1

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in

ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ১০ 
শিবাংশু দে 


আমায় তাই পরালে মালা, সুরের গন্ধ ঢালা... 


"আকাশ যখন চক্ষু বোজে অন্ধকারের শোকে 
তখন যেমন সবাই খোঁজে সুচিত্রা মিত্রকে 
তেমনি আবার কাটলে আঁধার, সূর্য উঠলে ফের 
সবাই মিলে খোঁজ করি কার? সুচিত্রা মিত্রের 
তাঁরই গানের জ্যোৎস্নাজলে ভাসাই জীবনখানি 
তাইতো তাঁকে শিল্পী বলে, বন্ধু বলে জানি...." 
(নীরেন্দ্রনাথ) 


প্রিয় শিল্পী হয়ে ওঠার অবশ্যই কিছু ব্যাকরণ থাকে। কিন্তু শিল্পী যখন বন্ধু হয়ে ওঠেন, তখন তাকে যুক্তিগত ব্যাকরণের বাইরে একটা নৈসর্গিক মাত্রা ছাড়া আর কিছু বলা যায়না। সত্যিকথা বলতে কী, 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' ছাড়া আর কিছু না গেয়ে (অন্যগানগুলি না গাইলেও কোনও ব্যাসকম হতোনা) বাঙালি শ্রোতার অস্তিত্ত্বের এত গভীরে শিকড় নামিয়ে দেবার শক্তি আর কোনও 'মহিলা' শিল্পীর মধ্যে আমরা পাইনি। 'শক্তি' শব্দটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি। বাঙালির স্বভাবে 'শক্তি-সংস্কৃতি'র প্রতি যে আনুগত্য তাকে দেশের অন্যান্য প্রান্তের থেকে একটু আলাদা করে, তার মধ্যে ওজস্বী দেবীচেতনার একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। সুচিত্রা মিত্রের গানে ওজস্বিতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ তাঁকে পূর্ব ও উত্তরসূরিদের থেকে পৃথক করেছিলো। বাল্যবয়স থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবহে বড়ো হলেও তাঁর আত্মপ্রকাশের সলতেটিতে আগুনটি লেগেছিলো শান্তিনিকেতনে। সেই সময়ে, বা তার আগে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়নভঙ্গিতে এতো মসৃণভাবে মেধার প্রয়োগ মানুষ বিশেষ শোনেনি। এই মেধার নির্দিষ্ট পরিভাষা 'শাস্ত্রীয়' অর্থে ধরা যাবেনা। একান্তভাবে নৈসর্গিক ক্ষমতার মাত্রা থেকেই তাকে আয়ত্ব করা যায়। প্রথম গান থেকেই তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতে যে আবহটি সৃষ্টি হয়, তার তুলনা মানুষ অন্য কোনও শিল্পীর পরিবেশনায় পায়নি। ১৯৪৫ সালে তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড। একদিকে "মরণ রে", অন্যদিকে "হৃদয়ের একুলওকুল দুকুল ভেসে যায়"। তখন তাঁর বয়স একুশ বছর। রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশ্রুত শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, "সুচিত্রা মিত্র মানে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন এবং নিজস্ব একটি বিশেষ ঘরানায় সমৃদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীতের শেষকথা।" এত সংক্ষেপে সুচিত্রা মিত্রের গানের এমন নির্ভুল মূল্যায়ণ আর কাউকে করতে দেখিনি। 


পূর্বসূরিদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় পঙ্কজকুমার ছাড়া আর কেউই জীবনের প্রথম রেকর্ডটি থেকেই 'বিশেষ ঘরানায় সমৃদ্ধ' রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের জন্য এনে দিতে পারেননি।যাঁরা শান্তিনিকেতনে সুচিত্রার সঙ্গীতগুরু ছিলেন, যেমন ইন্দিরা দেবী, শৈলজারঞ্জন, অনাদি দস্তিদার এবং তাঁর ভাষায় 'সর্বার্থে' গুরু শান্তিদেব, কারো গায়নেই সুচিত্রা অনুসৃত গায়নের ইঙ্গিত ছিলোনা। অতএব আমরা স্বচ্ছন্দেই বলতে পারি সুচিত্রার'ঘরানা' একেবারেই তাঁর নিজস্ব। তাঁর উচ্চারণ, সুর-লাগানো, যতি'র টাইমিং বা লয়ের ছন্দ সবই তাঁর একান্ত ছাপ বহন করে। এ প্রসঙ্গে বলি, গায়কি ও ঘরানার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। গায়কিঘরানার অংশ হতে পারে। কিন্তু ঘরানা নামক ধারণার মধ্যে একটা পরিপূর্ণ সঙ্গীতভাবনার প্রকাশ আছে। গায়কির মধ্যে সঙ্গীতের কোনও বিশেষ ধারায় গায়নভঙ্গির কয়েকটি বিশেষ লক্ষণ ধরা থাকে মাত্র। 'ঘরানা' শব্দটির বিস্তার অনেকটা বড়ো। সুচিত্রার সমসাময়িক শান্তিনিকেতনি ঘরানার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন যাঁরা, সেই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বা নীলিমা সেনের গায়কি এক নয়, কিন্তু ঘরানা এক। সুচিত্রা ও কণিকার ঘরানা যেন চিত্রাঙ্গদার দুই রূপের মতো। স্বতন্ত্রা ও দয়িতার মধ্যের ফারাকটি মূর্ত হয়ে উঠেছিলো তাঁদের দুজনের পরিবেশনা। লক্ষ্যনীয়, গুরু ও সত্র এক। শিক্ষণ ও পথনির্দেশও একই। কিন্তু সুচিত্রার যাত্রাপথ প্রথম থেকেই আলাদা। মাত্র একুশ বছর বয়স থেকেই সঙ্গীতের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গেলে, তাঁর স্বাতন্ত্র্যবেমিসাল ছিলো। তিনি তাঁর সতীর্থদের থেকে কিভাবে আলাদা হলেন, তার উৎস নিয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমত, রবীন্দ্র-আবহে বেড়ে উঠলেও তিনি কলকাতার মেয়ে। পড়াশোনা করেছেন বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে। সেখানে গান শেখাতেন অমিতা সেন। তাঁর গানের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা জানেন তাঁর সুর লাগানো ও লয়ের ব্যবহার, ছন্দের ধরন কেমন ছিলো। ঐরকম স্ট্যাকাটো শৈলিতে স্বর লাগানোর কৌশলসেকালে আর কারুর কাছে শোনা যেতোনা। এছাড়া পঙ্কজকুমার ছিলেন সুচিত্রার 'গানের জগতের হিরো'। প্রতি রবিবার রেডিওতে 'সঙ্গীতশিক্ষার আসর' শোনা ছিলো তাঁর অবশ্যকৃত্য। শান্তিনিকেতন পৌঁছোবার আগেই সুচিত্রা রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের যে ভঙ্গিটি আত্মস্থ করেছিলেন সেটি পরবর্তীকালে পরিমার্জিত হয়েছিলো হয়তো। কিন্তু কোনওদিন পরিবর্তিত হয়নি। 


সুচিত্রা শান্তিনিকেতনে প্রথম যান ১৯৪১ সালের অগস্ট মাসে। কবিপ্রয়াণের অব্যবহিত পরে। তখনও সেখানকার আলোবাতাসে কবির স্মৃতি ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে ছিলো। ইন্দ্রপতনের পর শূন্যতাটি বিশেষভাবে প্রকট তখন। কবির নির্বাচিত সঙ্গীতগুরু শৈলজারঞ্জনের প্রগাঢ় প্রভাব সঙ্গীতভবনে। যদিও এই বিষয়ে একটু ভিন্ন ভাবনার পথিকৃৎ স্বয়ং ইন্দিরাদেবীও তখন সেখানে তালিম দিতেন। কিন্তুসেই মুহূর্তেশিক্ষার্থীরা বহুলভাবে শৈলজারঞ্জনের গুরুমুখী শৈলীকেই নিষ্ঠাভরে অনুসরণ করতেন। 'শৈলজাদা'র হাতে সুচিত্রার 'প্রকৃত পাঠ' শুরু হলেও 'সর্বার্থে তাঁর গুরু' ছিলেন শান্তিদেব। ২৯শে অগস্ট, ১৯৪১, বাড়িতে চিঠি দিয়েছিলেন সুচিত্রা। সেখানে উল্লেখ আছে, "...শান্তিদেব ঘোষের রবীন্দ্রনাথের গানের ক্লাসটা খুব ভালো লেগেছে। শিখতে শিখতে একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল।"শৈলজারঞ্জন অনুসারী গীতধারা, যা কণিকা বা নীলিমার অন্বিষ্ট, তার থেকে সুচিত্রার শৈলী পৃথক হয়ে গিয়েছিলো প্রথম পর্ব থেকেই। 

সুচিত্রার যে গায়নশৈলীটি শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের মতে পরবর্তীকালে তাঁর নিজস্ব 'ঘরানা' হয়ে গিয়েছিলো, সে বিষয়ে সুচিত্রা কিন্তু শিল্পীস্বভাবজাত বিনয়ে 'ঘরানা' শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি 'গায়কী' ও 'ঢং' এই দুটি শব্দই ব্যবহার করেছিলেন। ‘গায়কী’র সঙ্গে সুচিত্রা ঐতিহ্যের যোগ খুঁজে পেয়েছিলেন। ঢং'বস্তুটি' তাঁর কাছে একান্ত ব্যক্তিগত একটি ধরন। শিল্পী বিশেষে তা বদলে যায়। কিন্তু যেমন ধ্রুপদের গায়কি মেনে খ্যয়াল গাওয়া যায়না, তেমনই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গিয়ে ঠুমরির গায়কি সর্বতোভাবে ত্যাজ্য। তাঁর মতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ‘গায়কী’বদলে অন্যকোনও ভাবে তা পরিবেশন করতে গেলে কম্পোজারের ক্ষমতা রবীন্দ্রনাথের থেকে অধিক হওয়া প্রয়োজন।তাঁর এই বিশ্বাসটি যেসব শিল্পীও শ্রোতার কাছে স্বীকার্য, তাঁরাই সুচিত্রার ঘরানার ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছেন। 


রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্বন্ধে তিনি যে মন্তব্যগুলি করেছিলেন, তার থেকে এই সঙ্গীতধারাটি বিষয়ে তাঁর ধারণাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 'জীবনের আলোবাতাস' এবং 'অন্ধের যষ্টি'। 'জীবনের সুখদুঃখের ওঠাপড়ার প্রধান অবলম্বন।' 'একটা দিনও রবীন্দ্রসঙ্গীত না গেয়ে থাকতে পারিনা' ইত্যাদি। 

ডেকার্স লেনে সম্ভবত আইপিটিএর এক অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, 'সে বেশ গলা ছেড়ে, পুরো দমে গান গায়। এর মধ্যে কোনও গোঁজামিল নেই। তার সাবলীলতা- সে একটা দেখার এবং শোনার জিনিস বটে। ... তার ছন্দজ্ঞানও অসামান্য। মেয়েরা সচরাচর তালে খাটো হয়। কিন্তু সুচিত্রা নিখুঁত। মনে হয় দিনেন্দ্রনাথ বুঝি ফিরে এলেন।' একজন সদ্যোতরুণী শিক্ষার্থী গায়িকার গান শুনে স্বয়ং ধূর্জটিপ্রসাদের এহেন প্রতিক্রিয়া বেশ ব্যতিক্রমী বলতে হবে। এই সময়কালটি সুচিত্রার সঙ্গীতব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার পথে তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর নিজের ভাষাতে বলতে গেলে, "...শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে এসে আই পি টি এ-র সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া যদি বলে, তবে সেটা তখনই। কিন্তু রাজনীতি করেছি, এই দাবি আমি কখনও করিনা। গণনাট্যসঙ্ঘের সক্রিয় সদস্য ছিলাম। কলেজে থাকতে গেট মিটিং করেছি। বক্তৃতা দিয়েছি। ঘাড়ে ঝান্ডা নিয়ে হেঁটেছি পথে পথে। একটা বিশ্বাস, একটা আদর্শের জন্য সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়েছিলাম। মিছিল, টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ- এসবের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছি ঠিকই, কিন্তু তাকে মোটেই রাজনৈতিক জীবন আখ্যা দেওয়া যাবে না।"এই যাপনের পথে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় জর্জদা, হেমন্ত, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়ের। তাঁর সামগ্রিক সঙ্গীত দর্শন ও পরিবেশনা জীবনের এই পর্বের পর একটা নির্দিষ্ট মোড় নিয়েছিলো। জীবনের 'অহরহ যুদ্ধ' তাঁকে একটি রাজনৈতিক সচেতনতা দিয়েছিলো। রাজনীতি মানেবৈঠকঘরে তোলা চায়ের কাপে তুফান নয়। সেটা একটা 'হোলটাইম ডেডিকেশন'। তিনি কোনও পার্টিতে নাম লেখাননি, কিন্তু নিজস্ব 'রাজনৈতিক আদর্শ' বিষয়ে তিনি স্থির নিশ্চিত ছিলেন। সেই বিশ্বাস থেকেই মাঠেময়দানে সলিল চৌধুরী বা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের গানের সঙ্গে 'সার্থক জনম আমার' অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। 

১৯৪৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'রবিতীর্থ'। সঙ্গে দ্বিজেন চৌধুরি। তাঁর গুরুদের থেকে পাওয়া শিক্ষা, নিজস্ব শৈলীতে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করলেন তিনি। তখন তাঁর বয়স মাত্র বাইশ বছর। হারমোনিয়ম বাজাতে জানতেন না। সুচিত্রা মিত্র ঘরানার প্রস্তুতি পর্বটি এভাবেই শুরু হলো। 

'শুধু গুরুর মুখের বাণীটি নয়, প্রতিটি মুহূর্তে গুরুর জীবনটিকে, গুরুর জীবনাদর্শটিকে দেখবার ও বোঝবার চেষ্টা....' শিক্ষক হিসেবে তাঁর প্রশিক্ষণ পদ্ধতির ভিত্তিটি ছিলো এরকম। 'সপ্তাহে একদিন তানপুরা ঘাড়ে করেধ্রুপদ-ধামার পকেটস্থ করা' যে রবীন্দ্রসঙ্গীত, তার বিরুদ্ধে আজীবন জেহাদ করে গেছেন। 

তাঁর প্রথম রেকর্ডটিগীত হয়েছিলো ইন্দিরাদেবীর প্রশিক্ষণে। ১৯৪৬-এ তাঁর দ্বিতীয় রেকর্ডটিতে 'আমার কী বেদনা সে কি জান' ও 'আরো কিছুক্ষণ না হয় বসিও' গেয়েছিলেন তিনি। 


স্বাধীনতালাভের আবেগমথিত সময় ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে মহাত্মা গান্ধির জীবৎকালেই সুচিত্রা রেকর্ড করেছিলেন তাঁর দুটি প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত, 'জীবন যখন শুকায়ে যায়' এবং 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে'। 


রবীন্দ্রসঙ্গীতের সর্বভারতীয় আবেদন সৃষ্টির মূলে এই রেকর্ডটির বড়ো ভূমিকা আছে। রবীন্দ্রনাথের গানের 'সাহিত্যমূল্য' বিষয়ে তিনি শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের সতত অবহিত করতেন।'....রবীন্দ্রনাথের গান শুধু সুর, তাল, লয় নয়। রবীন্দ্রনাথের গানের সাহিত্যমূল্য না বুঝলে কিছুই হবে না। বারে বারে পড়তে হবে। বুঝতে হবে। উচ্চারণ, পাংচুয়েশন শিখতে হবে। গানটাকে চোখের সামনে দেখতে হবে। 'ভিস্যুলাইজ' করতে হবে। আমি দেখতে পারি। আমি চোখের সামনে গানকে ভাসতে দেখি।' 

সম্ভবত তাঁর বিখ্যাততম রবীন্দ্রসঙ্গীত 'কৃষ্ণকলি' সম্বন্ধে তিনি লিখেছিলেন, 'আমি কৃষ্ণকলির পাঁচটা স্ট্যানজা যখন গাইতে বসি, চোখের সামনে স্পষ্ট দেখি-'ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের পরে লোটে'। আমি দেখতে পাই: 'আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু, শুনলে বারেক মেঘের গুরু গুরু'। পাঁচটা স্ট্যানজা আমি স্লাইডের মতো দেখতে পাই।' 


বহুদিন ধরে গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইলেও রেকর্ড করেছিলেন ১৯৬১ সালের মার্চমাসে। পরবর্তীকালে এই গানটি না গেয়ে তাঁর অনুষ্ঠান কখনও শেষ হতোনা। মনে পড়ছে, ১৯৭৪ সালে জামশেদপুরে একটি অনুষ্ঠানের সকালবেলার আড্ডায় উপস্থিত শান্তিদেবকে আমরা অনুরোধ করি সন্ধেবেলা 'কৃষ্ণকলি' ও 'খাঁচার পাখি' পরিবেশন করার জন্য। তিনি তৎক্ষণাৎ পাশে বসা সুচিত্রার দিকে নির্দেশ করে বলে ছিলেন, 'ও দুটি সুচিত্রার গান। ওর অনুমতি না পেলে আমি গানদুটি গাইনা।' যথারীতি সুচিত্রা প্রতিবাদ করেন। শেষে ঠিক হয় অনুষ্ঠানের সময় সুচিত্রা 'খাঁচার পাখি' ও শান্তিদেব 'কৃষ্ণকলি' শোনাবেন। 


সাক্ষাতে বসে শোনা ছাড়াও তাঁর গীত অসংখ্য গান, যেগুলি এই অধম বিভিন্ন মাধ্যমে শুনে বড়ো হয়েছে, তার মধ্যে'নৃত্যের তালে তালে' ও 'কান্নাহাসির দোল দোলানো'র মহিমা অন্যরকম ভাবে কানে বাজে। এ প্রসঙ্গে যেটা আমার মনে হয়েছে, সুচিত্রাই প্রথম সাধারণ, পথঘাটের শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা নতুন চেহারা তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তিনি পঙ্কজকুমার, জর্জদা বা হেমন্ত ন'ন, যাঁদের কণ্ঠসম্পদ এবং ব্যক্তিত্বের প্রভাব বহুমুখী। বিশেষত পঙ্কজকুমার এবং হেমন্ত, দুজনেরই নিবেদিত শ্রোতাদল তৈরি হয়েছিলো তাঁদের বহু ধরনের গানের সঙ্গে সম্পর্কেরসূত্রে। সুচিত্রা তথাকথিত রাবীন্দ্রিক পরিবেশজাত, শান্তিনিকেতন-প্রশিক্ষিত একটি বিশেষ আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর অংশ। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক চেতনা থেকে তিনি অনভিজাতকিন্তু শ্রদ্ধাবান শ্রোতাদের মনোজগতের ঠিকানা পেয়ে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলো তাঁর ওজস্বী কণ্ঠের সঙ্গে ওতপ্রোত,সনিষ্ঠ মন্ত্র উচ্চারণের মতো পবিত্র রবীন্দ্রশ্লোকের অনিঃশেষ ধারাপাত। ছায়াছবির পর্দা বা মঞ্চজগতের জেল্লার তোয়াক্কা না করে, শুধু নিজস্ব আত্মবিশ্বাসের শক্তিতে, তিনি অর্ধশতক ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে সাধারণ-অসাধারণ সব বর্গের শ্রোতাদের অভিভূত করে রাখতে পেরেছিলেন। এখনও পর্যন্ত এই কৃতিত্বের ক্ষেত্রে তিনি অনন্য। এটা এইজন্যই সম্ভব হয়েছিলো যেহেতু সুচিত্রা মনে করতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা তাঁর একধরনের 'চিত্তশুদ্ধি'র অবলম্বন। 

অভিনয়কলার সূক্ষ্ম লক্ষণগুলি বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট ধারণা থাকার সুবাদে তিনি যখন নৃত্যনাট্য বা নাটকের গানগুলি করতেন, আধেয় চরিত্রগুলির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তা অবিকল মিশে যেতো। সঙ্গীতে নিয়ন্ত্রিতভাবে নাট্যরসের সফল প্রয়োগ প্রসঙ্গে জর্জদা ও সুচিত্রার সিদ্ধি প্রশ্নাতীত। পঙ্কজকুমার বা হেমন্তের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের মধ্যেও এই লক্ষণ সুস্পষ্ট ছিলো। কিন্তু তাঁদের ছিলো চিত্রজগতে প্লেব্যাক গায়নের বিপুল অভিজ্ঞতা। সুচিত্রার সে অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাঁর অভিনয়বিদ্যার ধারণা তাঁকে গানের নাটকীয় অংশগুলি নিখুঁতভাবে পেশ করার ক্ষমতা দিয়েছিলো। একটা ধারণা রয়েছে টপ্পাঙ্গের রবীন্দ্রসঙ্গীতে তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। মনে করিনা এই ধারণার বিশেষ ভিত্তি রয়েছে। কারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত একটি স্বকীয় গীতশৈলী। টপ্পাগানের কিছু অঙ্গ হয়তো বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেগুলি রবীন্দ্রসঙ্গীতই থাকে। টপ্পা হয়ে ওঠেনা। মুক্তছন্দের রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি সুচিত্রা সম্পূর্ণ নিজের ঢঙে গাইতেন। 'তবু মনে রেখো',' সার্থক জনম'বা 'সকল জনম ভরে' মন দিয়ে শুনলে ব্যাপারটি বোঝা যাবে। টপ্পার দানা বা মীড় কোনও গীতশৈলী নয়, অলংকারমাত্র। তার ব্যবহার শিল্পীসাপেক্ষ। সার্বভৌম নয়। মনে রাখতে হবে, ধূর্জটিপ্রসাদ তাঁর 'সার্থক জনম' শুনে ভেবেছিলেন সুচিত্রার কণ্ঠে 'টপ্পার দানা' বেশ ভালোভাবেই রয়েছে। 


সুচিত্রা ব্যক্তিপরিচয়ে নারী হলেও তাঁর পরিবেশনে কোনও 'মেয়েলিপনা' ছিলোনা। যা ছিলো, তা সামগ্রিকভাবে মানবিক অনুভূতির বিস্তৃত পরিবেশনা। সম্পূর্ণভাবে লিঙ্গনিরপেক্ষ। তাঁর আগে রবীন্দ্রসঙ্গীতে নারীকণ্ঠের গায়নে এই ব্যাপারটি দেখা যায়নি। ধূর্জটিপ্রসাদ সম্ভবত এই জন্যই বলেছিলেন সুচিত্রার গায়কী 'পুরুষালি' ধরনের। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে যে শৈলীটিকে 'মর্দানি' হরকত বলা হয় তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। 

শৈশব থেকে বিভিন্ন আসরে তাঁর গান শুনেছিবার দশেক। যখন তাঁর কণ্ঠ সম্পূর্ণ স্ববশে ছিলো অথবা বয়সের ভার যখন তাঁর স্বরপর্দায় ছায়া মেলেছিলো, দুই অবস্থাতেই। একবার একটি অনুষ্ঠানে শুনেছিলুম 'অন্ধজনে দেহো আলো'। কণ্ঠ স্ববশে ছিলো না সেদিন। কিন্তু সেই আপাত দুর্বলতাটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন গানটির অন্তর্নিহিত আর্তিটিকে গভীরভাবে প্রতিষ্ঠা করার কৌশলে। 'প্রেমসলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান,আ প্রভু'। রোমাঞ্চবোধ করেছিলুম। আসরে তাঁর গান নির্বাচনের কৌশল অন্যমন শ্রোতাদেরও গানের প্রতি টেনে রাখতে পারতো। 


রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রচলিত 'আভিজাত্য'বোধের পরিভাষাটি তাঁর সম্বন্ধে ব্যবহার করা যায়না। তিনি স্বঘোষিত ভাবে এই ধারণার বিপরীত মেরুর অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু ইতর বা অভিজ্ঞ শ্রোতা, উভয়ের মননেই তাঁর পরিবেশনার 'আভিজাত্য' বিস্তৃতি ছড়িয়ে যেতো। ঘন্টা দেড়েক তাঁর গান শুনে বাড়ি ফেরার পথে যেন আর কিছুই ভাবা যেতোনা। এক একটি গানের অনুরণন ঘুরে যেতো 'মাথার চারিপাশে'। তাঁর মেধা ও রুচিবোধ রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিপুল জগতে তাঁকে হিমালয়শৃঙ্গের মর্যাদা দিয়েছে। নীরেন্দ্রনাথের যে কবিতাটির ঊদ্ধৃতি শুরুতে দিয়েছি তার যাথার্থ্য প্রশ্নহীন, সর্বমান্য। তাঁর সর্বমান্য মহিমা অন্য কবিতায় বোধ হয় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

".... এইখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত 
এই কণ্ঠে শব্দধ্বনি ডানা মেলে 
পার হয়ে যায় পাহাড়বাতি, ফুলসাজ, চার দেয়াল 
দৃপ্ত ঝাপটে হাওয়া টলায় 
আবার নীলে নীলে ভেসে চলে 
এই কণ্ঠে শব্দধ্বনি মানুষ, পৃথিবী, ঋতু নিয়ে 
প্রাণসূত্রে দিনরাতকে বাঁধে 

এই কণ্ঠ সুচিত্রা মিত্র, 
আমি ঘরের মধ্যে গান শুনি 
ঘর? 
কই ঘর? 
আমি তো এক অনন্ত ভুবনে... 
(অরুণ মিত্র) 


1 comment:

  1. আমার সবচেয়ে প্রিয় শিল্পীকে নিয়ে এমন আলোচনা, এমন কবিতার পংক্তিগুলো, আর ইউটিউবের লিংক। আহা!

    ReplyDelete