0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী 


কথামালা

বিপুল দাস



১৯৭০-এ পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্ব বোঝা যাচ্ছিল। পার্টির একটা বড় অংশ ভারতবর্ষের মাটিতে চারু মজুমদারের নীতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলে। ১৯৭১-এ পার্টি ভেঙে সত্যনারায়ণ সিং বেরিয়ে গেলেন। তার আগে বেরিয়ে গেছেন অসীম চ্যাটার্জী, সন্তোষ রাণা। আমাদের ধারণা ছিল সি এম কোনও দিন ধরা পড়বেন না। তিনিই তো গেরিলা যুদ্ধের কথা ছড়িয়ে দিয়েছেন। নিশ্চয় তিনি নিজেও গেরিলা কায়দাতেই পুলিশকে লেজে খেলাবেন। কয়েকবার ধরা পড়তে পড়তেও বেঁচে যান। কিন্তু যেদিন কাগজ পড়ে জানতে পারলাম চারু মজুমদার গ্রেপ্তার, সেদিন আমরা হতাশায় ভেঙে পড়েছিলাম। কেউ কারও মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছিলাম না। এও জানতাম, অন্যান্য বন্দীদের মত তাকেও কারাগারেই মেরে ফেলা হবে। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১৯৭২-এর ১৬ই জুলাই এন্টালি থেকে। ২৮শে জুলাই সরকার ঘোষণা করে হৃদরোগে আক্রমণের ফলে তাঁর মৃত্যুর খবর।

পার্টির অবস্থা ছন্নছাড়া। সব কমরেডরা হয় জেলে, না হয় বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছে। ২৮শে জুলাই আলিপুর জেলে চারু মজুমদার মারা যান। সুশীতল রায়চৌধুরী আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাকালীনই মারা যান। কমরেড সরোজ দত্তকে পুলিশ ভোরে লেকের ধারে চিরাচরিত প্রথায় গুলি করে মারে।

১৯৬৭ তে নির্বাচনে বামফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। নির্বাচনে জিতে সরকারে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে চারু মজুমদার এবং আরও কয়েকজন মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট নেতা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। সি পি আই এম থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন কয়েকজন। সিপিএম কানু সান্ন্যালের নেতৃত্বে নক্‌শালবাড়ি এলাকায় সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে শুরু করেছিলেন। ১৯৬৯ এর ১ল মে ময়দানে কানু সান্ন্যাল ঘোষণা করলেন সি পি আই(এম এল) গঠনের কথা।

তার আগেই সংসদীয় গণতন্ত্র বর্জন এবং সশস্ত্র আন্দোলনের প্রশ্নে দল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন চারু মজুমদার প্রমুখ কিছু নেতা। ১৯৬৭-এ নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহে সমর্থন ও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে হাত মেলালেন চারু মজুমদার, কানু সান্ন্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল। ৮ই মে থেকেই প্রকৃত পক্ষে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান শুরু হয়ে যায়। নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া এবং শিলিগুড়ির কিছু অংশে জমি দখল এবং ফসল কেটে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছিল চাষিরা। ১৬ই মে শিলিগুড়ি এলেন তৎকালীন সরকারের ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙার। যাওয়ার আগে জনসভায় এই আন্দোলনকে ‘হঠকারী’ বলে তীব্র সমালোচনা করলেন। ১৯৬৭, ১৮ই মে, কানু সান্ন্যালের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ভূমিহীন কৃষকদের নতুন ভাবে ভূমির অধিকার অর্জনের সশস্ত্র লড়াইকে সমর্থন জানালেন শিলিগুড়ি কিষাণ সভার সভাপতি জঙ্গল সাঁওতাল। ১৭ই মে শুকনার ফরেস্ট বাংলোয় কানু সান্ন্যাল আরও কয়েক জনকে নিয়ে হরেকৃষ্ণ কোঙারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন সেখানে পুলিশের এস পি, ডি আই জি রয়েছে। মন্ত্রীমশাই বললেন পুলিশ যে লিস্ট দেবে, তাদের মধ্যে যাদের নামে ওয়ারেন্ট আছে, তাদের সারেন্ডার করালে পুলিশ কেস তুলে নেবে।

১৮ই মে থেকেই গ্রেপ্তার শুরু হয়েছিল। ক’দিন বাদেই একজন ভাগচাষিকে আক্রমণ করল জোতদারের পোষা লেঠেল বাহিনী। ২৪শে মে নকশালবাড়ি থানার সেকেন্ড অফিসারের নেতৃত্বে দারোগা সোনাম ওয়াংদিসহ একদল পুলিশ এল হাতিঘিঁষার ঝড়ু জোতে। ওদের কাছে খবর ছিল বিপ্লবী নেতারা এখানে আত্মগোপন করে আছে। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ল। বুড়াগঞ্জ, আজামাবাদ এবং বিজয়নগর চা-বাগান এবং পাশ্বর্বর্তী জোত থেকে আড়াই-তিন হাজার সশস্ত্র মানুষ পুলিশকে ঘিরে ফেলল। শুরু হ’ল নকশালবাড়ির প্রথম সশস্ত্র লড়াই। তীরের আঘাতে মারা গেলেন দারোগা সোনাম ওয়াংদি।

২৫শে মে প্রসাদ জোতে একটি মহিলা সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। আচমকাই সেখানে উপস্থিত হ’ল এক গাড়িভর্তি আসাম ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্‌-এর পুলিশ। খুব দ্রুত ওরা গাড়ি থেকে নেমেই পাশেই একটি বাঁশঝাড়ের আড়ালে পজিশন নিল। তারপর শুরু হয় নিরস্ত্র মহিলা এবং শিশুদের ওপর বিনা প্ররোচনায় অবিরাম গুলি বর্ষণ। সমাবেশের এগারো জন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। এই সভার আহ্বায়ক ছিল প্রহ্লাদ সিং। তার স্ত্রীর পিঠে বাঁধা ছিল ছোট শিশু। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন উত্তরবাংলার রাজবংশী মহিলারা কীভাবে তাঁদের শিশুদের পিঠে কাপড় দিয়ে আটকে কাজকর্ম করে। একটা গুলি প্রহ্লাদ সিং-এর স্ত্রীর বুকে ফুঁড়ে তার শিশুটিকেও খতম করে দেয়।

কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরিতে গঠিত হ’ল নকশালবাড়ি কৃষক সংগ্রাম সহায়ক কমিটি। সভাপতি প্রমোদ সেনগুপ্ত। সম্পাদক পরিমল দাশগুপ্ত। সভায় প্রস্তাব নেওয়া হ’ল নকশালবাড়ি থেকে পুলিশ প্রত্যাহার ও বন্দী কৃষকদের মুক্তি। ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে সি পি এম-এর রাজ্য কমিটি চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী এবং সৌরীন বসুকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করল। পরে বেরিয়ে এলেন মহাদেব মুখার্জীও। 

কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম শরিক সি পি এম এই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নকশালবাড়ির মত সশস্ত্র আন্দোলন দাবানলের মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে দিল। উদ্দীপ্ত ভূমিহীন কৃষক এবং ছোট ভাগচাষিরা জোতদারদের বিরুদ্ধে শুরু করল সশস্ত্র গণ-আন্দোলন। ১৯৬৯-এর ২২শে এপ্রিল লেনিনের জন্মদিনে কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া( মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হ’ল। 

শ্রেণিশত্রু খতমের ডাক দিলেন চারু মজুমদার। ১৯৭১ এ বিশাল সংখ্যায় ছাত্রছাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল বিপ্লবে অংশ নিতে(পরে দেখা যায় প্রকৃত রাজনৈতিক চিন্তার অভাব এবং তাৎক্ষণিক আবেগ তাদের এই প্রয়াসকে অনেকটাই ব্যর্থ করে দেয়)। শোনা যায়, এ সময়ে শিয়ালদার একজন কংগ্রেসি এম এল এর বাড়ি পরিণত হয়েছিল নকশালদের টর্চার করার চেম্বার হিসেবে। পুলিশ এবং কংগ্রেসি দালালরা ছেলে তুলে এখানে ঢুকিয়ে দিত।

0 comments: