প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
ফকিরাণি কথা (দ্বিতীয় পর্ব)
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল হালিম ফকিরের সঙ্গে। সেই যে আশ্রমে গিয়ে গান শুনেছিলুম, সেই আশ্রমেই পরিচয়। মানুষটি কয়েকবার আমার বাড়িতেও পায়ের ধূলো দিয়েছেন। তাঁর কথায়—মুসলিম সমাজে 'ফকিরি' অবলম্বন করেন এইরকম ফকিরাণির সংখ্যা নেই বললেই চলে। তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো পর্দা প্রথা। বাউল-বৈষ্ণব সমাজের আচার-আচরণ, ধর্মমত অনেক বেশি খোলামেলা। মুসলিম সমাজের মেয়েরা শরিয়তি আইন লঙ্ঘন করা মানেই বেপর্দা, বেআব্রু হওয়া, আর সমাজের চোখে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই প্রকাশ্যে গুরুগিরিও তারা করতে পারেন না এই একই কারণে। হালিম ফকিরকেও জিজ্ঞাসা করেছি---কিন্তু মুসলিম সমাজে রাবিয়া বশরী তো একজন শ্রদ্ধেয়া চরিত্র, তিনি তো ছিলেন ‘ফকিরি’ নারী, তা কিভাবে সম্ভব?’ হাসি মুখে বলেছেন, কজন মানে, জানে তাঁর কথা...একবার কিজ্ঞেস করবেন দেখি?’
এই বিষয়ে মুসলিম সমাজের বন্ধুদের কারোর সঙ্গেই কথা বলতে বাকি রাখিনি। মসজিদের ইমাম, মুসলিম বিয়ের কাজী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পরিচিত শিক্ষিত মুসলিম বন্ধু, জ্ঞানী বলে পরিচিত কেউই বাদ যাননি। প্রশ্ন ছিল একটাই—তাহলে কি ফকিরাণি বলতে আমরা যা বুঝি, সেইরকম ‘ফকিরি’ নেওয়া নারীর সাধনা সম্ভব নয়! কারো মনে কি ঈশ্বরচিন্তা আসতে পারে না? এলেও কি তা দূর করে দিতে হয়? বিস্ময় বোধ করেছি, সকলে একই উত্তর দিয়েছেন, সংসার ত্যাগ করে ফকিরি নিয়ে বিবাগী হয়ে ঈশ্বরচিন্তা শরিয়তে বিধি নেই। শরিয়ত এই নিয়ম মানেন না। আরোও বেশী বিস্ময় বোধ করেছি, আমার এই মুসলিম সমাজের বন্ধুরা কেউই তাঁদের নাম জনসমক্ষে আসুক, চাননি। উত্তর দেবার একটাই শর্ত ছিল, নাম প্রকাশ্যে না আসা। এ এক আশ্চর্য সত্যি। তাহলে আর শুধু মহিলাদের দোষ দিয়ে কি লাভ! শরিয়তের ভয় তো সকলেরই। অথচ, এঁরা সকলেই রাবিয়া বশরীকে স্বীকার করেন, শ্রদ্ধা করেন। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! রাবিয়া তো মুসলিম ছিলেন, তাহলে তাঁর পক্ষে কি করে সংসার ত্যাগ করে ঈশ্বরচিন্তায় জীবন বাহিত সম্ভব হয়েছিল? অনেকেই উত্তর দিয়েছেন, এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, আর ব্যতিক্রমী ঘটনা তো সাধারণ উদাহরণ হিসাবে ধরা যায় না! অনেকে আবার বলেছেন, রাবেয়া মুসলিম হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি সুফী সাধিকা ও গায়িকা, তাই হয়ত সম্ভব। অর্থাৎ সমাজের একটা অংশ এই জীবনের প্রতি আস্থা রাখেন। রাবিয়া বশরী নিয়ে এত কথাই যখন হল, কে এই রাবিয়া বশরী একটু জানা যাক। যদিও হয়ত অনেকের জানা আছে, তবু সেই সাধিকা সম্বন্ধে দু-চার কথা বলি।
রাবিয়া বশরীর জন্ম ইরাকের বসরা শহরে। সম্ভবতঃ ৯৫-৯৯ হিজরীর মধ্যে ওনার জন্ম। তিনি ছিলেন পিতামাতার চতুর্থ সন্তান, তাই তাঁর নাম রাবিয়া। হিজরী গণনা অনুযায়ী চতুর্থ মাসটির নাম রবি-উল। দারিদ্র্য ছিল তাঁর আজন্ম সঙ্গী। পিতামাতার মৃত্যুর পর বসরা শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষের তাড়নায় অন্যান্যদের সঙ্গে রাবিয়া অন্যত্র গেলে পরিবারের অন্যান্য সহোদরা বোনেদের থেকে বিচ্ছিন হন এবং দস্যুদের দ্বারা লুন্ঠিত হন ও ক্রীতদাসী হিসাবে বিক্রিত হন। কিন্তু এত দুঃখ,যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জীবন কাটলেও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও অনুরাগ ছিল অটুট। তাই দেখে যিনি তাঁকে ক্রয় করেছিলেন, মুক্তি দেন। ধীরে ধীরে এই ঈশ্বর প্রেমই তাঁকে একজন সাধিকা রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়। এই সাধনার পথে তাঁর মুরশিদ ছিলেন হজরত হাসান বশরী। রাবিয়ার ভগবৎ প্রেম, ঈশ্বরসাধনা, ঈশ্বরচিন্তা তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। অনেকেই তাঁকে বিবাহ করতে চান, কিন্তু রাবিয়া ঈশ্বর ছাড়া আর কোন কিছুর কাছে নিজেকে ধরা দেন না। তিনিই প্রথম প্রচার করেন ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরলাভ সম্ভব। সুফী সাধনার অন্যতম কবি ও সাধিকা রাবিয়া বশরীর নাম আজও অম্লান হয়ে আছে।
এক ফকিরের কথায় মুরশিদ ছাড়া কখনই এই ধরণের সাধনা সম্ভব নয়। মুরশিদই হলেন সেই পথের দিশারী। যতই প্রকাশ্যে স্বীকার অথবা অস্বীকার করুন না কেন, মুরশিদই সাধনার উপায়ের পথটি বাতলে দেন। তাই যদি হয়, তাহলে কি বাউলসাধনার সঙ্গে খুব আলাদা কিছু? এখানেও তো গুরুই সব। তাঁর মতে, অনেক ফকিরই গোপনে বাউলদের মত সাধনা করেন, সাধনসঙ্গিনীও রাখেন, কিন্তু প্রকাশ্যে তা স্বীকার করেন না। এ তো নাহয় গেল ফকিরদের কথা, কিন্তু ফকিরাণি, তারাও কি তাই? রাবিয়া বশরী কিন্তু মুরশিদের সাহায্যেই সাধনার উন্নত স্তরে পৌঁছতে পেরেছিলেন।
কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে যদিও বা দু/একজন ফকিরাণির সন্ধান পাওয়া গেল, তাঁরা নিজেরা পুরুষের উপস্থিতিতে কোনরকম শিক্ষা, দীক্ষা দিতে নারাজ। সে দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন কোন পুরুষের হাতে। প্রশ্ন করতেই তাঁরা নাম করলেন হজরত কন্যা ফতেমার কথা, যিনি মারফতি জীবন যাপন করলেও শিক্ষা-দীক্ষার ভার তুলে দিয়েছিলেন আলির হাতে। তবে কি, শরিয়তে মেয়েদের জন্য বিধান বড়ই কঠোর?
মুর্শিদাবাদ থেকে আগত দুই ফকিরের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তাঁরা হলেন আমীরচাঁদ ফকির এবং মোসলেম ফকির। তাঁরা জানালেন, তাঁদের ওদিকে ভিক্ষাজীবি ফকিরাণির সংখ্যা অনেক। দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই একত্র বসবাস করলেও তাঁরা কতটা ঠিক মারফতি জীবন যাপন করেন, কিংবা সাধনভজন করেন, একথা বলা শক্ত। অনেক স্থানেই ফকির-ফকিরাণিরা একসঙ্গে থাকেন, কিন্ত তার অর্থ এই নয় যে একত্রে তারা সাধনায় রত। ছুটেছি আরো কয়েক জায়গায়। কোথাও তাঁদের দেখা মেলেনি, কোথাও আবার ছিলেন, যেদিন গেছি, তাঁর দেখা পাইনি। শুধু চিন্তা করে গেছি, তবে কি, এই সমাজে মেয়েদের ঈশ্বরচিন্তায় বাধা আছে? শিক্ষা-দীক্ষা দিতে নিষেধ আছে? তাঁরা কি প্রকাশ্যে দেখা দিতেও নারাজ?
হঠাতই এক ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে কি একটা কাজে এলেন। আমি তখন মুসলিম সমাজের কোন মানুষ দেখলে, যাঁরাই একটু এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, শিক্ষিত মানুষ মনে করলেই তাঁকে এসব কথা বলি, জিজ্ঞাসা করি। ভদ্রলোক অবাক, বুঝিবা কিছুটা অবিশ্বাসও করেন। আমি এসব জিজ্ঞাসা করব হয়ত ভাবেন নি। সেদিন অন্যত্র কাজ ছিল বলে তাঁকে চলে যেতে হল। একদিন এসে এই নিয়ে আলোচনা করবেন, আমায় কথা দিয়ে গেলেন। প্রশ্ন করলাম, তাঁর নামটি কি জানাতে নিষেধ আছে? যদি আমি আমার আলোচনায় তাঁর নামের উল্লেখ করি?’
দৃঢস্বরে জানালেন, না।
আমিও আশা নিয়ে রইলাম, তাঁর কাছে হয়ত বা কিছু উত্তর মিলবে।
0 comments: