প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
ধ্রুব জাতক
অনিন্দিতা মণ্ডল
পর্ব ২
এমন অদ্ভুত এক ঘোরে সুদত্ত আবিষ্ট হলেন যে তিনি শ্রাবস্তীতে এসেই তথাগতর উপযোগী একটি স্থান নির্বাচনে উদ্যোগী হয়ে পড়লেন। সন্ধান পাওয়া গেলো একটি অতীব রমনীয় উদ্যানের। সেটি জেত কুমার নামে এক ধনী ব্যক্তির। সুদত্ত চললেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তিনি মনে মনে স্থির করে ফেলেছেন যে এই উদ্যানটিই তাঁর চাই। এমন রম্য উদ্যান বিনা তিনি বুদ্ধকে কোথায় প্রতিষ্ঠা করবেন? কিন্তু হায়। জেত কুমার এই উদ্যানটির সম্পর্কে ভীষণ মায়া পোষণ করেন। এ উদ্যান তিনি কোনও ভাবেই সুদত্তকে বিক্রয় করতে পারেননা। ক্রমে দুপক্ষেই ভীষণ রকমের বাদ প্রতিবাদ চলতে লাগল।
অনাথপিণ্ডদের পাঁচশত বন্ধু ছিলেন। এঁরা প্রত্যেকেই শ্রাবস্তীর বিত্তশালী বণিক। সকলেই কোনও না কোনও শ্রামনিক ধর্মের আশ্রয়ে আছেন। অনাথপিণ্ডদ একদিন প্রাতে নিদ্রা ভঙ্গ হলে তাঁর গৃহের প্রাঙ্গনে সম্প্রতি যে শ্বেতমর্মরের বুদ্ধ মন্দিরটি রচনা করেছেন সেখানে বসে বুদ্ধ শরণের মন্ত্র ও ধুপ দীপ সহযোগে পুজা অর্চনা করছেন, এমন সময় তাঁর কতিপয় বন্ধুর আগমন ঘটল। তাঁদের দেখেই অনাথপিণ্ডদ ভাব্লেন নিশ্চয় জেত কুমার কোনও সনবাদ পাঠিয়েছেন। এই মহাপুরুষ তথাগতর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। সে সময় তাঁর মনে বিহার স্থাপনের চিন্তা ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। কিন্তু বন্ধুরা সম্পূর্ণ অন্য কথা বললেন। তাঁরা বললেন – ওহে শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডদ, জেত কুমার যে কোটি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়েও ও কানন হস্তান্তর করবেন না। তুমি ও আশা ছাড়ো। শ্রেষ্ঠী বুঝতে পারছিলেন, বুদ্ধের সদিচ্ছার প্রভাব কতদুর যায় তা এঁরা অনুভব করতে পারছেন না। তিনি হতাশ হলেও মুখে সে কথা স্বীকার করলেন না। সেদিন কোনও মতে কাটিয়ে তিনি যখন নিশা আগমনে আহার শেষে তাঁর ক্ষুদ্র মন্দিরটির সম্মুখে বসে উপাসনারত, তখন হঠাত তাঁর মনে হলো একবার, আরও একবার জেত কুমারের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। বস্তুত এই উদ্যানটি কোশলরাজ প্রসেনজিতের কোনও কুমারের। উদ্যানটি সত্যিই বড় সুন্দর। অনাথপিণ্ডদ অতএব স্থির করলেন আরও একবার কথা বলবেন জেত কুমারের সঙ্গে।
সেদিন জেত কুমার দেখা করলেননা শ্রেষ্ঠীর সঙ্গে। তাঁর দুত এল শুধু। অনাথপিণ্ডদ অধীর অপেক্ষায় বসেছিলেন। জেত কুমার না এলেও দূতমুখে এক প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী শ্রেষ্ঠী যদি এতটাই আগ্রহী হয়ে থাকেন তবে তিনি বরন তাঁর উদ্যানভূমিকে স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে ঢেকে দিন। কারন জেত কুমারের কাছে এই উদ্যান থিক ততটাই প্রিয় যতটা একজন শ্রেষ্ঠীর কাছে তাঁর আহৃত স্বর্ণমুদ্রা। দূত দাঁড়ালো না। অনাথপিণ্ডদ লক্ষ করলেন তাঁকে বিরত করতে জেত কুমার যত রকমের পথ হয় সবই অবলম্বন করছেন। তিনি দূত দ্বারা বার্তা বিনিময় করে তাঁকে অপমান করে, উদ্যানের অদ্ভুত বিনিময়মূল্য ধার্য করে অনাথপিণ্ডদকে প্রকারান্তরে প্রত্যাখ্যান করছেন। তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ হলেও অসফল হতে বাধ্য।
অনাথপিণ্ডদ সেদিন ভারী খুশি মনে গৃহে ফিরলেন। তথাগতকে অদেয় তাঁর কিছুই নেই। স্বর্ণমুদ্রার আর মূল্য কি? সেই দুটি কমল নয়নের স্নিগ্ধ সর্বদুঃখহর দৃষ্টি, সেই স্মিত অধরের স্নেহপরশ, সেই সুললিত কণ্ঠের করুণাধারা, তার চেয়ে বেশি কি আছে স্বর্ণমুদ্রায়?
পরদিন প্রভাতে শ্রাবস্তী নগরী হতবাক। স্তব্ধ বিস্ময়ে সকল নাগরিক নিজের নিত্যকর্ম স্থগিত রেখে এসেছেন জেত বনে। এক অভাবনীয় দৃশ্য। গোশকটে করে স্থলীবন্দী স্বর্ণমুদ্রা আসছে উদ্যানে। একদিকে শান্ত স্থির অনাথপিণ্ডদ দাঁড়িয়ে। তাঁর নির্দেশে সেই সব মুদ্রা ঢেলে পরম যত্নে বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে উদ্যানভূমিতে। উদ্যানের ভূমি সূর্যালোকে এক অপূর্ব সৌন্দর্য ধারন করছে। যেন অমরাবতী। নাগরিকগণের মধ্যে ক্রমে মৃদু থেকে উচ্চকিত, গুঞ্জরন থেকে জয়ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে। অনাথপিণ্ডদের জয়। তাঁর মতন এমন মহান আর কে আছে শ্রাবস্তীতে!
চরের মুখে সনবাদ পেয়েছেন জেত কুমার। নাহ। উদ্যান আর রাখা যাবেনা। নিজের চোখে একবার দেখে আসতে হবে। তিনি শিবিকা বের করতে নির্দেশ দিলেন। পথে চলতে চলতে চারিদিকে সেই একই কথা শোনা যাচ্ছে। এই অল্পসময়ের যাত্রাপথেই জেত কুমারের মনের পরিবর্তন ঘটল। কে এই তথাগত? এমন মহান যে অনাথপিণ্ডদ তাঁর সর্ব সঞ্চয় ঢেলে দিচ্ছেন মাটিতে? কেমন তাঁর আকর্ষণ?
উদ্যান দুয়ারে পৌঁছে জেত কুমারের চোখে যেন ভ্রম লাগলো। এ যে মাটিতে দিবাকরের পুনরুদয়! তবে কি ধর্মের আকাশে নতুন সূর্য? তিনি অনুধাবন করতে পারেননি? শিবিকা থেকে নেমে তিনি ছুটে গেলেন অনাথপিণ্ডদের কাছে। জড়িয়ে ধরলেন তাঁর হাত। “ক্ষমা করো। শ্রেষ্ঠী, তোমার মতন মহান আর কে আছে? কী অদ্ভুত দৃশ্য! দয়া করো। আর একটিও মুদ্রা তুমি ভূমিতে রেখনা। তোমার ওই সম্পদের বিনিময়ে কতশত অনাথ অসহায় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের প্রাণরক্ষা হয়। ও মুদ্রা তুমি আর ভূমিতে রেখনা। আমি এ উদ্যান আর কোনও মুদ্রার জন্য বিক্রয় করবনা”। অনাথপিণ্ডদের মুখে স্মিত হাসির শিহর। এই ত তথাগতর অলৌকিক করুণা! জেত কুমার অর্ধমুল্যে উদ্যান দিয়ে দিচ্ছেন। তখন জেত কুমার বলে চলেছেন – তুমি মহান, শ্রেষ্ঠী তুমি মহত্তম! কিন্তু সুদত্ত তাঁকে থামিয়ে দিলেন- না, জেত কুমার। মহত্তম তিনিই, জিনি আগামী বর্ষায় এ উদ্যানে এসে আমাদের করুণা করবেন। আসুন আমরা মিলিতভাবে তাঁর জন্য বিহার নির্মিতিতে মন দিই।
ক্রমশ
0 comments: