখ বেঁধে দিলো। কথা বলতে চেষ্টা করে সুকান্ত, চিৎকার করে ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু তার গলা দিয়ে একটাও শব্দ শোনা যায় না। তার মনে হয় হারান বাতাসে উড়ে উড়ে চলেছে। আর সে ও চলেছে তার সঙ্গে প্রায় উড়তে উড়তে। 

নদীর পাড়ে এক মালঞ্চের বেড়া দেওয়া ভিটের সামনে এসে হারান হাত দেখায়। তারপর উল্টোদিকে হাটা শুরু করে। হালকা চাঁদের আলোয় দেখা যায় চারপাশটা। বেড়ার পাশ দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ চলে গেছে নদীর ঘাটের দিকে। দরজাটা খুবই জীর্ণ। কড়া নাড়ার আগেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল দরজাটা। সাদা চুল সাদা শাড়ির ভবানী বুড়িকে দেখে একটু নিশ্চিন্ত হল সুকান্ত। পিঠে একটা খুব ঠান্ডা স্পর্শ লাগে সুকান্তর, "আয় আয় কত বছর পর, না না প্রণাম করতে হবেনা। খাটে বোস দাদুভাই।" সুকান্ত খাটের উপর বসে। ঘরের কোনায় একটা ছোট্ট প্রদীপ জ্বলছে। এবাদে কোনো আলো নেই। চাঁদের আলো এসে পড়ছে জানলা দিয়ে। তবে ঘরের মধ্যে যেন প্রবল এক ঠান্ডা। লাশকাটা ঘরের মতন। শ্বাস নিতে কষ্ট হয় সুকান্তের। মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। হাতে পায়ের জোর ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকে। এক প্রবল ক্লান্তি আর অদ্ভুত সম্মোহনে সে লুটিয়ে পড়তে থাকে বিছানায়। 
- "এই নে, দুটো মুখে দে দাদু ভাই,সেই তো কোন সকালে বেইরেছিস।" একটা মাটির থালায় কিছুটা ভাত ও মাছ এগিয়ে দেয় ভবানী বুড়ি। খিদের পেটে মুঠো মুঠো করে তাই খেতে থাকে সুকান্ত। এরপর ধীরে ধীরে এলিয়ে পরে বিছানায়। 

ঠাকুমা নাতির চুলে বিলি কেটে দেন, সাথে গুনগুন করে সেইই ছোটবেলার ঘুমপাড়ানি গান, হালকা আলোয় ঠাকুমার গলায় একটা মোটা নেকলেস চক চক করতে থাকে। এই গহনার কথা সুকান্ত তার বাবার মুখে শুনেছে।
"সব জলে গেছে রে দাদুভাই, শুধু এইটাই রয়েছে" ভবানী বুড়ি বলে ওঠে। সুকান্ত কিছুই বুঝতে পারে না। সে, হাপরের মতো মাঝে মাঝে শুধু শ্বাস নিতে থাকে। মনে হয় তার গলাটা কেউ চেপে ধরেছে। এবার ঠাকুমা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। বলেন, "সকালে তুলসী মঞ্চের নিচেতে দেখিস, দাদু ভাই। নইলে বাকিটুকুও জলে যাবে।"
নদীতে একটা বিরাট কিছু পড়ার শব্দ হতেই ঘরের আলোটা নিভে সব অন্ধকার হয়ে যায়।

চোখে জলের ঝাপটা লেগে ঘুম ভাঙ্গে সুকান্তের। তখনও ভোর হয়নি। কয়েকজন মাঝি গোছের লোক ঘিরে আছে তাকে। আর তার শরীরটা দাওয়া থেকে ঝুলছে। সুকান্ত তাকাতেই মাঝিরা নিজেদের মধ্যে, "বাঁচি আছে, বাঁচি আছে" বলতে থাকে। এবার বয়স্ক লোকটা বলে, "যাক, আল্লার দোয়ায় বাঁচি গেছো। এখান থেকে কেউই বাঁচি ফেরেনা। গতবছর হারানও এই খানেই…চলে যাও, চলে যাও।" সুকান্ত বেকুবের মতো সবটা বোঝার চেষ্টা করে। মাথা যে খুব ভাল কাজ করছে তা নয়। কেমন একটা ঘোরের মত লাগে তার।

আর একজন মাঝি দরজার কোনায় রাখা মাটির থালায় কিছুটা ভাত আর মাছের ঝোল ঢেলে দেয়। মাটির থালাটা দেখে সুকান্তর গতরাতের কথা মনে পড়ে। হৃদকম্পন চলতে থাকে প্রবল গতিতে। মাঝিরা ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। এবার সুকান্ত উঠে দাঁড়ায়। পায়ে যেন বল নেই একেবারে। "ও মাঝি, ওই মাছ ভাত রাখলা কেন?" চিৎকার করে ওঠে সুকান্ত। নৌকা ছাড়তে ছাড়তে এক মাঝি বলে, "ওইটা না দিলে বুড়ির ভিটার উপর দিয়া মাছ ধরতে জামু কেমনে!" 

ধীরে ধীরে সকাল হতে থাকে। সুকান্ত তাকিয়ে দেখে পড়ো বাড়িটার দরজা জানলায় কোনো কপাট নেই। ঘরের ভিতরের জঙ্গলে মনে হয় সাপের আড্ডা। ভেঙ্গে যাওয়া কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে চামচিকের দল। বাড়ির অনেকটা অংশ চলে গেছে নদীর ভাঙ্গনে। হঠাৎ তার গত রাতের কথা মনে পড়ে। ভবানী বুড়ি বলছে, "নইলে বাকি টুকুও জলে যাবে। এবার তুলসী মঞ্চের দিকে চোখ যায় তার। বহু দিনের যত্নের এভাবেও বেচে আছে তুলসী গাছটা। তবে তুলসী মঞ্চেরও অর্ধেকটা গেছে নদীর ভাঙনে। একটা বাঁশের টুকরো দিয়ে সুকান্ত প্রাণপনে খুঁড়তে থাকে তুলসী মঞ্চের গোড়াটা। খানিকটা মাটি সরাতেই একটা কলসী উঠে আসে। আর তার ভিতরে সেই নেকলেসটা আর হলুদ হয়ে যাওয়া বাড়ির দলিলের কাগজপত্র।

কোথায় যেন একটা পাখি ডেকে ওঠে। মাটির থালার ভাত আর মাছের উপর ঘুরতে থাকে মাছির দল।

2 comments:

  1. খুবই সাসপেন্সে ভরা লেখা। একনিঃশ্বাসে পড়লুম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। আপনারা পড়েন তাই লেখার উত্সাহ পাই।

      Delete