মুক্তগদ্য - অভিষেক ঘোষ
Posted in মুক্তগদ্য
মুক্তগদ্য
কুয়াশার দানা
অভিষেক ঘোষ
১
ঝুলন্ত পুকুরটার নীচ দিয়ে আমরা রাস্তা করেছিলাম। সে রাস্তা থেবড়ে দিয়ে একপাল গরুর পায়ে বর্ষা দাগ এগিয়ে যেতেই আমি বুঝলাম এসব বলার কথা নয়। নিঝুম মাঝে মাঝেই আমার পাশে এসে বসত।তার নাম জানতে চাইলে কিছুই বলত না,ঠিকানা পদবি সব আমিই ওকে দিলাম। আলোর চত্তরগুলো কেটে কেটে একটা লম্বা ইটভাঁটা হয়েছে এখানে। সেখান থেকে প্রতি রাতেই বরফের হাওয়া পাই গায়ে। জিভে ঠক ঠক শব্দ তুলে ঘোড়ার দল এগিয়ে যায়। রাজা রাজ্য শাসন সব কিছুই আমার হাতে তৈরি করি, আবার ভেঙে দিয়ে ঠাণ্ডা ছাদের কার্নিশে শ্যওলা পড়তে পড়তে যতগুলো দেয়ালে কবিতার পতাকা লাগিয়েছিলাম সব কটা নয় দেখি কিছু কিছু পতাকার গায়ে সমুদ্র পিক ফেলে ফেলে তাকে নোনতা করতে চাইছে। নিঝুম স্কুলে চলে গেলে আমি আরও কিছুটা বড় হয়ে উঠি, সিলিং ফ্যান মুছি, দড়ি ধুই, সাবান খেতে ইচ্ছে করে না খরগোশগুলোর তাই কেটে কেটে এক দুটো টমেটো খাওয়াই, খবরের কাগজে প্রজাপতি দেখলেই, চোখের সামনে বিয়ের কার্ড দেখলেই হলুদ আর সেন্টের গন্ধটা রুমালে ঘসে ঘসে টানিয়ে রাখি বারান্দায়।
দুপুর হলে এদিকটায় একজন শিল কাটাও বলে চিৎকার করে। তার মুখটা দেখতে পাইনি কোনওদিন, শুধু গলার স্বরে বুঝেছি সে এসেছে। আমি দেয়ালে একটা গর্ত করি। হাতুড়ি মারতে মারতে একটা মার ভুল পড়ে যেতেই হাত দিয়ে রংমশালের আগুন বেরয়।আঙুলগুলির দিকে চাইলে দেখি সব বুড়িয়ে আসছে, ঝড়ের আগে পাখি গুলো বাসা বদল করতে পারছে না বলে একটা একটা করে ডিম মাটিতে ফেলে দিচ্ছে। সেই ডিম ফাটছে না। নিঝুম স্কুল থেকে ফিরে আসে, ওগুলোকে নিয়ে ফুটবল খেলতে খেলতে। আমি বারণ করেছি ওকে বহুবার। নিঝুম বলে—দাদা আমি হ্যান্ডরাইটিং এ দশে আট পেয়েছি, আর কল্পনা, স্মৃতি শক্তির খেলায় দশে দুই।
২
মিক্সির আওয়াজে নিঝুম ভয় পেত ছোটবেলা। দেয়ালে দুটো সাঁওতাল দম্পতির মুখোশ দেখে ও খুব ভয় পেত। আমি ভয় পেতাম রামধনু কাঁদলে। জানলায় আগুনপাখির ডানা থেকে জল বেরত।তার ঠোঁটে হাত দিতে ভয় পেতাম না তেমন, ছাদ ছোট হয়ে আসত, ফুটো ফুটো ফ্রিজ থেকে সবজির খোসা মুখে করে টিকটিকি ঘড়ির পিছনে চলে যেত। আমাদের বালতি থেকে মরা কেরসিনের গন্ধে বর্ষার ঘরটা দমকা ফ্ল্যাড লাইটের আলোর থেকে নিংড়ে নিত ঘাসের ফুলকি। শিশিরের আগেও এখানে শীতকালে কেউ কেউ আসত।
ভিজে চাদর থেকে ছেঁচরে টেনে নিয়ে যাওয়া রক্তের দাগে পিঁপড়ে এসে বসলে, মাছিরা এদিক ওদিক খুঁজে জানলার বাইরে যেতে চাইত। ফ্লাস্কে কফি ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ আগেই। ছাই দানির ভিতর ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় খ্যলনা গাড়ির ব্যটারিটা পড়ে ছিল। দু চার টে ছেঁড়া তারে মাথা গুঁজে শুয়ে ছিল চীন দেশ,তার গোলাপ কক্ষ থেকে ফিনাইলের গন্ধ আসতেই আমরা ছুটে গিয়েছিলাম দরজায় দরজায়... কিন্তু না্, সেদিন কেউ দরজা খোলেনি।
৩
একটানা চোদ্দশো বার ফোন করার পর ফোনটা ছুড়ে ফেলে দি।রাত সারে তিনটে বাজলেও নিঝুম আগে আসত।এখন দু চার মাস আসছে না। চিঠি লিখেছিলাম ওকে একটা, ঠিকানাটা বদলেছে কিনা তাও জানি না। রাত দেড়টা দুটো বাজলে ছাদে চেয়ার নিয়ে আসে ভ্রান্ত। উপরে ওঠার সময় আমায় একবার টোকা দিলেই আমি ওর সাথে গিয়ে ছাদে বসি। এখন আকাশের রংটা রাতে তেমন পালটায় না।তারাদের গাড়ি চলে সেখানে।হাট বসে। পরীরা বাজারের থলি হাতে নিলেও, ডানার আলোয় আমাদের চোখ আরাম পায়। মাছের দেহ নিয়ে ব্যবসা হয় না সেখানে। সমুদ্রের মাঝখানে একটা মাছঘর বানিয়ে সেখানেই পরীরা স্নান করে। পিঠের দিকটা শুধু দেখতে পাই। সাদা গোলাপি কালো লাল নীল হলুদ কত রঙের পিঠ। ভ্রান্ত আমায় ফিস খেলতে বলে। আমি ফিস ফিসিয়ে ওকে বলি-- দেখছ না? ও বলে ওসব পুরনো ব্যপার। আসলে কিছুই নেই।আমি বলি আছে আছে যা আছে তাতেই আছে। মোষের খুব বড় বড় মাছ হয় সেখানে, ডলফিনের বাচ্চা পাউরুটি খেয়ে লাফাতে শেখে,ফটাস জলের ফস ফস আওয়াজে আমরা দুজন লেজ নাড়ি,কোকিলের বাসায় হীরের ডাল রান্না করছে কাক।বাচ্চাদের এড়িয়ে যাচ্ছে রোডম্যপ।সব ফ্যকাশে চোখের মধ্যে গরম সুচ ঢুকিয়ে কেউ দুল পড়িয়ে দিচ্ছে আর আমরা ধিরে ধিরে নগ্ন থেকে নগ্নতর নদীর চরা দিয়ে হেঁটে আসছি যদি সামনে কোন চায়ের দোকান খোলে তবে দুটো বিস্কুট কিনে পকেটে রেখে দেব আরও কিছু দিন।যেদিন খিদের চেয়েও বেশি খিদে পাবে গলায় এক কামড় দিয়ে আবারও রেখে দেব পকেটে...আর ভ্রান্ত বার বার বলবে ওই জামা আমার ঘরে রাখবে না...পিঁপড়ে হলে বিছানায় আমার ঘুম হবে না... আমি বলি তুমি ঘুমাও কোথায়?আমরা তো রোজ রাতেই ছাদে বসে থাকি....
৪
ময়ূরের পালক কেটে কেটে শান্তা তখন কোলাজ বানাচ্ছিল।উপরে সারাসারি পাল্কী করে ব্যট ম্যান সুপার ম্যান আর জাম্বু ম্যান একসাথে এগিয়ে যাচ্ছে মরুভূমির দিকে।উটের চিৎকার শুনতে পেয়ে মাহুতরা হাতির গায়ে জল দিয়ে ভাল করে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে।এখনও লম্বা একটা পথে তাদের যাত্রা।তাবু নেই,কিন্তু কাপড় আছে,আগুন আছে,দড়ি আছে,খুঁজলে বাঁশ জোগাড় হয়ে যাবে।রাতে তাবু খাটানো যাবে অনায়াসেই।যদি বেশি ঠাণ্ডা লাগে তার জন্য দুটো গরম জামা নেওয়া আছে।গানের দুটো কলি থেকে কবিতার বুলি হবে না জেনে মাটি খোঁড়া আছে,ক্যকটাসের গায়ে দুটো ধুপকাঠি দিয়ে আরও দু পা এগিয়ে যাওয়া আছে যদি না কাঁচ এসে কেটে দেয় বালি।
কাঁকড়ার গলায় একটা দামি লকেট দেখে শান্তা বলে, আমার ওটা চাই।আমি ছুটতে ছুটতে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে তার পিছু নিতে নিতে শেষ মেশ মন্দারমনির হোগলা বনে গিয়ে তাকে ধড়তে পাই।আমি বলি ওই লকেট টা দু দিনের জন্য দেওয়া যাবে?কাঁকড়া তেড়ে এসে আমার পায়ে কামড় দিয়ে আমায় বালির নীচে নিয়ে চলে যায়...আমি লাথি মারি,ঘুষি মারি,চিৎকার করি সে ছাড়ে না,অবশেষে একজন গেরুয়া বসন পরা মানুষ এসে তার পকেট থেকে চাকু বার করে কাঁকড়া টিকে মেরে দেয়।কাঁকড়া কে মারতে গিয়ে আমারও বুড়ো আঙুলটা কিছু টা কেটে যায়... আমি খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাড়ি ফিরে আসি।পকেটে হাত দিয়ে লকেট দিতে গিয়ে শান্তার সামনে বেজায় বোকা হয়ে যাই... শান্তা বলে—
পেলে?
আমি মনে মনে বলি, পেয়েছিলাম, কিন্তু আসার পথে ওই গেরুয়া বসন আমার সাথে এসেছিল কিছুটা পথ...তার পরে আর পকেটে হাত দি নি... তাই মনে পরছে না...
দাঁড়াও... না হয় আরো একবার যাচ্ছি...
৫
টর্চের আলোটা চোখে এসে ধাক্কা মারতেই চোখের মণিটা স্থির করলাম।তারপর এ বি সি ডি র রেললাইন ধরে ছোট ছোট হিল জুতো,গাম্বুট এগিয়ে এগিয়ে এক জায়গায় স্তুপ হয়ে পরে থাকল।ঝরা পাতা আর ঝরা মানুষের স্তুপে পেট্রল দিয়ে দেশলাই টা যেমনই ছুড়তে যাচ্ছিল নন্দ বাজ পরল আকাশে।বাড়িতে বাড়িতে টি ভি গুলো কাঁপতে কাঁপতে বন্ধ হয়ে গেল।টেলিফোনের ওদিকের আওয়াজ এদিকের আওয়াজ শুনতে পেল না... সকলেই হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে... সেখান থেকে এমন এক সুর তৈরি হল যে জানলার পাশে গীটার নিয়ে বসা ছেলেটা গীতা খুলে বসল।ঠাকুমা দিদিমার পানের ডিবেতে ফাগুন লাগা সুপারির দানা থেকে হাত পা বেড়িয়ে এসে একে একে তারা সুপারি গাছে গিয়ে উঠল।চাঁদের ছবি তুলতে এসে একজনের হাত থেকে ফোন পড়ে গেল খাদের নীচে।বেঞ্চিতে কুয়াশার দানা দানা জল মুছে দুজন অতি বৃদ্ধ দম্পতি কোটের পিছন থেকে একটা পায়রা উড়িয়ে দিল।সেই পায়রা উড়তে উড়তে কোথায় হারিয়ে গেল আমি দেখতে পেলাম না...আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম—কোথা থেকে পেলেন এই সময়ে পায়রা?তারা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হেঁসে বলল—এ আমার পিতৃ দেবের আমলের জিনিস।আমিও নিয়ে ছিলাম তাকে, এই প্রায় আশি বছর..... আজ উড়িয়ে দিলাম... হঠাৎ আচমকা টর্চের আলোয় কে এসে পিছন থেকে বলল--- ওঠ ওঠ...তারা উঠে চলে গেল।
জাহাজের আগে একটা নৌকা ছিল এই পথে বাঁধা।আমরা ছোটবেলা থেকে সেই নৌকায় এসে বসতাম।নীচে কোন জল ছিল না...কংক্রিটের রাস্তাকে জল ভেবে গাছ থেকে একটা ডাল ভেঙে আমরা নৌকা পারি দিতাম...সে দূর দূর দেশ... কত কুয়াশা সেখানে,কত পাহাড়,কত পাখি,কত সূর্য।সেখানে স্কুলের ঘণ্টা বাজলে আমরা দৌড়ে গিয়ে জানলার পাশে এসে বসতাম না...পাছে জানলার বাইরে চোখ পরে যায়?তাহলেই তো মুশকিল... তাহলেই তো পুকুর,তাহলেই তো রাজার মুকুটে জং দেখতে পাবো...তাহলে তো হাত মুঠো, সপাং সপাং স্কেলের বারি খেতে খেতে ফিরে আসব আবার নৌকায়।চোখে কোন জল নেই,মনে কোন বল নেই,কাউরর উপর এতটুকু কোন ক্ষোভ নেই,
আছে যা তা আরও আরও বেশি ভাল ওরা বলতে পারবে...আমার বলার ছিল যেটুকু সেটুকু বলার আগেই চোখে টর্চের আলো পরেছিল,দরজার বাইরে আজ ভ্রান্ত নেই, শান্তা নেই, নিঝুম তো কত দিন হল নেই...ডাক্তারের মুখ থেকে হাল্কা ব্লু লেবেলের গন্ধ নাকে এল...চোখটা বুজে হাতের কাছে একটা পেপার ওয়েট পেলাম,ভাবলাম ছুঁড়ে মারি আয়নার দিকে,যদি চুরমার হলে আবারও ওরা ফিরে আসে, তবে গিয়ে বলব ওদের এতদিন ধরে যা শেষ করতে পারছিলাম না আজ তা করেই ছাড়ব। ভ্রান্ত এসব শুনে বলবে, ছাদে চলো...শান্তা এসব শুনে বলবে ঘুরে এসো,নিঝুম এসব শুনে বলবে, দাদা এবার আমার বাড়িতে এসে থেকে যাও কিছুদিন,আর আমি এসব শুনে কি বলব সেটাই ভাবছিলাম, কিন্তু দেখলাম—এসব ভাবার বিষয় নয়।
0 comments: