ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে
Posted in ঝরনাতলার নির্জনে
ঝরনাতলার নির্জনে
জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ৪
শিবাংশু দে
'...ফেরার পন্থা বন্ধ করে আপনি বাঁধো বাহু ডোরে
ওরা আমায় মিথ্যে ডাকে বারে বারে
জানি নাই...'
রবীন্দ্রনাথকে 'এলিটিস্ট' বলার প্রথাটি আধুনিক বাঙালি, অর্থাৎ বঙ্কিমপরবর্তী যুগের নব্যশ্রেণীর নাগরিক সমাজের কাছে একধরনের সেরিব্রাল কণ্ডূয়ণ হয়ে উঠেছে দীর্ঘকাল ধরে। হয় এই সৃষ্টিটিকে ‘ফুলের মালা, দীপের আলো, ধূপের ধোঁয়া’দিয়ে পুজোআচ্চা অথবা সঙ্গীতবোর্ডের সংরক্ষণ দিয়ে দিয়ে আবেষ্টিত রাখা হবে। নয়তো মাঠময়দান, চা'য়ের ঠেকে চীৎকৃত নানা অগভীর যুক্তিঝঞ্ঝায় ছিন্নভিন্ন করাটাই অভীষ্ট স্মার্টনেস। যতো সময় এগিয়েছে, দ্বিধাবিভক্ত বৃহত্তর আমশ্রোতার জগৎ পরস্পর আরো দূরে চলে গেছে। এই নিয়ে প্রথম বিভাজনটি প্রকট হয় পঙ্কজকুমার মল্লিকের রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার সূত্রে। তিনি নিজে ছিলেন ন্যাচরল গায়ক। সুকণ্ঠ এবং একান্তভাবে রবীন্দ্রমনস্ক। খোদ রবীন্দ্রনাথও তাঁকে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচারপ্রসারে নিজস্ব ধারার প্রবর্তন করেন। লোকপ্রিয় জনমাধ্যম চলচ্চিত্রের তারকা কুন্দনলাল সহগলকে অনর্গল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার সুযোগ করে দেন। তার সঙ্গে নিজেও সবধরনের গণমাধ্যমে নিরন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে চলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের একটি পৃথক জঁর, যেটা জোড়াসাঁকো-শান্তিনিকেতনের গায়নধারা থেকে ভিন্ন, সাধারণ শ্রোতার শ্রবণ অভ্যাসের মধ্যে জায়গা করে নিতে থাকে। চলিত গণমাধ্যমের শ্রোতাদের কাছে তখনও পর্যন্ত জোড়া-নিকেতনের গান বিষয়ে বিশেষ স্পষ্ট ধারণা ছিলনা। শ্রোতাদের যে অংশটি চিরকাল এলিটিজমের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলো, তারা পঙ্কজকুমারের প্রয়াসকে কেন্দ্র করে নিজস্ব মতপ্রকাশের একটি মঞ্চ খুঁজে পায়। যদিও পঙ্কজকুমার নিজে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এই জাতীয় কাজিয়ার অংশ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর এবং কুন্দনলাল সহগলের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিপুল জনসমাদর জোড়া-নিকেতনের অনেক প্রভাবশালী মানুষকে তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলে।
এই বিরূপতা বেশ প্রকট হয়ে ওঠে পরবর্তীকালে, যখন দেখা যায় পঙ্কজকুমারের অনুসারী গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা আরো পরে কিশোরকুমার গীত রবীন্দ্রসঙ্গীত বৃহত্তর শ্রোতৃবর্গকে একেবারে অভিভূত দিয়েছিল। এই দুই ধারাকে সমন্বিত করার একটা আন্তরিক প্রচেষ্টা করতেন সন্তোষকুমার সেনগুপ্ত মশায়। তিনি নিজে ছিলেন একজন গুণী শিল্পী ও এইচ এম ভির রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষক। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত জোড়া-নিকেতন নির্দিষ্ট শাসনের বিরুদ্ধে দেবব্রত বিশ্বাস নামক নেমেসিসকে আটকাতে পারেননি। মনে হয়, তিনি চান'ওনি। কারণ প্রথমতঃ তিনি দীর্ঘকাল ব্যবসায়িক রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত থাকার সূত্রে জনগণেশের রুচি ও চাহিদার ক্রমবিবর্তন বিষয়ে ওয়াকিফ ছিলেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি দীর্ঘকাল ধরে জর্জদার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে জর্জদার ধারণাটির সঙ্গে তাঁর সম্যক পরিচয় ছিলো। একবার একটি একান্ত আলাপচারিতার সময় উপস্থিত থাকার সুবাদে তাঁর কাছে শুনেছিলুম রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক গীতধারাটিকে অনভিজাত শ্রোতার দরবারে পত্রপুষ্পে ভরিয়ে তোলার যে শ্রেয়ফল তা পঙ্কজকুমার ও তাঁর অনুসারী শিল্পীদেরই প্রাপ্য। পঙ্কজকুমার ও তাঁর অনুসারী শিল্পীদের ন্যাচরাল গায়নভঙ্গির অংশীদার হওয়া ব্যতিরেকে জর্জ বিশ্বাস নিজে সচেতনভাবে এই বিভাজনের সঙ্গে সংলিপ্ত ছিলেন না। কিন্তু পাকেচক্রে তিনিও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো অতি লোকপ্রিয় অথচ 'এলিট' শ্রোতা অনাদৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ন ঘরানার পথিকৃৎ হয়ে পড়েন। কালক্রমে রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক শিল্পধারণাটির ভবিষ্যতের অভিমুখ নির্দিষ্ট করে দেন।
'...আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা'
জর্জ বিশ্বাসের 'স্বেচ্ছায়' রেকর্ডিং বন্ধ করা একালের বাঙালিমানসে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভবিষ্যত বিষয়ে একটি নির্ণায়ক মোড়। এই ঘটনাটি বৃহত্তর শ্রোতাসমগ্র ও পরবর্তী প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে একটা নতুন বাঁক এনে দিয়েছিলো।
" এলিটিস্ট বলতে যা বোঝায়, রবীন্দ্রসঙ্গীত যে কেবল তাঁদেরই 'বিষয়' হয়ে রইলো, একথাটা আমি মানিনা তত। স্কুলের প্রাঙ্গনে, পাড়ার ক্লাবে, রাজনীতির আখড়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীত আজও একেবারে অপাঙক্তেয় বা অপরিচিত হয়ে যায়নি। এলিটিজমের বৃত্তে নয়, এইটুকু হয়তো বলা যায় যে এই গান আমাদের মধ্যবিত্ত গণ্ডিটিকে এখনও পেরিয়ে যেতে পারেনি।" (শঙ্খ ঘোষ)
'রবীন্দ্রসঙ্গীত' বিষয়ে খোদ রবীন্দ্রনাথের ধারণাটি কী ছিলো? মানে নিজস্ব চিন্তা-কল্পনা ও মননে সৃষ্ট সঙ্গীতের রূপ নিয়ে তাঁর প্রত্যাশাটি কেমন ছিল তা নিয়ে একটু ভাবা যেতে পারে।
যখন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড হতে শুরু করেছে তখন থেকে একটা ডকুমেন্টেশন আছে। কিন্তু তার আগের পর্বে লোকমুখে ও স্মৃতিকথাসূত্র অনুসারে জনমনে এই গানের ছাঁচটি কেমন ছিল তাও মনে রাখতে হবে।
১৮৯৮ সালে গায়ক শ্যাম ভট্টাচার্য মশায়কে মাসিক বেতনের চুক্তিতে শান্তিনিকেতনে নিযুক্ত করা হয়। তিনি উপাসনামন্দিরে প্রভাতী ও সান্ধ্য অধিবেশনে ব্রহ্মসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। এই সব গানের সিংহভাগের রচয়িতা ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন সদস্যেরা। উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন যে রবীন্দ্রনাথই ছিলেন মুখ্য রচয়িতা। তিনি যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করতেন তখন রবীন্দ্রনির্দিষ্ট স্বরলিপি ও গায়নভঙ্গির বিশেষ তোয়াক্কা করতেন না। সম্পূর্ণ নিজের ঢঙে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে গেছেন খোদ শান্তিনিকেতনে বসে ১৯৪০ সালে তাঁর দেহাবসান পর্যন্ত। কবি যখন শান্তিনিকেতনে থাকতেন, তিনি এই ভঙ্গিতেই নিজের গান শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কখনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন বলে জানা যায়না। ১৯১৫-১৬ সালে শান্তিদেব যখন ৫-৬ বছরের বালক তখন তিনি দেখতেন দেহলি বাড়ির একতলার অধিবাসী দিনু ঠাকুরকে দোতলার মালিক রবীন্দ্রনাথ গান বেঁধে শোনাচ্ছেন আর দিনু ঠাকুর তৎক্ষণাৎ সেগুলির সুর লিখে ফেলছেন। তার পর সেই সব গান সবাইকে ডেকে শেখানোর মধ্যেই তাঁর আনন্দ। 'সবাই' মানে পাঁচ থেকে পঞ্চান্ন বয়সি সব আশ্রমিক। তাঁদের অধিকাংশেরই কোনও যথার্থ সঙ্গীত শিক্ষা ছিলোনা। কিঞ্চিৎ বেসুরো বা বেতালা হবার ক্ষেত্রে কোনও বাধাও ছিলোনা। সচরাচর বিকেলের দিকে এই গানের আসর অনুষ্ঠিত হতো এবং সেখানে অধিকাংশ দিনই কবি স্বয়ং উপস্থিত থাকতেন। তিনি নিজে দিনু ঠাকুরসহ গলা মেলাতেন খোলা মনে। সানন্দে, সমস্ত সহগায়কদের সঙ্গেই। এই পরিবেশনের সময় একটা বিষয় স্পষ্ট থাকতো, সবাই যেন স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের সঙ্গে এই যজ্ঞে ভাগ নেয়। অতএব শুরু থেকেই এটা নির্দিষ্ট ছিল তাঁর গান নিছক আনন্দের গান, 'আভিজাত্যে'র ছদ্ম আবরণ মুক্ত। বাঁধাবাঁধির বহুদূরে তার স্থান।
কবির গান পরিবেশনের শাস্ত্রীয় অঙ্গটি নিয়ে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস নে'ন পন্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী। তিনি যে শুধু বিভিন্ন হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় গায়নকলায় দক্ষ ছিলেন তাই নয়। তিনি তবলা, পাখোয়াজ আদি বাদ্যযন্ত্রেও সমান পারদর্শী ছিলেন। ১৯১৪ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে সঙ্গীত অধ্যাপক হয়ে আসেন এবং প্রায় পনেরো বছর ধরে এই দায়িত্বপালন করে যন। তিনি বাংলা জানতেন না, কিন্তু একান্ত আগ্রহী চেষ্টায় বাংলা শেখেন। তার পর রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতে শুরু করেন। যদিও তাঁর বাংলা উচ্চারণে কিছু জড়তা ছিলো, কিন্তু কবি তাঁর গায়ন খুব পছন্দ করতেন । বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে দিয়ে একক গানও করাতেন। অতএব ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চারণের নিখুঁতত্বও কবির বিচারে তেমন জরুরি ছিলোনা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন আগে থেকেই বিভিন্ন পেশাদার গায়কগায়িকারা রবিবাবুর গান গ্রামোফোন রেকর্ড করতে উদ্যোগী হয়ে পড়েন। এঁরা কেউ সুর-বাণী-লয়-তালের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রাবীন্দ্রিক মানদণ্ডের ধার ধারতেন না। যে যেমনভাবে পেরেছেন, গান রেকর্ড করে গেছেন।
সেকালের যে রেকর্ডিংগুলি রয়েছে সেখানে প্রাচীনতম দ্বিজেন্দ্রনাথ বাগচী গীত 'কেন যামিনী না যেতে জাগালে না'। ১৮৯৭ সালে রচিত এই গানটি ১৯০৪ সালে প্রথম রেকর্ড হয়। প্রথম থেকেই বিতর্কিত এই গানের বাণী এবং বক্তব্য। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তো রীতিমতো যুদ্ধং দেহি রব তুলেছিলেন এবং অশ্লীল বলে ঘোষণাও করেছিলেন এই গানটিকে। আমাদের পিতৃদেবেরা যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুরু করেন, তখন হেমন্ত গীত এই গানটির রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এখনও পর্যন্ত সেটাই স্ট্যান্ডার্ড গায়ন। হেমন্তের মাপদণ্ডের নিরিখ নিয়ে যদি নিরপেক্ষও থাকি, তবু দ্বিজেন্দ্র বাগচী গীত রেকর্ডটি নবীন প্রজন্মের শ্রোতা কেন, আমাদের প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছেও একটি কমিক গান বোধ হবে। সেই একই পরিণাম দেখবো ১৯০৫ সালে রেকর্ড করা পূর্ণকুমারী দাসীর দু'টি গান, 'পুরানো সেই দিনের কথা' ও 'আমি চিনি গো চিনি তোমারে'।
আমি নিশ্চিত, বলে না দিলে একালের শ্রোতা বুঝতেই পারবেন না, এগুলো আসলে কোন গান রেকর্ড করা হয়েছিলো। অথবা ১৯০৬ সালে বেদানা দাসীর গাওয়া 'আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে'। 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকে বসন্ত রায়ের গান, কিন্তু আমরা এই গানটি যাঁর কণ্ঠে শুনে বড়ো হয়েছি, অর্থাৎ অশোকতরু বন্দোপাধ্যায়, তাঁর সঙ্গে এই গান বা গায়কি এত-ই আলাদা যে বোঝাই যায়না যে কোন গান।
এর সঙ্গে ১৯০৫ সালে মানদাসুন্দরীর গাওয়া 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই' নেওয়া যেতে পারে। এই সব গায়িকারা দু'রকম গান জানতেন, টপ্পা-খেমটা বা নিজের মতো করে কীর্তন। তাই এই সব 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' ঐ সব শৈলীর জারজসন্তান হয়ে বিক্রি হতো। আবার ১৯১৮ সালে জিতেন্দ্রনাথ দত্তের গাওয়া 'একদা তুমি প্রিয়' বা ' এতোদিন যে বসেছিলেম' শুনলে মনে হবে প্রসাদী শ্যামাসঙ্গীত শুনছি।
কবি এ সমস্তই শুনতে পেতেন। কিন্তু এই সব যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে কোনও সরব প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন, এমন কোনও উল্লেখ দেখিনি। ১৯২৬ সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হবার পর কবি এ বিষয়ে সচেতন হতে শুরু করেন। যেসব রেকর্ড কোম্পানি রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রকাশ করতো, তাদের তিনি নির্দেশ দেন যে গানের বাণী ও সুর যথার্থভাবে শেখার পরেই যেন গায়কেরা তা রেকর্ড করেন। কিন্তু এ ব্যাপারেও তাঁর কোনও গোঁড়ামি ছিলোনা কখনও। বরং তিনি স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে তৎকালীন লোকপ্রিয় শিল্পীদের উৎসাহিত করেন। যদিও এই সব শিল্পীদের সঙ্গীত শিক্ষণ ছিলো অন্য ধারার, কিন্তু তাঁরা কবির প্রেরণা ও আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখ্য, কুন্দন লাল সহগল, কানন দেবী, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কৃষ্ণচন্দ্র দে, নীহারবালা, শান্তা আপ্তে, রেণুকা দাশগুপ্ত প্রমুখ। লক্ষ্য করার বিষয়, কবি কিন্তু নিজে কখনও এঁদের গায়নপ্রক্রিয়ার মধ্যে কোনও অসম্পূর্ণতা বা বিধিচ্যুতি আবিষ্কার করেননি, যা পরবর্তীকালে তাঁর তাঁদের নিজস্ব ধ্বজাধারীরা খুঁজে পেয়েছিলেন।
অনেক পরে কবির পরিণত বয়সেও এ নিয়ে তাঁর অবস্থানে কোনও পরিবর্তন আসেনি। ১৯৩১ সালে কবির সত্তরবর্ষ জন্মদিন উদযাপনকালে সেই সময়ে বাংলার যতো প্রথিতযশা শিল্পীরা ছিলেন, তাঁরা নিজস্ব সঙ্গীতধারা নির্বিশেষে সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। সেখানে ২৭ জন পুরুষ শিল্পী ও ৪৭ জন মহিলা শিল্পী সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন, বিষ্ণুপুরের গোপেশ্বর, সত্যকিঙ্কর, রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, অনাদিকুমার দস্তিদার, পঙ্কজকুমার মল্লিক, অনিলকুমার বাগচি, সুধীর কর থেকে মালতী বসু (ঘোষাল), কনক দাস, রমা কর, সাবিত্রী গোবিন্দ (কৃষ্ণন), অমিয়া ঠাকুর, অমিতা সেন, হাসি বসু এবং আরো অনেকে। এই চুয়াত্তর জন শিল্পীর মধ্যে শান্তিনিকেতন থেকে ছিলেন মাত্র কুড়ি জন। তাই বোঝা যায় শিল্পী নির্বাচন নিয়ে কোনও গোঁড়ামি আয়োজকদের মধ্যে তখনো দেখা যায়নি।
আর্নল্ড বাকে সাহেব ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে আসেন। যদিও তাঁর নিজস্ব গায়ন বা শিক্ষণ পদ্ধতি একেবারে পৃথক ছিলো, কিন্তু কবি নিজে বা দিনু ঠাকুর কখনও তা নিয়ে কোনও বিরূপ অবস্থান নেন'নি। এর থেকে স্পষ্ট হয়, কবি নিজে বা তাঁর সহযোগী রবীন্দ্রসঙ্গীতের চিহ্নিত ধারকবাহকেরা এই সৃষ্টিমাধ্যমটির বিস্তৃত প্রচারে আগ্রহী ছিলেন। জনগণেশের মধ্যে একে আরো অধিক মাত্রায় প্রসারিত করার জন্য যথাযোগ্য প্রয়াসে তাঁদের অনীহা ছিলোনা।
যদিও এ প্রসঙ্গেও শঙ্খ ঘোষের বক্তব্যটি প্রনিধানযোগ্য।
“.... রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাষা, তার অনুভূতিজগৎ, তার সুরকাঠামো একেবারে সেই সাহিত্যরেখারই সঙ্গে লগ্ন, সাহিত্যেরই যেন আরো-একটা দিক। তাই ঐতিহাসিক কারণেই একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে এর প্রতিপত্তি হওয়া শক্ত। রামপ্রসাদি বা বাউলগান, পদাবলীসঙ্গীত বা পল্লিগীতি, তার সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যপ্তিগত দূরত্ব একটা থেকেই যাবে। কয়েক প্রজন্মের মধ্যে 'গীতাঞ্জলি'র গান পথের ভিখিররও কাছে পৌঁছে যাবে, সাতাশি বছর আগে (শঙ্খ এই কথা ১৯৯৯ সালে বলেছিলেন) বলা ইয়েটসের এই ভবিষ্যবাণী সফল হয়ে উঠবার কোনো সম্ভাবনাই নেই কোথাও।“
'... এ জীবনে যা কিছু সুন্দর, সকলই আজ ভরে উঠুক সুরে'
তথ্যমূলক সুন্দর
ReplyDelete