গল্প - অভীক চৌধুরী
Posted in গল্প
গল্প
বড়ো হওয়ার গল্প
অভীক চৌধুরী
-- কি রে মেঘ, সেই সকালে থেকে কি খুঁজছিস এত তন্ন তন্ন করে?
মেঘনামায়ের দিকে ফিরে তাকায় কিন্তু কোনো উত্তর দেয়না।
মা আবার বলেন, -- আমাকে বলনা একবার,আমি তাহলে খুঁজে দেখতে পারি।এখনো চান করিসনি এত বেলা হয়ে গেলো।আজ ছুটি বলে কোনো তাড়া নেইদেখছি।সন্ধেবেলা আবার তোর কোথায় যাবার কথা....
-- তুমি জানোনা মা আমি ঠিক খুঁজে বার করবো, আর একটু পরেই আমি রেডি হয়ে যাচ্ছি, প্লিজ মা তুমি আমাকে একটু কাজ করতে দাও। মেঘনামাকে জড়িয়ে ধরেবলে।
অমিতা আর কোনো কথা বলেন না। কিন্তু অনেক ভেবেও কিছু বুঝতে না পেরে নিজের কাজে চলে যান,আজ বাদে কাল কলেজ যাবে মেঘা, এখনো যেন ছোট্টটি আছে।
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেছে মেঘনার,শীতের ভোরে ঠিক কটা বাজে ঠাওর হচ্ছেনা,মোবাইলটাও হাতের কাছে খুঁজে পেলোনা,বিছানায় কোথায় মিশে আছে কে জানে।হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা প্রায় বন্ধ ঘরেও মালুম হচ্ছে।একবার ভাবলো আর একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক কিন্তু তারপরইলেপ কাঁথা একপাশে রেখে উঠে পড়লো,দেওয়াল ঘড়িতে তখন সবে পাঁচটা।মনে পড়লো প্যাকেটটার কথা,কাল রাতেই শোবার সময় ভেবে রেখেছে।রঙ্গীন গোলাপী কাগজে মোড়া প্যাকেটটা কত বছর আগে এমনি এক ভোরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো কাঁদতে কাঁদতে,মা যত্ন করে তুলে রেখে দিয়েছিলো।তখন ক্লাস ফাইভ হবে আর এখন টুয়েলভ পরীক্ষা দেবে দুমাস পর।আলমারি,বইয়ের তাক,ক্যাবিনেট সব ঘেঁটেও কিছুতেই পাওয়া গেলোনা সেই প্যাকেট।সাত বছর আগে এক অলীক পাওয়ার বেদনায়,স্বপ্নভঙ্গের ব্যথায় অঝোর ধারায় কেঁদেছিলো আর আজ আবার দুচোখ ভারে জল এলো মেঘনার।একসময় হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলো।
-- আজ এত আনমনা কেনরে মেঘনা ? বেশি কথা বলছিসনা এসে অবধি - শতাব্দী জানতে চায়।মেঘনার কোনো সাড়া নেই দেখে অদৃজা ফোড়ন কাটে -- কার কথা ভাবছিস রে মেঘনা?
-- এই তোরা চুপ করবি,পার্টিতে এসেছিস মজা কর,আমার পিছনে লেগে আছিস কেন ? মেঘনা চোখ পাকিয়ে বলে।
-- কি করে মজা করি,এখনোতো শুরুই হয়নি। তাছাড়া পারমিতা,সৃজন,শিমূল,অভিজাত কেউ আসেনি।কাজেই তোর পিছনেই একটু লাগি ---কথাকলি কলকলিয়ে ওঠে।
সুমন স্যারের কোচিঙের ক’জনবন্ধুমিলেআজপার্কস্ট্রীটেএসেছেএকনামীরেস্টুরেন্টে।অমিতা ছাড়তে চাননি মেঘনাকে,বন্ধুরা মিলে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে।এই প্রথমবার মেঘনা রেস্টুরেন্টে এসেছে বন্ধুদের সঙ্গে।অমিতামেয়েকে অনেক করে বলে দিয়েছেন রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে। নাহলে আবার বাবা ভীষণ রেগে যাবেন।
আলোয় ঝলমল করছে পার্কস্ট্রীট।এত আলো জীবনে দেখেনি কোনোদিন,ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এমনি এক দিনে এসেছিলো। কিন্তু সেদিন এমনটা ছিলোনা।সকলেই আনন্দে মেতে উঠেছে,গোটা পার্ক স্ট্রীট ধরে আনন্দের ঢেউ যেন সুনামি হয়ে আছড়ে পড়ছে প্রতিটি কোণে।শুধু মেঘনার মন খারাপ। অথচ ছোটবেলায় এমনি দিনটার জন্য সারাবছর দিন গুনতো প্রতিটি পলে।
বন্ধুরা সবাই এসে গেছে,অভিজাত এক রেস্টুরেন্টে ওদের জন্য সিট বুক করা।একটা বড় টেবিলের দুধারে ওরা বসেছে,নরম মোমের আলোয় টেবিলে সকলের মুখ কেমন মায়াময়।টেবিলের মাঝখানে খ্রীষ্টমাস ট্রী সাজানো লাল নীল আলোর বাহারে।আটটা থেকে নাচ গান পার্টি শুরু হবে,মিউজিক সিস্টেমে অনুরণিত হচ্ছে -- উই উইশ ইউ আ মেরি খ্রীষ্টমাস.....
সবাই নাচছে, গাইছে,মজা করছে।মনে হয় না এধরাতলে কোথাও দুঃখ আছে।পার্টি পুরোদমে জমে উঠেছে,সকলের অলক্ষ্যে মেঘনা উঠে পড়ে আস্তে আস্তে রেস্টুরেন্টের বাইরে আসে।বাইরে তখন জনসমুদ্র, মেঘনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।
-- কি রে মেঘনা এভাবে কাউকে কিছু না বলে চুপি চুপি পালিয়ে এলি কেন ? মেঘনা পিছন ফিরে দেখে অভিজাত।-- চল ফিরে চল আমার সঙ্গে,ওরা কি ভাববে বলতো ?-- অভিজাত আবার বলে।
-- তুই ফিরে যা অভি আমি আর যাবো না ---
-- কি হয়েছে আমায় বল মেঘনা ----
-- আর দেরি করলে বাড়ি ফিরতে রাতহয়ে যাবে,বাবা খুব রাগ করবে। তাই মা বলে দিয়েছে বেশি রাত না করতে।
-- এইজন্য তুই কাঁদছিস ? ঠিক আছে চল আমি তোকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি,আর তাছাড়া তুই একাগেলে কাকিমার কাছে পরে আমরা মুখ দেখতে পারবোনা রে মেঘনা।
-- না নাঅভি! ওরা কি মনে করবে ?
-- আমারও ঠিক ভালো লাগছে না রে মেঘনা,মায়ের শরীরটা ভালো নেই .......
অভিজাত কোনো কথা শোনেনা,মেঘনার হাত ধরেকখনো চিৎ সাঁতার কখনো ডুব সাঁতার দিতে দিতে আবার কখনো ভাসতে ভাসতে অতল সাগরের ঢেউ কাটিয়ে এগিয়ে চলে।প্রবল জনপ্লাবনেরঅভিঘাতেএকসময় ওদের হাত আলগা হয়ে যায়,তলিয়েযেতে যেতে কেউ একজন ওর হাত চেপে ধরে এক ঝটকায় বাস স্টপেজে পৌঁছে দেয়।তারপর সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়,হাতে একটা গোলাপি প্যাকেট -- এই নাও মেঘনা তোমার সেই হারিয়ে যাওয়া খ্রীষ্টমাস গিফট।মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাত বাড়াতে গিয়ে দেখে সেই লাল সাদা প্যান্ট আর জোব্বা,মাথায় লাল সাদা টুপি, রঙচঙ মেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সান্তা ক্লজ হাসিমাখা ম্লানমুখে।
মেঘনা জানতে চায়-- কি আছে ওই প্যাকেটে ?
-- একবার খুলে দেখো নাভিতরে কি আছে,তোমার সব থেকে প্রিয়……
-- মেঘনা চিৎকার করে ওঠে - না না আমার চাই না আর কিছু,মিথ্যার মোড়কে সবটাই ঢাকা।তুমি কে বলোতো, তোমার লজ্জা করেনা ? আমি চিনতে পেরেছিতুমি আমারকাকাই ,আমার ছোটবেলাটা মিথ্যারনকশি কাঁথায় মুড়ে দিয়েছিলে.......
-- মেঘনা কাকে কি বলছিস বিড়বিড় করে,তোর কি হয়েছে বলতো ? আমি অভিজাত তোর সামনে দাঁড়িয়ে,চিনতে পারছিস না ?
-- অভিজাতর হাত ধরে রোবটের মতো বাড়িআসে মেঘনা।ধুম জ্বরে গা পুড়ে যায় মেঘনার।কোনোরকমে সবাই মিলে ধরাধরি করেবিছানায় শুইয়ে দেয়।দশটাবেজেগেছে,আজ আবার রবিবার,এই রাতে ডাক্তার পাওয়া কি যে দুষ্কর!মেঘনার মা বাবা দিশাহারা হয়ে পড়েন, অভিজাত ডাক্তার ডাকতে ছুটে যায়.......
এখন অনেক রাত,ডাক্তারবাবু দেখে ওষুধ দিয়েছেন,বলেছেন -- ভয়েরকিছু নেই,শক জাতীয়কিছু ঘটনা থেকে এই জ্বর হতে পারে,কালকেই জ্বরটা একদম কমে যাবে,তবে কাল একটা ব্লাড টেস্ট করিয়ে নেবেনআর ওর কাছে আজ রাতটা থাকবেন।অভিজাত আর বাড়ি ফিরতে পারেনা।মেঘনার বাবা পাশের ঘরে সোফায় বসে থাকেন,অভিজাত কিছুতেই শুতে চায়না, কাকিমার সঙ্গে জেগে বসে থাকে।রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডাও জাঁকিয়ে বসে।
জ্বরটা অনেক কমে গেছে মেঘনার,ঘুমের ঘোরে এক বরফের দেশে পৌঁছে যায় সে।স্পষ্ট দেখতে পায় বরফের মধ্যে একটা স্লেজ গাড়ি আসছে,ছোট ছোট শিশুর দল ছুটে আসছে উপহারের আশায়।গান হচ্ছে --- জিঙ্গল বেল জিঙ্গল বেল জিঙ্গল অল দা ওয়ে,ও হোয়াট এ ফান ইট ইজ টুরাইড ........হাসি মুখে সান্তা ছোটদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বেলুন,লজেন্স,বল,পুতুল, আরো কত কি।
-- তুমি কে আবার এসেছো,তুমি সান্তা না,তুমি কিকাকাই, আমার কোনো উপহার চাইনা তুমি ফিরে যাও - মেঘনার কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যায়।
-- নাগো মামনি, আমিই সান্তা। আবার তোমার কাছে আমিইকাকাই,আবার কারুর কাছে বাবা,মামা,জেঠু,দাদু ।তুমি কেমন সারাবছর ধরে প্ল্যান করতে,চিঠি লিখতে কি চাই সান্তার কাছে।
-- ওগুলো সব মিথ্যে,ক্লাস ফাইভেই আমি জেনে গেছি,তুমি এতো মিথ্যুক কাকাই ? আজ আবার এলে কেন,আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি।
-- তোমার যে বয়েসে আমি ছিলাম সান্তা, সেটা মিথ্যে ছিলোনা মামনি,সেটা ছিল সোনা রুপো আর জহরতে মোড়া রূপকথার শৈশব।সেটা না থাকলে শৈশব শুধু সাদা কালো জঞ্জালেভরা থাকতো।
-- রেস্টুরেন্টের বাইরে তুমি আজ আবার সান্তা সেজে আমার কাছে এলে কেন ?
-- কেন,তোমাকে ওই গোলাপি প্যাকেটটা ফিরিয়ে দিতে এলাম,দশ বছর আগে যেটা তুমি রাগের বশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে।
-- কি আছে ওতে ?
-- এই তো তোমার হতে দিলাম,তুমি দেখো কি আছে ওতে ?
মেঘনার শরীরে আর জ্বর নেই,ঘুম ভেঙে গেছে,হতে ধরা গোলাপি প্যাকেট।বিছানায় আস্তে আস্তে উঠে বসে।
এতক্ষণে মেঘনার মায়ের মুখে হাসি ফোটে।পরম মমতায় মেঘনা গোলাপি প্যাকেটটা খুলে ফেলে,ভিতরে মেঘনার সব থেকে প্রিয় ছোট্ট এক লাল টুকটুকে বার্বি ডল আর একটা চিঠি।চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করে...
-- প্রিয় মামনি আমার,
এ বছরেই লুকিয়ে তোমায় শেষ খ্রীষ্টমাস গিফট,এরপরে তুমি আস্তে আস্তে বড়ো হবে এসব ভুলে যাবে,আমিও চলে যাচ্ছি শহর ছেড়ে অনেক দূরে।বড়ো হয়ে যদি কোনোদিন ভুল করেও এ চিঠিটা তুমি আবার পড়ার সুযোগ পাও, সেদিন আমায় ক্ষমা করে দিও।মিথ্যে সান্তা হয়ে তোমার শৈশব যে আমি হাসি আর আনন্দে রাঙিয়ে দিতে পেরেছিলাম এ আমার জীবনের পরম পাওয়া।আমি আবার সান্তা হয়ে ফিরে আসবো একদিন তোমার সন্তানের কাছে।অনেক বড় হও,ভালো মানুষ হও।
ইতি
তোমার কাকাই
অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে মেঘনা চিঠিটা বুকে জড়িয়ে।মেঘনার শরীরে কোনো যন্ত্রনা নেই আর। তবু বুকের ভিতর কেমন গুড়গুড় করে কাকাই এর জন্য,কনকনে শীতের রাতে ঘোরা হত দরিদ্রসান্তাদের জন্য আর অবশ্যই হারিয়ে যাওয়া শৈশবের জন্য।বার্বি ডলটা হাতে নিয়ে আদর করতে থাকে মেঘনা,চুমু খায়। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-- মা দেখো, গুড্ডিটা আজও তেমনি ছোটোটাই আছে। শুধু আমিই বড়ো হয়ে গেলাম।অমিতা জড়িয়ে ধরেন মেয়েকে তারপর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেন,সবাই এ ভাবেই বড়ো হয়ে যায় মেঘ।
অভিজাত মা আর মেয়ের পশে এসে দাঁড়ায়।মেঘনার মা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন অভিজাতর দিকে,তাঁরই মেয়ের বয়সী ছেলেটা কিনিপুণভাবে সারারাত সান্তার অভিনয় করে গেলো মেঘনাকে সুস্থ করার জন্য।
0 comments: