প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
কাল্পনিক ঘটনা অবলম্বনে একটি সত্য কাহিনী
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী
হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে হায়দ্রাবাদের হুসেন সাগরের উত্তর পাড়ের এক বেঞ্চিতে বসে উদাস দৃষ্টিতে জলের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখের সামনে অপর সব পাড়ের সমস্ত জীবন চূড়ান্ত ভাবে জঙ্গম।
হুসেন সাগরের এই পাড়টা মধ্যসপ্তাহে বেশ ফাঁকা থাকে। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু কপোত-কপোতী আবেগঘন অবস্থায় বকবকমরত। আমি প্রত্যেক জুটির থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে সবুজ ঘাসের আঙিনায় একটা রেলিঙে হেলান দিয়ে বসে আছি। সপ্তাহান্তে অবশ্য এইরকম নিরাপদ স্থান নির্বাচন করা অতীব দুরূহ।
একটু পরেই চার পাশের সব আলো জ্বলে উঠে জায়গাটাকে স্বপ্নপুরী বানিয়ে দেবে। এখন অস্তগামী সূর্যের আলো হুসেন সাগরের জলে রক্ত রাঙা হোলি খেলতে খেলতে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতিফলন আর প্রতিসরণের অধ্যায় শেখাচ্ছে।
অদূরে মূর্তিমান বুদ্ধদেব মাঝ সাগরে চির শান্তির প্রতীক রূপে দণ্ডায়মান।
অবশ্য আমার চোখের সামনে সবকিছুই ধরা পড়ছে কিন্তু কিছুই যেন দেখা দিচ্ছে না। কোন এক আধুনিক কবি (শঙ্খ ঘোষ বোধহয়) বলেছিলেন যে চেয়ে থাকা আর দেখা এক নয়। এত দিনে আমি কথাটার মানে উপলব্ধি করলাম। বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বুঝতে পারলাম যে আমি অনেকক্ষণ ধরে কিছুই দেখছি না।
আসলে মনের দিক থেকে আমি আজ একটু বিধ্বস্ত।
কোম্পানির প্রথম তিনমাসের আয়ব্যয়ের ফল প্রকাশিত হয়েছে। আমার অঞ্চলের ফল একেবারে লালে-লাল – সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আমি এক্কেবারে লাল বাদশা হিসেবে পরিচিত হয়ে গেছি। ভিডিও কনফারেন্সে উপরওয়ালা নিকৃষ্টতম চার অক্ষরীয় শব্দ সহযোগে মোজা টেনে তুলতে বলে দিয়েছেন আর কোমর-বন্ধনীও কষে বাঁধতে বলেছেন।
আকারে ইঙ্গিতে এটুকু বুঝিয়ে দিয়েছেন যে বৎসরান্তে আমার অঞ্চলের ব্যবসায়িক ফলের রং একেবারে সবুজ ক্যাপ্সিকাম না হলেও নিদেনপক্ষে যেন তার হলুদ জাত ভাইয়ের গোত্রে থাকে, আর তা না হলে আমার হিমালয় পর্বত সমান স্থবির কপালে গোলাপি চিরকুটের প্রাপ্তিযোগ অবশ্যম্ভাবী।
যে সব অত্যুৎসাহী ব্যক্তিগন চারঅক্ষরীয় শব্দ সহযোগে জনগণকে শাসন করে থাকেন, তাঁদের উদ্দ্যেশ্যে ক্রুশবিদ্ধ যীশুখ্রীষ্টের ন্যায় বলতে ইচ্ছে করে, “হে পিতঃ, এদের ক্ষমা করে দিও। “ভালবাসা”-ও যে একটা চারঅক্ষরীয় শব্দ এই বোধোদয় তাঁদের আর হয়ে উঠল না!”
তাই আজ হুসেন সাগরের ধারে আমার এই শ্মশান বৈরাগ্য।
এমত অবস্থায় বাতাসে ভাসমান কয়েকটি শব্দ আমার কানে চাবুকের মত আছড়ে পড়ল। বক্তার বাচনভঙ্গি বঙ্কিম যুগীয় এবং তা অতি পরিচিত বোধ হল।
শব্দের উৎস সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলাম আমার থেকে প্রায় হাত কুড়ি দূরত্বে দুই বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে কোন এক অত্যন্ত জরুরি বিষয়ে আলোচনারত। আলোচনায় ওনারা এতই মগ্ন যে বাইরের জগত ওনাদের ওপর কোন প্রভাব ফেলছে বলে মনে হচ্ছে না।
দুজনেরই সাজপোশাক, চুলের বাহার ইত্যাদি আমার কাছে ভীষণ রকম পরিচিত বলে মনে হল।
অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষটির কদম ছাঁট চুল। পরনে একটি অর্ধ মলিন ফতুয়া আর হাঁটু পর্যন্ত ধুতি। তবে বৃদ্ধের ফতুয়া আর ঘাড় সংলগ্ন উন্মুক্ত কাঁচা সোনার মত গায়ের রঙের ওপর উঁকি মারছে তাঁর দুধশুভ্র যজ্ঞপবীতটি। সঙ্গের বাঁশের বাঁকানো বাঁটওয়ালা ছাতাটি ভাঁজ করে পাশে রাখা থাকলেও তার বয়সটি সহজেই অনুমান করা যায়। হিসেব করে দেখলাম ছাতাটি লর্ড ক্লাইভের আমলের না হলেও লর্ড কর্নওয়ালিসের সমসাময়িক তো হবেই।
অপর ভদ্রলোকটির বয়স যথেষ্ট হলেও চোখ দুটি খুবই উজ্জ্বল। মাথায় অযত্ন লালিত একমাথা সাদা চুল। মুখের চামড়ায় জ্যামিতির আঁকিবুঁকি। পরনে কোট-প্যান্ট।
ভাল করে একটু নজর করতেই চমকিয়ে উঠে নিজেই নিজেকে বলে উঠলাম, আরে, এ তো এক্কেবারে ছবি থেকে উঠে আসা আমাদের আইনস্টাইন সাহেব!
এই ভর সন্ধে বেলাতে সাহেব হুসেন সাগরের ধারে কি করছে আর অপর বৃদ্ধটাই বা কে!
ঠিক সেই মুহূর্তেই আবার বঙ্কিমি ভাষার চাবুক।
(২)
"যাহাই বল তুমি সাহেব, তোমাদের বৈজ্ঞানিক কুবুদ্ধির জোরেই আজ আমাদের প্রসন্ন গোয়ালিনী তাহার গাভীটিকে হরমোন ইনজেকশন দিয়া অতি লাভের ব্যবসা ফাঁদিয়াছে।"
আরে এ তো আমাদের কমলাকান্ত! কমলাকান্ত চক্রবর্তী!!
এই প্রাতঃস্মরণীয় বিখ্যাত চরিত্রদ্বয় এই হুসেন সাগরের ধারে ভর শ্রাবণের পড়ন্ত বিকেলে কি করছে! আমি কি জেগে ঘুমচ্ছি না ঘুমন্ত অবস্থায় জেগে আছি সেটা বোঝার জন্য ডান হাতের একটি সপাট থাপ্পড় গালে মেরে দেখি মাথাটা একেবারে ঝন-ঝন করে ঝনাৎ শব্দ করে উঠল।
চাকুরির অনিশ্চয়তার প্রভাবে কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি!
তারপর মনে হল যতই অবাস্তব হোক, এই দুই কিংবদন্তি চরিত্রর আলোচনায় একটু কান পাতা যাক। এটা মনে হতেই সরীসৃপের মত নিঃশব্দে দুই বৃদ্ধের বেঞ্চের পেছনে ঘাপটি মেরে বসলাম।
এরপর
অহো,
যাহা শুনিলাম তাহা যেন অমৃতসমান।
স্বামী ধ্রুবানন্দ কহে ইহা শোনে পুণ্যবান।।
গীতার গাত্র (গীতা আমার বন্ধু পত্নী) স্পর্শ করিয়া বলিতেছি যে যাহা শুনিয়াছি তাহাই লিপিবদ্ধ করিব, কোনপ্রকার অতিরঞ্জন করিব না।
যাই হোক, কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে আইনস্টাইন সাহেব আর আমাদের কমলাকান্তের কথোপকথন শুনবার পর বুঝতে পারলাম যে এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব “বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ” এই বিতর্কে মত্ত।
কমলাকান্ত অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে আর ওদিকে যথেষ্ট যুক্তি সহকারে আইনস্টাইন সাহেব তা খণ্ডন করবার অক্লান্ত চেষ্টা করে চলেছেন।
এই বিচিত্র বিতর্কসভার শ্রোতা-দর্শক একমাত্র আমি।
বিতর্কে ভাষার ব্যবহারে আমি চমকিত। কমলাকান্ত এবং আইনস্টাইন দুজনই দেখলাম ইংরেজি এবং বঙ্কিমি বাংলায় সমান পারদর্শী। আল্লা কে পেয়ারে হবার পর এই দুই ব্যক্তি মহোদয় মনে হয় মা সরস্বতীর কৃপায় বহু ভাষা বিশারদ হয়ে উঠেছেন। তাই দুই ভাষাতেই বিতর্ক একেবারে জমে দই।
তবে আমি এই বিতর্কের সব যুক্তি-তক্কো সর্বসাধারণের জন্য বঙ্কিমি বাংলায় লিপিবদ্ধ করার দুর্বল প্রচেষ্টা চালালাম মাত্র। আশা করি পাঠক নিজ গুনে বুঝে নেবেন।
এবারে সেই অদৃষ্টপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব বিতর্ক সভায় প্রবেশ করা যাক।
কমলা – যাহা বলিতেছিলাম সাহেব, তোমাদিগের বিজ্ঞান মানুষকে অসৎ উপায় অবলম্বনে প্রলুব্ধ করিতেছে। ইহার ফলে আমাদের প্রসন্ন গোয়ালিনীর গাভীর দুগ্ধে সে স্বাদ নাই। আসল ক্ষীর, ননী, দধি আর পরমান্নের আজ চরিত্রের বদল ঘটিয়াছে।
আইন - তোমার মতন খাদ্য বিশারদের দৃষ্টিতে ইহা বাস্তব হইলেও বর্তমান সমগ্র পৃথিবীর সাতশত কোটি বুভুক্ষু জনসাধারণের দুইবেলা দুই মুঠা আহারের সংস্থান কল্পে বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ আবাদ অতীব জরুরি।
কমলা - সাহেব, তোমার বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিতে যতই এই ব্রাহ্মনের যুক্তিকে খণ্ডন করিবার চেষ্টা কর না কেন, আমি ইহা জোর গলায় বলিতে পারি যে তোমাদের সমস্ত বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন আজ সৃষ্টিকে ধ্বংসের পথে চালিত করিতেছে।
আইন – দেখ ব্রাহ্মণ, তুমি যাহা বলিতেছ, তাহাতে যে কোনই যুক্তি নাই তাহা আমি বলিতেছি না। কিছু অতি লোভী মানুষ তাহাদের ক্ষুদ্রতর স্বার্থ সিদ্ধির তাগিদে বিজ্ঞানের যে কু-ব্যবহার করিতেছে, তাহার জন্য বিজ্ঞানকে কোনমতেই দায়ী করা যায় না।
কমলা – সাহেব, সমস্ত বিজ্ঞানীদের ইহা এক পলায়নকর মনোবৃত্তি। আমি বিজ্ঞানের অপব্যবহারের কথা কহিতেছি না। তোমরা সকল বৈজ্ঞানিক মানবজাতির উন্নয়ের নামে প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত বলাৎকার করিতেছ। তোমাদের সকল উদ্ভাবনী শক্তি মানব জাতির একটি ক্ষুদ্র সমস্যা সমাধানের হেতু ক্রমাগত বৃহৎ সমস্যার সৃষ্টি করিয়া চলিতেছে।
আইন – শোন হে বেরাদর কমলা, বিজ্ঞান মানুষের অজানাকে জানিবার আগ্রহকে উদ্দীপীত করে। আর তাই আজ মনুষ্যজাতির এত অগ্রগতি, এত উন্নতি। বিজ্ঞানের শক্তিতেই মানুষ আজ পৃথিবী শাসন করিতেছে। তাহা না হইলে জন্তু জানোয়ার আর মানুষে আর কোনও প্রভেদ থাকিত না।”
(৩)
কমলা – তোমার যুক্তি কুযুক্তি মাত্র সাহেব। অগ্রগতি আর উন্নয়নের নামে তোমরা যাহারা বিজ্ঞানের ধ্বজাধারী, তাহারাই আজ পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে দাঁড় করাইয়া দিয়াছ। ভোগবিলাসের যথেচ্ছচারীতায় বিজ্ঞান ক্রমাগত ইন্ধন যোগাইয়া চলিতেছে এবং উহার ফল স্বরূপ সকল সৃষ্টি আজি এক অতল গহ্বরের সামনে দাঁড়াইয়া তাহার অন্তর্জলি যাত্রার প্রহর গুনিয়া চলিতেছে মাত্র।
আইন – তোমার যুক্তি কুযুক্তি বটে ব্রাহ্মণ। তুমি কি বলিতে চাহ মনুষ্য জাতির জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পথে বিজ্ঞানের কোন অবদান নাই? বিজ্ঞান যদি উন্নয়নের আলোকিত পথটি না দেখাইত তবে আজও মানূষ গুহাবাসী থাকিত।
কমলা – সাহেব, তোমার মত সুপক্ক মস্তিষ্কবান বিজ্ঞানীদের এই আত্মতুষ্ট ভাবটিই বর্তমান মনুষ্যজাতির প্রভূত ক্ষতি করিয়াছে। তোমাদের নিত্যনূতন আবিষ্কারের মোহ তোমাদের দৃষ্টি শক্তিকে যে অস্বচ্ছ করিয়া তুলিয়াছে তাহা তোমরা মানিতে চাহিতেছ না আর ইহার ফলেই এত মারাত্মক রকম গোল বাধিয়াছে।
আইন – মনে হইতেছে তোমার আফিঙ্গ সেবন আজ কিছু বৃদ্ধি পাইয়াছে। সঠিক কি বলিতে চাহ তাহা যদি কিছু উদাহরনসহ পেশ কর তবে বির্তকটি চলিতে পারে, তাহা না হইলে এই আমি ক্ষেমা দিলাম।
কমলা – ভুল করিলে সাহেব। আমার উদাহরণ এতই মর্মান্তিক হইবে যে তোমায় অতি শীঘ্রই রণে ভঙ্গ দিতে হইবে।
আইন – আচ্ছা, তাহা দেখা যাইবে। এক্ষণে তোমার দু-একটি উদাহরণ তো পেশ কর দেখি।
কমলা – তবে শোন সাহেব, বর্তমান মনুষ্যজাতির বিজ্ঞান প্রদত্ত যে অগ্রগতির ধারাটির কথা তুমি বলিতেছ সেই বিদ্যুৎ শক্তি অতিমাত্রায় প্রচলিত জ্বালানী পদার্থ নির্ভর। সেই প্রচলিত জ্বালানী পদার্থ দহনকালে যে বিপুল পরিমাণ দূষণ সৃষ্টি হইতেছে সেই বিষয়ে তোমার আশা করি কোন দ্বিমত নাই। একটি বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন কেন্দ্র যে পরিমাণ দূষণ উৎপাদন করিয়া থাকে তাহা তাহার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং উর্বর কৃষি জমির উৎপাদন ক্ষমতা বিপুল ভাবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে হ্রাস করিয়া থাকে। আইস একটি ছোট্ট উদাহরণ পেশ করি।
আইন – তাহা হইলে সেটা বেশ হয়, ব্রাহ্মণ। তোমার উর্বর মস্তিস্ক প্রসূত যুক্তিহীন আলাপ-আলোচনা হইতে আমি মুক্তি পাই।
কমলা – বঙ্গভূমির বক্রেশ্বরের বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা তোমার জানা আছে সাহেব?
আইন – অতি অবশ্যই। দুর্জনে যাহাকে একদা রক্ত বিদ্যুৎ প্রকল্প বলিয়াছিল।
কমলা – সঠিক ধরিয়াছ। সেই প্রকল্পের উড়ন্ত ছাই দূর-দুরান্তের মানবজীবন অসহনীয় করিয়া তুলিয়াছে। তাহার জেরেই দূষণ বাড়িতেছে বীরভুমের বক্রেশ্বরে। নদীর জলে ছাই, জমিতে ছাই, হাওয়াতেও ছাইয়ের গুঁড়া। বিপন্ন এলাকার পরিবেশ এবং বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য। এলাকার একদা বহতা ষোড়শী চন্দ্রভাগা নদী এখন একটি মজিয়া যাওয়া খালে পরিণত হইয়াছে। আজ দেশের সর্বচ্চ আদালত অতিশীঘ্র বক্রেশ্বরের বিদ্যুৎ প্রকল্পের কতৃপক্ষকে দূষণ নিয়ন্রনে আনিতে আদেশ জারি করিয়াছেন নচেৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের আদেশ জারি করিয়াছেন।
আইন – আহা, ইহা তো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটির গাফিলতি মাত্র। উপযুক্ত আধুনিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখিবার ব্যবস্থা আজি প্রমাণিত। কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তাহার সাহায্য না লইলে, বিজ্ঞানকে কখনই দায়ি করা যায় না। সে তো দূষণ নিয়ন্ত্রণেরও পথ দেখাইয়াছে।
কমলা – ইহা একটি অতি অবশ্য সত্য কথা। কিন্তু তুমি ইহা তো মান সাহেব যে সারা পৃথিবী জুড়িয়া যে কয়েক লক্ষ মহাশক্তি সম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আজি বিদ্যুৎ শক্তি প্রতিনিয়ত ২৪x৭x৩৬৫ ধরিয়া উৎপাদন করিয়া চলিতেছে তাহার দূষণ পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখিতে পারিলেও তাহা অতীব বিপজ্জনক মাত্র।
আইন – হাঁ তাহা আমি স্বীকার করিতেছি বটে তবে অপ্রচলিত জ্বালানি শক্তি দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচেষ্টায় বিজ্ঞান আজি যথেষ্টই সফল হইয়াছে।
কমলা – সাহেব, তোমাদিগের জয়যাত্রার ইহাই এক যন্রনা। তোমরা সর্বপ্রথমে সমস্যার সৃষ্টি কর এবং তাহা হইতে নিস্তার পাইতে আর একটি বড় সমস্যার আনয়ন কর। পরমাণু শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ শক্তির ফল যে কি ভয়ঙ্কর তাহা জাপান দেশের সুনামির সময় এবং রুশ দেশের চের্নোবিলের অঘটন কালে আমাদিগের চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছে যে ইহার প্রচলন অতীব ভয়ঙ্কর। যখন উন্নত দেশগুলি ইহার ভয়ঙ্কর ধ্বংস ক্ষমতার হাত হইতে নিস্তার পাইতেছে না সেস্থলে উন্নয়নশীল দেশগুলি তো জতুগৃহ মাত্র।
(৪)
আইন – অঘটনের আশঙ্কায় কোন আবিস্কারের প্রচেষ্টাই স্তব্ধ হইয়া যাইতে পারে না। বাবু কলম্বাসের যদি সমুদ্র ঝঞ্ঝায় তরীর সলিল সমাধির ভয় থাকিত তবে বিশ্বের দরবারে আজি ভারতবর্ষ যে অপরিচিত থাকিয়া যাইত না তাহা কে বলিতে পারে। অজানাকে জানিবার, অচেনাকে চিনিবার এই যে স্পৃহা তাহা বিজ্ঞানই মানুষের মনে সদা জাগরিত রাখিয়া দেয়।
কমলা – তোমার যুক্তি অস্বীকার একমাত্র মূর্খেরাই করিবে। তবে একথা একবারটি ভাবিয়া দেখিতে পার সাহেব যে বিজ্ঞান তাহার কাজটি পূর্ণাঙ্গরূপে সুসম্পন্ন করিতে অপারগ এবং ইহার ফলেই যে সকল সর্বনাশ আজ মনুষ্য প্রজাতি উপর বজ্রের ন্যায় পতিত হইতেছে তাহার সকল কারন-ই বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের ভ্রষ্ট চিন্তারই নামান্তর মাত্র। তোমাদিগের বহুল আবিস্কার শুধুমাত্র মনুষ্যজাতিকেই নহে, সমগ্র পৃথ্বীকেই আজি অন্তিম ক্ষণের দিকে ঠেলিয়া লইয়া চলিতেছে।
আইন – সমস্ত বিজ্ঞানীই যে সৎ উদ্দ্দেশ্যে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করিতেছে তাহার দাবি বিজ্ঞান কখনই করিতে পারে না ইহা যেমন আলোকের ন্যায় সত্য তেমনই সকল ইষ্টচিন্তাময় বিজ্ঞানম্নষ্ক মানব সকল মনুষ্য সমাজ এবং পৃথ্বীর কল্যান সাধনে সদাই জাগ্রত।
কমলা – সাহেব তোমার এই মন্তব্যটিও আমি মানিয়া লইতেছি। কিন্তু আমি যাহা বলিতে চাহিতেছি তাহা ভিন্ন। তুমি যদি ইহা সঠিক অনুধাবন করিতে পার তাহা হইলে তুমি বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের বালখিল্যতা উপলদ্ধি করিতে পারিবে। নচেৎ আমার সকল অকাট্য যুক্তি বেণু বনে মুক্তা ছড়াইবার সামিল হইয়া যাইবে।
আইন – ভাই হে কমলাকান্ত, তোমার বক্তব্যে যত না যুক্তি খুঁজিয়া পাইতেছি তাহা হইতে অনেক বেশী বিজ্ঞানীদের উপর তোমার আক্রোশ প্রকাশ পাইতেছে। তোমার ব্যক্তিগত মতামতের ঝুলিটি আপাতত বন্ধ করিয়া যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় প্রবেশ করিলে বড়ই বাধিত হইব।
কমলা – সাহেব, তুমি দেখিতেছি চতুর্থ রিপুর বশবর্তী। সমালোচনা শুনিতে মোটেই অভ্যস্ত নও।
আইন – অন্যায্য, কুযুক্তিপূর্ণ সমালোচনা কখনই কোনও সৎ উদ্দেশ্য সাধন করিতে পারে না। তুমি কি বলিতে চাহ মানব জীবনের উন্নতি সাধনে বিজ্ঞানের কোন অবদানই নাই! আজি মানব জাতি দূরূহ সকল রোগ-ভোগের হাত হইতে নিস্তার পাইয়াছে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হইয়াছে, দ্রুতগতির যানবাহনের আবিস্কারের ফলে সময়ের অপচয় বন্ধ হইয়াছে ইত্যাদি কত সফল বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের কথা বলিয়া শেষ করা যাইবে না।
কমলা – সাহেব, তুমি বিজ্ঞানের সাফল্যের দম্ভে স্বচ্ছ দৃষ্টি শক্তি হারাইয়া ফেলিয়াছ। হইতে পারে তুমি অর্ধ-পূর্ণ কুম্ভের কথা বলিতেছ। কিন্তু আমি সদাই চিন্তিত কুম্ভের পশ্চাতের ছিদ্রটির লাগি। আমি তাই সদাই ভীত কুম্ভটি যেন বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানীদের যথেচ্ছচারিতায় একেবারে নিঃশেষিত না হইয়া যায় । আজি উন্নয়নের নাম লইয়া তোমরা সকলে প্রকৃতি ধ্বংসের যে হোরি খেলায় মাতিয়াছ তাহা অবলোকন করিয়া কোন সুস্থ্য মানব স্থির থাকিতে পারিবে না। ইহার লাগি তোমরা আমাকে যতই নেতিবাচক মনোবৃত্তির অধিকারি বলিয়া গালি দাও না কেন আমার তাহাতে কোন প্রকার দুঃখ নাই। তোমরা দ্রুত গতির যানবাহনের লাগি সুদীর্ঘ রাজপথ বানাইতেছ আর তাহার লাগি সবুজ পত্রবান, ফলদায়ক, সুনিবিড় ছায়াময় বৃক্ষরাজির পতন ঘটাইতেছ। অতিশীঘ্র আমাদিগের এই সুজলা সুফলা জননী পৃথ্বী বৃষ্টিপাত হইতে বঞ্চিত হইয়া এক শুষ্ক নীরস এক রেগিস্তানে পরিণত হইবে। হায়! মানব প্রজাতির দ্বিচারিতা! বৃক্ষ ধ্বংস করিয়া তাহারা বৈজ্ঞানিক প্রথায় কাগজ বানায় আবার তাহাতেই “বৃক্ষ সকল পরিবেশ সংরক্ষণ করিয়া থাকে। বৃক্ষ নিধন বন্ধ করিতে হইবে।” ছাপাইয়া বিলি করিয়া থাকে। অহো! কি পরিমাণ এই আত্মপ্রবঞ্চনা!! হস্তে কুলহারি লইয়া বৃক্ষছায়ার সন্ধানে ঘুরিয়া মরিতেছে। তোমাদিগের সৃষ্ট কলকারখানার বিষাক্ত ধুম্রজালের প্রভাবে কোমল সদ্যজাত শিশুটিও আজি জম্নমূহুর্তেই শ্বাসকষ্টজাত রোগের শিকার। সস্তা সুবিধালাভের প্ররচনায় তোমরা “পলিথিন” নামক অজড়-অমর এক আত্মঘাতী পদার্থ আবিস্কার করিয়াছ যাহার সৃষ্টি এবং বিণাশ উভয় কালেই পৃথ্বি দূষণের দ্বারা আক্রান্ত হয়। কত আর উদাহরণ দিব সাহেব? শীঘ্রই তোমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিবে। তোমরা যে পরিমাণ মারণাস্ত্রের আবিস্কার ঘটাইয়াছ তাহার দ্বারা কত সহস্রবার এই পৃথিবীর ধ্বংস সম্ভব তাহা কি একটি বারের তরেও আঁক কষিয়া দেখিয়াছ কি? তোমাদের সৃষ্ট e-যুগের e-Waste আজি সর্বংসহা ধরিত্রী জননীর শিরঃপীড়ার কারণ।
(৫)
আইন – তুমি সত্যই বুদ্ধিভ্রষ্টের ন্যায় কথা বলিতেছ।
কমলা -সত্য বলিতেছি সাহেব, তোমরা এক-একটি ভষ্মলোচন সৃষ্টি করিয়া মানব জাতির অতীব ক্ষতি সাধন করিয়া চলিতেছ। তোমাদিগের সমস্ত মানবজাতির হিতকারি আবিস্কার, অনাসৃষ্টিকারি আবিস্কারের নিকট আত্মসমর্পন করিয়াছে। খেয়াল কর সাহেব, সদ্য দোয়ানো প্রসন্ন গোয়ালিনির গাভীর খাঁটি দুগ্ধও যেমত একবিন্দু অম্লরসের প্রভাবে ছিন্ন হইয়া তাহার দুগ্ধত্ব হারাইয়া ফেলে, সেইরূপ তোমাদিগের শতসহস্র মানব হিতকারী আবিস্কার আজি তাহাদের শ্রেষ্ঠত্ব বিষর্জন দেয় তোমাদিগের-ই আবিস্কৃত অনাসৃষ্টিকারি সকল আবিস্কারের নিকট।
(একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে দম নিতে কমলাকান্ত একটু থামল। ধুতির কোনা দিয়ে মুখ মুছল। আইনস্টাইন সাহেবের অবস্থা খুবই করুন মনে হল। দূর্মুখ কমলাকান্তের কাছে যে এতটা হেনস্তা হতে হবে সেটা বোধহয় না ভেবেই তিনি এই বিতর্ক সভায় যোগ দিয়েছিলেন। এখন দেখছি ডানহাতে কপালের দুই রগ টিপে ধরে বসে আছেন। শেষের দিকে সাহেব কিছু যুক্তি পেশের চেষ্টা করলেও কমলাকান্ত তাঁকে মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে থামিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে সাহেব একেবারে নীরব শ্রোতামাত্র। একটু দম নেবার পর কমলাকান্ত আবার শুরু করে)
কমলা – শোন সাহেব, অপরাধ লইও না। তোমরা সম্যক বুঝিতে পারিয়াছ যে এই পৃথিবী ক্রমশ বসবাসের অনুপযুক্ত হইয়া উঠিতেছে। ইহার ফল স্বরূপ আজি দেখিতে পাইতেছি যে তোমাদিগের মহাকাশ অনুসন্ধান বাড়িয়া উঠিয়াছে। তোমাদিগের ভাতৃ-বন্ধু সকল আজি চন্দ্র অভিযান সম্পূর্ণ করিয়া মঙ্গলে মাহাকাশযান পাঠাইতেছে, ধূমকেতুতে মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণাগার স্থাপন করিয়াছেন।
(এইবার দেখি আইনস্টাইন সাহেব তড়িঘড়ি নিজের বক্তব্য রাখলেন)
আইন – মূর্খ ব্রাহ্মণ, তোমার অতি উর্বর মস্তিষ্কের দ্বারা ইহা উপলব্ধি করা অতীব দুষ্কর মনে হইতেই পারে কিন্তু ইহা চিরকালীন সত্য যে কোন সৃষ্টিই চিরকালীন নয়। অতএব মানব জাতির নতুন বাস যোগ্য স্থান সন্ধানের প্রচেষ্ঠা জারি রাখা অতীব জরুরি।
কমলা – সাহেব, তুমি আমায় মূর্খ বলিয়া যতই গালি দাও না কেন, আমার ক্ষুদ্র বিদ্যায় আমি ইহা বুঝিতে পারি যে আজি সারা বিশ্বে উষ্ণায়নের দ্বারা পৃথিবী ধ্বংসের যে ডঙ্কাটি বাজিয়াছে তাহার হোতা বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের যথেচ্ছচারিতা মাত্র। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের শিখন্ডীটি সামনে রাখিয়া তাহারা আমাদের অনাসৃষ্টিকারি জীবনযাত্রায় প্রলুব্ধ করিয়াছে। ইহার ফলে শীতকালে গ্রীষ্ম এবং গ্রীষ্মে শীতের অভিজ্ঞতার স্বাদ লইতে মানবজাতি আজি লালায়িত। অতএব ইহার ফল স্বরূপ আজি বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়ন।
আইন – তুমি একটি গো-মূর্খ অপগন্ড! তোমার সহিত আলোচনা শুধু কালক্ষেপ মাত্র।
কমলা – সাহেব, তুমি চটিয়া যাইতেছ দেখিতেছি। আমার উপর তোমার এই অন্যায় ক্রোধ আমায় আরো সাহসী করিয়া তুলিতেছে। আমি বুঝিতে পারিতেছি যে আমার যুক্তি সকল খণ্ডন করিতে তোমার তূণ এক্ষণে নিঃশেষিত। অতএব এই আলোচনায় যতি টনিবার পূর্বে তোমার জ্ঞাতার্থে জানাই যে বিজ্ঞান বস্তুত একটি একচক্ষু সমৃদ্ধ হরিণ মাত্র। তোমাদের ওই একটি চক্ষুতে যাহাই দৃশ্যমান তাহাই তোমরা সঠিক বলিয়া মানিয়া লও। শুধু নিজেরাই মানিয়া লইয়া ক্ষ্যান্ত দাও না, নিজেদের কন্ঠ শক্তির সাহায্য লইয়া নিজেদেরই আবিস্কৃত সকল শব্দ যন্ত্রের সাহায্যে চোঙা ফুঁকিয়া সকল মানব জাতিকে বুঝাইতে চাহ যে তোমাদের সকল মতবাদই সঠিক। পরবর্তীকালে সেই মতবাদের আমূল পরিবর্তন তোমরা নিজেরা করিলেও তোমাদের একবিন্দু লজ্জিত অথবা অপদস্ত বোধ হয়না।
(সাহেব দেখি কঠিন চোখে কমলাকান্তের দিকে তাকালেন)
(৬)
কমলা - না সাহেব, তুমি যতই অগ্নিসম দৃষ্টি দ্বারা আমায় ভষ্ম করিতে চাহ না কেন আমি কিন্তু আমার উপলব্ধি হইতে একবিন্দু টলিব না। উদাহরণ চাহ?
(সাহেব হাল ছেড়ে দিয়েছেন মনে হল। কিন্তু কমলাকান্ত দেখলাম ছেড়ে দেবার পাত্র নয়।)
কমলা - শুন সাহেব,
উদাহরণ-১ - তোমরাই প্রথমে প্রচার করিয়াছিলে যে পৃথিবী সমতল। তাহার পর ঘোষণা করিলে যে পৃথিবী সমতল নহে গোলাকার মাত্র। অবশেষে এক্ষণে সকল বিজ্ঞানী সহমত হইয়াছেন যে পৃথিবীর আকৃতি সঠিক গোলাকৃতি নহে তবে নাসপাতি ফলের ন্যায়। একমাত্র ঈশ্বরই বলিতে পারেন যে অদূর ভবিষ্যতে তোমাদিগের মতের আবার পরিবর্তন হইবে কিনা। ঈশ্বরকে যন্ত্রণা দিয়া লাভ নাই কারন বিজ্ঞান তো আবার ওনার উপস্থিতিতে বিশ্বাস করে না।
(এইক্ষণে আমার স্বীকার করিতে দ্বিধা নাই যে ঈশ্বর প্রসঙ্গে তুমি অবশ্য অন্য গোত্রভুক্ত। কারন প্রকৃতির নিখুঁত সময় জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করিতে গিয়া তুমি বলিয়াছ, “God doesn’t play dice।” আবার গীতা প্রসঙ্গে তোমার উক্তি, “When I read the Gita and reflect about how God created the Universe, everything else seems so superfluous.”)
উদাহরণ-২ – তোমাদিগের বিখ্যাত ষ্টিফেন হকিন্স সাহেব একদা সদর্পে ঘোষণা করিয়াছিলেন যে কৃষ্ণ গহ্বর সর্বগ্রাসী মাত্র। উহার উদরে কোনকিছু একবার প্রবেশ করিলে তাহা সেই “দূর্বাসা মুনির বাতাপি হজম” কর্ম কাণ্ডের সামিল হয়। কৃষ্ণ গহ্বরের উদর হইতে কোন কিছু নির্গত হইবার সম্ভবনা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু পরবর্তী কালে হকিন্স সাহেব নিজেই স্বীকার করিয়াছেন যে কৃষ্ণ গহ্বর হইতে কিছু রশ্মির বিকিরণ এক্ষণে প্রমানিত সত্য। তাঁহার এই মত পরিবর্তনের ফলে ওনার এক বৈজ্ঞানিক বন্ধুর নিকট বাজী হারিবার খেসারত হিসাবে আমেরিকান ফুটবল রাগবির একটি হ্যান্ডবুক ক্যুরিয়র মাধ্যমে পাঠাইতে হইয়াছিল। তোমার বিশ্বাস না হইলে তুমি গুগুল জ্যাঠামশায়ের শরণাপন্ন হইতে পার।
উদাহরণ-৩ – আমাদিগের প্রাচীন মুণি-ঋষিগন বহুকাল হইতেই বলিয়া আসিতেছেন যে মহাকাশের নবগ্রহের মধ্যে রাহু এবং কেতু পুর্ণ গ্রহ নহে। তোমরা আমাদিগের এই গরীব দেশটির মহাকাশ চর্চার প্রতি কটাক্ষ করিয়াছ। অবশেষে নিজেরাই স্বীকার করিয়াছ যে তোমাদিগের “প্লুটো” গ্রহটি অর্ধ গ্রহ মাত্র। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে তোমরাই আবার অন্য কোন গ্রহকে “অর্ধ” বানাইয়া আমদিগের পাঠশালাতেই নাম লিখাইবে।
যাহাহৌক, উদাহরন সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া তোমাকে আর লজ্জায় ফেলিতে চাহি না সাহেব। আশা করি আমার বক্তব্য তুমি সঠিক উপলব্ধি করিয়াছ। কিন্তু আমায় যাহা ক্রমাগত পীড়া দেয় তাহা বিজ্ঞানের এই চঞ্চলতা নহে। আমি এই বিষয়ে তোমার “আপেক্ষিক” তত্ত্বকে শতকরা শতভাগ বিশ্বাস করিয়া থাকি। এই জগতে কোন কিছুই চিরকালীন সত্য নয়, সবই আপেক্ষিক মাত্র। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি ঘটিয়া চলিয়াছে তাহাতে সকল সত্য নূতন আলোকে আলোকিত হইতেই পারে ইহাতে কোন দ্বিমত নাই।
আইন – হাঁ, ইহা সত্য বটে যে বিজ্ঞান কখনই এই দাবি করে না যে সে চিরকালীন সত্যটি জানিয়া গিয়াছে।
কমলা – তাহা আমি জানি সাহেব। তবে বিজ্ঞান তাহার পুরাতন মতটিকে বেমালুম ভুলিয়া গিয়া, যখন তাহার বর্তমান মতটিকে জবরদস্তি করিয়া অন্য সকল মতবাদকে তাহার কন্ঠশক্তিতে পরাজিত করিয়া প্রতিষ্ঠিত করিবার যে অপচেষ্ঠা করিয়া থাকে তখনই আমার প্রবল আপত্তি সাহেব।
আইন – তোমার এই কথার কোন যুক্তি নাই।
(৭)
কমলা – বল কি সাহেব? তবে আইস তোমায় উদাহরণ স্বরূপ বলি, তোমরা তোমাদিগের বিজ্ঞান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত “অ্যাষ্ট্রোনমি”কে মান্যতা দাও, কিন্তু “অ্যাষ্ট্রোলজি”তে বিশ্বাস কর না যদিও বহু বিজ্ঞান মনষ্ক মানবক নব গ্রহের শান্তি স্বস্ত্যয়নের জন্য বহু প্রকার প্রস্তর খন্ড ধারণ করিয়া থাকেন। বিজ্ঞান এই সমগ্র বিশ্বাসটিকে কুসংস্কার বলিয়া ব্যঙ্গ করিয়া থাকে। বিজ্ঞান বলে কোন গ্রহের প্রভাবে মানব জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় না এবং কোন প্রস্তর খন্ড ধারণ দ্বারা নব গ্রহের প্রভাব মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্ঠা মূর্খামি মাত্র। এই প্রসঙ্গে তর্ক সাপেক্ষে একটি কথা বল দেখি সাহেব, চন্দ্র-সূর্যের আকর্ষন-বিকর্ষনের ফলের প্রকাশ হিসেবে যদি পৃথিবীর সমুদ্র আর নদীতে জোয়ার-ভাঁটা খেলিতে পারে তাহা হইলে মানব জীবনে উহাদের প্রভাব অবশ্যি থাকিতে পারে এই “Hypothesis” টির প্রতিষ্ঠা পাইতে বাধা কোথায়? এই “Hypothesis”টিকে “Law”-এ পরিণত করিবার প্রচেষ্টায় সাহায্য না করিয়া বিজ্ঞান আজ তাহাকে ব্যঙ্গ করে মাত্র। বিজ্ঞান অদ্যপি “মানব জীবনে গ্রহের প্রভাব” রহস্যটি উদ্ঘাটন করিতে পারে নাই বলিয়া তাহা যে সত্য নহে – এই অপপ্রচারটি বিজ্ঞানের প্রবল কন্ঠশক্তিরই পরিচয় মাত্র।
আইন – কমলাকান্ত, তুমি নিজের বিজ্ঞান বিদ্রোহ প্রকাশ করিতে ক্রমাগত অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ টানিয়া আনিতেছ।
কমলা – হাঁ সাহেব। এই অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ উপলক্ষে বিজ্ঞানের আর একটি অস্বাভাবিক আচরণ অনুধাবন কর সাহেব। বিজ্ঞান দ্বারা যেহেতু “অ্যাষ্ট্রোলজি” একটি প্রমানিত সত্য নয় সেই কারন বশত ইহা বিজ্ঞান জগতে অচ্ছুৎ। আবার যেহেতু অপ্রমাণিত সত্য বিজ্ঞান স্বীকার করিয়া থাকে না সেহেতু “অ্যাষ্ট্রোনমি”তে নোবেল পুরস্কারের বরাদ্দ নাই। এই কারনে তোমাদিগের ওই ষ্টিফেন হকিং সাহেবের কপালে নোবেল জোটে নাই এবং ইহাতে তিনি যথেষ্ট মনক্ষুন্নই ছিলেন বলিয়া শুনিয়াছি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মহলে তিনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি! “অ্যাষ্ট্রোলজি”র চর্চারত ব্যক্তিগণের ন্যায় তিনি মোটেই অচ্ছুৎ নন। এই দুইটি বিষয়-ই যখন “প্রমাণিত সত্য” নয় তখন বিজ্ঞানের “অ্যাষ্ট্রোনমি”র ক্ষেত্রে এই পক্ষপাতিত্ব কেন – এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর সাহেব তোমার নিকট আশা করিতে পারি কি? অবশ্য তোমার নিকট যদি তাহা উপলব্ধ হয়।
আইন – কমলাকান্ত, মনে হইতেছে তুমি বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক সংক্রান্ত সকল কর্মকান্ডেরই বিরোধী। ইহা মোটেই সুস্থ্য মস্তিস্কের পরিচয় নয়। বর্তমান মানব সমাজের দৃশ্যমান যা সকল উন্নয়ন এবং মনুষ্য জীবনযাত্রার উন্নতি প্রকল্পে বিজ্ঞানের অবদানকে অস্বীকার করা আত্মহননের সামিল হইবে এই সত্যটি আশা করি বিস্মৃত হইবে না। “কূপমণ্ডূক” শব্দটির অর্থটি তোমার নিশ্চয় অজানা নয় ব্রাহ্মণ।
কমলা – তুমি সাহেব আমায় অনর্থক দোষী সাব্যস্ত করিতেছ। আমি বিজ্ঞানের সফলতাকে কখনই কটাক্ষ করিতেছি না। আমি আবার আমার বক্তব্য পরিষ্কার করিয়া বলিতেছি যে নিত্য নূতন আবিস্কারে মোহে বৈজ্ঞানিকেরা তাহাদের সকল আবিস্কারের নেতিবাচক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলিতে সঠিক দৃষ্টিদান হইতে বিরত থাকিতেছে। এই ধারাটি বজায় থাকিলে বিজ্ঞানসহ মনুষ্য প্রজাতির সমূহ ক্ষতির সম্ভবনা আছে। উদাহরণ স্বরূপ বলিতে পারি যে মানব জীবন যাত্রার মানের উন্নতিকল্পে বিজ্ঞান মানুষকে ক্রমাগত অলস করিয়া তুলিতেছে এবং ইহার ফলে মানুষ ক্রমশ শ্রম বিমুখ হইয়া উঠিতেছে। সাহেব আশা করি ইহা স্বীকার করিতে তোমার দ্বিধা নাই যে বর্তমান আধুনিক জীবনযাত্রা জনিত রোগ-ব্যাধির আক্রমণে মনুষ্য জাতি আজিকে যৌবনেই পঙ্গু হইয়া পড়িতেছে। বিজ্ঞান মানুষের গড় পরমায়ূ বৃদ্ধি করিতে সফল হইলেও তাহার মান বৃদ্ধি করিতে পারে নাই।
আইন – একটি কথা তোমায় জানাইয়া রাখা জরুরী মনে করি কমলাকান্ত, বিজ্ঞান মানুষের ক্ষতি সাধন করিতে কখনই ইচ্ছুক নহে। আমি আবার বলিতেছি, বিজ্ঞানকে অসৎ পথে চালিত করিতে কিছু দুষ্ট লোক সদাই তৎপর।
কমলা – তোমার এই যুক্তি মানিয়া লইয়াও বলা যাইতে পারে যে বিজ্ঞানকে অসৎ পথে চালিত যাতে না করা যায় সেই দিকে বিজ্ঞানের যাঁহারা সেবক বলিয়া দাবি করিয়া থাকেন, তাঁহাদেরকেই সচেষ্ট থাকিতে হইবে। তাঁহারা এক একটি ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন সৃষ্টি করিয়া তাহাদেরকে মনুষ্য সমাজে ছাড়িয়া দিলে সাধারন মানুষ কখনই বিজ্ঞান এবং তাহার ধারক ও বাহকদের ক্ষমা করিবে না। সেই ক্ষেত্রে বিজ্ঞান চিরকাল মনুষ্য জাতির নিকট অভিশাপ রূপেই পরিগণিত হইবে।
আইন – ব্রাভো কমলাকান্ত ব্রাভো! তোমার শেষ দিকের বক্তব্য শুনিয়া আমার এই ধারণা হইতেছে যে তুমি নিজেও বিশ্বাস কর যে একমাত্র বিজ্ঞান প্রদর্শিত আলোকিত পথেই জগত এবং মনুষ্য প্রজাতির উন্নতি সম্ভব। কিন্তু তুমি বিচলিত হইয়া পড় যখন দেখিতে পাও কিছু অসাধু ক্ষমতা প্রিয় মানুষ অতি লোভী কিছু বিজ্ঞানীর সহিত একত্রে জগত এবং মানুষের ধ্বংসের কাজে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করিতেছে। হাঁ কমলাকান্ত, এই বিষয়ে আমিও তোমার সহিত একমত। অতএব আইস, এইস্থলে আমাদিগের আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটাই।
(৮)
(এরপর দেখলাম আইনস্টাইন সাহেব কমলাকান্তকে একটি Tight Bear Hug দিলেন। তারপর শুনলাম কমলাকান্ত সাহেবকে বলছে...)
কমলা – তথাস্তু! অপ্রাসঙ্গিক হইলেও সর্বশেষে তোমায় একটি কথা জানাইয়া রাখি সাহেব। তোমার আপেক্ষিক তত্ত্বটির আমি একটি সহজ সরল ব্যাখ্যা আমি এই হায়দ্রাবাদে উপলব্ধি করিয়াছি। তুমি অনুমতি করিলে তোমার গোচরে আনিতে পারি। আশা করি তুমি এই মুর্খের অবিমৃশ্যকারিতায় রুষ্ট হইবে না।
আইন – আমার Theory of Relativity তত্ত্বের তুমি যে সহজ-সরল ব্যাখ্যাটি উপলব্ধি করিয়াছ তাহা আমি শুনিতে অতীব ব্যাকুল। তুমি অকপটে তাহা আমার নিকট এইক্ষণে ব্যক্ত করিতে পার।
কমলা – অপরাধ লইও না সাহেব। তোমার ওই জটিল তত্ত্বটির সরল উপলব্ধি হইবে যদি কোন ব্যক্তি হায়দ্রাবাদের আমিরপেট নামক স্থানে রাজপথ দিয়া হাঁটিতে থাকে এবং কিয়ৎকাল পরে যদি সেই ব্যক্তি সেই রাজপথে মোটরযান যোগে ভ্রমণে প্রবৃত্ত হয়।
আইন – হন্টন এবং মোটর যান যোগে ভ্রমণ – এই দুই কার্য-কারণে কি প্রকারে আমার এই Theory of Relativity তত্ত্বটি উপলব্ধি হয় তাহা একটু বুঝাইয়া দাও দিকি ভাই।
কমলা – দেখ সাহেব, তুমি যখন আমিরপেটের রাজপথে হাঁটিতেছ, তখন তোমার মনে হইবে যে রাজপথের সকল মোটর যান তোমার স্কন্দে আসিয়া পড়িতেছে, আবার সেই রাজপথেই যদি তুমি মোটরযানে ভ্রমণ করিতে থাক তাহা হইলে তোমার মনে হইবে যে রাজপথের সকল পথিক তোমার মোটরযানের সামনে আসিয়া আত্মহত্যায় ইচ্ছুক। অতএব ইহা সঠিক নয় কি যে পথিকের মানসিক উপলব্ধি তাহার আপেক্ষিক অবস্থানের উপর সতত নির্ভরশীল?
(কমলাকান্তের এই Theory of Relativity-র এই ব্যাখ্যা শুনে সাহেব দেখি এক লাফ দিয়ে উঠে কমলাকান্তকে জড়িয়ে ধরে তার ডান গালে একটি সশব্দ চুমু খেয়ে ফেলল! কমলাকান্তের শ্মশ্রু-গুম্ফ হীন দুধ শুভ্র গাল ম্লেচ্ছ চুম্বনে রক্ত বর্ণ ধারণ করল। ধুতির খুঁট দিয়ে সাহেবের উপহারটির পরিচর্যা করতে করতে কমলাকান্ত সাহেবকে বলল…)
কমলা – সাহেব, তুমি বল দেখি আমার এই ব্যাখ্যা সঠিক কিনা?
আইন – ভাই কমলা, আমার Theory of Relativity তত্ত্বের ব্যাখ্যা আমি নিজেও দিয়াছি আবার বহু বড় বড় বিজ্ঞানীরাও দিয়াছেন। কিন্তু এত সহজ-সরল ব্যাখ্যা আমি কখনও শুনি নাই। আমি আজই বৈদ্যুতিন পত্রের মাধ্যমে জেনিভা নগরে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সঙ্ঘের নিকটে তোমার এই ব্যাখ্যা পেশ করিব। “বোস-আইনস্টাইন” থিওরির ন্যায় “আইনস্টাইন থিওরি ও চক্রবর্তীর ব্যাখ্যা” নামে ইহা তাহাদের আগামী বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হইবে এবং ইহা বৈজ্ঞানিক মহলে অতি অবশ্যি স্বীকৃতি পাইবে।”
এরপর দেখি দুই বয়োবৃদ্ধ মানুষ হাত ধরাধরি করিয়া “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে...” গানটি গাইতে গাইতে হুসেন সাগরের দিকে হাঁটতে লাগলেন। হঠাৎ পাশের ঝোপ থেকে “ম্যাঁও” ডাক শুনে সেদিকে চেয়ে দেখি “হ-য-ব-র-ল” র সেই হুলো বেড়ালটা কেমন ফ্যাক ফ্যাক করে এক চোখ বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওকে তাড়া দিতেই দেখি সে তার মোটা ল্যাজ তুলে ভোঁ দৌড়।
তারপর আবার সামনে তাকিয়ে সেই ঐতিহাসিক চরিত্রদ্বয়ের আর দেখা পেলাম না।
কি আর করি বাড়ি ফিরে গিন্নীকে এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার কথাটি জানাতে উনি যে দৃষ্টিতে আমাকে দেখলেন, তাতে আমার পক্ষে তাঁর কাছে আমার এই দূর্লভ অভিজ্ঞতাটির বিবরণ সম্পূর্ণ করা হয়ে উঠল না। শেষমেশ ঠিক করলাম আমার এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার কথাটা লিপিবদ্ধ করে “ঋতবাক”-এর সম্পাদকের দপ্তরে পাঠিয়ে দেব।
তারপরের কথা পরে ভাবা যাবে।
0 comments: