0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিশ্রোত
সুবল দত্ত

॥২৪॥ 

অরণ্য থেকে অরণ্যে এঁকে বেঁকে বয় মুক্তি স্রোত/আদিমেরা স্বাধীনতাহীনতার নৌকো বেয়ে খুঁজে যায় নিজস্ব মাটি 

জেরেকা 

অরণ্যের যত গভীরে যাওয়া যায় তত তার রূপ বিভ্রান্তিকর হতে থাকে। দিনের বেলায় অপার অথৈ সমুদ্র মাঝে কম্পাসহীন নাবিকের যেমন গতি হয়, ঠিক তেমনি গভীর জঙ্গলের ভিতরে যেতে যেতে একসময় দিকহীনতার ভ্রান্তি ও ভয় চেপে বসে। দ্বিতীয়বার ও শেষবারের মত ঢাকের ভাষা অনুযায়ী অঞ্চলবাসীদের বলা হয়েছে দুধঝর্ণার জল যেখানে গড়িয়ে পড়ছে অনেক নিচে বিশাল খাদ শেষ হওয়ার ঠিক আগে পাহাড় প্রমাণ চ্যাটালো পাথরের পিছনে সবাই সূর্য মাথার উপর থাকতে থাকতেই যেন চলে যায়।কিন্তু এখনো ময়দানেই পৌছনো গেল না,আর বেলা ডুবু ডুবু।দুধঝর্ণার পাশে বড় ময়দান অব্দি পথ নির্দেশ জনজাতির প্রত্যেকে জানে,প্রথমবারঢাকের সংকেত যেখানেসবাইকে ঘর ছেড়ে জমায়েত হতে বলা হয়েছিল।দুর্গম চড়াই বেয়ে ময়দানে পৌছনো অব্দি প্রত্যেকের রাস্তা ও দিশা চেনা। কিন্তু তারপর ঢালু সঙ্কীর্ণ খাঁড়ি বেয়েপথ তৈরি করে অত্যন্ত গভীর জঙ্গলের ভিতরে কেউ যেতে সাহস করেনি।অবশ্য তা সেখানে হিংস্র বন্যপশুর জন্যে নয়,একবার ভুলভুলাইয়ায় ধরলে তার আর ঘরে ফিরে আসা মুশকিল। 

সন্ধে হবহব।একটানা না থেমে উঁচু দুর্গম চড়াই পথে ঘন জঙ্গলে রাস্তা করতে করতে এগিয়ে চলল সবাই। একসময় উঁচু আসন ও পাইন গাছ ভেদকরে দিগন্তের টুকরো লাল রোদের ঝিলিক দু একবার পেতেই ডুলির বাহকেরা থামল। ডুলি থেকে নেমে জেরেকা দেখল চড়াই পথের শেষে এক সমতল জমিতে সে দাঁড়িয়ে। এই সেই বড় ময়দান যেখানে অঞ্চলবাসীদের বলা হয়েছিল ঘর ছেড়ে এখানে জমায়েত হতে।পেরো নিশ্চয়ই বুঝেছে এখানে সবাই একসাথে এলে সৌমজিতের স্নাইপার টিম আড়ালে তাদের পিছু নিতে পারে।তাই ওর দেওয়া ড্রাম ম্যাসেজে একটা কথা বারবার বলা হয়েছে ময়দানে কেউ যেন না থাকে,আরো নিচে শ্লেট পাহাড়ের পিছনে নেমে সেখানে যেন চলে যায়।পেরোর দূরদর্শিতায় জেরেকার মনে সম্ভ্রম জাগলো। 

ময়দানের পাশ দিয়ে খরশ্রোতা নদীর ঝর্ণা ভীষণ বেগে পাথরের দেওয়ালে আঘাত করে বহু নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নিচে যেখানে পড়ছে সেখানে বিশাল এলাকা জুড়ে দুধের মত ঘন ধোঁয়া। তাই নিচের কিছুই দেখা যায় না। এবার ওদের নিচে ওই ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে কোনো ঢালু পথ খুঁজে নিয়ে সেখানে যেতে হবে। জেরেকা দেখল নিচে নামার জন্যে কোথাও কোনো পথ নেই। একদিকে শুধুই রক্তলাল গোল গোল মারবেলের মত ছোট কাঁকর মাটি আর মস্ত বড় বড় মসৃণ পাথর। এই পথে পা দিলেই পা হড়কে একেবারে নিচে। আর এক দিকে ছুঁচালো স্ফটিক পাথরের মতো গ্রুজি কোয়ার্জ পাথরের চাঁই।এই পারদর্শী পাথরগুলির হীরের মত কাটিং প্রকৃতিই করে রেখেছে। এগুলো এতো ধারালো যে পা রাখলেই রক্তারক্তি।বাচ্চা বুড়ো মেয়ে মরদ প্রায় একশ জনজাতি ভাইয়েরা এই সমতল ঘাটিতে জমায়েত হতে লাগলো।প্রতিটি পুরুষের মাথায় ঘাড়ে প্রকাণ্ড বোঝা ও কাঁধে ভারী বাঁক।কেউ কেউ কুঁড়েঘরের চালা ধরে রাখা তালকাঠের ভারী মূর্ধা যীশুখৃষ্টের মত টানতে টানতে নিয়ে আসছে।মহিলাদের কাঁখে ও মাথায় ভারী মাটির ঘড়াতে শস্য ও তরল পেয়। বাচ্চাদের কাঁধে প্রয়োজনীয় খাবার। এরা সবাই একসাথে মিছিলের মত করে এখানে পৌঁছয়নি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোটো গ্রুপে নিজস্ব পথ তৈরি করে কিছু বুনো ফল,মধুভরামৌচাক, বুনো শস্য, মাটির নিচ থেকে উপড়ে নেওয়া কন্দমূল ও ঔষধি আহরণ করতে করতে এখানে পৌঁছেছে। 

সবাই শান্ত চুপচাপ। শহরের মানুষেরা থাকলে পরিবেশ কোলাহলে ভরে যেত। অরণ্যবাসী অথচ অরণ্যে বাস করার অধিকারচ্যুত। প্রাণ হাতে করে চলেছে সবাই এক অজানা গন্তব্যের দিকে। ময়দানে পৌঁছেই মেয়েরা পাঁচ ছয়টি দলে ভাগ হয়ে কয়েকটা গাছের নিচে হাঁড়িগুলো নামিয়ে রাখল। পুরুষেরা তেমনই দলবিভক্ত হয়ে সেই হাঁড়িগুলো ঘিরে বসল। মেয়েরা শালপাতার দোনাতে হাঁড়ি থেকে দুধের মত সাদা পেয় হাঁড়িয়া ভরে সবাইকে পান করতে দিল। একজন মাটির নিচ থেকে উপড়ে আনা ঢোলকের মতো দেখতেএকধরনের গাছের মোট শিকড় সুস্বাদু ও বলকারী রামকন্দমূল লম্বা ছুরি দিয়ে পাতলা ফালি করে কেটে ছোটদের খেতে দিল। কয়েকজন গাঁয়ের প্রধান পিয়াল, মিষ্টি বুনোকলা ও ফ্যাকাসে কমলা রঙের বিকৃত আকারেরপাকা ভুডরু ফল এনে জেরেকার সামনে রেখে বসল। জেরেকা চাইছিল ওদের অনুমতি নিয়ে যত শীঘ্র সম্ভব এই জায়গাটা খালি করতে। মুখ খুলে এইকথা বলতেই যাবে তখন বয়স্ক একজন মোড়ল লাঠি ধরে হাঁফাতে হাঁফাতে বোঙা ভগবানের নাম নিয়ে ওদের ভাষায় যে কথাগুলো বলতে লাগলো তার মানে এই দাঁড়ায়, ওদের এখানে আসার পথ অবরুদ্ধ করে কয়েকজন সৈনিক আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। ওরা গোপনে পিছন পিছন এসেছে। আমাদের জওয়ান বাচ্চারা লুকিয়ে ওদের দেখেছে। এখন দুধঝর্ণার নিচে স্লেট পাহাড়ের পিছনে ওরাও যদি সঙ্গে সঙ্গে যায়? ওদের কাছে বোমা বন্দুকআছে। আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। এর থেকে বাঁচার উপায় বের কর জেরেকা বহিন। 

-তার আগে বল,তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে?যে এখান থেকে দুধ ঝর্ণার নিচে যাবার পথ চেনে? জেরেকার প্রশ্ন। কয়েকমুহূর্ত সব চুপচাপ। পাগড়ি বাঁধা একজন বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াল। 

-আমি ওই দুধ ফেনা অব্দি নিচে গেছি। বেশ কয়েকবার।এখানে আসার ও ফেরার পথ একটিই কিন্তু নিচে যাবার অনেক পথ। কিন্তু আমি জানি সব পথগুলিই ভয়ংকর। কয়েকটি পথে ছুরির মত ছুচালো বালি পাথর। ও পথ দিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কয়েকটা পথে পিছল পাথর আর চোরা গভীর খাদ। পা পিছলে মরণ। অন্য অনেকগুলি পথ লম্বা। আর সেগুলো সবই ভুলভুলাইয়া। বিশ্বাসঘাতক। তবে যে রাস্তা করে আমি নিচে গেছি, সেটা দিয়ে গেলে অনেককম সময়ে নিচে যাওয়া যায়। কিন্তু সেই পথের একটু দূরেই প্রচুর গর্ত।আর সেই গর্ত দিয়ে সবসময় গরম জল ও ভাপ বেরিয়ে পথ ঢেকে রেখেছে। জানা না থাকলে ওইগুলো পেরিয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। 

-তাহলে মেয়ে বাচ্চা নিয়ে সেই পথ দিয়ে আমরা কি করে এগোব? গরম ভাপ,মারণ গর্ত, পিছল, ধোঁয়া। এই পথ দিয়ে আমরা যেতে পারব কি? 

-হ্যাঁ জেরেকা বহিন। খুব সহজেই ওই ধোঁয়ার আড়াল পার করে ওই গর্ত পার করার কায়দা আমি জানি। একটু কষ্ট করে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখবে খুব ভালো রাস্তা। 

-হ্যাঁ।সন্ধে প্রায় হয়েই এল। দূরের দৃশ্য ঝাপসা হয়ে আসছে। ঠিক আছে, তুমি যে পথ দিয়ে সবাইকে নিয়ে যেতে চাইছ, আমরা সেদিক দিয়েই যাবো। আচ্ছা? সৈনিকরা আমাদের থেকে আন্দাজ কত দূরে আছে? 

একজন বলে উঠল,-এখানথেকে দুধ ফেনা যতদূর ততদূরে আছে ওরা। ওদের কাছে হাতিয়ার অনেক। 

-হুঁ। আর নিশ্চয়ই এমন দূরবীন রাইফেল আছে,অনেক দূর থেকে অন্ধকারে মানুষের চলাফেরা দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি মানুষ গাছের আড়ালে থাকলেও। 

-কি এমন যন্ত্র, অন্ধকারে গাছপালা ভেদ করে মানুষকে দেখা যায়? 

-মানুষের গায়ের গরম তাপ ওই মেশিনে ধরা পড়ে। তাই মনে হয়, গরম ভাপ ভেদকরে ওই রাস্তা দিয়ে আমরা যদি যাই তো ওদের দূরবীণে আমরা দেখা যাবনা। ওরা আমাদের খুঁজে পাবে না।তাই এই রাস্তাই ঠিক। সবাইকে উঠতে বল। আলো থাকতে থাকতে আমরা বেরিয়ে পড়ি। তার আগে আমাদের কজন জওয়ান যারা সেনাদের উপর লক্ষ্য রাখছে। তাদের খবরটা দিয়ে দাও। 

আবার শুরু হলো যাত্রা। আগের মতই স্নাইপার সেনাদের বিভ্রান্ত করতে ছোটো ছোটো গ্রুপ করে ডানদিক বাঁদিক পিছনদিকে সামনে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে আগে এগোতে লাগলো। সবাই জানে, যেখানে গায়ে হালকা তাপ লাগবে পায়ের নিচে গরমজল, সেখানে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। আবার একজুট হয়ে চলা, এই আদেশ। সেই বৃদ্ধের উত্সাহ ও ক্ষমতা দেখে জেরেকা অবাক। সবকটি গ্রুপের কাছে দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে পথনির্দেশ দিয়ে আসছে। একটুপরেই চারপাশের আবহাওয়া বদলে গেল। পরিবেশ আবছা হয়ে গেল। জেরেকা আর ডুলিতে চাপতে চাইলনা। গায়ে যেন উষ্ণমেঘ উড়ে উড়ে বসছে। পায়ের নিচে গরমজল কুলকুল। এখানেই কিছুক্ষণ জেরেকাকে থামতে হলো।একসময় সবাইকে একত্রিত করে একটা লাইনে বেঁধে বৃদ্ধ চলতে শুরু করল।কিছুক্ষণ চলার পর একজন যুবক দৌড়ে পথ প্রদর্শক বৃদ্ধের কাছে এসে বলল চার পাঁচজন সেনাকে এদিকে আসতে সে দেখেছে। বৃদ্ধ শান্ত স্বরে বলল,-ওরা আমাদের দলের খোঁজ পাবেনা। আমি এমনভাবে জলের ভিতরে শক্তমাটি খুঁজে খুঁজে চলছি, এপথের হদিস পাওয়া খুব কঠিন। ওরা এগিয়ে আসতে আসতে অসংখ্য গর্তের সামনে আটকা পড়ে যাবে। 

কিছুক্ষণ দমবন্ধ গরম ঘন বাষ্পের ভিতর দিয়ে এইভাবে চলার পর হঠাত্‍ যেন ভারী আবরণ সরে গিয়ে উন্মুক্ত খোলা ঘাসভূমিতে পা রাখল সবাই। জেরেকা দেখল, খুব কাছেই দুধঝর্ণা একটা বিশাল সাদা গ্রানাইট চাট্টান পাথরে সবেগে ঠিকরে পড়ে আবার ঝর্ণা স্রোত নিচে পড়ছে। সেখানে দুধের মত ঘন জলীয়বাষ্প আশেপাশের পরিবেশ ঢেকে রয়েছে। বাঁদিকের আকাশে উঁকি দিচ্ছে চ্যটালো স্লেটের মত পাহাড়। আপাতত ওইখানে সবাইকে যেতে হবে।

0 comments: