গল্প - সনাতন সিংহ
Posted in গল্প
গল্প
বাসি মালা
সনাতন সিংহ
...'ও স্যার, আমার মা না, বিষ খেয়েছে।'
...বপ, চুপ কর বদমাশ। সকালবেলায় আবার দুষ্ঠুমি?
...হা স্যার, সত্যিই বলছি। বিশ্বাস না হলে বুচিকে জিগ্যেস করো। বুচিদি, এই বুচিদি?
...আরে, তুই চেঁচাচ্ছিস কেন?
ধমকে সোনাই এর চেঁচানি কমলেও তার অস্ফুট কথার স্পন্দন, তার স্যারের কানে গিয়ে মিইয়ে গেল সংশয়ের নিস্তেজ অনুরণনে।
...'আমার মাকে কাল রাতে হাসপাতলে ভর্তি করেছে। বলছি তবু বিশ্বাস করছে না।'
বলেই উবু হয়ে বসে ব্যাগ থেকে খাতা, পেনসিল, বই অনিচ্ছা সত্বেও টেনে টেনে বের করছে। ধমক আর অবিশ্বাস তার মুখটাকে কেমন বিরক্তিতে ভরিয়ে তুলেছে।
কিন্তু পিলে চমকে গেল দীনেশের। সে সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়াতে এসেছে এ পাড়ায় যা শহুরে উপাধিতে বস্তি বলেই স্বীকৃত।খালের পাড় ধরে ছোটো ছোটো, গা ঘেঁষাঘেঁষি এক একটা স্বপ্নের বুদবুদ এই টালি ও প্লাস্টিককের ছাউনি দেওয়া বাড়িগুলো। যেখানে খিস্তি-খেউর, ঝগড়া ঝাটি, দুই দলের বোমাবাজি হামেশাই ঘটে। বা টাইমকলে রান্নার বা স্নানের জল নিয়ে মেয়েদের চুলোচুলি থেকে শুরু করে এমন কি নেই যে সভ্যতার এই পাদভুমিতে যার উন্মেষ ঘটেনি?
তিন বেলায় কাঠ-কয়লার ধোঁয়া। অলিগলিতে তারের বিনুনি। সরু রাস্তা। তার শরীর জুড়ে জলভরা প্লাস্টিকের গামলা বালতি যেন এক একটা ছোটো খাটো টালার ট্যাঙ্ক। কোথাও কোথাও বাবুদের অনাদর আর অবহেলার আসবাবপত্রে ভরা নাভিশ্বাস ওঠা পথের বাঁক। প্রায় হোঁচট খেতে খেতে সে সপ্তাহে পাঁচ দিন এখানে পড়াতে আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আসতে ইচ্ছা না করলেও তবু আসে।কেননা তার ক্লাসমেটের খুব কাছের লোক তাই একপ্রকারে বাধ্য হয়ে আসে। নয়তো তার বন্ধু রাগ করবে। তার বিশেষ অনুরোধে এ টিউশন করতে আসে।
কিন্তু সকালে এধরণের কথা শুনলে কার না পিলে চমকে যায়?
তবু বাচ্চা ছেলের কথা যাচাই না করে বিশ্বাস করতে তার কোথায় যেন খটকা লাগছে। লাগারই কথা।বাচ্চারা নাকি ফুলের মতো পবিত্র, নাকি ভগবান স্বরূপ, নাকি সত্যের প্রতীক, নাকি মিথ্যে বলে না! কিন্তু এখন তার এমন নির্বিকার প্রকাশ ভঙ্গি তাকে যে কোনো রূপে ধরে অবিশ্বাসী করে তুলতে পারছে কই? তার দিদাকে সে মাঝে মাঝে দেখে এখানে আসতে ও থাকতে। কিন্তু আজ তিনি তো আসেননি। কাকেই বা জিজ্ঞেস করবে?
পাশেই প্লাস্টিকের বেড়ার ফাঁক যা ওদের ভাষায় সিসি ক্যামেরা দিয়ে বুচিকে দেখা যাচ্ছে। সকালে সে রান্না করছে। তাদের ঘরের উনুনে কাঠের ধোঁয়া টালির চাল বেয়ে এঘরেও আসছে। চলন্ত পাখা তাকে সবলে টেনে নামিয়ে ঘর ভরিয়ে দিচ্ছে। ওদিকে বুচিদের ঘরের সামনে রাস্তায় তার তিন ভাই-বোনের সঙ্গে পাশের বাড়ির পুচকিও খেলছে। আর তাদের পাশে মাদুরে শুয়ে খেলছে পুচকির সাত মাসের ভাই। তবে কি বুচিকে জিজ্ঞেস করবে?
বুচিকে সে চেনে না তা নয়। সোনাই এর মায়ের সঙ্গে তাকে অনেক বার দেখেছে তাদের পঞ্চপাণ্ডবের ভাড়া বাড়িতে। বলতে গেলে সোনাইয়ের মাযের ছায়া সঙ্গী এই ষোড়শী। কিন্তু সে কেন এই চিৎকার করা ডাকে কোনো সাড়া দিল না? এ প্রশ্ন পাক খাচ্ছে... ঘরে, ধোঁয়ায়, তার মাথায়। কেমন যেন অবিশ্বাস ও রহস্যের জালের ছোটো ছোটো ফাঁসে আটকে যাচ্ছে দীনেশর চেতনার কানকো।
সোনাই আলতো ঠেলা দিয়ে বলে
...জানো স্যার, মা না, কালকে রাতে কি লিখছিল। আর লিখতে লিখতে কাঁদছিল। আমি মা বলতে, আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে, মাথায় কত চুমু খেল।আমার না তখন কি কান্না পাচ্ছিল।...
কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে সে। কান্নার কালো অদৃশ্য মেঘ যেন তার গলায় বসে ভারী হয়ে আছে।একটু শীতল আদরে নিমেষে যেন ঝরে পড়বে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে আবার বলতে থাকে...আমি কাঁদলে মা আরো বেশি কাঁদতো বলো? তাই আমি কাঁদিনি।
জানো স্যার, মা কাঁদলে আমার না খুব কান্না পায়।
সে বলছে ঠিকই কিন্তু তার ছোটো ছোটো চোখের টোল পড়া বেলাভূমিতে বেদনার বিন্দু স্রোতের মতো গড়িয়ে পড়ছে।
এমন বেদনাদীর্ন কথার স্নেহময় আকুতি সকালের ধোঁয়াময় ঘর কাতর হয়ে উঠল। দীনেশের মনটা ভারী হয়ে গেল। তার মার কথা মনে পড়তে বুকটা ছলাৎ করে ওঠে। গ্রেজুয়েশন করার পর সে মাকে ছেড়ে এসেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ক্লাস শেষ করে প্রায়ই বাড়ি ফিরে দেখে অন্য বন্ধুরা ঘুমাচ্ছে, কেউ বেরিয়ে গেছে। যখন হাঁড়ি খুলে দেখে ভাত নেই, খিদে পেটের নাড়ি যেন হজম হয় যায়, তখন তার মায়ের সেই শূন্যতা বুকটাতে হু হু করে দাপিয়ে বেড়ায়। আজ এতটুকু বাচ্চার সেই শূন্যতায়, বেদনায় তার চোখ ছলছল করে উঠল। স্নেহের হাত হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল তাকে।
বেদনা, শোক বা বিপদ চির নবীন। অসময়ে সে সবাইকে কাছের সেতারে একই হাহাকারের বাঁধে। দুটো প্রাণ আজ তাই বুঝি একই বেদনার বারাণসীতে অবস্থান করছে। বেদনার ভারে দীনেশর গলা বুজে আসে।তবু সে জোর করে কান্নাকে গিলে বলে
...মা, কেন বিষ খেলে রে?
... জানি না। ...ওওওও মনে পড়েছে। ওই যে একটু কালো মতো স্যার, তোমাদের সঙ্গে থাকে, ওই স্যারটার জন্য।
...বপ। এসব তোকে কে বলেছে?
...কাল রাতে বুচিদি তো দিদাকে বলল।ওই স্যারটা নাকি মাকে বিয়ে করবে বলেছিল।
চমকে ওঠে দীনেশ। সন্দেহের সেই ছবিগুলোকে সে মিলিয়ে দেখতে থাকলো...
দরজায় টোকা পড়ছে ঘনঘন। একটা মেয়েলি গলা বন্ধ দরজা ভেদ করে ঘরে প্রবেশ করছে।
...কেউ আছেন?
...কাকে চাই? দরজা খোলা আছে ভেতরে আসুন।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে বলে
...বসন্ত আছে?
দীনেশ চমকে যায়। সেই মহিলা। বসন্ত যেদিন এল আই সির প্রচার অনুষ্ঠান করছিল ওর পিসীদের বস্তির সামনের মাঠে, সেদিন সকালে প্যান্ডেলের ভেতরে অন্য দুজন মহিলার সঙ্গে তাকে দেখে ছিল...বটিতে বসে আলু কাটতে। পরনে লাল সালোয়ার কামিজ। বটিতে উবু হয়ে বসেছে। ওড়না সরে গিয়েছে বুক থেকে। দুই হাঁটুর চাপে বুকের নরম উচ্ছাস সাঁতরে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে প্রাণপণে। অন্তর্বাসের নিষ্ঠুর বাঁধন উপেক্ষা করে দুর্দমনীয় মহিমায় বাইরে অবারিত আলোকিত বেলাভূমিতে আছড়ে পড়তে চাইছে।সেই অবদমিত উত্তাল নরম তরঙ্গে যে কোনো পুরুষের চোখ পড়া মাত্রই না ঝাঁপিয়ে পারবে না। এমনকি দীনেশও না। যেন সেদিনে সকাল থেকে সে ফিরে এসে বলল.…
...নেই। একটু পরে আসবে।
...একটু বসেই যাই, তাহলে।
বলেই পরনের শাড়ির কুঁচি একহাতে ধরে হাসি মুখে ঘরের সোফায় গিয়ে বসল। নাকটা চাপা, বড়োজোর ছাব্বিশ, মাঝারি উচ্চতা, তবে গায়ের উজ্জ্বলতা ঈর্ষণীয়। যৌবনের উচ্ছল পসরা পোশাকের আটোসাটো বন্ধনে আটকে থাকতে চাইছে কই? শরীরের হাটে তার আভা যেন পরতে পরতে ফুটে বেরচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গেই বসন্ত হাজির।
... বলো কতক্ষণ? উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলতে থাকল ...এ দীনেশ।
একগাল মুচকি হেসে ওই মহিলা বলল...ওকে আমি চিনি। তোমার অনুষ্ঠানের দিন ওকে দেখেছি। ভালো আঁঙ্কারিং করে। ও হ্যাঁ, আমি মালা।
হাত জড়ো করে নমস্কার জানিয়ে দীনেশ বসন্তের দেওয়া টাকায় মিষ্টি আনতে চলে গেল। এনে দেখে ঘরের দরজা বন্ধ।বেশ কিছুক্ষণ পরে দরজা খুললে দুজনের হাবভাব ও পোশাক দেখে অনেক কিছু সন্দেহ হয়েছিল।
তারপরেও এমন ঘটনা ওদের পঞ্চপাণ্ডবের ভাড়া বাড়িতে কয়েকবার ঘটেছে।
সব সন্দেহগুলো সরু গলির মতো। ঠাসাঠাসি অমীমাংসিত সংশয় নিয়ে মন যাপন করে। তারা আজ যেন সোনাইয়ের কথাকে সত্যিই বলে প্রমাণ করতে চাইছে।
কিন্তু সন্দেহ আর অভিযোগে তাকে আশ্বস্ত করতে পারছে কই? তার আরো প্রমাণ চাই।
...হ্যাঁ রে, মার সে লেখাটা কোথায়?
বলেই দীনেশ তার বই, খাতা, ব্যাগ হাতড়াতে শুরু করে। হাতড়াতে হাতড়াতে তার হাত যেন সন্দেহের রাজত্বে ঘুরে ঘুরে প্রমাণের সন্ধান করতে থাকে। সন্দেহের অলিগলি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে খাবি খাবি খেতে খেতে ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে...নোনা ধরা ইটের দেওয়াল।মাথার ছাদ রড বের করে ধসে পড়ার অপেক্ষায় প্রতীক্ষায় রত।কালো কালো ঘেঁষ ইটের ফাঁক থেকে অবলীলায় বেরিয়ে এদের দীনতা প্রকাশ করছে। যেখানে সেখানে পেরেক থেকে ঝুলছে নানা প্লাস্টিকের ব্যাগ, ঠাকুরের ছবি, ইত্যাদি ইত্যাদি। মেঝের অর্ধেক মাটি। গ্যাস ও ওভেন সেখানে। বাইরের আলো দেখা যাচ্ছে দেওয়ালে ফুটো থেকে।
...ও স্যার, ওখানে নেই। মা লিখে ওই প্লাস্টিকের মধ্যে রাখছিল দেখেছি।
বলেই বিরক্তির সঙ্গে হাত বাড়িয়ে প্লাস্টিকটা টেনে নিয়ে ঢেলে দিল বিছানায় স্যারের সামনে। টুং টাং আওয়াজে সেই গুপ্তধন...মানি ব্যাগ, লিপস্টিক, নেলপলিশ, হেয়ার ক্লিপ, আরো অনেক কিছুর সমাধিতে যেন চাপা পড়ে আছে বলে মনে হলো। সেগুলো ঘেঁটে দীনেশ সবেমাত্র মানি ব্যাগটা ধরতে যাবে এমন সময় সোনাই বলল
...ওটায় হাত না।মার টাকা থাকে না!
ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে সে খুলতেই দেখা গেল..রুলটানা কাগজ যেন জোর করে চেপে ঢোকানো, বেরিয়ে এলো ব্যাগের চেন খোলার সঙ্গে সঙ্গে।
...এই দেখো। বলেই সোনাই টান মেরে খুলতে কাগজের সঙ্গে খানচারেক দশ ও পঞ্চাশ টাকার নোট বেরিয়ে এলো। একটা পাতায় কয়েকটা বাংলা গানের কলি লেখা আছে। আর দুটো পাতা লিখে লিখে যেন মনের কথা শেষ করে উঠতে পারেনি।
বাঁকা বাঁকা অক্ষর রুলটানা অংশ ছেড়ে উপর ও নীচের সাদা অংশে বিরাজ করছে কি কি মনস্তাপে কে জানে?
কৌতূহলের কুহুকে দীনেশ চুপ করে থাকতে পারল না। পড়তে গিয়ে আঁতকে গেল সে... প্রথমেই বসন্তের নাম লেখা। নামটাও ঠিক করে লিখতে পারেনি। নাম ও তার পাশে লেখা ... 'পিয় বসনতো---I lav you.'
একটু করে এগোতেই হোঁচট খেতে লাগল বারবার। অগোছালো লেখা। অনুচ্ছেদের ধার ধারেনি।ভুল বানানে ভরা শব্দের শরীর।
সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে পাঠকের সামনে তা সংশোধিত ভাবে তুলে ধরতে পারতাম কিন্তু তাতে মালার কলমকে অপমান করা হত.…
...তুমী নাকী বিএ করছ। তাই তমার দেশের বাড়িতে গিএ ছিলুম। বিএ জদি করবে তবে এতদিন আমার সংগে এত কিছু করলে কেন আমাকে শুধু ভগ করলে (বেশ কিছুটা জায়গা নীল কালি দিয়ে কেটে কেটে ঢেকে দিয়েছে। কয়েক ফোঁটা জলের ছাপ কালিগুলোকে ভিজিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে না।) তমার বাবার পাএ ধরে বলে ছিলুম। সব সুনে আমাকে বুচিকে দূর দূর করে তারিএ দিল। দুপুরে একগেলাস জল ও দেয়নি। রোদ মাতায় নিয়ে খিদে পেটে বাড়ি ফিরি।...
না, না, এখানে এই লেখা পড়ার উপযুক্ত স্থান ও সময় নয়।
বোধহয় অনেক কথা, অনেক ঘটনা বাঁকা বাঁকা অক্ষরে পাতা জুড়ে রয়েছে। কাটাকাটি, আবার লেখা। সঙ্গে স্বপ্ন ভাঙার বেদনাবিন্দুতে শব্দের সমাধি। কি জানি হয়তো সব বেদনার বর্ণমালা এক। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে এখন থেকে বেরতে হবে। কিন্তু চিঠি?
তা ফেলে গেলে বসন্তের ...
না, না, না। সঙ্গে তা নিয়ে যেতে হবে। এটুকু পড়তে গিয়ে ভয়ে দীনেশর হাত পা যেন শরীরে সেঁধিয়ে যেতে লাগলো। তার উপর চিঠি নিয়ে গেলে কেউ যদি দেখে ফেললে? বিছানায় বসে থেকেও যেন সে সেখানে হওয়াতে ভাসছে।
কাগজ তিনটে ভাঁজ করতে করতে তার চোখ আটকে গেল একটা লাইনে ...'তমার সনতান আমার পেটে।'
স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। নিমেষে লজ্জার নিকষ কলঙ্কের কালি যেন তার সারা শরীরে কেউ লেপে দিতে থাকলো। ভূমিষ্ঠ না হওয়া সন্তানের অস্ফুট আর্তনাদ তার কাছে যেন বিচারের জন্য নিভৃতে কাঁদতে লাগলো।
সে মনে মনে উচ্চারণ করে...বসন্তের সন্তান মালাদির গর্ভে।
সে এমন কামুক প্রতারক পুরুষের বন্ধু।
ভাবতেই তার শরীর ঘিন ঘিন করে উঠল।
সোনাইকে বলে...আজ পড়াবো না। বই খাতা গুছিয়ে নে।
মনে মনে বলল… চিঠিগুলো রেখেই যাবো। ওর শাস্তি পাওয়া উচিৎ।
কিন্তু গত সাত মাসে জানা তথ্যগুলো পরক্ষণে একটা যুক্তি হয়ে কাঠি করে দিয়ে গেল...মালাদির তো ডিভোর্সের মামলা চলছে। তার স্বামী ব্যাঙ্কে পিয়ন। রোজ রাতে ফিরে মদ খেয়ে অত্যাচার করত।সোনাই যখন দু'মাসের তখন নাকি বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। তাকে আর ফিরিয়ে নেয়নি। নিরুপায় হয়ে তাই এখানে মায়ের কাছে থাকে।
তাই বলে সে কি এই ভাবে বসন্তের কাছে বিকিয়ে যাবে?
যে যাচ্ছে যাক।
এই বসন্তই তাকে একদিন কলকাতায় এই ভাড়া বাড়িতে এনেছিল।ক্লাস ফাইভ থেকে তারা এক সঙ্গে বার ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে। আপদে বিপদে পরস্পর পাশে থেকেছে। এমন বিপদে সে কি সত্যিই সরে যাবে? নিয়তি যেন কানে কানে এসে বলছে...পাপ, লাম্পট্য, শাস্তি এর হিসাব করার তুই কে? মালা তোর কাছে আগে হল? বসন্ত নয়?
পরিণামদর্শী মন যুক্তি খাড়া করছে অগোচরে
... 'ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন/যথা নিযুক্তোহষ্মী তথা করোমি।'
অন্যদিকে সোনাই বইপত্র গোছাতে থাকে। সেই সুযোগে সে দুটো পাতা জামার ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। আর গান লেখা পাতাটা সোনাইকে দিয়ে বলে ওই ব্যাগে রেখে দে।
...মালাদি, মালাদি।
আর রক্ষে নেই। কেউ এগিয়ে আসছে এদিকে।
না,চিঠি চুরি বা অপরাধ চাপা দেওয়ার অপরাধে সে বুঝি এ যাত্রায় বেঁচে বাড়ি ফিরবে না। রুমাল বের করে ঘাম মুছতে থাকে। দূর থেকে আওয়াজটা আরো কাছে আসছে।
...বাড়িতে নেই নাকি?
আরে এ তো চেনা গলা। পর্দা উঁচিয়ে মাথা ঢোকাতে দেখে রমেশ। তাদের পঞ্চপাণ্ডবের এক। জামার ভেতর থেকে চিঠি দুটো লুকিয়ে তার হাতে দিয়ে বলে যত তাড়াতাড়ি পারিস চলে যা।
... কি? কেন?
...পালা। বলেই এক প্রকারে তাকে ঠেলে বের করে দিল।
সোনাই ততক্ষণে নিজের ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত।
এদিকে সে খেয়াল করেনি।
রমেশ যেতে না যেতেই দরজার বাইরে গোল বেঁধে গেল।
কানে আসছে গত রাতের অসফল মনোবাসনার অনেকগুলো উদ্ধত হুঙ্কার।
...ওই মাস্টারকে ধরে পেটাও। তবে ও শালা আসবে।
...আসুক শালা, ওর কিমা বের করে নেব।
...তা তোর ওই মাগী কি ধোয়া তুলসী পাতা। নাং করে খায়। জানিস না। কত দেমাগ। মর মাগী মর।
...আমরা বাবুর বাড়ি বাসন মেজে খাই। আর ওই ছেনালি, খয়রি মাগী সংসার চালায় কি করে জানি নে!
...এই শালা খানকির ছেলে মাস্টার। বাইরে আয়। ডাক তোর বন্ধুকে।
...ডেকে আন না শালা-শুয়োরের বাচ্চাকে। যেখান থেকে বেরিছে, শালাকে সেখানে ঢুকিয়ে দেব।
ভয়ে দীনেশর সারা শরীরের রক্ত যেন শুকিয়ে যেতে লাগলো।হাড়গুলোতে কাঁপুনি শুরু হল।
সোনাই বলছে ... ও স্যার চল।ওরা ডাকছে।
এখনই না বেরলে সে আর আস্ত থাকবে না। মনে মনে ভাবে উদোর পিণ্ডি যে বুদর ঘাড়ে পড়ে, তা আজ আর একবার প্রমাণ হবেই।
ধীরে ধীরে সে বাইরে এল। বাইরে তখন অনেকেই ফুটছে। এমন বিষয়ে সবাই যেন একটু বেশি বেশি স্পর্শকাতর। সবাই যেন সমাজসংস্কারক। এর বিহিত করেই তবে ছাড়বে। ভিড় থেকে না জানি কে কে বলছে...
...বসন্ত এখন কোথায় আছে রে ?
...এমন করলে হবে না, ওনাকে এই ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে রাখ। তারপর ওনাদের ভাড়া বাড়িতে খবর দে। ও মাল সুরসুর করে আসবে।
...এই ব্যে কেলানি খাবি? বল, চুপ করে আছিস কেন?
বুচকির পরের বোনটা হঠাৎ ভিড়ের মাঝখান থেকে চেঁচিয়ে বলে.....…স্যারটা না ব্যাগ থেকে কি বের করে নিয়ে পড়ছিল।
...কি পড়ছিলি ?
...বল শালা? সেগুলো কি ?
...কোথায় রেখেছিস ?
দীনেশ উত্তর দেবে কি! এতক্ষণ তবু ঠিক ছিল। শেষের প্রশ্নগুলো তার পায়ের তলায় মাটি কেড়ে নিল। গলা, জিভ শুকিয়ে এলো।বুকটায় হৃদপিণ্ড আতঙ্কে জোরে জোরে হাতুড়ি চালাতে লাগলো।
কি বলবে সে। আর সত্যি বললে তাকে ছেড়ে দেবে ?
চোয়াল শক্ত করে সে বলে
...সে কাগজ সোনাইকে দিয়ে দিয়েছি।
...কি লেখা আছে তাতে? কোনো স্যুইসাইট নোট?
এদের অনুমান যে সত্যি তা বলবে কি করে?
...না, কয়েকটা গানের লাইন। সোনাই ওটা এনে দেখা তো।
দৌড়ে গিয়ে সেটা এনে সবার সামনে দেখালো।
সবার উদ্যমে যেন জল ঢেলে দিল সে। মুখগুলো কেমন নিরুৎসাহ হয়ে পড়ল।
কে যেন ফিস ফিস করে বলছে...পকেটটা একবার দেখ না।মালটা ঝেঁপে দিতে পারে?
সত্যিই তো একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। যদি কাছেই থাকতো কি হত কে জানে?
সবে পকেটে হাত দিতে যাবে এমন সময় ভিড়ের শেষ প্রান্ত থেকে একজন মহিলা চেঁচিয়ে বলে...এসব কি করছিস তোরা? মাথা খারাপ হল তোদের?
ভিড় হঠিয়ে কাছে এল সোনাইয়ের দিদা। শোনাল...
...ওনাকে যেতে দে।
পরের দিন ঘুম থেকে বেলা করে উঠল দীনেশ। তখন পথে রোজকার মতো লোকজন, গাড়ি চলেছে যে যার তাগিদে। রোদ এসে পড়েছে লম্বা লম্বা বাড়িগুলোর ফাঁক থেকে। ব্রাশ হাতে নিয়ে চোখ ঘসতে ঘসতে এসে দাঁড়াল ঝুল বারান্দায়। দেখে...নীচে রাস্তায় এসবের মধ্য দিয়ে একজন খই ছড়াতে ছড়াতে চলেছে। পিছনে, চার জনের কাঁধে মড়ার খাটিয়া। সাথে আরও কিছু লোক। ঠিক তার পিছনে একজন বয়স্ক মহিলার হাত ধরে রাস্তা হাঁটছে একটা বাচ্চা।
কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে তাকে।
সে চোখ বড়ো বড়ো করে দেখে ... সোনাই তার দিদার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে চলেছে। পরনে সেই আগের দিনের পোশাক। চকিতে তার নজর পড়ে মড়ার মুখে। চমকে ওঠে সে। রোদ এসে পড়া সেই ফ্যাকাসে মুখের বীভৎসতা তাকে যেন চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে তার শরীর। চোখের তুলসী পাতা দুটো নিমেষে তার চোখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিচ্ছে সজোরে। খুব কর কর করছে তার চোখ। চারদিক ঝাপসা হয়ে আসছে। ব্রাশ ফেলে দুহাতে জোরে জোরে চোখ ঘষছে। আর তখন তার কানে ভেসে আসছে...
...বলো হরি।
...হরি বোল।
...ব--লো--- হ---রি।
...হ---রি--- বো---ল।
0 comments: