0

স্মৃতির সরণী - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in

স্মৃতির সরণী


মেজোমামী
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস


মেজোমামী মারা গেলেন গত শনিবার। চিররুগ্ন মানুষ ছিলেন। সারা জীবনটাই ধুঁকতে ধুঁকতে গেছে তাঁর। কিন্তু তাঁর ছোট্ট সংসারের উপর তাঁর দুর্বল মুঠোর রাশটা কখনো আলগা হয়নি। সেই অর্থে তিনি সুখীই ছিলেন। মামীকে যে আমি খুব ভালোটালো বাসতাম, তা নয়। সহজসরল শান্ত মানুষ ছিলেন বলে আমার ভালোই লাগতো। মামীর কথা মনে পড়লেই তাঁর সংসারটাই চোখে ভাসছে শুধু। 

বড়ো রাস্তাটার ধারে কাঠের দোকানে ঘ্যাঁসঘ্যাঁস করে করাত চালাচ্ছে কেউ। বাতাসে কাঠের গুঁড়ো উড়ছে। কাঠের গন্ধের মধ্যে দিয়ে দোকানের পাশের গলি ধরে তিরিশ সেকেন্ড হাঁটলেই বাইরের শব্দ নিভে আসে। গাছপালায় ঘেরা বিশাল উঠোন তকতক করছে। ডাইনে বেড়ার দেওয়াল আর টিনের চাল দেওয়া বিশাল দালানখানা। জুতো খুলে মাটির মেঝেতে পা দিলেই আরাম লাগে পায়ের তলায়। বারান্দায় একটা খাট পাতা…দুটো কাঠের চেয়ার…একটা পাটী গুটোনো। বারান্দা পেরিয়ে মূল ঘরখানা বেশ বড়ো। সংসারের যাবতীয় আসবাব, মানে পালঙ্ক-আলমারী-মিটসেফ-আলনা-ঠাকুরঘর, সবটাই ওই ঘরে। পাশাপাশি আছে, কিন্তু ঠাসাঠাসি অগোছালো নয়। একটা কান মোচড় দেওয়া সাদাকালো টিভি…তাতে নীল কাঁচ বসিয়ে রঙিন করবার চেষ্টা করা হয়েছে। টেবিলক্লথের কোণে একগোছা সুতোর ফুল…পাশে'মনে রেখো'। মূলঘরের পিছনে কামরা ঘরে আরো একটা বড়ো তক্তপোশ। বেড়ার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর এসে বরফি আঁকে তার সারা গায়ে। এ বাড়িতে একটা গন্ধ আছে…ধূপ-কাঠের আসবাব -ন্যাপথালিন- বাঁশ- মাটি- রেক্সোনা মেশানো গন্ধ। এই গন্ধ শুধু এই বাড়িতেই ছিল…যতদিন না বেড়ার ঘর ভেঙে পাকা দালান তোলে মেজোমামা!

মামীর সংসারের ছন্দ বড়োই সরল। সকালে উঠে ঘরদোর ঝাঁড়পোঁছ করে রান্নার জোগাড় করা। রান্নার শেষে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। ঘুম থেকে উঠে রাতের রান্নার জোগাড়। তারপর খাওয়া। আবার ঘুম। আমার মায়ের সংসারে সর্বদাই ব্যস্ততা…একা থাকলেও…সবাই থাকলেও। মামীর সংসারে কোনো ব্যস্ততা নেই। যখন রান্না শেষ হবে, তখন মামা খেয়েদেয়ে অফিসে যাবে। তাতে ট্রেন পেলে পাবে, না পেলে নেই! মামী রুগ্ন বলে এ সংসারে সবাই কাজ করে। মামী উনুন জ্বালালে মামা শাক কুটতে বসে, দাদা উঠোন ঝাঁট দিতে যায়। কেউ বসে থাকে না, কিন্তু কারো কোনো ব্যস্ততাও নেই। বকফুল গাছের তলা সাদা হয়ে যায়…শুকনো পাতার উপর দিয়ে তক্ষক ছুটে পালায়। এবাড়ির ভাড়াটে বৌ'টা শব্দ করে বালতিতে জল তোলে চাপকল থেকে। শিরশিরে হাওয়ায় মটমট শব্দ হয় বাঁশবনে। 

মামীর রান্নার হাতটি বড়ো সরেস। পোলাও-কোর্মাটাইপ সরেস নয়। এ বাড়িতে রগরগে রান্নাগুলো মামা রাঁধে। মামী ঝকঝকে কাঁসার থালায় জুঁইফুলের মতো ভাত উঁচু করে দেয়…এক পাশে লবণ, কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ। তারপাশে চালের গুঁড়ো দিয়ে বকফুলের বড়া, মাছপাতা বা ঘ্যাঁটকোল পাতা বাটা, রসুন দিয়ে কলমীশাক ভাজা। পাশে খাঁজকাটা বাটিগুলোতে থাকে কাঁচামুগের ডাল, উচ্ছে-আলু দিয়ে ছোট মাছ, ফুলকপি আর নতুন আলু দিয়ে কাতলার ঝোল, জলপাইয়ের টক…। জলভরা কাঁসার গ্লাসে আলো ঠিকরায়। এখানের জলের স্বাদ কষাটে…ভারী…খুব ঠাণ্ডা। 

মামীর কথা মনে পড়লে তাঁর রোগজীর্ণ ডানহাতটার কথা মনে পড়ে। ঢিলঢিলে শাঁখা-পলা-লোহাপরা হাতখানা ঝাঁঝড়ি ডুবোচ্ছে আমার দিদার আমলের কড়াইতে। কড়াইভরা তেলে একটা মালপোয়া ফুলে উঠছে। বাইরে উঠোনের উনুনে মামা কাস্তেপিঠে বানাচ্ছে মাটির ছাঁচে। একবাটি নতুন গুড় নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন বুক ফুলবে ধপধপে পিঠেগুলোর। পাশে থকবক করে ফুটছে দুধ। ওতে পাটালী পড়বে…এলাচ-তেজপাতা পড়বে…কাঁচি পোড়া পিঠেগুলো ডুবে নরম হবে গোটা রাত ধরে…

মামীর কথা মনে পড়লে একটা স্মৃতির কথা মনে পড়ে। স্মৃতিটা আমার নয়। কিন্তু বহুশ্রুত হওয়ার দরুণ স্মৃতিটা আমার হয়ে গেছে। আমার জন্মের পরপরই মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভর্তি হতে হয় কৃষ্ণনগরের সরকারী হাসপাতালে। এর হাত ওর হাত ঘুরতে ঘুরতে মামীর হাতে এসে পড়ি একসময়। মা ফিরে আসার আগে অবধি মামীর কাছেই ছিলাম। রাজুদাদা, মামীর একমাত্র সন্তান, ছোট ছিল বলে আমাদের দুজনকেই ঐ চিররুগ্ন মানুষটা স্তনপান করিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল। মামীর সাথে যতবার আমার দেখা হয়েছে, মামী এই গল্পটা আমায় করেছে। এগারো বছর মামাবাড়ি যাই না। তবুও মামীর সংবাদটা শোনার পর থেকে বারবার ফিরে যাচ্ছি ঐ বাড়িটায়। কোনো বেদনা নয়, মনখারাপ নয়। তবু কোথায় যেন তিরতির করে কাঁপছে…টান পড়ছে ফাৎনায়…বুদবুদ উঠছে…। একটা শীর্ণ সুখী মানুষ উঠোনের পাটি পেতে উঁচু একটা বালিশে শুয়ে গুনগুন করে গল্পটা আরো একবার বলছে…।

0 comments: