0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক 


গার্ড (অনুবাদ গল্প) 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 


৮ 

‘বোকা ছেলেটা!’ শুধু এইটুকু বলে চুপ করে গেলো ঠীল, কারণ ঠিক তখনি তার গায়ে গাছের গুঁড়ির ছালের ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো খসে পড়ল। 

ঠীল আর টোবিয়াস যখন ফিরল, লেনা তখনো মাটি কোপাচ্ছিল। অর্ধেকের বেশি জমি সে খুঁড়ে ফেলেছিল ততক্ষণে। কিছুক্ষণ পর পর ট্রেন যাচ্ছিল; প্রত্যেকবার টোবিয়াস মুখ হাঁ করে দেখছিল। লেনাও মজা পেয়েছিল ট্রেনের যাওয়া আসায়। সেও প্রত্যেকবার কাজ থামিয়ে অদ্ভুত মুখ করে ট্রেন দেখছিল। 

শুয়োরের মাংসের ঠাণ্ডা রোস্ট আলু দিয়ে খেয়ে দুপুরবেলায় ওরা সবাই জিরিয়ে নিচ্ছিল ঠীলের গার্ড- কেবিনে বসে। ঠীল সহজ ব্যবহার করবার চেষ্টা করছিল লেনার সঙ্গে। টুকটাক নানা কথা বলছিল তার কাজ নিয়ে, তার ডিউটির ব্যাপারে। লেনার হাঁ-মুখ বন্ধ হচ্ছিল না এটা জানতে পেরে যে একখানা রেলওয়ে ট্র্যাকের মধ্যে ছেচল্লিশখানা স্ক্রু থাকে! 

সকালবেলায় লেনা মাটি খুঁড়েছিল; বিকেলে ক্ষেতের মধ্যে আলু বুনে দিয়ে তবে তার কাজ সারা হবে। সে চাইছিল টোবিয়াস যেন একটু ছোট বাচ্চাটার কাছে বসে; ঠীল যেন এবেলা টোবিয়াসকে সঙ্গে নিয়ে চলে না যায়। 

‘ঠিক আছে।’ ঠীল যেতে যেতে আবার কি মনে করে ফিরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘সাবধান! রেলওয়ে ট্র্যাকের কাছাকাছি তোমরা কেউ যেওনা কিন্তু!’ 

প্রত্যুত্তরে লেনা কাঁধ ঝাঁকালো। 

ঠীলকে শীগগিরই রেলগেটের কাছে যেতে হবে। সাইলেশিয়ান এক্সপ্রেস ট্রেনটা এখনই আসবে। সিগনাল হয়ে গেছে। ঠীল গেট বন্ধ করে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেখতে পেল ট্রেনটা আসছে। 

ট্রেনটা দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে আসছে একটা দানবের মত। কী প্রচণ্ড শক্তিতে বাষ্প বেরিয়ে আসছে এঞ্জিনের চিমনির কালো খোলামুখ দিয়ে। দুধ- সাদা বাষ্প বেরিয়ে এলো ফোয়ারার মত, তারপর ভীষণ জোরে হুইস্‌ল বেজে উঠলো। এক, দুই, তিন, হ্যাঁ, তিনবার বাষ্প বেরিয়ে এলো আর পর পর তিনবার হুইস্‌ল বেজে উঠলো তীক্ষ্ণ শব্দে। তার পর ইঞ্জিনটা ব্রেক কষল ভয়ঙ্কর শব্দে। কেন? ঠীল বুঝতে পারছিলনা কেন হঠাৎ ট্রেনটা ব্রেক কষলো! তারপর আবার এমারজেন্সি হুইস্‌ল বাজলো, এবার একটানা বাজতে লাগলো, একটুও না থেমে। 

ঠীল ট্র্যাকের কাছে ট্রেনের সামনের দিকে তার গার্ডের লাল পতাকাটা নিয়ে এগিয়ে গেলো নিয়মমাফিক। পতাকাটা লাগাতে গেলো সে ট্র্যাকের সামনে... হা ঈশ্বর! হায় পরমপিতা যীশু! সে কি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল? হা ভগবান, হায় যীশু, যীশু, যীশু... রক্ষা কর ভগবান... বাঁচাও ঈশ্বর, তুমিই পারো... কী? কী ওটা? ট্রেনের সামনে রবারের বলের মত ধাক্কা খেয়ে ট্র্যাকে পড়ে আছে! হা ঈশ্বর! ‘ওইখানে’... সর্বশক্তি দিয়ে গার্ড চিৎকার করে উঠল। বড্ড দেরি হয়ে গেছে কি? ট্রেনটা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেছে স্থির। ওই তো... ব্রেকের ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজটা এখনো মিলিয়ে যায়নি। 

নিস্তব্ধ অরণ্যের মাঝখানে রেলওয়ে ট্র্যাকটা যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ট্রেনের ড্রাইভার, কনডাকটার, স্টাফেরা সব্বাই ট্র্যাকের নুড়িপাথরের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এসেছে ট্রেনের সামনে। ট্রেনের জানালা দিয়ে ভিতরে অজস্র কৌতূহলী চোখমুখ দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ মাথা বের করে সামনের দিকে দেখবার চেষ্টা করছে। ভীষণ ভিড় হয়ে গেছে চারদিকে হঠাৎ করে। 

ঠীল ভীষণ হাঁপাচ্ছিল। সে কি পড়ে যাবে? চারদিকে এত ভিড় কেন? না, তাকে এখন হেরে যাওয়া মোষের মত পালিয়ে গেলে চলবে না। শক্ত হতে হবে। না, হারতে পারবেনা সে, ভেঙ্গে পড়তে পারবেনা। সত্যিই... উঠে দাঁড়াও, সে নিজেকে বলছিল। অ্যাকসিডেন্টের জায়গাটা থেকে কেমন যেন একটা জান্তব গোঙানির আওয়াজ আসছিল। কে ওটা? কার কণ্ঠস্বর? লেনা? নাহ... লেনার গলা এরকম নয়। কে?... বেঁচে আছে, এখনো বেঁচে আছে। 

একটা লোক ট্র্যাকের উপর দিয়ে দৌড়ে এলো। 

-‘গার্ড!’ 

-‘আজ্ঞে, বলুন।’ 

-‘একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।’ ভয়ার্ত গলায় লোকটা বললো। গার্ড কেমন অদ্ভুতচোখে তাকিয়ে ছিল লোকটার দিকে। গার্ডের টুপিটা বেঁকে গিয়েছে। চুলগুলো এলোমেলো। গার্ডের মাথায় কিছু ঢুকছিল না। রেলওয়ে স্টাফের মেসেঞ্জার এসে গার্ডকে বোঝাচ্ছিল... ‘দুর্ঘটনা! বুঝলে তো? বেঁচে আছে এখনও। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা পড়লে বেঁচে যাবে।’ 

উত্তরে গার্ডের গলা দিয়ে একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরিয়ে এলো। 

-‘তাড়াতাড়ি এসো। তাড়াতাড়ি!’ লোকটা বোঝাচ্ছিল। 

ঠীল শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। তার পেশীগুলো কঠিন হয়ে আছে। সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছেনা। কেমন শূন্য, হাবাটে চোখের দৃষ্টি, মুখটা মরা মানুষের মত। 

ঠীল মেসেঞ্জারের সাথে দৌড়াতে থাকে। সে ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা আতঙ্কিত, ভয়ার্ত মুখগুলো দেখতে পায়না। এক যুবক, এক হকার, এক দম্পতি যারা মধুচন্দ্রিমা করতে বেরিয়েছে– সবাই, সবাই কেমন অদ্ভুতভাবে ট্রেনের জানালা দিয়ে মুখ বাড়ায়। গার্ড ঠীল জানেনা এই এক্সপ্রেস ট্রেনটার খুপরি খুপরি কামরাগুলোর ভেতরটা ঠিক কিরকম! ঠীল দৌড়ায়। হঠাৎ তার কানে এসে ঢুকতে থাকে লেনার আর্তস্বরের কান্না আর চিৎকারের আওয়াজ। তার চোখের সামনে অজস্র হলুদ রঙের বিন্দু ফুটে উঠতে থাকে। ঠীল হতবাক, বিস্মিত চেয়ে থাকে। হলুদ রঙের বিন্দুগুলোর মধ্যে দিয়ে একটা মুখ সে দেখতে পায়। ফ্যাকাসে কপালে কালশিটে, নীলচে ঠোঁটের নিচে রক্তের দাগ। উফফ... হ্যাঁ, ও... 

ঠীল কথা বলতে পারেনা। তার মুখ একেবারে ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য হয়ে গেছে। অচেতনভাবে হাল্কা হাসির রেখা ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে। সে বেঁকে বসে পড়ে। তার হাতের মধ্যে তুলে নেয় ওকে। উফফ, এত ভারি লাগছে কেন ওর ছোট্ট শরীরটা? 

‘এখন ওকে নিয়ে যেতে হবে।’ মেসেঞ্জার বলে। 

‘কোথায়?’ ঠীল প্রশ্ন করে। 

‘রেলের ডাক্তারের কাছে।’ মেসেঞ্জার কেমন অদ্ভুতভাবে বলে। 

‘আমরাই নিয়ে যাচ্ছি।’ রেলের একজন স্টাফ একটা রেল সার্ভিস ওয়াগন নিয়ে হাজির হয়... ‘এখনই’। 

ঠীল ওকে যেতে দেবে কিনা বুঝতে পারেনা। ওকে ঝাঁকায়। কোনও সাড়া পায়না। 

একটা স্ট্রেচার নামিয়ে নিয়ে আসে ওরা সার্ভিস ওয়াগন থেকে। চেঁচিয়ে বলে আরেকজন লোককে ঠীলকে সাহায্য করবার জন্য। 

সময় বেরিয়ে যাচ্ছে। সময় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ট্রেনে হুইস্‌ল বেজে ওঠে। ট্রেনের জানালা থেকে কারা যেন পয়সা ছুঁড়ছে। লেনা পাগলের মত চিৎকার করছে। ট্রেনের কামরা থেকে রব ওঠে, ‘ওই যে মা! আহা গো!’... লোকে চেঁচিয়ে বলে, ‘ইসস... উফফ, হায় রে... আহা, মায়ের কী অবস্থা গো!’ 

ট্রেনের ড্রাইভার আবার হুইস্‌ল বাজায়। আওয়াজের সাথে সাথে আবার ধোঁয়া বেরিয়ে আসে। ট্রেনের এঞ্জিনের চাকার সঙ্গে লেগে থাকা ধাতব দণ্ডগুলি সঙ্কুচিত-প্রসারিত হতে থাকে। চাকাগুলো আবার নড়ে ওঠে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ভীষণ গর্জন করে দ্বিগুণ বেগ তুলে ট্রেনটা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে চলে যায়। 

ঠীলের মাথায় তখন কোনো কথাই ঢুকছিল না। আধমরা ছেলেটাকে সে স্ট্রেচারে শুইয়ে রেখেছিল। ছেলেটার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া জামার নিচে, রুগ্ন পাঁজরের নিচে খুব জোরে জোরে শ্বাস উঠছিল, পড়ছিল। হাত পাগুলো একদম ভেঙ্গে গিয়েছিলো দুমড়ে। হাতগুলো স্ট্রেচারের বাইরের দিকে ঝুলছিল। 

লেনা হাঁউমাউ করে কেঁদে কেঁদে কি যেন বলছিল। তার মুখরা, উদ্ধত স্বভাবের চিহ্ন ফুটে ফুটে বেরিয়ে আসছিল এই চরম বিপদের সময়েও। সে বার বার বলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল যে কীভাবে ব্যাপারটা ঘটে গেলো; বারে বারে প্রমাণ করবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল যে পুরো ব্যাপারে তার কোনও হাত ছিল না। 

ঠীলের মাথায় এসব কিছুই ঢুকছিল বলে মনে হয়না। সে কিছুই শুনছিল না। একদৃষ্টে বিস্ফারিত চোখে সে ছেলের দিকে তাকিয়েছিল তখন। 

চারদিক একদম নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। মৃত্যুর মত একটা নৈঃশব্দ ঘিরে আছে যেন। নুড়িপাথরের উপরে কালচে, গরম রেলওয়ে ট্র্যাক শুনশান শুয়ে আছে। দুপুরবেলার পর থেকে চারদিকে কোনও বাতাস নেই। কিচ্ছু নড়ছেনা কোথাও। জঙ্গলের গাছপালাগুলো অবধি পাথরের মত স্থির হয়ে আছে। 

চারপাশের লোকগুলো ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে তাড়াতাড়ি ফ্রিডরিশহাগেনে ডাক্তারের কাছে পৌঁছাতে হলে উল্টোদিকে, মানে ব্রেসলাউয়ের দিকে এক স্টেশন গেলে ভালো হয়। কারণ এর পরের যে প্যাসেঞ্জার ট্রেনটা আসছে, সেটা আবার ফ্রিডরিশহাগেনে থামে না। 

ঠীল সঙ্গে যেতে চায়, কিন্তু এখানে সে কার কাছে নিজের ডিউটি বুঝিয়ে দিয়ে যাবে? কীভাবে যাবে সে? সে লেনার দিকে ইশারা করে। লেনার নিজের দুধের বাচ্চাকে ফেলে যাবার ইচ্ছে না থাকলেও ঠীলের কথা অমান্য করবার সাহস হলনা। লেনা আরেকজন অচেনা লোকের সঙ্গে স্ট্রেচার বয়ে নিয়ে গেলো; গেলো ওয়াগনে ছেলের সঙ্গে। ঠীল নিজের ডিউটির এলাকার সীমানা অবধি গেলো সার্ভিস ওয়াগনের সঙ্গে; স্থির হয়ে দাঁড়ালো সেখানে। তাকিয়ে রইল ছেলের দিকে, যতদূর তার দৃষ্টি যায়। তারপর হঠাৎ নিজের কপাল চাপড়াতে শুরু করল। 


(চলবে) 

[গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘বানভ্যার্টার ঠীল’ গল্প অবলম্বনে রচিত] 

0 comments: