0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ৩০
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়


Diary Entry - 28 
9th. November, 1942, Monday





প্রিয় কিটী, 

গতকাল ছিল পিটারের জন্মদিন। এই জন্মদিনে পিটার ষোলো বছর বয়সে পা দিল। জন্মদিনে পিটার বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর উপহার পেয়েছে। উপহারের মধ্যে একটা হল জনপ্রিয় "ব্যবসায়ী গেম—মনোপলি"। এ'ছাড়া একটা দাড়ি কাটার রেজার, একটা লাইটার, ইত্যাদিও পেয়েছে। পিটার খুব একটা সিগারেট খায় না। তবু লাইটারটা দেখতে বেশ ভাল, আর অন্যকে “এটা আমার নিজের জিনিষ”, বলে দেখাতেও ভাল লাগবে। 

তবে আমাদের সবথেকে বড় চমকটা দিলেন মিঃ ভ্যান ড্যান। ঠিক বেলা একটার সময় তিনি এসে বললেন, 'যুদ্ধের সবথেকে চমকপ্রদ খবর।' খবরটা হল, বৃটিশ সৈন্য তিউনিস,আলজিরিয়া, ক্যাস্যাব্লিয়াঙ্কা এবং ওয়ানে নিজেদের যুদ্ধ ঘাঁটি স্থাপন করতে পেরেছে। অর্থাৎ জার্মানির নাৎসি বাহিনী পিছু হঠতে শুরু করেছে। তারা আর অপরাজেয় শক্তি নয়।এই বিশ্বাসটা দেশনায়ক, বিশেষকরে সৈন্যদের মধ্যে ছড়াতে শ্ররু করেছে। মিঃ ভ্যান ড্যান বললেন, চারদিকের সবাই বলতে শুরু করেছে "এটা হোল অন্তিম পর্বের সূত্রপাত বা শুরু।" কিন্তু বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, যাঁর কানেও সাধারণ মানুষের এই কথা গিয়েছিল, তিনি তাঁর রেডিও ভাষণে বলেন, "এটা কখনই শেষ নয় অথবা এটা কোন শেষের শুরু নয়। বরং এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা ভাল, যে এটা আরম্ভের শেষ।" অর্থাৎ এবার শুরু হবে আরম্ভের পরবর্তী পর্যায়। এক কথায় অন্তিমের শুরু, বা আরম্ভের শেষ। কথা দু'টোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। একটা কথা নিশ্চিত, এর ফলে সাধারণ মানুষ ক্রমেই আশাবাদী হয়ে উঠবে। আরও খবর হল গত তিন মাস যাবত জার্মান সৈন্য রাশিয়ার স্ট্যালিনগ্র্যাড শহরটিকে চারদিক থেকে অবরোধ করে আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্ট্যালিনগ্র্যাড শহরের পতন ঘটানো সম্ভব হয় নি। 

এ'সব আপাততঃ থাক। হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষ কিছুতেই কমবে না, আমদেরও লুকিয়ে থাকতে হবে। এখন বরং আমরা আমদের গুপ্ত আস্তানার বিভিন্ন খবরে ফিরে আসি। আমাদের গুপ্তগৃহে খাবার সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে কিছু বলা দরকার। আমাদের ওপর তলায় কিছু লোভী, পেটুক আর খিটখিটে লোক আছে। মিঃ কোপহৌসের এক পরিচিত লোক, একটা ভাল বেকারীর ভাল রুটি আমাদের জন্যে এনে দেয়। তবে বাড়িতে থাকতে আমরা যতগুলো আনতাম, ঔ ভদ্রলোকটি আমাদের জন্যে ততগুলো আনতে পারতেন না। তবে যতটুকু আনতেন, ততটুকু আমাদের পক্ষে যথেষ্ঠ। আমাদের খাবার জোগাড় করার জন্যে বেআইনিভাবে চারটে রেশন কার্ড সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো দেখিয়েই আমাদের জন্যে খাবার জোগাড় করা হত। বাইরে প্রতিটি জিনিষের দাম অত্যধিক বেড়ে গেছে। এর আগে জিনিষের দাম এতটা কোনদিনই বাড়ে নি। আগে সাতাশ ফ্লোরিনের বিনিময়ে যে জিনিষ পাওয়া যেত, এখন তার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে তেত্রিশ ফ্লোরিন। আর সেটাও পাওয়া যাবে, রেশন কার্ডের বিনিময়ে ইস্যু করা স্লিপের বিনিময়ে। খোলা বাজারে দাম আরও বেশী। দোকানে গিয়ে স্লিপ দেখালে তবেই প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যাবে। সে দ্রব্যগুলো প্রতি সপ্তাহে নিয়ে এসে, আমাদের গুপ্তগৃহের তিন তলার স্টোরে রেখে দেওয়া হত। এ'ছাড়াও সেখানে প্রায় ১৫০ টিন সব্জী আছে। এরসাথে, আমরা প্রায় ২৭০ পাউন্ড মটর আর সিমমটর সঙ্গে এনেছিলাম। তবে এই সমস্ত আমরা শুধুমাত্র নিজেদের জন্যেই নিয়ে আসি নি। অফিসের লোকেরাও তা' তাদের খাবার জন্যে নিত। আমাদের লুকানো যে র‍্যাক/দরজা ছিল, সেখানে সিঁড়ির দেওয়ালে হুক লাগিয়ে শুকনো মটর আর সিমমটরের বস্তাগুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। প্যাকেটগুলো বেশ ভারী থাকার কারণে বেশ কয়েকটা প্যাকেটের ঝোলানোর জায়গাটা আলগা হয়ে গিয়েছিল। এ'সব দেখে আমরা ঠিক করলাম এ'গুলো আর এখানে ঝুলিয়ে রাখা ঠিক হবে না। তারচেয়ে এ'গুলো ওপরের চিলেকোঠার স্টোরে রেখে দেওয়াই সব থেকে ভাল হবে। পিটারকে বলা হল সে যেন এই প্যাকেটগুলোকে এখান থেকে খুলে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখে। 

ছয়টা প্যাকেটের মধ্যে পাঁচটা প্যাকেট ঠিকঠাক চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে এলো। তারপর যখন ছয় নম্বর প্যাকেটটাকে হুক থেকে নামিয়ে চিলেকোঠায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে তুলেছে তখনই বিপর্যয়ের শুরু। প্যাকেটের নীচের সেলাইটা পুরো ছিঁড়ে গিয়ে বৃষ্টির মত --- না ঠিক বৃষ্টির মত বললে ঠিক হবে না, "শিলাবৃষ্টির মত" ভিতরের মটর আর সিমমটরগুলো টকাটক শব্দে ছড়িয়ে পড়ে সারা জায়গাটাতে যেন তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে দিল। সিঁড়ির চারদিকে মটরদানাগুলো নাচানাচি, লাফালাফি শুরু করে দিল। প্রায় পঞ্চাশ পাউন্ড ওজনের প্যাকেট সিঁড়ির ওপর পড়ে যাওয়াতে যে বিকট শব্দ হল, তাতে একটা মরা মানুষও তার খাট থেকে লাফিয়ে উঠতে পারত। নীচের লোকদের মনে হতে পারত, ওপরের তলাটা বোধয়হ হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছে (ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সেই সময় অফিসে কোন বাইরের লোক ছিল না )। পিটার এক মুহূর্তের মধ্যে বিষয়টা বুঝতে পেরে, হো হো করে হেসে উঠল। আমি ঠিক সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমায় দেখেই যেন পিটার অত জোরে হেসে উঠেছিল। মটর আর সিমমটরগুলো সিঁড়িতে ছড়িয়ে পড়ায়, প্রথমে মনে হচ্ছিল, সিঁড়ির নীচে আমি যেন একটা মটরের ছোট দ্বীপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আমার চারদিকে স্তূপীকৃত মটর আর মাঝখানে আমি। দ্রুত আমরা সবাই মটরগুলো মাটি থেকে তুলে ফেলার কাজে হাত লাগালাম। কিন্তু ছোট ছোট মটরদানা গড়িয়ে, হাত থেকে পিছলে ওই জায়গার বিভিন্ন সম্ভব- অসম্ভব কোণে ঢুকে যেতে থাকল। তারপর থেকে যারাই যখন নীচে যাচ্ছে, তখনই হাতের মুঠোর মধ্যে করে মটরদানা নিয়ে এসে শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের কাছে হাজির করছে। 

আমি বলতে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, বাবার জ্বর ছেড়ে গেছে। বাবা এখন অনেকটা সুস্থ। 



ইতি, 

অ্যানি। 



নোটঃ- এইমাত্র রেডিওর খবরে জানা গেল, মিত্র শক্তির কাছে আলজিরিয়ার পতন ঘটেছে। বেশ কয়েকদিন বৃটিশ সেনাবাহিনী মরক্কো, ক্যাসাব্লিয়াঙ্কা এবং ওরানকে নিজেদের দখলে রেখেছে। এখন আমরা টিউনিশের জন্যে আধীরভাবে অপেক্ষা করছি। 



অনুবাদকের সংযোজন ঃ- চ্যান্সেলার হিটলারের মানসিক গঠন, তার তীব্র কমিউনিস্ট বিদ্বেষের পাশাপাশি তীব্র ইহুদি বিদ্বেষ ও ঘৃণার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেক ঐতিহাসিক তাঁদের নিজস্ব ভাবনা ও ব্যক্তি বিশ্লেষণ থেকে এরূপ মন্তব্য করেছেন, ১৯০৮ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তরুণ ও উচ্ছাকাঙ্খী হিটলারের এই বৈকল্পিক ও চরম ইহুদি বিদ্বেষী মনোভাবের ক্ষেত্রভূমি প্রস্তুত হয় তাঁর ভিয়েনায় অবস্থানকালীন সময়ের স্মৃতি থেকে। বিংশ শতকের প্রথম দিকে ভিয়েনার মোট জনসংখ্যার নয় শতাংশ ছিল ইহুদি--- কিন্তু ভিয়েনার বৃহত্তম নাগরিক সমাজের মানসিকতার সুপ্ত কিন্তু স্পষ্ট অভিমুখ ছিল ইহুদি বিদ্বেষ। এই জাতি বিদ্বেষের অন্যতম ভাষ্যকার তথা অফিসিয়াল প্রচারক ছিলেন ভিয়েনার মেয়র কার্ল ল্যুগার (Karl Lueger )। এ;ছাড়াও ছিল ইহুদি বিদ্বেষী বেশ কিছু সংবাদপত্র আর পত্রিকা। 

আরও যে দুটি বিষয় হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষের তীব্র ভাবনাকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল, তা'হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে বিজয়ী ইউরোপীয় শক্তির যুদ্ধ অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করে জার্মানকে সব দিকথেকে দমন করার প্রচেষ্টা ; এবং দ্বিতীয়তঃ জার্মান জাতীয়তাবাদের আর্য রক্তের জাতি কৌলীন্যের গরিমা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার জার্মান সৈনিক হিসাবে যুদ্ধের অগ্রভাগেই ছিলেন। অনেক জার্মান সৈনিকের মত হিটলারও যুদ্ধের পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নিতে পারেন নি। অনেকের মতই হিটলারও বিশ্বাস করতেন, যে, জার্মান যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরাজিত হয় নি। তারা পরাজিত হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে। দেশের একাংশের বিশ্বাসঘাতকতা জার্মান সৈন্যবাহিনীর পিছন থেকে ছুরি মেরে তাদের পরাজয়কে সুনিশ্চিত করেছিল। আর আভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতক হিসাবে আঙ্গুল তোলা হয়েছিল, সমাজতন্ত্রী আর কমিউনিস্টদের দিকে। সরাসরি দায়বদ্ধ করা হয়েছিল জার্মান তথা ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বসবাসকারী ইহুদিদের দিকে। অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ও অস্ট্রিয়ান বাহিনীতে প্রায় লক্ষাধিক ইহুদি একই সাথে ফরাসী ও ইংরাজ বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের দেশের হয়ে লড়াই করেছিল,এবং বারোহাজারের অধিক ইহুদি যুদ্ধে সৈনিক মৃত্যুবরণ করেছিল। 

হিটলারের আভ্যন্তরীণ নীতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ ছিল ইহুদি-নিধন। তিনি সরকারী-বেসরকারী সমস্ত ক্ষেত্রেই ইহুদিদের কাজের সুযোগ বন্ধ করে দেন। এমন’কি ইহুদিদের সাথে আত্মীয়তাসূত্রে (বৈবাহিক) আবদ্ধ জার্মান পরিবারগুলিকেও যে’কোন চাকরি থেকে বঞ্চিত করার নীতি গৃহীত হয়। ঝটিকা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বহু ইহুদিকে কারারূদ্ধ করা হয়। ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের পর নাৎসি দলের ইহুদি নির্যাতন পাশবিক পর্যায়ে চলে যায়। আইনকরে ইহুদিদের জার্মান নাগরিকত্ব নিষিদ্ধ করা হয়। নির্বিচারে হুদিদের আটক ও হত্যা হতে থাকে। নাৎসি অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দলে দলে ইহুদি দেশত্যাগ করে চলে যেতে থাকে। এই দেশত্যাগী পরিবারের একটি ছিল অ্যানি ফ্রাঙ্কের পরিবার। 

0 comments: