0

গল্প - স্বাতী রায়

Posted in


গল্প


বাস্তু-হারা 
স্বাতী রায় 

।। ০।। 

সেদিন সদর শহরের কাছের ক্যান্টনমেন্টে এক ছোকরা অফিসার ছুটতে ছুটতে এসে তার লাঞ্চরত সুপারভাইজারকে খবর দিল, স্যার আকাশে একটা ইউ এফ ও র মত কি দেখা যাচ্ছে। স্যর যখন ন্যাপকিনটি নামিয়ে, সেটি প্লেটের পাশে গুছিয়ে রেখে হাত মুখ ধুয়ে ধীরে সুস্থে এসে টেলিস্কোপে চোখ ঠেকালেন, তখন আকাশ মেঘমুক্ত – একেবারে নিদাগ। ছোকরাটি তুতলে মুতলে যা বিবরণ দিল, তাতে লাহোরিয়া সুপারভাইজার শুধু হিমশীতল কন্ঠে “আপকা কাম করো” বলে শিশ দিতে দিতে বেরিয়ে গেলেন। সুবে সুবে খোয়াব দেখ রহা হ্যায়। ইঊ এফ ও! ড্যাম, মাই ফুট! ইসিকো কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্টমে ইয়ে ডালনা পড়েগা। ইসি লিয়ে শালে গিদ্ধরকে বাচ্ছে বাঙ্গালী লোগোকা কুছ নেহি হোগা। 

।। ১।। 

বৃষ্টি থামছিল না কিছুতেই। ভগবানের কি খেলা! জষ্টির শেষে আকাশ ছিল নিদাগ। দিনভর, রাতভর। আষাঢ়ের গোড়াতেও তাই। পুব দিকে ওই আবছা পাহাড়ের মাথায় অন্য বছর এই সময় লেগে থাকে ভগবানের মনখারাপের ছায়াগুলো। অথচ এবার দেখ! খটখটে রোদ্দুরে পাহাড়গুলোর বোঁচা নাক একেবারে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। এমনকি ছাগল-পাড়ীর মাঠে দাঁড়িয়ে, যখন রোদটা ধাঁধিয়ে উঠে সব অন্ধ করে দেয় না, তখন কপালে দুহাত জড়ো করে চোখটাকে একটু আড়াল করে সামনের দিকে ঠাহর করলে চোখে পড়ে এই সামনের পাহাড় পেরিয়ে, দূরের, আরও দূরের পাহাড়ের মাথা। মনসার অবাক লাগে! ওই অত দুরেও লোক থাকে! থাকে, সে কথা বামুনদাদু বলেছে। বামুনদাদু যে যায় ওই পাহাড় পেরিয়ে। পাহাড় পেরিয়ে বড় নদী – নদীর গায়ে বড় শহর। সেসব পেরিয়ে আবার যে পাহাড় উঠেছে তার গায়ে বামুনদাদুর যজমানের বাস। নদীর পাড়ের শহর নাকি মস্ত বড়। অনেক বাড়ী, অনেক দোকানপাট। রাতের বেলা সেখানে হ্যাজাকের আলো জ্বলে। একেবারে দিনের মত আলো হয়ে যায় চারিদিকে। বামুনদাদু আরো বলে যে ওইখানে যারা থাকে তারা নাকি আমাদের মত না। আমাদের মত গাজনের ফোঁড় লাগায় না। শিবের পুজো করে না। মনসার পুজোও করে না তারা। বামুনদাদুর কথা শুনে হাঁ হয়ে যায় মনসা। মনসার পুজোও করে না? তবে কি ওরা পীরের মাজারে যায়? বামুন দাদু বলে, নাঃ -ওরা পীর-টীরেও বিশ্বাস করে না। তাহলে লতায় কাটলে ওরা কি করে? বামুনদাদু হাসে। বলে, ওরা সব জঙ্গলের গাছপালা চেনে রে পাগলী। ওদের যারা কবরেজ, তারা জঙ্গল ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে সেসব ওষধি তুলে আনে – বিষ বার করে, জড়িবুটি লাগায় – তাতেই যাদের তখনো আয়ু শেষ হয় নি, তারা বাঁচে। যাদের খাতায় চিত্রগুপ্ত ঢ্যাঁরা কেটে দিয়েছে, তারা মরে। মনসা আকুল হয়ে ওঠে। 

ও বামুনদাদু, তুমি কেন ওদের বিষহরির পুজো শিখিয়ে দাও না! তাহলেই তো সবাই বেঁচে যাবে। বামুনদাদু নিজের মাথার ক’গাছি চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, পাগল মেয়ে! ওরা কি আমাদের মত হিন্দু! ওরা হল বৌদ্ধ। ওদের আচার-বিচার সব আলাদা। ওরা ওদের বিশ্বাস নিয়ে থাকে, আমরা আমাদের বিশ্বাস নিয়ে থাকি। 

মনসার ছোট্ট মাথায় এত কিছু ঢোকে না। বছর পাঁচেক আগের এক দামাল বর্ষার সময় মনসার জন্ম। চারিদিক জলে ভেসে গিয়েছিল সেবার। ওই অত উঁচু যে মা শীতলার থান, পাশের দুধপুকুরের জল উপচে উঠে ঢেকে দিয়েছিল সেই মায়ের পায়ের তলার বেদী। জল ঢুকেছিল ইস্কুলবাড়িতেও। সেই থই থই জলের মাঝে,ইঁটের উপর ইঁট বসিয়ে উঁচু করা তক্তপোশের উপর জন্ম হয়েছিল মনসার। তক্তপোশের উপরে ছিল সদ্যজাত বাচ্চাকে নিয়ে তার মা আর নীচে জলের মধ্যে তোরঙ্গের ফাঁকে ঢুকে ছিল একহাত লম্বা এক লতা। সাতদিন লেগেছিল জল নামতে সেবার – সাতদিন তিনি ছিলেন ঘরের মধ্যে। সাতদিন যেতে আঁধার কাটল, রোদ উঠল ঝলমলিয়ে, জল নামতে শুরু করল, জলের সঙ্গে তিনিও এঁকেবেঁকে ভেসে চলে গেলেন। ছেঁড়া কানিতে জড়ানো মেয়েকে হ্যারিকেনের তাতে গরম করতে করতে, তক্তপোশের উপর থেকে মা কপালে হাত জড়ো করে পেন্নাম ঠুকলেন, জয় মা মনসার জয়। ওর নামই হয়ে গেল মনসা। 

সেবার ঝামেলাও হয়েছিল খুব। জল যখন খুব বেড়ে উঠছে, তখন নাকি গোয়ালা-পাড়ার ছেলেরা সব ক্ষেপে উঠেছিল। বলেছিল, এ সব হচ্ছে ওই নতুন সরকারী রাস্তার জন্যে। তা নাহলে এ দিকে বন্যা হয় কেউ শুনেছে? জল হয়, পুকুর খাল উপছে পড়ে, চাষের ক্ষেত জল টুপটাপ হয়ে যায়, তবু ঘর ভাসার আগেই সে জল নেমে যায় মাঠ-ঘাট ভেঙ্গে, পাহাড়ের ফোঁকর গলে পড়ে গিয়ে ওই দক্ষিণ-পশ্চিমের নদীতে। সে কি আর যে সে নদী! খরখরিয়ে জল ছোটে সে নদীতে। এক লহমায় রাশি রাশি জল নিয়ে ফেলে সমুদ্দুরে। এই সামান্য বর্ষার জল তার কাছে নস্যি! শুধু তো ওদের গ্রাম বলে না, আশেপাশের সব গ্রামের জল গিয়ে নামে ওই নদীর কোলে। পাহাড় ধুয়ে আসা ঈষৎ গেরি-রঙের জলে মিশে যায় মাঠ-ক্ষেত-ধোয়া কাদাগোলা জল। দুয়ে মিলে ঘূর্ণি হয়ে ছুটে চলে সে জল। সেই কতদুর ছুটে সমুদ্রের বুকে ঢেলে দিয়ে তবে শান্তি। মনসার জন্মের বছরে ওদের গ্রাম আর সে নদীর মাঝখানে উঠেছে সরকারী সড়ক। ওই গ্রামের বাইরে ছাগল-পাড়ীর মাঠ, হোসেন মিয়াঁর কলাবাগান, চৌধুরীদের পাটের ক্ষেত সব ছাড়িয়ে আরও দূরে উত্তর- দক্ষিণে ছুটে চলেছে এক মানুষ উঁচু সড়ক। আরও অনেকদূর গিয়ে নাকি পাহাড়ের গায়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে যায় একেবারে মাথায়। আবার নেবে আসে পাক খেয়ে খেয়ে ওই শহরের গায়ে। কত দূর দূর থেকে লোকজন এসেছিল সেই রাস্তা তৈরির সময়। মনসার বাবাও নাকি মজুর খেটেছিল। এক কাঁড়ি টাকাও পেয়েছিল। রাতের খাওয়া হয়ে গেলে মা যখন হ্যারিকেন নিভিয়ে দেয়, লম্ফ হাতে নিয়ে এ ঘর ও ঘর করে হাতের কাজ সারে, বারান্দার ঝিঁকের উনুনে শুকনো পাতার আগুনের নিবু নিবু আলোয় মনসা বাবার কাছে সে সব গল্প শোনে। বাবা বলে, রাস্তা তৈরির জন্য নাকি একদল লম্বা, টকটকে ফর্সা লোক এসেছিল – তারা নাকি কিসব অজানা ভাষায় কথা বলে! বামুনদাদু পরে শুনে বলেছিল, আরে ও তো মুসলমানদের ভাষা, ওরাই এখন আমাদের রাজা! মনসার আরো গুলিয়ে যায়। মুসলমান কারা ও জানে বৈকি। শীতলার থান পেরিয়ে ঝুপসি বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে কাঁঠালতলার দিকে, সেই পথে বাঁশবন পেরিয়েই আছে পীরসাহেবের মাজার। সেখানে উরস হয়। যারা শীতলার থানে পুজো দেয় তারা হল মনসার মত হিন্দু আর যারা পীর সাহেবের মাজারে সিন্নি চড়ায় তারা হল মুসলমান। যেমন ওর পাঠশালার মইনুল। কিন্তু সে তো বাংলাতেই কথা বলে! আর মইনুল কি করে রাজা হবে! ওর আব্বু তো চৌধুরীদের ভাগচাষি। 

কিছুই মাথায় ঢোকে না মনসার। তবু বড় বড় চোখ মেলে মন দিয়ে গল্প শোনে। শুধোয় যে ওই যে গোয়ালা-পাড়ার ছেলেরা ক্ষেপে গেল, কি হল তারপর। বাবা এক কথায় গল্প সারে – কি আবার হবে! সব কোদাল-ঝুড়ি নিয়ে গেছিল রাস্তা কাটবে বলে। কিন্তু চৌধুরী সাহেব আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনিই খবর পাঠিয়ে দেন পুলিশ-চৌকীতে। তারপর বন্দুক, বেয়নেট নিয়ে পুলিশ এসে হাজির। দমাদ্দম মার খেয়ে সব কোদাল ঝুড়ি রেখে ভাগলবা। জলে বাস করে কি আর কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা যায়। বাবা বিশাল একটা হাঁই তুলে নারায়ণ নারায়ণ বলে তুড়ি মারতে মারতে শুয়ে পড়েন। কোলের মধ্যে টেনে নেন মনসাকে। চোখে ঘুম আসার আগে অবধি মনসার মনে ভাসতে থাকে অচেনা ভাষায় কথা বলা অজানা মানুষের ছবি। 

।। ২।। 

তবে রাস্তাটা হয়ে বামুনদাদুর ভারী সুবিধা হয়েছে। এখন আর অত দুরের পথ হেঁটে পাড়ি দিতে হয় না। সেই শহর অবধি বাস যায় এখন। ওদের গ্রামের থেকে বেরিয়ে আলপথ দিয়ে রাস্তায় উঠতে হবে। তারপর বাসের অপেক্ষা - বাসে চেপে বসলেই হয়ে গেল – কয়েক দণ্ড চোখের পাতা বন্ধ করতে না করতেই পৌঁছে যাবে শহরে। আর ভাগ্যিস বাস হয়েছিল! তাই তো অনেক কান্নাকাটি করে বামুন দাদুর সঙ্গে মনসাও যেতে পারল শহর দেখতে। কত বড় শহর! কত বাড়ী, কত দোকান, কত গাড়ী – মনসার হাঁ আর বন্ধ হয় না। রাতের বেলাও আলো নেবে না সব জায়গায়। মনসা অবাক হয়ে দেখে – সব থেকে অবাক হয় রাজার বাড়ী দেখে – শহরের মাঝখানটিতে কত্ত বড় বাড়ী – দেখে দেখে চোখের পলক পড়ে না। বামুন দাদুর যজমানদের ঘরেও খুব খাতিরদারী পায় মনসা। ভরপেট ঘন দুধে পাটালি দিয়ে ভাত মেখে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে শোনে, বামুনদাদুর সঙ্গে গল্প হচ্ছে বাড়ির বড়দের, এখান থেকে নাকি প্যাঁটরা বেঁধে চলে যাওয়ার সময় এসেছে। পাহাড়ের ওপারে নাকি নদীর উপর কিসব কারখানা হচ্ছে। এই সব জায়গা সেই জন্য সরকারের কাজে লাগবে। সরকারী দপ্তর থেকে চিঠি এসেছে। কবে উঠে যেতে হয় তার ঠিক নেই। কর্তারা দুঃখ করেন রাজা হয়ত চেষ্টা চরিত্র করলে ঠেকাতে পারতেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি। রাজা এক কথায় রাজী হয়ে গেছেন। সময় থাকতে থাকতে তাই মায়ের এক বছরের কাজটা এখানেই সেরে ফেলতে চান এ বাড়ীর কর্তা। 

পরের দিন সকালে এ বাড়ীতে সাজো –সাজো রব। তিন জোয়ান ছেলের মা-জননীর বাৎসরিক। তার জোগাড় যন্ত্র, হাঁক ডাকে বাড়ি সরগরম। বামুন দাদুও ভারী ব্যস্ত। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় মনসা। ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে যায় পিছনের বাগানে। পাঁচমিশালি গাছ একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। বাড়ীর কাছের অংশটা তাও একটু সাফসুতরো করে রাখা – কিন্তু বাড়ী থেকে যত দূরে যাওয়া, ততই বুনো ভাব বেশি। সে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে এ বাড়ীর চৌহদ্দী ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেছে বুঝতেও পারে নি। অবাক হয়ে গাছ দেখছিল – কত রকমের গাছ। চেনা গাছ যত না, অচেনা গাছ অনেক বেশি। কত রকমের গন্ধ তাদের। ব্যাঙের ছাতাও কত রকমের। এতক্ষণে একেবারে ঘোর জঙ্গল। মাথার উপর পাতার ছাতা। তার ফুটো দিয়ে যেটুকু আলো ঢোকে, সেই আলোছায়ার পথ ধরে এগিয়ে চলে মনসা। পথও ঠিক পথ নয়, কোথাও মাটি, চারটে-ছটা পাথর দেখা যায়, কোথাও সব ঢেকে গেছে কচি কচি পাতায়।অবাক হয়ে এগিয়ে চলছিল মনসা। হঠাৎ সুঁড়িপথ আটকে একটা কাঠের কুঁড়ে। এমন ভাবে জঙ্গল-ঘেরা যে একহাত দূর থেকেই প্রায় বোঝা যায় না। আর তার সামনে হুঁকো হাতে বসে এক আদ্দিকালের বুড়ো। মনসাকে দেখেই এক হুঙ্কার ছাড়লেন, কে তুই! এখানে এসেছিস কেন? মনসা দুরদুড়িয়ে পালাতে যাবে, কিন্তু বিধি বাম। একটা লতায় লেগে হোঁচট খেয়ে পড়ল ধড়াম করে। পা টা জড়িয়ে গেছে লতাপাতার মধ্যে। আর খুব জোর লেগেছে, উঠতেই পারছে না। ব্যথায়, ভয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল মনসা। ততক্ষণে বুড়ো উঠে মনসার কাছে চলে এসেছে। বাচ্চা মেয়ে , কাঁদছে দেখে বুঝি গলাটা একটু নরম হল। দেখি কি হল, বলে লতাপাতা ছাড়িয়ে মনসার পাটা টেনে বার করলেন। তারপর মাটি থেকে টেনে তুলে কোলে করে নিয়ে গেলেন ঘরে। বসিয়ে দিলেন বিছানার উপরে। ঘরে ঢুকে কিন্তু মনসার কান্না বন্ধ হয়ে গেছে। একটা চওড়া বারান্দা পেরিয়ে ঘর - বেশ বড়সড় ঘরটা – তাতে একটা বিছানা আছে আর একটা দড়িতে গামছা আর কটা জামা কাপড় ঝুলছে। ঘরের প্রতিটা ইঞ্চি ঢাকা পড়ে আছে বিভিন্ন গাছে। শুধু মেঝেই নয়, যেখানে যেটুকু দেওয়াল আছে সেখানেও বাঁশের তাক বানিয়ে তাতে ঝুলছে গাছ। আর ঘরের আধাআধি জুড়ে একটা বিরাট মাচা রয়েছে উপরের দিকে – তার থেকে সরু জালের মধ্যে ঝুলছে বিভিন্ন গাছের শিকড়। শুকনো, আধা শুকনো। বুড়ো মানুষটা ঘরে ঢুকেই এটা ওটা সেটা টেনে কি করছিলেন – এবার হাতে করে দুটো খল নিয়ে এসে একটা ওর পায়ের উপর লাগিয়ে দিলেন। আর একটা খল ওর হাতে দিয়ে বললেন, চেটেপুটে খেয়ে ফেল দেখি। বাধ্য মেয়ের মত খেয়ে নিল মনসা। নাঃ এখন আর ঠিক আগের মতন ভয়ানক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। প্রশ্ন করে করে জেনে নিলেন কাদের বাড়ির মেয়ে, কোথায় এসেছে। বামুনদাদুর কথা শুনে চিনতেও পারলেন। খানিকটা সাহস সঞ্চয় করেই মনসা জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? বুড়োর হাসি মুখে বলল, আমি কোবরেজ। এই বার আরেকটু সাহস এনে মনসা জানতে চাইল, এত গাছ কেন তোমার ঘরে? এই বার বুড়ো হা হা করে হেসে বলল, ঘর কি রে! এটা দেখে তোর ঘর মনে হচ্ছে? এটা আমার চিড়িয়াখানা। লোকে জানোয়ার পোষে আর আমি গাছ পুষি। বামুন দাদুর কাছে শোনা একটা কথা মনে পড়ে গেল মনসার – এবার বলে উঠল, তুমি কবিরাজ? তাহলে তুমিই বুঝি গাছ গাছালি দিয়ে লতায় কাটা মানুষদের সারিয়ে তোল? এই বার বুড়োর মুখটা একটু করুণ হল। “চেষ্টা করি রে মা, চেষ্টা করি। কিন্তু এখনো সব রুগীকে সারিয়ে তুলতে পারি না। “ “আমি জানি তুমি কেন পার না। তুমি বিষহরির পুজো করো না , তাই তোমার হাতে সব সাপের বিষ নামে না। তোমার কাছে বিষ ঝাড়ার পাথর আছে? দেখাবে আমাকে? “ – বলে ওঠে মনসা। ঠা ঠা করে হেসে ওঠেন বুড়ো মানুষটা। হাসির দমক কমলে বলেন, “আচ্ছা তোর কাছে তাহলে বিষহরির পুজোটা শিখে নেব। কিন্তু এখন তুই ওঠ দেখি , তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। আরও বেলা বাড়লে সবাই চিন্তা করবে। আর শোন, এই সব গাছ পালার কথা বাড়ি গিয়ে বলবি না যেন।“ “বা।রে! আমি যে তোমার সব গাছগুলো দেখব। “ “না না এখন নয়। এখন তোকে বাড়ী দিয়ে আসি। কাল সকালে আবার নিয়ে আসব তোকে। তখন দেখিস, কেমন তো? “ নতুন দাদুর কোলে চেপে বাড়ী ফিরে এল মনসা। 

কদিনের জন্য এসেছিল মনসা। কিন্তু ফিরে যাওয়া মুলতুবী রাখতে হল। ধারে পাশের সব পাহাড়ের কোলের গ্রামই উচ্ছেদের নোটিস পেয়েছে। সবাই তল্পি তল্পা গোটাচ্ছে। তারই মাঝে যেই বামুন দাদার আসার খবর পাচ্ছে, সেই বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করে পাঠাচ্ছে। সব বাড়িতে কচি মেয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই মনসা রয়ে গেছে এখানেই। বাসের লোকদের দিয়ে বাড়িতে খবর পাঠান হয়েছে। মনসার ভারী মজা - নতুন দাদুর সঙ্গে ভাব গাঢ় হয়ে উঠল। বাড়িতে শুনেছে নতুন দাদুকে সবাই পাগলা কবিরাজ বলে। কবিরাজীর সুখ্যাতি আছে। ওঁর ওষুধে নাকি মরতে-বসা রুগীও আবার চাগাড় দিয়ে উঠে পড়ে। রাজার মাও এঁর ওষুধ ছাড়া খেতেন না। তবে অত ভালো কবিরাজ হলে কি হবে, একেবারে পাগল - গাছ-পাগলা। লোকের বাড়ির গাছ কাটার খবর পেলেই গিয়ে বাধা দেন। ওঁর জ্বালায় এ দিগরে লোকের গাছ কাটাই এক মহা বখেরা হয়ে উঠেছে। নিজের বাড়িটাকেও দেখো না! বাপের আমলের অত সুন্দর বাগানটাকে কেমন ঘন জঙ্গল বানিয়ে ফেলেছে। লোকের মুখে মুখে নামই হয়ে গেছে পাটলছড়ির জঙ্গল-বাড়ী। পাগল ছাড়া আর কি! অত অত গাছ সব নতুন দাদু নিজে হাতে করে জোগাড় করেছে। মাসে কিছুদিন ঘরে থাকে, রুগীপত্তর দেখে – একটু পয়সা জমলেই বেরিয়ে পড়ে জঙ্গলে। সঙ্গে থাকে একটা আদ্যিকালের পুঁথি। সে নাকি দাদুর গুরুদেবের বই। তিনি নাকি জানতেন কোন গাছড়ার রস খাওয়ালে তীব্র বিষধর সাপেরও কামড়ে কিছু হয় না। আরও অনেক কিছু জানতেন তিনি। তাঁর বলে যাওয়া সেই সব বিভিন্ন অমুল্য গাছেরই সন্ধান করে চলেছেন দাদু। এই গোটা গারো-খাসিয়া পাহাড় জুড়ে। মনসার অজস্র প্রশ্ন সেই সব গাছ নিয়ে। দাদুও যত্ন করে চেনান ওকে। কোন গাছে কি হয়, তার পাতা, মুল কি দেখে চিনবে – কিসের থেকে কি অসুখ সারে। বাচ্চা মেয়ে , কতটুকু মাথায় রাখতে পারে তা জানা নেই, কিন্তু ভারী মন দিয়ে শোনে। শুধুই কি আর ওষধির গাছ! কত যে এমনি গাছও ঠাঁই পেয়েছে এই জঙ্গলে। মনসা অবাক হয় – বলে ও দাদু এ গাছের তো কোন গুণই নেই – একে তুলে এনেছ কেন? দাদু লাজুক হেসে বলেন, ভগবানের দান মা রে, ফেলে চলে আসছিলাম, পিছন থেকে খোঁটা টেনে ধরল – কি করি! মনসা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে । 

অবশ্য চুপ করে বসে শুধু জমিয়ে গল্প কি আর হয়। রুগী-পত্তরের লাইন লেগেই আছে, এর নাড়ি দেখেন, ওর চোখের পাতা টেনে দেখেন, তার পেট টেপেন। তারপর খল নুড়ি নিয়ে ঘস-ঘস করে ওষুধ তৈরি করেন, রুগীকে খাওয়ান। মাচার থেকে খুঁজেপেতে শুকনো শিকড় পেরে আনেন – পুলিন্দায় বেঁধে দিয়ে দেন। মনসা হাতে হাতে সাহায্য করে। আর হাজারটা প্রশ্ন করে। এটা কি, ওটা কি করে ? দাদুও কাজ করতে করতে উত্তর দেন। তারপর বেলা বাড়লে মনসাকে পৌঁছে দেন বাড়ীতে। বামুন দাদু বাড়ি থাকলে দাওয়ায় বসে এক ছিলিম তামুকও টানেন দুই জনে। বামুন দাদু জানতে চান, গোছগাছ শুরু করলেন কিনা? কোথায় যাবেন, কার আছে উঠবেন ? নতুন দাদু ছিলিমে গুড়ুক গুড়ুক টান দেন আর সংক্ষেপে বলেন , ভাবছি, ভাবছি একটু তামুক খেয়ে মাথাটা পরিস্কার করতে দাও দেখি! বামুন দাদু তাও নাছোড়বান্দা হয়ে বলেই চলেন, এ বাড়ীর কর্তা বলছিলেন যে এঁনারা তো সব সদরে জমি জিরেত ঘর বাড়ি করে নিয়েছেন – সেখানেই গিয়ে উঠবেন, তা আপনি গেলে তো আপনাকে মাথায় করে রাখবেন। আপনি নাকি সে কথা কানেই তোলেন না। নতুন দাদু একটু রেগে বলেন, আরে আমি হলাম রাজার তুতো কাকা – রাজবাড়ীর কবিরাজ – আমার কি অন্যের বাড়িতে গিয়ে ওঠা মানায়। এইবার বামুন দাদু চটে ওঠেন, দ্যাখেন কর্তা, জীবনে আপনাকে কখনো রাজার নাম নিতে শুনি নি, এখন নেন কেন? এই সব ফ্যাদরা কথা রাখুন। যাবেন না তাই বলুন। নতুন দাদু কিছু উত্তর দেন না। শুধুই মাথায় হাত বোলান আর তামাক টানেন। বামুন দাদু আবার বলেন, কাঁঠালতলির ওদিকে আমার দু চার ঘর যজমান আছে, তার বলছিল ওরা নাকি গ্রামসুদ্ধ সবাই চলে যাবে পাহাড় পেরিয়ে, আরও ওদিকে। এদিকে তো আর সীমানার তেমন কড়াকাড়ি নেই। দরকারে সীমানা পেরিয়ে চলে যাবে ওদিকে। সবটাই তো ঘন জঙ্গল – আবার নতুন করে জমি বানিয়ে জুম চাষ শুরু করতে পারলেই হল। জঙ্গল শুনে নতুনদাদুর চোখটা একটু চক চক করে ওঠে। পরক্ষণেই মন দিয়ে তামাক টানতে থাকেন। বামুন দাদু বলেন, বলি ওদের? আপনি যাবেন ওদের সাথে? অনেকক্ষণ পরে নতুন দাদু মুখ তুলে বলেন, ভাবি আর একটু। তারপর বলবখন। 

কেউ যখন থাকে না কাছে পিঠে, তখন মনসা জিজ্ঞেস করে, ও দাদু, তুমি ভাবলে? কোথায় যাবে? দাদু বলেন, কোথায় যাব বলতো দিদিভাই? আমি তো পালিয়ে বাঁচব, কিন্তু সারা জীবন ধরে যাদের এনে এনে জড়ো করলাম এই বাগানে, তাদের কি হবে রে? তাদের বাঁচাব কি করে? এই যে ঘর ভরা সব গাছ, এদেরই বা নিয়ে যাব কি করে? কতগুলো গাড়ী লাগবে বলতো এদের কোথাও নিয়ে যেতে? অত পয়সা কোথায় আমার? মনসা বুদ্ধি দেয়, তুমি রাজাকে বল না? তিনি যদি তোমার গাড়ীর বন্দোবস্ত করে দেন! করুণ হেসে বলেন দাদু, রাজা ! রাজা আর কি করবে? একটা কথা বলতে শুনেছে কেউ তাকে? এই তামাম পাহাড়ের সব মানুষ তাকে রাজা ডাকে – অথচ তাদের বাড়ী ছাড়া করার আগে একটি বারও ভাবল সে? আর সে কি শুধু কি সে মানুষের রাজা? এই পাহাড় জঙ্গল গাছপালা পশু পাখি – এদের রাজা নয় সে? তাদের কথা একটি বার সে ভাবল না? এই সব বলি বলে ওরা আমাকে পাগল ভাবে রে! ওরা আমার গাছের জন্য কুটোটি নাড়বে না । আর গাড়ী দিলেই বা কি? পাহাড়ী জঙ্গলের গাছ কি সমতলে বাঁচে? আর তাছাড়া যে গাছগুলো মাটিতে পোঁতা, তারা যাবে কেমন করে? এই গাছগুলোকে ঘিরে সারা দিন পাখিরা খেলা করে, কাঠবিড়ালী ঘোরে, যেখানে মানুষ যায় না, সেখানে শিয়াল ঘোরে – তারা যাবে কোথায়? বলতে বলতে গলা ধরে আসে নতুন দাদুর! মনসার বুকের মধ্যে কেমন গিঁট পাকিয়ে ওঠে। ছোট্ট ছোট্ট হাতে ও শুধু দাদুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। 

।। ৩।। 

বাড়ী ফিরে আসতে হয় মনসাকে। বামুন দাদুর কাজকর্ম এখনকার মত শেষ হয়েছে। বাড়ী ফিরে দেখে ওদের গ্রামেও কত নতুন লোক এসে ভিড় করেছে। পীরের মাজারে যাওয়ার পথের সেই ঘন বাঁশবন প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে – উঠেছে রাশি রাশি দরমা আর চাটাইর বেড়ার ঘর। পাহাড়ের থেকে লোকজনের ঢল নামছে সমতলে। ওদের পাঠশালাতেও কত নতুন ছেলে মেয়ে এসেছে। তাদের নাকি আদিবাসী বলে। তারা নাকি হিন্দুও না, মুসলমানও না, তারা হল বৌদ্ধ। এবার আর মনসা অবাক হয় না। নতুন করে বন্ধু পাতাতে শুরু করে সবার সাথে। 

হঠাৎ একদিন গ্রামে শোরগোল শুরু হয়। নদীর বাঁধের সব কাজ শেষ। এবার জল ছাড়ার সময়। দিনক্ষণ সব ঠিক হয়েছে। আগামী পরশু সকাল আটটায়। শেষ যারা নেমে এসেছে পাহাড় থেকে, তারাই খবর এনেছে। মনসা ছুটে যায় বাঁশ বাগানে। জনে জনে জিজ্ঞেস করে তারা নতুন দাদুর খবর জানে কিনা! কিন্তু না, কেউ কোন সদুত্তর দিতে পারে না। মুখ শুকিয়ে ঘুড়ে বেড়ায় মনসা। বামুন দাদু সান্ত্বনা দেন, নিশ্চয় কোন দলের সঙ্গে নেমে এসেছে পাহাড় থেকে। হয়তো পাহাড় পেরিয়ে ওদিকে চলে গেছে। রাজবাড়ীর কিছু জন তো ওদিকে গেছে বলে খবর। মনসা সান্ত্বনা পায় কিনা বোঝা যায় না। 

তারপর সেই দিন এল। জল ছাড়া হচ্ছে বলে শোনা গেল রেডিওর খবরে। এবার নাকি এত বিদ্যুৎ তৈরি হবে যে সবার ঘরে ঘরে সুইচ টিপে আলো পাখা চলবে। চাষের জমিতে জল দিতে আর মানুষের মেহনত লাগবে না। সব মুশকিল আসান করবে বিদ্যুৎ। হাটে-বাজারে সেই সব গল্প শুনে বাড়ি আসে মনসার বাবা। রাতের বেলা বৌ-মেয়েকে শোনায় সে সব গল্প। বাবার মুখের চওড়া হাসি দেখেও হাসি ফোটে না মনসার মুখে। বরং তার মুখে ফুটে ওঠে তার মনের উথালপাথালের খবর। নতুন দাদুর কোন খবর মেলে নি। চেনা শোনা কোন দলের সঙ্গেই নামেন নি তিনি। উত্তর মুখে যারা রওনা দিয়েছে, তারা দুদিন তিন আগেই বেরিয়ে পড়েছে, গাড়ীতে চেপে, পায়ে হেঁটে, গাধা-গরুর পিঠে মাল পাত্র চাপিয়ে। তাদের দলেও গেছেন বলে কেউ দেখে নি। নামী মানুষ – কবিরাজ হিসেবে তাঁর নামডাক ছিল পাহাড়ের সব গ্রামেই। তাই তাঁকে কেউ চিনবে না এমন সম্ভাবনা কম। 

একটু বেলার দিকে বাস নেমে এল পাহাড়ের মাথার থেকে – জানিয়ে গেল রাজার বাড়ী ডুবে গেছে গো – জল উঠছে উপর পানে। মনসার চোখ দিয়ে অঝোর ধারে জল নেমে আসছে। বামুন দাদু ওকে জড়িয়ে ধরে আছেন। হঠাৎ একটা বিস্মিত চিৎকার ছিটকে এল ভিড়ের ভিতর থেকে! পাহাড়ের যে জায়গাটা আজ জলে ভরে ওঠার কথা, সেখানে পাহাড়ের মাথার উপর দিয়ে কি দেখা যাচ্ছে? আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠছে – একটা আবছা কিছু বিশাল জিনিস। একটা বিশাল বড় বুদবুদ মত – তার ভিতরেও কিছু রয়েছে। এতটাই বড় সে বুদবুদ যে এত দুরের থেকেও চোখে ধরা পড়ছে। সূর্যের আলো লেগে ঝকঝক করছে – ভিতরে গাঢ় সবুজ সবুজ ছোপ দেখা যাচ্ছে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখার পরে মনসা চিৎকার করে উঠল, আরে এতো পাটলছড়ির জঙ্গল। নতুন দাদুর বাড়ী ! ওই তো ঘরের পাশের ঝুড়ি নামানো বটগাছটা! শুনে সবাই ভালো করে ঠাহর করল। মন দিয়ে কিছুক্ষণ দেখার পরে একটা গুঞ্জন উঠল – ঠিক, ঠিক, সে রকমই লাগে বটে! ততক্ষণে সে বুদবুদের উপরের আস্বচ্ছ আবরণ খসে পড়েছে – জল পেরিয়ে পাহাড় টপকে ভেসে আসছে একটি আশ্চর্য উড়ন্ত কার্পেট – তার নীচের দিকে ঝুলে রয়েছে অজস্র গাছের মুল – উপরের দিকে গাছের পাতাগুলি হাওয়াতে দুলছে, পাখির ঝাঁক ডানা দিয়ে আড়াল করে রয়েছে চড়া সূর্যের আলো – কার্পেটের এক ধারে রয়েছে নতুন দাদুর ঘরটি – আর দাওয়াতে হুঁকো হাতে বসে আছেন নতুন দাদু। মুখে শান্তির হাসি। কাঠবিড়ালী ঝামরলেজটি মাথার উপর তুলে বসে আছে তার পাশে। মনসার দিকে হাত নাড়তে নাড়তে ধীরে ধীরে ভেসে যেতে লাগলেন উত্তরপূর্বে । আর মনসা কানের মধ্যে শুনতে পেল দাদুর গমগমে গলা, দিদিভাই চললাম নতুন ঠিকানার খোঁজে। দেখি কোথায় ঠাঁই মেলে! গুছিয়ে বসে পাখির মুখে তোকে খবর পাঠাবো ঠিক। তখন আবার আসিস দাদুর কাছে। 

গ্রাম শুদ্ধ সব লোক হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এমন আশ্চর্য ঘটনা তারা কখনো দেখে নি। মনসা উত্তেজনায় খামচে ধরে বামুনদাদুর হাতটা। ও দাদু, জায়গা পাবে তো? 



0 comments: