গল্প - জয়দীপ মজুমদার
Posted in গল্প
গল্প
নচনি নইরা
জয়দীপ মজুমদার
উলানবাটর থেকে ইস্টার্ন হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালাচ্ছিল গ্যানজোরিগ। ইচ্ছে ছিল পুরোটা রাত এই সাড়ে ছয়শ সাতশ কিলোমিটার ড্রাইভ করে চলে যাবে চৈবালসান। চৈবালসান থেকে উলানবাটর গাড়ী চালিয়ে এসেছিল অর্ডার করা মাইনিং এর রক-ড্রিলিং মেশিনটা রিসিভ করার জন্যে। মঙ্গোলিয়ার গোবি ডেসার্টের উত্তর প্রান্তের খেন্তি আর দক্ষিণে বায়ানমুখের মাঝখানে মুরান বলে ছোট্ট একটা গ্রামের ওপর দিয়ে যাচ্ছে হাইওয়ে ধরে। রাস্তার ধারের একটা সরাইখানা চোখে পড়তেই গ্যানজোরিগ গাড়ি ঢুকিয়ে পার্ক করে দিল। আজকে আর গাড়ি চালাবে না। ঘুম পাচ্ছে খুব এখন। রাস্তার ধারের এই নিরিবিলি সরাইখানায় বসতেই মেনু কার্ড দিয়ে গেল। একটু ড্রিংক নেবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু এখানে লোকাল অ্যাইরাগ ছাড়া কিছুই পেল না। গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থকতে থাকতে পোর্সিলিনের বাটিতে করে অ্যাইরাগেএ একটা চুমুক দিয়ে তৃপ্তির একটা নিশ্বাস ফেলল গ্যানজোরিগ। যাবে মঙ্গোলিয়ার উত্তর-পূর্ব দিকে রাশিয়া আর চীনের মাঝখানে একটু ঢুকে থাকা এই মঙ্গোলিয়ার ছোট এক ভূখণ্ড চৈবালসান। একটু দূরে হাল্কা আলোয় দেখতে পাচ্ছে একটা ছোট মেয়ে দু-তিনটে ভেড়ার দুধ দোয়াচ্ছে। এই দুধ ফার্মেন্ট করেই এরা বানায় অ্যাইরাগ হবে হয়ত এক সরাইখানারই কারোর মেয়ে। এক প্লেট চিকেন মোমো অর্ডার করল গ্যানজোরিগ অ্যাইরাগেরর সঙ্গে।
মঙ্গোলিয়ার খোবসগল লেক এক সময় রাশিয়ার বৈকাল হ্রদের অংশ ছিল শুনেছে অনেক আগে গ্যানজোরিগ বাবা জেভের কাছে। মঙ্গোলিয়ার উত্তর-পশ্চিমে রাশিয়ার সীমানা বরাবর এই লেক। প্রকৃতির চরম প্রখরতা সাইবেরিয়ার এই জায়গাকে বানিয়ে দিয়েছে শীতল মরুভূমি। দু-একটা ছোট নালা বা ছড়া বহু দিন এই দুটো লেকের যোগাযোগ রেখেছিল কিন্তু এখন জায়গায় জায়গায় সেগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কোথাও কোথাও আবার শুকিয়ে গেছে। যদিও জনপদ বেড়েছে কিন্তু এই দুটো লেকের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া নিয়ে কেউ কখনো মাথা ঘামায়নি।
গোটা দশ বারোটা তুরকিক বেদুইন পরিবার। বসতি বানিয়ে রেখেছে খোবসগল লেকের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। চীনের উত্তর দিকের এক পাহাড়ি উপজাতি এই তুরকিকরা। চেঙ্গিস খান এদেরকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে চীনের হাত থেকে বের করে নিয়ে আসে।
ইয়র্ট ক্যাম্পগুলো খুব খাসা করে বানায় এরা, গোল গোল তাঁবুর মতো ঘর পুরু ইনুলেশনের দেওয়াল। সমস্ত রকম ঠাণ্ডার প্রকোপ ও তুষার ঝড় সইতে পারে এই ইয়র্ট ক্যাম্পগুলো। রাশিয়ায় এই ক্যাম্পগুলোকে এরা বলে জুরটা। নিজেদের ভাষা ছাড়া রাশিয়া আর চীনের ভাষাও এরা সবাই বোঝে এবং বলতে পারে।
পরিবার বললে ভুল হবে গ্যানজোরিগ এই ইয়র্ট ক্যাম্পে গত পাঁচ বছর ধরে একা থাকে বিয়ে করেনি। গ্যানজোরিগ একটু বড় হতেই ওর বাবা ওকে একটা ইয়র্ট দুটো ঘোড়া আর আর বেশ কিছু ভেড়া দিয়ে আলাদা করে দেয়। পড়াশুনোর গণ্ডি বলতে লিখতে টিখতে পারা আর ব্যবসায় লাভক্ষতির হিসেব লিখে রাখা এই অবধি খুব ভালোভাবে চালিয়ে দিতে পারে। গ্যানজোরিগের বাবা জেভ খালি সময় সময় মাঝে মাঝে নজর রাখে ছেলে ঠিক মত নিজেরটা চালাতে পারছে তো। জেভ মাঝে মাঝে যখন কাজে কর্মে এদিকে আসে, থেকে যায় এখানে, গ্যানজোরিগের সঙ্গে দেখা করে যায়। এসব বেদুইনদের কোন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকত না আগে কিন্তু গ্যানজোরিগের আছে। একটা এ টি এমও আছে। খোবসগল লেকের ধারে হোটেলগুলো যেখানে বিদেশী পর্যটকরা বেড়াতে আসে সেখানেই ওর এ টি এম। মাঝে মাঝে যায় টাকা পয়সা তুলতে ও রাখতে। জীবন ধারণের রুজি-রুটি এই লেকের ধার থেকেই আসে। এখানে দুধ সাপ্লাই করে। দুধের ডিমান্ড সময়ে সময়ে খুব ওপর-নীচ ওঠা নামা করে। তারপর রয়েছে কম্পিটিশন। যখন দুধের ডিমান্ড কমে যায় তখন উদ্বৃত্ত দুধে তৈরি করে মিল্ক পাউডার পনীর ও বিভিন্ন রকম মিষ্টি। জেভের বন্ধু দাভা ও তার মেয়ে এরহি মিষ্টি বানানো ব্যাপারটায় গ্যানজোরিগকে সাহায্য করে। উদ্বৃত্ত দুধের বেশীর ভাগটাই চলে যায় ‘আরুল’ বলে একরকম শুকনো পনির বানাতে। দুধকে একবার আরুল বানিয়ে ফেলতে পারলে সেটা অনেকদিন যায়, নষ্ট হয়না। আর এই আরুল জলে গুলে আবার দুধের প্রয়োজন মেটানো যায়। গ্যানজোরিগের ঠিক পাশেই দাভা, মানে এরহির ইয়র্ট ক্যাম্প। দুধ ছাড়াও গ্যানজোরিগ ওর ভেড়াগুলোর নিয়মিত লোম ছাটাই করে বাইরে চালান দিত। একা এতসব কাজ সামলে উঠতে পরত না। এরহি অনেক সাহায্য করত তাকে দৈনন্দিন কাজে।
গ্যানজোরিগের একার সংসার তাই জেভের চাইতে বেশ সচ্ছল। দাভার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে হুলনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে এরহি। উর্বশী রূপ এরহির। একই সঙ্গে এই ইয়র্ট ক্যাম্পগুলোয় বড় হয়েছে একসঙ্গে খেলাধুলো করেছে, মারামারি করেছে গ্যানজোরিগ আর এরহি। গ্যানজোরিগকে এরহির খুব ভাল লাগে এইজন্যে যে যখনই ওরা কুস্তি লড়ে গ্যানজোরিগ হেরে যায়। রেগে গেলে গ্যানজোরিগকে মারা যায় গ্যানজোরিগ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খায়। অথচ যখন সত্যিকারের কুস্তি কম্পিটিশন হয় গ্যানজোরিগ সবাইকে হারায়। এরহি বুঝে উঠতে পারেনা এই হারা ব্যাপারটা কি ‘নচনি-নইরা’ মানে মঙ্গোলীয় ভাষায় ম্যাচ-ফিক্সিং নাকি অন্য কিছু। হারার ব্যাপারে গ্যানজোরিগের এই নিখুঁত অভিনয় এরহি ধরতে পারেনা। গ্যানজোরিগ পরপর দুবছর কিকরে নাদামে শীর্ষ-স্থানীয় রেস্টলার হয়? কিন্তু গ্যানজোরিগকে খুব ভাল লাগত এরহির। গ্যানজোরিগও সেটা বুঝত কিন্তু সেটাকে ঠিক ভালবাসা বলে কিনা বুঝে উঠতে পারত না। একটু বড় হতেই দাভা গ্যানজোরিগ আর এরহির রেস্টলিং ব্যাপারটাকে একটু অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল। মেয়ে বড় হচ্ছে, মঙ্গোলিয়ায় রেস্টলিংএ মেয়েদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই তাই এরহির জন্যে প্রফেশনাল আর্চারি সেট কিনে আনল। তাতেই চলত এরহির তিরন্দাজির অনুশীলন। লক্ষ্য উলানবাটরে নাদামে অংশগ্রহণ করা ও মেডেল আনা।
তীরন্দাজি, ঘোড়ার রেস আর কুস্তি এই তিনটে ইভেন্ট দিয়ে হয় এই নাদাম উৎসব, চালু করেছিল ইতিহাসের চেঙ্গিস খান আর এখন সেটা মঙ্গোলিয়ায় পালন হয় প্রতি বছর জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চীনের কাছ থেকে পাওয়া স্বাধীনতা দিবসে। সারা বিশ্ব থেকে বহু পর্যটক আসে এই অনুষ্ঠান দেখতে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটরের ন্যাশনাল স্পোর্টস স্টেডিয়ামে।
গ্যানজোরিগ ঘোড়ার দৌড়েও হারাতো সবাইকে এই বেদুয়িন পাড়ায়। গোল ইয়র্টের পাশে গোল করে ঘিরে একটা জায়গায় বালি মাটি মিশিয়ে বানিয়েছে কুস্তির গ্রাউন্ড। এই বেদুয়িন পরিবারের বাচ্চা গুলো এখানে আসে তালিম নিতে। কিন্তু সেখান থেকে পয়সার সেরকম আমদানি হয় না। কিন্তু খানিকটা দূরে খোবসগল লেকের একদম দক্ষিণে ছোট একটা গ্রাম খাতগাল ভিলেজ থেকে যে বাচ্চাগুলো তালিম নিতে আসে গ্যানজোরিগের কাছে, ওরা জানে সে এক স্টার রেস্টলার। পর পর দুবছর বেশ কতোগুলো অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে রাজধানী উলানবাটরের ন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল নাদামে। ওরা অনেক পয়সা দেয় কুস্তির তালিম নেবার জন্যে। আর বেশী পয়সা দেবার আরও একটা কারণ ছিল গ্যানজোরিগ এর সঙ্গে বাচ্চাদের ঘোড়ার রেসেরও তালিম দায়ে দিত। নাদামের হর্স রেসিংটা বাচ্চাদের দিয়েই করানো হয়। তাই অর্থ উপার্জনের ব্যাপারে গ্যানজোরিগ ছিল বেশ সচ্ছল।
একদিন গ্যানজোরিগ খুব দেরী করছিল ঘুম থেকে উঠতে ইয়র্টে। অনেক বেলা হয়ে গেল, তা ও উঠল না দেখে এরহিকে পাঠাল দাভা খোঁজ করতে। এরহি এসে বেশ কয়েকবার দরজা ধাক্কা দেবার পর গ্যানজোরিগ দরজা খোলে। গ্যানজোরিগের গায়ে হাত দিয়ে দেখে প্রচণ্ড জ্বর গা হাত পা পুড়ে যাচ্ছে। এরহি সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গিয়ে দাভাকে খবর দেয়, গ্যানজোরিগকে বলে যায় দরজা বন্ধ না করে এমনি ভেজিয়ে রাখতে। দাভা আসার আগেই এরহি জল-পট্টি দেওয়া শুরু করে দিয়েছিল। দাভার বানানো একটা ওষুধ খাইয়েও দিয়েছে। চিকিৎসা ঠিক দিকেই চলছে দেখে নিশ্চিন্ত হল দাভা।
এরহির সেবা যত্নে সুস্থ হয়ে উঠল গ্যানজোরিগ। মনের মধ্যে এক এক ভালবাসার সুরের জন্ম নিলো। বেহালার মত মঙ্গোলিয়ার এক ধরনের সুরেলা বাদ্য যন্ত্র এই এরহি। নীচটা চৌকো মত। মনে হল দাভা একদম উপযুক্ত নাম রেখেছে এরহির। এরহির কথাবার্তা এবং প্রতিটা কাজে কর্মে যেন সেই সুরেলা ছন্দ রয়েছে। এরহিকে একটা দামী উপহার দিতে হবে আর ভাবছে প্রপোজ করবে। সেই দামি উপহার দেবার সুযোগ করে দিল হঠাৎ মোবাইলে আসা একটা ফোন কল। একটা মোটা টাকার ডিল, গত দুবছরের স্টার রেস্টলার গ্যানজোরিগকে নাদামের রেস্টলিং টুর্নামেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। মাথায় আইডিয়া খুলে গেল। কি হবে জিতে পর পর দু বছর জিতেছি, কত পয়সা পেয়েছি? এবছর যদি হেরে যাই তাহলে...। উফ ভাবা যাচ্ছে না, হ্যাঁ একটা ফোর বাই ফোর হামার গাড়ী দেবে, গিফট করব এরহিকে। রাজি হয়ে গেল গ্যাম্বলারের প্রস্তাবে। শর্ত রাখল আগে গাড়ীর ডেলিভারি দিতে হবে। রাজি হয়ে গেল গ্যাম্বলার। হামার গাড়ী চলে এলো গ্যানজোরিগের ইয়র্ট ক্যাম্পে। গাড়ীর আর সি আসতে দু তিন দিন সময় লাগবে। উলানবাটরে এলে পাওয়া যাবে। আর সি হাতে এলেই চাবি সহ গাড়ীর পুরো প্যাকেটটা এরহিকে উপহার দেবে।
চুরুটের বাক্স খুলে নিভিয়ে রাখা আগের আধখানা চুরট বের করে ধরাল গ্যানজোরিগ। অ্যাইরাগের খানিকটা বাটিতেই রাখা রয়েছে পাশে। সবাই অ্যাইরাগটা এমনি এমনিই খায় এখানে কিন্তু গ্যানজোরিগ এটাকে চিকেন মোমো দিয়ে খেতে খুব পছন্দ করে। যে মেয়েটা এতক্ষণ ভেড়ার দুধ দোয়াচ্ছিল সে চিকেন মোমো আর বেশ কিছু বিভিন্ন রকম সস ট্রে হাতে করে নিয়ে এলো। সরাইখানার বাইরেটা বেশ ঠাণ্ডা হলেও মন্দ লাগছিল না গ্যানজোরিগের। মোমোর একটা বাইট আর আইরাগের একটা সিপ নিয়ে সাদা হামার গাড়ীটার দিকে তাকিয়ে গ্যানজোরিগ ভাবনার গভীরে চলে গেল সত্যি সত্যি কতটা পাপ বা অসৎ কাজ সে করেছে এ জীবনে এরহির ব্যাপারে...।
দাভা খানিকটা আয়ুর্বেদিক ধরনের হাতুড়ে বৈদ্য। বাবার সঙ্গে থাকতে থাকতে ওষুধ বানানো ব্যাপারটা বেশ খানিকটা শিখে গেছে এরহি। যখন দাভা বাড়ী থাকেনা কোন রোগী বাড়ীতে দেখাতে এলে দাভার অনুপস্থিতিতে এরহিই চালিয়ে দেয় বাবার দেওয়া তালিম ও বানানো বিভিন্ন কবিরেজি ওষুধপত্র দিয়ে।
গ্যানজোরিগের আদি বাসস্থান মঙ্গোলিয়ার গোবি ডেসার্টের ওয়ু তোলগৈ। সারা বছরের ঋতুচক্র অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম কাজ করে ওরা সবাই। অত্যন্ত ক্রুড এবং দেশীয় পদ্ধতিতে সামান্য এবং দুষ্প্রাপ্য গোল্ড মাইনিং ও গোল্ড ওয়াশিং করা এদের দৈনন্দিন জীবিকা। তবে নামেই গালভারি গোল্ড-মাইনিং বা গোল্ড-ওয়াশিং কিন্তু খুবই কষ্টকর জীবিকা। বহু ঘাম ঝরিয়ে কখনো কিছু পাওয়া যায় কখনো খালি ঘামই ঝরে কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়না। পূর্ব পুরুষের অভিজ্ঞতা ও পরম্পরা কাজে লাগিয়ে ওপেন-কাস্ট মাইনিং আর খানিকটা পিট মাইনিংও করে। কিন্তু প্রাণসংশয়ে মাটির নীচে বেশিদূর ঢুকতে পারেনা। বহু পূর্ব-পুরুষ অকালে প্রাণ হারিয়েছে সোনার খোঁজে খনিতে ঢুকে। প্রকৃতি মোটেই প্রসন্ন নয় যে চাষবাস করে এখানে অনুর্বর জমিতে শস্য ফলায়।
এখন তো মোবাইল ফোনের যুগে দুনিয়া কত সোজা হয়ে গেছে। আগে এসব বেদুইনদের একই পরিবারের লোকেরা ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যেত। পথ চলতে চলতে পরে আবার কোথাও দেখা পেত, কখনো পেত না একেবারে হরিয়ে যেত কিন্তু পথ চলা বন্ধ হত না। হারিয়ে হারিয়েই পথ চলা এদের। যেখানে পথ হারাত সেখানে আবার নতুন করে জীবন শুরু হত।
গ্যানজোরিগের পূর্বপুরুষ মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কখনো পড়াশুনো করেনি কিন্তু ওরা মাটির রং রূপ এবং গন্ধে বুঝতে পারত মাটিতে কোথায় গুপ্তধন লুকিয়ে আছে। আঁচ করতে পারত কিন্তু সব সময় সেই গুপ্তধন অবধি পৌছতে পারত না। এটাকেই বোধ হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কেরামতি বলে। তা না হলে কি করে ওরা যেখানে মাটি খোঁড়া শুরু করে সরকার পরে এসে সেখানে ঢোকে আর ওদেরকে উৎখাত করে। সরকারি ভাবে মাইনিং শুরু হয় সেখানে? সরকার তো আর এমনি এমনি পুঁজি লাগায় না।
জুলাই মাসের সাত তারিখ, দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল। নাদাম এসে গেল। গ্যানজোরিগ তৈরি হচ্ছে উলানবাটর যাওয়ার। জিনিষপত্র সব রেডি করে সদ্য সদ্য গ্যাম্বলারের দেওয়া গাড়ীটায় তুলছে। এক এক করে। এরহি এসে আর্চারি সেটটা গাড়ীতে রেখে গেল আর বলল পরে আসবে উলানবাটর। গ্যানজোরিগের সঙ্গে আসছে না। সব জিনিষ পত্র রেডি করে রওয়ানা হয়ে গেল গ্যানজোরিগ। হাতগাল থেকে উলানবাটর আটশ কিলোমিটার রাস্তা। এগারো বারো ঘণ্টার পথ। রাস্তায় কোথাও নাইট স্টে করে নেবে। একা এতটা পথ গাড়ী চালাতে খুব বোর লাগে। হাতগাল থেকে পাঁচ ঘণ্টার পথ বুলগান। সেখানেই রাত্তিরটা কাটিয়ে পরেরদিন ভোর বেলা রওয়ানা হবে আবার উলানবাটরের জন্যে। গাড়ী বটে একখানা। কোন রাস্তাঘাটের দরকার হয়না এর। অফ-রোডের গাড়ী, মোটামুটি জলের পাথুরে ঝরনার ওপর দিয়েও চলে যায় এই গাড়ী।
দুপুর বারোটা নাগাদ গ্যানজোরিগ এসে পৌঁছুল স্টেডিয়ামে। স্টেডিয়ামের ভেতরের কিছু রুম, বাইরে ফাঁকা জমিতে কিছু ইয়র্ট ক্যাম্প, আর সমনে একটা হোটেল এই তিনটে জায়গাতে সব ব্যবস্থা করা হয়েছে সব খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের। গ্যানজোরিগ স্টেডিয়ামে ঢুকতেই পুরনোদের অনেকেই চিনতে পারল। এরহিকে ফোন করে পৌঁছাবার খবর জানিয়ে দিল। এরহি বলল কাল বিকেল বেলা এসে পোঁছাবে। সবাই জোর কদমে প্র্যাকটিস করছে। গ্যানজোরিগের প্র্যাকটিস করার কিছু নেই। যে হারতে এসেছে তার আবার কিসের প্র্যাকটিস? কিন্তু এগুলো সব গ্যাম্বলারের সঙ্গে চুক্তি মত কাজ। প্র্যাকটিসের অ্যাক্টিং করতে হবে যাতে কারোর কোন সন্দেহ না হয়। এরহিরা পরের দিন এসে পৌঁছে গেল স্টেডিয়ামের ক্যাম্পে। আর্চারির কিটটা নিয়ে গেল এসে। ক্যাম্পে পৌঁছে খাওয়া দাওয়া করে বেশ খানিকক্ষণ তীরন্দাজি প্র্যাকটিস করল এরহি। মাঝখানে এসে একবার দেখেও গেল গ্যানজোরিগ প্র্যাকটিস করছে কিনা। কিন্তু গ্যানজোরিগের ক্যাম্পে এসে একদম থ হয়ে গেল গ্যানজোরিগকে দেখে বলল, কি ব্যাপার সমস্ত রেস্টলাররা নিজেরা নিজেরা প্র্যাকটিস করছে আর তুমি এখানে পরে পরে ঘুমাচ্ছ। গ্যানজোরিগ বলল, খুব ভুল হয়েছে। আমার যেকোনো দুএকটা স্টুডেন্টকে নিয়ে আসতে হত এখানে প্র্যাকটিস করার জন্যে। সবাই এরকম নিয়ে আসে কিংবা কোচের সঙ্গে প্র্যাকটিস করে। আমার তো আর কোন কোচ নেই। সব কিছুই এমনি এমনি শেখা। সরকারি কোচকে বলেছিলাম সে মানা করে দিয়েছে। আমার সঙ্গে লড়বে না বলেছে। আর বলেছে আমায় বাইরে অন্য কোথাও থেকে ম্যানেজ করে নিতে। এরহি ইয়র্টের দরজা বন্ধ করে দিল। জোব্বা লং কোট জামা কাপড় খুলতে শুরু করে বলল চল তুমিও চলে এস জামা কাপড় খুলে। আমার সঙ্গেই প্র্যাকটিস কর। এখানে আর রেস্টলার পাবে কোথায় প্র্যাকটিসের জন্যে। গ্যানজোরিগ তখনো ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে ফোল্ডিং খাটে পড়ে রয়েছে। ওদিকে এরহি ডাকছে, আমি রেডি হয়ে রয়েছি ঠাণ্ডা লাগছে তাড়াতাড়ি এস। এই ইয়র্টগুলো ঠিক মত বানায় নি একদম। চার দিকে হু হু করে ঠাণ্ডা ঢুকছে। গ্যানজোরিগ হুড়মুড়িয়ে উঠে পরল, বলল হ্যাঁ খুব তাড়াহুড়ো করে কনট্রাক্টর দিয়ে বানায় এরা। গ্যানজোরিগ হামার গাড়ীটার কাগজপত্র আর সি এবং চাবি ভরা প্যাকেটটা এরহির হাতে দিয়ে বলল এই নাও রাখ, এটা তোমার জন্যে আমার ছোট্টো একটা উপহার। এরহিকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খেল গ্যানজোরিগ আর বলল না তোমার সঙ্গে এখানে আর প্র্যাকটিস করব না লেগে যাবে তোমার। তোমারও তো আর্চারি রয়েছে, তোমকে এবার মেডেল আনতে হবে। আমি যদি তোমায় ওপরে তুলে আছাড় মেরে ঠ্যাং ভেঙে দিই তাহলে আর্চারিতে মেডেল আনবে কে? আমি হয়ত এবার পারব না। উপহারটা নিলো না, ফিরিয়ে দিল এরহি। তোমার হয়েছেটা কি গ্যানজোরিগ, এখন থেকেই বলছ পারব না, হবেনা। তোমার শরীর ঠিক আছে তো। গ্যানজোরিগ জড়িয়ে ধরে রেখেছে এরহিকে আর এরহি গ্যানজোরিগের কপালে গলায় পিঠে হাত দিয়ে দেখছে টেম্পারেচার আছে কিনা। এরহি বলল, আমি গাড়ী চাইনা, আমি তোমার মেডেল চাই। মেডেল পাওয়ার পর আমি সারা রাত তোমার সেবা শুশ্রূষা করব, যেখানে যেখানে চোট লাগবে সেখানে সেখানে স্পঞ্জ করে ঠিক করে দেব সারা রাত পাশে শুয়ে কিন্তু মেডেল তোমায় আনতে হবে। গ্যানজোরিগ বলল, দাভা কি বলেছে মনে নেই, তুমি এখন থেকে আর আমার সঙ্গে আর কুস্তি লড়বে না, তুমি এখন বড় হয়ে গেছ। এরহি বলল আমিতো তোমার সঙ্গে কুস্তি লড়ি নি এত দিন। আজকে লড়তে চাইছি তোমার প্র্যাকটিসের জন্যে, ভুলে যেওনা তুমি একজন স্টার রেসটলার। গত দুবছর মেডেল পেয়েছ। গ্যানজোরিগ বলল, এবছর মনে হচ্ছে না পারব। তোমার সঙ্গে খাতগালে ফিরে গিয়ে প্রতি দিন কুস্তি লড়ব বিয়ে করে। খুব রাগ হয়ে গেল এরহির। জামা কাপড় যেগুলো সব খুলেছিল কুস্তি করবার জন্যে, কুস্তিতে খারাপ হয়ে যাবে বা ছিঁড়ে যাবে বলে, সেগুলো সব এক এক করে পরে নিলো। চলে গেল এরহি গ্যানজোরিগের ক্যাম্প থেকে, হয়ত চিরকালের জন্যে জীবন থেকেও। বেহালার মত এই বাদ্য যন্ত্র এরহির তার ছিঁড়ে গেল চিরতরে।
রিংএ উঠল গ্যানজোরিগ কিন্তু একি মার খেয়ে যাচ্ছে খেয়ে যাচ্ছে । এরহি অবাক হয়ে যাচ্ছে কি করে গ্যানজোরিগ অ্যালাও করছে অপনেন্টকে এসব মুভগুলো নেবার। এগুলো তো বেসিক স্টেপ। গ্যানজোরিগের কাছ থেকেই শেখা ওর। যাই হোক প্রথম রাউন্ডেই আউট হয়ে গেল গ্যানজোরিগ। রাত্তিরে গ্যানজোরিগ এরহির ক্যাম্পে এলো গাড়ীটা দেবার জন্যে। ছুঁড়ে ফেলে দিল গাড়ির চাবি ও কাগজ পত্র এরহি। বলল অপদার্থ শাড়ী পরে চুড়ি পরে ঘুরে বেড়াও। আমার গাড়ী চাইনা মেডেল চাই। আমি একটা শক্তিশালী বীরপুরুষ চাই যেটা আমি গ্যানজোরিগের ভেতর দেখেছিলাম। গ্যানজোরিগ নামের মানে বীর পুরুষ। সেই নামের কুলাঙ্গার তুমি। একি সেই গ্যানজোরিগ যে পর পর দুবছর এখান থেকে মেডেল পেয়েছে। এরহি বলে দিল যে এখান থেকে মেডেল নিয়ে যাবে আমি তার, আমি গ্যানজোরিগের নই। আর কোন কথা না বলে চলে গেল গ্যানজোরিগ। যাওয়ার আগে খালি বলে গেল এরহিকে, একবার যাচাই করে দেখ যাকে তুমি চাও সে তোমায় চায় কিনা। উড়ো ভালবাসার ফায়দা নিতে সবাই আসবে, যে ভালবাসতে জানেনা সেও আসবে। কিন্তু সেই ভালবাসাকে বাস্তবায়িত করার ক্ষমতা আছে কিনা যাচাই করে নিও। এরহি বলে দিল, সেটা আমি তোমার কাছ থেকে শিখব না।
নিজের ক্যাম্পে ফিরে এলো গ্যানজোরিগ। কালকে বিকেলের মধ্যে ক্যাম্প ছেড়ে দিতে হবে গ্যানজোরিগকে। ক্যাম্পগুলোতে যারা রয়েছে দিনে দুবার করে স্ট্যাটাস চেক হয়। ক্যাম্পের বাইরে অ্যারেঞ্জ করা বাফে ডিনারে অল্প কিছু খেয়ে নিলো গ্যানজোরিগ। দূরে এরহিকে দেখতে পেল বাটুহান আর আলটানের সঙ্গে হৈ হুল্লোড় করে যাচ্ছে। দুজনের সঙ্গেই কখনো কখনো ডান্স করছে। এরহি জানেনা এদের দুজনকেই গ্যানজোরিগ গত বছর কিভাবে হারিয়েছিল। এখনো যদি এই ক্যাম্পের সামনে লড়াই করে নাকানি-চোবানি খাইয়ে ছেড়ে দেবে গ্যানজোরিগ।
ওয়ু তোলগৈ থেকে জেভের একটা ফোন এলো, বাবা, আমাদের এই ওয়ু তোলগৈ ছেড়ে দিতে হবে। সরকারের লোক এসে বলে গেছে। গ্যানজোরিগ বলল সে কি, তো আমাদের এখন কোথায় যেতে হবে? আরও উত্তর পূর্ব দিকে চৈবালসানের কাছে একটা নির্জন লেকের ধারে। এই বয়েসে আর এসব ধকল সহ্য করার বয়েস নেই। বাবা তুই এখনে চলে আয় ওখানে সব কিছু গুটিয়ে। চৈবালসানেও তোর নাদাম ফেস্টিভ্যাল হয়। তুই এখানে এসে তোর রেস্টলিং প্র্যাকটিস কর কোচিং কর, যা ইচ্ছে কর, খালি চলে আয়।
গোবি ডেসার্টের ওয়ু তোলগৈতে এখন মঙ্গোলীয় সরকার গোল্ড আর কপার মাইনিং করে বলে এসব বেদুয়িনদের পাকাপোক্ত-ভাবে উৎখাত করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মঙ্গোলিয়ার উত্তর পূর্ব দিকের শহর চৈবালসানেরও উত্তর পূর্ব দিকে খয়ার মেলখিত লেকের ধারে। সরকার একদম জমিজমা অ্যালট করে দিয়েছে এখানে প্রত্যেকটা উৎখাত করা বেদুইনকে। ওয়ু তোলগৈর চাইতে প্রকৃতি এখানে অনেক অণুকুল। এখানে একটা নদী আছে যদিও তাতে জল খুবই কম। অসংখ্য সাপ একসঙ্গে পেঁচিয়ে থাকলে যেরকম দেখতে হয় এই হার্লেন রিভারটাও দেখতে সেরকম। কিন্তু জল কম থাকলে কি হবে নদীটার তেজ আছে বলতে হবে। উলানবাটরের উত্তরের খেন্তি মাউন্টেন থেকে বের হয়ে ঠিক এই ভাবে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চৈবালসান বয়ে এসেও হারিয়ে যায়নি। আরও পূর্ব দিকে বয়ে গিয়ে চীনের হুলান লেকে গিয়ে পড়েছে। গ্যানজোরিগরা এখনে খনিতে কপার পেয়েছে অনেক কপার। গোল্ড এখানে নেই। তাতে কি যায় আসে? ওয়ু তোলগৈতে কতটা গোল্ড পাওয়া যেত নিজেদের ক্ষমতা ও হাতের নাগালের মধ্যে?
উলানবাটরের নাদাম ফেস্টিভ্যাল থেকে ফিরে এলো গ্যানজোরিগ। সারা দিন গাড়ী চালিয়ে ফিরে এলো খোবসগল লেক। সকাল বেলা ক্যাম্প ছাড়ার আগে এরহির ক্যাম্প হয়ে এসেছিল গ্যানজোরিগ। ইয়র্টে এরহি ছিলনা সারা রাত,দাভা বলল। রাত্তির বেলা কিছু ওষুধ নিয়ে চলে গেল আলটানের ক্যাম্পে, বলল সারা শরীরে খুব চোট পেয়েছে বাটুহানের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে। গ্যানজোরিগ বুঝল তার মানে আলটানই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তারপর আলটানের ক্যাম্পের সামনে গিয়ে এরহিকে মোবাইলে একটা ফোন করল গ্যানজোরিগ। বলল, আমি ফিরে যাচ্ছি, তুমি কি একবার বাইরে আসবে? আলটানের ইয়র্টের ভেতর থেকে এরহির জবাব এল, না, কালকে অনেক ধকল গেছে সারা রাত, শুতে অনেক রাত হয়েছে তাই এখন আর ইয়র্টের বাইরে বের হবো না আর তা ছাড়া বাইরে বেশ ঠাণ্ডাও। ঠিক আছে বলে গ্যানজোরিগ চলে গেল।
আড়াই মাস লেগেছিল গ্যানজোরিগের খোবসগল লেকের ইয়র্ট ক্যাম্প গুটিয়ে চৈবালসান ফিরে আসতে। চৈবালসানের এই মেলখিত লেকের ধারে এসে বেশ ভালই লাগছিল গ্যানজোরিগের। যেন ধড়ে প্রাণ পেল। জেভ ঠিক সময়ে ফোনটা করেছিল একদম।
মাইনিংএর সবকিছু সেট-আপ তৈরি করতে করতে প্রায় বছর ঘুরে গেল। দেখতে দেখতে আবার নাদাম চলে এল। এবছর আর উলানবাটর যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই গ্যানজোরিগের। এবছর চৈবালসানের নাদামে যোগ দেবে। জায়গাটা বেশী দূরেও নয় এখান থেকে। আর এখানে এত কম্পিটিশনও নেই। কিন্তু বাদ সাধল উলানবাটর থেকে স্পোর্টস মিনিস্ট্রির এক সেক্রেটারির কল। গ্যানজোরিগকে চৈবালসান না গিয়ে উলানবাটর আসতে অনুরোধ করা হল। গ্যানজোরিগ পুরোনো ভুল হয়ে যাওয়ার প্রায়শ্চিত্য করবার একটু যেন শক্তি পেল। গতবছর গ্যানজোরিগের এভাবে হেরে যাওয়া নিয়ে স্পোর্টস অথারিটি একটু চিন্তিত। তাই এ বছর ক্যাম্পগুলোয় কড়াকড়ি একটু বেশী। প্রত্যেকটা ক্যাম্পের বাইরে সি সি টিভি লাগানো হয়েছে আর অথারিটির অনুমুতি ছাড়া কেউ ক্যাম্পাসের বাইরে যেতে পারবেনা। নচনি নৈইরা রুখবার যতরকম প্রচেষ্টা সম্ভব চালিয়েছে সরকার। এবছরের স্টার লিস্টে রয়েছে বাটুহান আর আলটান। গ্যানজোরিগকে সবাই ভুলে গেছে। গ্যানজোরিগ প্র্যাকটিস করার জন্যে কাউকে বিশেষ পেলনা চৈবালসানে। সবাই প্রায় নবিশ এখানে, বেশ কাঁচা। ওর তালিম নেওয়া খাতগালের দু একটা স্টুডেন্ট হলেও চলে যেত। কিন্তু সে আর হলনা। অগত্যা মোবাইলেই ডেটা প্যাকেজ চালিয়ে দেখত কোন নতুন মুভ বা স্ট্রেটেজি নেওয়া যায় কিনা। বাটুহান আর আলটান এদের দুজননেরই খেলার স্টাইলটাতো জানা।
এরহিকে দেখতে পেল উলানবাটরের ক্যাম্পে। গত বছর বাটুহান আর আলটানের যে বন্ধুত্ব ছিল এবছর সেসব মিটে গেছে পদকের প্রতিযোগিতায়। বাটুহান এবছর খেতাব নেওয়ার খুব চেষ্টা করছে। ইদানিং আলটান ওকে আর হারাতে পারছেনা। গ্যানজোরিগকে সবাই আণ্ডারএস্টিমেট করছে এবার। ওর বেশ সুবিধেই হয়েছে তাতে। কোন টেনশন নেই, একদম পুরো কুল খেলে যাওয়া। এরহি একবার আড়চোখে গ্যানজোরিগকে দেখে নিল।
রেস্টলিং শুরু হয়ে গেছে প্রথম রাউণ্ডেই ভেল্কি দেখাল গ্যানজোরিগ। টেক ডাউন আর নেয়ার ফল মুভ গুলো এত পাওয়ারফুল ছিল যে ডিফেন্সিভ এস্কেপ বা রিভার্সাল মুভগুললো নিতেই হলনা। প্রত্যেকটা নেয়ার ফল বা নেয়ার পিন মুভ থেকে তিন তিন করে পয়েন্ট তুলল গ্যানজোরিগ যেগুলোয় দু পয়েন্টের বেশী ওঠানো যায়না। পাঁচ সেকেণ্ড পিন ডাউন করে রাখতে পরলে তবে গিয়ে তিন পয়েন্ট পাওয়া যায় নতুবা দু পয়েন্ট। মুভগুলোর ইমপ্যাক্ট এত বেশী ছিল যে অপনেন্ট এখন ভয় পেতে শুরু করেছে গ্যানজোরিগকে। মাথায় এখন তার খুন চেপে গেছে, আয় কে আসবি এরহির এই চুড়ি পরা নপুংসক রেস্টলারের কাছে। এরহি দূরে বসে আলটান আর বাটুহানের বেধড়ক পেঁদানি খাওয়া দেখল আর প্রমাদ গুনল। বাটুহান আর আলটান দুবছর আগেকার গ্যানজোরিগকে মনে করতে পারল। তার চাইতেও বেশী দুর্ধর্ষ মনে হল এখন গ্যানজোরিগকে। কুস্তির নিয়ম কানুনগুলো না থাকলে হয়ত কুস্তির স্টাইলে হাত পাগুলো লক করে গলা টিপে মেরেই ফেলত গ্যানজোরিগ ওদেরকে। বাটুহানকে যখন পেঁদাচ্ছিল তখন এরহির মুখটা বেশ চাঁদনি দেখাচ্ছিল। কুস্তির ফাঁকে ফাঁকে গ্যানজোরিগ লক্ষ্য করছিল সেটা।
আজকের মত ইভেন্ট শেষ হয়ে গেল। ক্যাম্পে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে গ্যানজোরিগ মোবাইলে কিছু সেভ করা রেস্টলিং ভিডিও দেখছিল। দরজায় হাল্কা করে একটা টোকা পড়ল। এরহি দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। গ্যানজোরিগ মোবাইলটা বন্ধ করে দিল। এরহি বলল কি ভতরে ডাকবে না ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে। গ্যানজোরিগ বলল যা বলার তাড়াতাড়ি বল, বাইরে সি সি টিভি রয়েছে। এরহি ইয়র্টের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমায় ক্ষমা কর গ্যানজোরিগ, তুমি এখান থেকে চলে যাও বা কালকে সব কটা ম্যাচ হেরে যাও যা চাইবে দেব। যতক্ষণ চাইবে থাকব তোমার কাছে। তোমার সঙ্গেই তো জীবন শুরু করেছিলাম, অদৃষ্টের একটা ভুলে সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেল। গ্যানজোরিগ বলল, সেটা অদৃষ্ট নয় তোমার বেছে নেওয়া পথ। সবকিছু তোমায় দিতে চেয়েছিলাম। শেষ উপহারটা এখনো চোখের সামনে রয়েছে ঐ ফোর বাই ফোর সাদা হামার গাড়ীটা। দরজা খুললেই দেখতে পাবে পার্ক করা রয়েছে। নচনি নইরা বলে তাতে লাথি মেরেছ। তো এখন এটা কি তাহলে? নচনি নইরা-শেষ বারের মত, আত্মসমর্পণের গলায় এরহি বলল। সাধ্য ও ক্ষমতার বাইরে গিয়ে এই উপহারটা কিনেছিলাম তোমার জন্যে। কিন্তু তোমায় এখন আর দেবনা সেটা। তুমি তার যোগ্য নও। আর এখন তুমি তোমার দেহ, রূপ, যৌবন যার বিনিময়ে আমায় কিনতে চাইছ, কটা পয়সা দিলেই উলানবাটরে সেটা পাওয়া যায়। নচনি-নইরা আমি আর করবনা। এরহি বলল, আলটান হেরে বেরিয়ে গেলে আমাদের যা ইনকাম ওতে সারা বছর চলবেনা। তুমি কোরোনা নচনি নইরা। আমি খালি আমার কাজের প্রয়শ্চিত্য করছি। এই বলে এরহি গ্যানজোরিগকে জড়িয়ে ধরল। কেন, দাভা বৈদ্য রাজের ব্যবসা কেমন চলছে? দাভা মারা গেছে ছমাস হল তোমায় জানাব ভেবেছিলাম। তোমরা দুজনেই দুজনকে খুব পছন্দ করতে। কিন্তু জানাব কোন মুখে। দাভা চলে যাওয়ার পর এখন আর কেউ আসেনা ওষুধ নিতে।
গ্যানজোরিগ বলল, দেখ কালকের ম্যাচ আমি হারব না কিন্তু যদি ফাইনালিস্ট হই তাহলে ম্যাচের পুরো পয়সা তোমায় দিয়ে যাব। এটাকে নচনি নইরা বলেনা। এটুকুনি আমি নিশ্চই করব। আর তুমি এটাকে দয়া বলে ভেবনা ধরে নাও তোমায় ধার হিসেবে দিচ্ছি। কখনো যখন সময় সুযোগ হবে ফেরত দেবে। আর বাটুহানের সঙ্গে যদি আমার খেলা আগে পরে তাহলে ওকে কেলিয়ে যতটা মেরামত করবার করে দেব যাতে আলটানের হারাতে সুবিধে হয় ওকে। এরহির কপালে একটা কিস করতে গিয়ে হাতে একফোটা জল পরল। গ্যানজোরিগ দেখল এরহি কাঁদছে। গ্যানজোরিগ বলল, যা কথা হল সেই কথা আমি রাখব। এরহি চলে গেল। দরজা খুলতেই হঠাৎ একঝাঁক ঠাণ্ডা হাওয়া ইয়র্টের ভেতর ঢুকে গেল।
এরহি চলে যেতেই গ্যানজোরিগ নিজের মনে ভাবছিল আমি সাট্টা খেলেছি আমার ক্ষমতার সঙ্গে। আমি আমার নিজের ক্ষমতাকে অবৈধভাবে বিক্রি করেছি। নচনি নৈইরা করেছি। কিন্তু গত বছর আমার প্রথম রাউণ্ডেই হেরে যাওয়াটা যদি নচনি নৈইরা ছিল তাহলে এরহির সঙ্গে ছোটবেলায় বারে বারে হেরে যাওয়াগুলো কি ছিল? এরহির সঙ্গে তো আমি কখনো রেস্টলিংএ জিতি নি। এরহির সঙ্গে হেরে যেতম বলেই তো সে আমায় ছোটবেলা থেকে ভালবাসা শুরু করেছিল। তাহলে যে নচনি-নইরা ঘর ভাঙল সেই নচনি-নইরাইতো অল্প অল্প করে এ ঘর বানিয়েছিল। আমি এখনও নিজেকে সান্ত্বনা দিই যে আমার উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। আমি যদি এরহিকে দেবার উপহারের মূল্যটা একটু নীচে বাঁধতাম তাহলে আমায় এই পন্থা নিতে হতনা।
বেধড়ক মার খেল বাটুহান গ্যানজোরিগের হাতে। বাটুহানের সঙ্গেই আগে খেলা পরে ছিল। আলটানও মার খেত যদি কাল রাতে এরহি গ্যানজোরিগের ইয়র্টে না আসত। আজকেই বেরিয়ে পরতে চায় গ্যানজোরিগ। রাতে পথে কোথাও সুযোগ বুঝে বিশ্রাম নিয়ে নেবে নয়ত গাড়ীতেই শোবে। জিনিষ পত্র সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে ডাকল এরহিকে নিজের ইয়র্টে। অ্যাওয়ার্ডে পাওয়া চেকের একটা ফটো কপি আর তার সঙ্গে একই মূল্যের একটা চেক হাতে লিখে দিল এরহিকে আর বলল, আমি ফোন করে বলে দেব আমার ব্যাঙ্কে চেকটা ক্যাশ হবার পর। তারপর জমা করবে চেকটা। বিদায় নিল এরহির কাছ থেকে গ্যানজোরিগ।
সরাইখানর বাইরের টেবিলটায় অনেকক্ষণ একা বসে আছে বলে বাচ্চা মেয়েটা একবার এসে জিজ্ঞেস করে গেল আর কিছু চাই কিনা। পকেট থেকে চারশ তুঘরিক মোঙ্গলীয় টাকা বের করে বাচ্চা মেয়েটার হাতে গুঁজে দিয়ে গ্যানজোরিগ বলল, না।
ভাবার চেষ্টা করল গ্যানজোরিগ, সততাকে সামনে রেখে যাকে জীবনে অসৎ কাজ করতে হয় তাকে কতটা আর কতক্ষণ অপরাধী বলা যায়? বেশীক্ষণ নয় নিশ্চয়ই। সময়ই এসব ওলট-পালটগুলো ঠিক করে দেয়। আবার নতুন করে জীবন গড়ব চৈবালসানের এই খয়র-মেলখিত লেকের ধারে।
শেষ মোমোটা মুখে পুরে দিয়ে বাটিতে পরে থাকা বাকী অ্যাইরাগটা খেয়ে নিয়ে সরাইখানায় পার্কিংএ রাখা গাড়ীটার দিকে এগিয়ে গেল গ্যানজোরিগ। গাড়ীর দরজা খুলে অর্ডার করা সখের মেশিনটার গায়ে হাত দিতেই একটা স্পর্শানুভূতিতে বুক ও মন ভরে গেল, এই মেশিন আমাদের আগামী বহু বছরের রুজি রুটির যোগান দেবে। ভাল থাকুক এরহি-আলটান। আমি আরো অনেক অনেক বেশী খাটব, ঘাম ঝড়াব, পয়সা কামাব আবার জীবন বানিয়ে নেব আর এই ছোট ভুলটা জীবনে কখনো হতে দেবনা। বাকীটা সময়ের হাতে। খুব সুন্দর হাল্কা একটা নেশা হয়েছে। গাড়ীর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে অটো লকটা টিপে সরাইখানার নিজের ঘরের দিকে চলে গেল গ্যানজোরিগ। কালকে ভোর হতেই চা জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে এই সরাইখানা থেকে চৈবালসানের পথে, নতুন আরেকটা জীবন শুরু করতে।
খুব সুন্দর লেখা
ReplyDelete