ধারাবাহিক - ফাল্গুনি ঘোষ
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
বইপাড়ারতন্ত্রধারক
ফাল্গুনি ঘোষ
নব্বই দশকের প্রথম ভাগ। কলেজস্ট্রিট বইপাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু। তারপর একসময়ে বেশ কয়েকবছর চব্বিশ ঘন্টাই কলেজস্ট্রিটের বুকে থেকে যাওয়া। ক্রমশ প্রকাশনার কাজে জড়িয়ে পড়ে আজও নিত্য সঙ্গী বইপাড়া। একদিন মফস্বল থেকে এসে পড়েছিলাম এই মহানগরে। সেই অথৈ সমুদ্রে এই বইয়ে ঘেরা পাড়াটি যে একটু একটু করে আমার পাড়া হয়ে উঠল, তার পিছনে এমন বেশ কিছু মানুষের ভূমিকা প্রবল, যাঁরা প্রচলিত খ্যাতির আলোকবৃত্তে হয়তো দাঁড়িয়ে নেই, কিন্তু আমার জীবনে আমার বইপাড়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের হাত ধরেই আমি বইপাড়াকে চিনেছি- আজও চিনে চলেছি। এই সিরিজ সেইসব মানুষের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের দুর্বল প্রয়াস।
৩
কলেজস্ট্রিট থেকে রমানাথ মজুমদার, রমানাথ থেকে শ্যামাচরণ, শ্যামাচরণ থেকে সীতারাম ঘোষ- মানে বইপাড়ার ইতিউতি প্রায় রোজই দেখা যায় তাঁকে। আকৃতি কিঞ্চিত লম্বা এবং রোগার দিকেই বলা চলে। একটু দোদুল্যমান। দৃশ্যত কিছুটা দুর্বলস্নায়ু, কিছুটা নেশাতুর। মুখ খুললে উচ্চারণ বুঝতে বেশ কষ্টই করতে হয়। তাই সচরাচর সৌজন্য বিনিময় ছাড়া নিজেকেই বাকসংযত রাখেন। কিন্তু কখনো কখনো বইপাড়ার ভিড়-সন্ধের মধ্যেও একা হওয়ার অবকাশ খুঁজে নেওয়া যায় যদি, আর যদি মেলে দু'একজন জিজ্ঞাসু সঙ্গী, সংযমের অবরোধ সরিয়ে নেন। "জানো, গরীব মানুষ ছিল তো, অভাবী ছিল। তবু কফিহাউসে কফিটা ও-ই খাওয়াতো।" "রাজনীতির জন্য পুলিশ খুঁজছিল। খবর দিলাম। পালিয়ে গেল। বম্বে।" প্রথম বক্তব্যের বিষয় শিবরাম চক্রবর্তী। আর দ্বিতীয়টির মৃণাল সেন। আর বক্তা আপাত অসংলগ্ন, মুখে থুতু ছিটোনো নিয়মিত অথচ নাতিউজ্জ্বল, বন্ধুদের ভুদো বা পাগলা, অনুপ চ্যাটার্জি। একাত্তরের যুদ্ধে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অভিযানের অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে। নানা কথায় ঘুরতে ঘুরতে প্রায়ই বলেন, "তখন মিসাইল ছিল না। গ্রেনেড ছুঁড়ে তাড়িয়েছি ওদের। বাংলাদেশ হল।" এই অব্দি বলেই একটু উদাস হয়ে যান। বিড়বিড় করেন, "বাংলা ... বাংলা ... কত বাংলা বই চারদিকে ...।" মুহূর্তে সন্ধের বইপাড়ার আবছায়া গলির হলদে আলো আরও নিবিড় হয়ে আসে। সীমান্তকে তুড়ি মেরে কলেজস্ট্রিট আর বাংলাবাজার গা-ঘেঁষে বসে। এই বইপাড়াই বাংলা তাঁর। কথার বাঁধ ভেঙেছে। বিদ্যাসাগরমশাই কিশোর বয়সে পড়তে আসেন মাস্টারমশাইয়ের কাছে। একটি প্রাচীন বাড়ি দেখিয়ে বলেন, "বিদ্যাসাগরের মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল। মাস্টারমশাইকে বিক্রি করে দিল!" একটা স্থাপত্য আর এক চরিত্র দেখা না-দেখায় মিশে এক হয়ে যায়। কলেজস্ট্রিটের প্রতিটি বাড়ি, তাদের হাতবদল আর চেনা-অচেনার গল্প বলে যান। এই বইপাড়ারই বাসিন্দা তিনি। "তুমি চেনো এদের?" অবলীলায় শুধোন। "কাদের বলো তো দাদা?" "আরে ওই যে বাড়িগুলোকে। কত বই বেরোতো এদের পেট থেকে! কত পড়া!" "না তো, জানি না। তুমি না কহিলে কেমনে কব?" পরম প্রশ্রয়ে পরস্পর জড়িয়ে যাওয়া শব্দ বয়ে চলে স্রোতের মতন। একটু মনোযোগে ছুঁয়ে ফেলা যায় অতি প্রাচীন, মধ্য প্রাচীন আর অধুনার কাছাকাছি বইপাড়ার সুপ্রসর বুকের লাবডুব। এই কিছুদিন আগে চায়ের দোকানের আড্ডায় কথা উঠল ঠাকুরদালানের। সামনের রোজ দেখা বাড়িটাকে দেখিয়ে বললেন, "এটাতেই আছে।" বললাম, "ধ্যুস! এবাড়িতে আবার ঠাকুরদালান কোথায়?" আক্ষরিক অর্থেই ঘাড় ধরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেলেন। ঠেলে ফাঁক করলেন দরজা। দেখলাম, ঠাকুরদালানে নির্মীয়মাণ প্রতিমা হাসিমুখে চেয়ে আছেন তাঁর এক বহুকালের পরিচিতের দিকে। ক'দিন পরে বললেন, তোকে দালানটা দেখিয়েছি কিনা বল? তাহলেই বল, তোকে কত ভালোবাসি !" হ্যাঁ, এমন করেই ভালোবেসো, অনুপদা। তাহলে বইপাড়াও আমাকে ভালোবাসবে।
0 comments: