0

প্রাচীন কথা - দোলা সেন

Posted in


প্রাচীন কথা


পঞ্চকন্যার তৃতীয়া – কুন্তী 
দোলা সেন


দ্বিতীয় ভাগ

হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে একশোপাঁচটি বালক। নিজেদের খেলা, দুষ্টুমির সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্র এবং শস্ত্রবিদ্যায় পারঙ্গম হয়ে উঠতে থাকে তারা। আর কুন্তীর আশা সত্যি করে মেধা ও স্বভাবগুণে পঞ্চপাণ্ডব কুরুকুলের সবার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। গুরু দ্রোণ তো অর্জুনকে চোখে হারান। পৃথিবীর সেরা ধনুর্ধর হিসেবে তাকে তৈরি করার শপথ তাঁর। এভাবেই একসময় শিক্ষাকাল শেষ হয়। আজ তাদের অধীত শিক্ষা প্রদর্শনের দিন।

প্রত্যেকে একে একে তাঁর নৈপুণ্য দেখাল। প্রত্যাশামতোই সেরা প্রদর্শন অর্জুনের। তৃপ্ত দ্রোণ প্রিয় শিষ্যকে সেরা ধনুর্ধরের শিরোপা দিতে যাবেন, এমন সময় বাধা এল এক জ্যোতির্ময় কিশোরের কাছ থেকে। সে এতক্ষণ বসে বসে দেখছিল অর্জুনের নৈপুণ্য। তার নাম কর্ণ। এবার সে উঠে দাঁড়াল। একে একে অর্জুনের করে যাওয়া সকল কৌশলের পুনরাবৃত্তি করে সদর্পে ঘুরে দাঁড়াল দ্রোণের দিকে। এবার কাকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেবেন গুরু দ্রোণ?

সবচেয়ে বড় চমকটা পেলেন কুন্তী! একে তো তীরন্দাজ অর্জুনকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারে এই ভাবনাটাই তাঁকে অবাক করেছিল প্রথমটায়। তারপর স্পর্ধিত যুবককে ভালো করে দেখে মাথা ঘুরে গেল তাঁর। এ কাকে দেখলেন তিনি? ওই দিব্য কবচ-কুণ্ডল যে বড় চেনা তাঁর। ভালো করে দেখলে সেদিনের সেই সদ্যোজাত কচি মুখখানির আভাসও কি নেই এই তরুণ দৃপ্ত মুখে? পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল তাঁর। এই তাঁর প্রথম পুত্র? তাঁর কলঙ্কের সাক্ষী অথচ প্রথম স্নেহের ভাগীদার আজ তাঁর স্বীকৃত পুত্রের প্রতিপক্ষ!কিন্তু কী বলছে সেই ছেলে? সে সূতপুত্র? অধিরথ সারথির সন্তান? সে রাধেয়?

মায়ের এই যন্ত্রণা, দোলাচলের মধ্যেই দ্রুতলয়ে ঘটে গেল পরপর কয়েকটি ঘটনা। ইতিমধ্যে কর্ণ অর্জুনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছে এবং সেই আহ্বানের পথ সুগম করতে দুর্যোধন কর্ণের অঙ্গরাজ্যে অভিষেক করিয়েছে। অসহায় কুন্তী বসে বসে দেখলেন জ্যেষ্ঠ পুত্রের সম্মান ও আদর এবং একই সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম করলেন তাঁর দুই মহারথী পুত্রের মধ্যে একটি অপার বিরোধের প্রাচীর দাঁড়িয়ে গেল। আর কতো নিতে পারেন পৃথা – তিনি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন। আর তাই নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পরায় তখনকার মতো গণ্ডোগোল থেমে গেল।

পরে সুস্থ হয়ে মাথা ঠাণ্ডা হলে কুন্তী ভাবে দেখলেন, যা হয়েছে তা এখন তাঁর আয়ত্ত্বের বাইরে। একটি স্বীকৃতি তাঁকে হয়ত তাঁর প্রথম নাড়িছেঁড়া ধনকে ফিরিয়ে দেবে; কিন্তু এতে রাজমাতা এবং রাজবধু কুন্তী শুধু নিজেই কলঙ্কভাগী হবেন না একই সঙ্গে আনিশ্চিত করে তুলবেন বাকি সন্তানদের জীবনও। অতএব তিনি মনে মনে কর্ণকে আরও একবার বিসর্জন দিলেন। আঁকড়ে ধরলেন তাঁর পাঁচ পুত্রের ভবিষ্যৎ আর নিজের সুনামকে।

এর জন্যই কুন্তী আমাদের কাছে এক অমীমাংসিত প্রহেলিকা হযে থেকে যান। তিনি এমন একজন মা – যিনি নিজের এবং সপত্নীপুত্রদের মধ্যে কোনদিন কোন বিভাজন করেন নি। বরং মাদ্রীপুত্র সহদেব তাঁর সবচেয়ে আদরের ছিল। তবু সেই স্নেহময়ী জননী তাঁর প্রথম পুত্রকে দ্বিতীয়বারও বিসর্জন দিলেন কী উদাসীন নৈর্ব্যক্তিকতায়! অথচ পিতা দায়িত্ব নিলে কানীন পুত্র তখন সমাজে স্বীকৃত ছিল। স্বয়ং মহর্ষি বেদব্যাস তার প্রমাণ। অথচ কর্ণকে তার পিতা মাতা দুজনেই ত্যাগ করেছিলেন। কেউই তার দায়িত্ব নেন নি!

পাণ্ডবদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও পরাক্রম দুর্যোধনকে ক্রমশঃ অসুখী করে তুলছিল। তাঁরা এখন আর ছোট নেই। অনেকদিন পর্যন্ত দুর্যোধন জানতেন হস্তিনাপুরের ভাবী রাজা তিনি। হঠাৎ করে পাণ্ডবদের আগমণ তাঁর কোনদিনই মনঃপুত হয় নি। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বৈরিতা বেড়েছে বই কমেনি। অতএব শকুনির সঙ্গে পরামর্শ করে দুর্যোধন পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। সেখানে জতুগৃহে তাঁদের পুড়িয়ে মারাই তাঁর উদ্দেশ্য। বিদুরের বুদ্ধিতে পাণ্ডবেরা সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলেন বটে; কিন্তু তার আগে? পালাবার আগের দিন সেই যে এক দরিদ্র নিষাদরমণী তার পাঁচটি ছেলে নিয়ে তাঁদের আশ্রয় নেয়? তাদের খাইয়ে দাইয়ে ঘুমের ব্যবস্থা করে ঘরে আগুন লাগিয়ে পলানোর বুদ্ধিটি কিন্তু কুন্তীর মাথা থেকেই বেরিয়েছিল! যাতে সকালে ছয়টি অগ্নিদগ্ধ দেহ দেখে দুর্যোধন তাঁদের মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হন আর কুন্তী তাঁর সন্তানসহ নিরাপদে অজ্ঞাতবাসে থেকে সুসময়ের অপেক্ষা করতে পারবেন।

কুন্তী চরিত্রের জটিলতা ও বৈপরীত্য আমাদের পদে পদে বিস্মিত করে। একদিকে উদার, স্নেহময়ী জননী, আবার অন্যদিকে এক অসম্ভব নির্মম এক রাজনীতিক। যিনি ঠাণ্ডামাথায় সন্তানসহ এক রমণীকে পুড়িয়ে মারতে পারেন, সেই তিনিই আবার বনবাস কালে আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণকে রক্ষা করার জন্য অপত্য ভীমকে বকরাক্ষসের কাছে পাঠাতে দ্বিধাহীন! ভীমের জন্য যুধিষ্ঠিরের আশঙ্কাকেও তিনি বিন্দুমাত্র আমল দেন না। আবার যখন তাঁর মনে হয় দ্রৌপদীর মতো বহ্নিশিখা থেকে দূরে থাকা কোন পুরুষের পক্ষেই সম্ভব নয়, বরং এ নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ বা অসন্তোষের বীজ জন্মাতে পারে – তখন তিনি তাঁর একটি সাধারণভাবে উচ্চারিত কথাকেই সত্য করে তোলেন। দ্রৌপদীর পঞ্চপতির সংসার হয়!

এরপর অল্প কিছুদিনের জন্য কুন্তীর সুখের সময়। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভ, রাজচক্রবর্তী হয়ে ওঠা – কিন্তু জুয়াসক্ত রাজা কবেই বা তাঁর রাজ্য ধরে রাখতে পেরেছেন? ফলে পাশাখেলায় রাজ্য, ধন, পত্নীর সম্মান সব হারিয়ে তিনি সপরিবারে বনবাসী হলেন। কুন্তী একাকিনী রয়ে গেলেন বিদুরের কাছে।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঠিক আগে কুন্তীকে আবার আমরা দেখি সম্পূর্ণ অন্য রূপে। সে সময় যুধিষ্ঠির যে কোন মূল্যে শান্তির প্রার্থী – পঞ্চগ্রামের পরিবর্তে রাজ্যের দাবী ছেড়ে দিতে রাজি – তখন কুন্তী গর্জে ওঠেন। না, সন্তানদের রাজ্যকামনায় নয়। কুরুসভায় দ্রৌপদীর যে চূড়ান্ত অপমান হয়েছিল, তার প্রতিবিধানের জন্য। রাজ্য নয়, সম্পদ নয়, এক নারী হয়ে আরেক নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য। সেই অপমানের বদলা নেবার প্রতিশ্রুতি যে ভোলে, সে আর যেই হোক, তাঁর সন্তান নয় – এমনধারা কঠোর বাক্যও তাঁর মুখে শোনা যায়। সেই পুরুষশাসিত দ্বাপর যুগে দাঁড়িয়ে এই তীব্র প্রতিবাদ আমাদের বহুক্ষণ বিস্ময়াবিষ্ট করে রাখে।

যুদ্ধ শুরু হলো। এইবার কুন্তীর মাতৃহৃদয় সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। তিনি খুব ভালো করে জানেন, ভীষ্ম, দ্রোণের মতো মহারথীদের হাতে পাণ্ডবদের বিশেষ ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তাঁরা প্রত্যেকেই এদের প্রতি স্নেহপ্রবণ। একমাত্র ভয়ের জায়গা তাঁরই ঔরসজাত কর্ণ! যে হাত রক্ষাকবচ হয়ে ভাইদের রক্ষা করতে পারত, পরিস্থিতি আজ একশ’ আশি ডিগ্রী ঘুরিয়ে সেই হাতেই অস্ত্র তুলে দিয়েছে। নিরপেক্ষ থাকাই হয়ত তাঁর পক্ষে সঙ্গত ছিল, কিন্তু যে প্রাণগুলিকে তিনি নিজের হাতে লালন পালন করে এত বড় করে তুলেছেন, তাদের দাবীই বড় বেশি ভারি হয়ে দেখা দিল। এই তৃতীয় বারেও তিনি কর্ণকেই বিসর্জন দিলেন।

রোজ ভোরবেলা নদীবক্ষে সূর্যস্তব করেন কর্ণ। উদায়ভানুর সঙ্গে অজানা এক অদ্ভুত বাঁধনে বাঁধা তিনি। পূজাশেষ জল থেকে যখন উঠে আসেন, তখন কোন প্রার্থীর প্রার্থনা তিনি ফেরান না। কুন্তী সেটা জানতেন। তাই ধর্মক্ষেত্র কুরক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালে কর্ণের দ্বারে আজকের প্রার্থীর নাম কুন্তী!

কুন্তীর মুখে নিজের জন্মকথা, সূর্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণের বা কবচকুণ্ডলের রহস্য জেনে সেই যুবকের মনে যে ঝড় উঠেছিল, তার কতটা আঁচ পেয়েছিলেন অথবা অনুধাবন করেছিলেন পৃথা তা জানা যায় না। হয়তো সেই অবকাশও তাঁর হাতে ছিল না। তিনি তখন কর্ণকে পাণ্ডবপক্ষে নিয়ে আসতে ব্যস্ত –

রাজ্যলোভ – ‘দোলাবেন ধবল চামর যুধিষ্ঠির’ – যদিও কুরুবংশের সিংহাসনে কর্ণের অধিকার কী করে হয়, সে বিষয়টা স্পষ্ট নয়। হয়ত বিজেতারাই নিয়ম তৈরি করে – জাতীয় কিছু হয়ে থাকবে। তাতেও কর্ণের হেলদোল নেই দেখে কর্ণকে দ্রৌপদীর পতি হবার লোভ দেখাতেও বাধল না পাণ্ডবজননীর! নদীতীরে এক নারীর হাতে দ্বিতীয়বার বস্ত্রহরণ ঘটল এক অভাগিনীর। যেন তেন প্রকারেণ কর্ণকে স্বপক্ষে আনার চেষ্টায় কুন্তী তখন অন্ধ।

এইখানে আমার একটু সন্দেহ হয়। কুন্তীর মতো প্রখর বুদ্ধিশালিনী এবং ধুরন্ধর রাজনীতিজ্ঞানসম্পন্ন নারী কি সত্যিই কর্ণকে নিজপক্ষে করতে চেয়েছিলেন? অথবা যুদ্ধ থামাতে? নাকি তিনি জানতেন যে, কর্ণের মতো এক মহাবীর ও উদারমনা পুরুষ, তাঁর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ছাড়া অন্য কিছু করতেই পারেন না? দ্রৌপদীর উল্লেখ কি সেই প্রত্যাখ্যান নিশ্চিত করতেই? কর্ণের প্রতি তাঁর সেই স্নেহ থাকলে তিনি তো পাণ্ডবদেরও একথা বলতে পারতেন? কিন্তু তা তো নয়! আসলে তিনি এসেছেন কর্ণের মনোবল ভেঙে দিতে। যাদের তিনি নিজের পুত্র বলে স্বীকার করেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। 

বারবার তিনবার। আর কতবার কত ভাবে পরিত্যক্ত হবেন কর্ণ? অর্জুন বাদে চার পাণ্ডবের প্রাণদান এবং জন্মদাত্রীর গোপনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বোধহয় জন্মঋণ শোধ করলেন রাধেয়। আর কুন্তী? এক সফল অভিযানের শেষে ঘরে ফিরে এলেন ঠিকই, কিন্তু এই দান গ্রহণের দীনতা তাঁর মর্মভেদ করল। নিজের তুচ্ছতায়, সংকীর্ণতায় রোজ একটু একটু করে মরে যেতে লাগলেন পৃথা।

যুদ্ধ শেষ হল যখন, তখন আর বোধহয় এই গ্লানি বহন করতে পারলেন না পৃথা। পুত্রদের কাছে কর্ণের পরিচয় দিয়ে তাকেও মর্যাদার সঙ্গে দাহ করার কথা বললেন। শোকে আকুল হলেন পাঁচভাই। বিচলিত যুধিষ্ঠির অভিশাপ দিলেন পৃথাকে – নারীজাতি এরপর থেকে সত্য গোপন করার ক্ষমতা হারাল।

চিরকাল যাকে ত্যাগ করে এসেছেন সেই কর্ণ নন, অভিশাপ দিলেন যুধিষ্ঠির – যাঁকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি সবকিছু বাজি ধরেছিলেন। চূড়ান্ত আত্মগ্লানি আর নির্বেদ গ্রাস করল কুন্তীকে। পাণ্ডবদের রাজ্যাভিষেকের কিছুদিন পরে তিনিও ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর সঙ্গে বাণপ্রস্থে গেলেন। সেখানেই এক ভয়ঙ্কর দাবানলে তাঁদের মৃত্যু হয়। বাইরের দাবানল পৃথার অন্তরের দাবানলকে প্রশমিত করলে কিনা জানিনা, শুধু তাঁর নশ্বর দেহ ছাই হয়ে গেল।

কুন্তী তাঁর জীবনে চারবার গর্ভধারণ করেছিলেন দেবতাদের আহ্বান করে। একবার স্বেচ্ছায়, বাকি তিনবার তাঁর স্বামীর আদেশে। কিন্তু চিরজীবন তিনি ঐ একবার স্বেচ্ছাধীন হবার মূল্য চুকিয়ে গেলেন। তাঁর ত্যাজ্যপুত্র তাঁকে বর দিল, আর যে স্বীকৃত সন্তানদের জন্য তিনি সারাজীবন প্রাণপাত করলেন, সেখান থেকেই পেলেন অভিশাপ। এর চেয়ে বড় নিয়তির পরিহাস আর কীই বা হতে পারত! তবু কুন্তীর এই হার না মানা চরিত্রের সামনে নতজানু হওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করবার নেই।

0 comments: