1

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক


সোয়ানার রহস্যময় মানুষ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 

৩ 

লুডোভিকো ঘাসের উপরে চিত হয়ে শুয়েছিল। জুন মাসের একটা বিকেল, বেশ গরম তখনও। ওর চারপাশে যথারীতি ছাগলভেড়াগুলো চড়ে বেড়াচ্ছিল ইতিউতি, ঘাস খাচ্ছিল। বেশ একটা আলসেমিভরা সময় ঝিমিয়ে ছিল পাহাড়ের উপত্যকায়। ও আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে চোখ মারলো, তারপর ইঙ্গিত করলো যাতে আমিও ওরই মতো ঘাসের উপরে এলিয়ে পড়ে বিশ্রাম করি। 

আমরা অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিলাম; হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে লুডোভিকো ঢিমেস্বরে বলে উঠল, 

-‘আপনি জানেন কি যে ইরোস ক্রোনোসের থেকে বয়সে বড় এবং অনেক বেশি শক্তিশালী? অনুভব করুন আমাদের কেমন নিঃশব্দ নরম আলো ঘিরে রেখেছে। ইরোস! ... শুনতে পাচ্ছেন আশেপাশে কেমন ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ? ইরোস!’ 

দুটো গিরগিটি পাশে পাথরের উপরে একটা আরেকটাকে তাড়া করছিল। লুডোভিকোর কণ্ঠস্বরে ভয় পেয়ে দুটোই ছিটকে গিয়ে পাথরের খাঁজে লুকিয়ে পড়লো। 

‘ইরোস! ইরোস!’ ও বারবার বলে যাচ্ছিল আদেশের সুরে। আমি খেয়াল করলাম দুটো বিশাল মদ্দা ছাগল একটা আরেকটার সঙ্গে শিং বাঁধিয়ে লড়াইয়ের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। লুডোভিকোর আদেশ পেয়ে ওরা কিছুটা দূরে গেলো; কিন্তু ওদের লড়াই সেভাবে থামলো না। শিংএর খটাখটি আর ঢুঁসো মারবার ধুপধাপ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল মাঝেমাঝেই। ‘ইরোস! ইরোস!’ লুডোভিকো আবার বলে উঠলো। 

তার পরেই আমি কিছুটা বুঝতে পারলাম যে কেন লুডোভিকো সম্বন্ধে ‘অদ্ভুত’, ‘রহস্যময়’, ‘শয়তান’, ‘নাস্তিক’ এরকম নানা বিশেষণ লোকের মুখে মুখে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। 

‘আমি বরং কোনো ছাগল কিংবা গরুমোষ এদের পূজা করবো। হয়তো এর জন্য আমাকে ফাঁসি দেওয়া হতে পারে। আমি ফাঁসিকাঠে দাঁড়িয়েও এদেরি আরাধনা করবো। আমি ভুল সময়ে জন্মেছি। আজকাল এদের শক্তিকে অবজ্ঞা করা হয়, এই ব্যাপারটা আমার অসহ্য লাগে। ভাবুন একবার, জুপিটার অ্যাম্মনের ভেড়ার মত শিং ছিল। প্যানের পা ছিল কৃষ্ণকায় মৃগের মত, ব্যাকাসের ছিল ষাঁড়ের মত শিং। আমি বলছি রোমান দেবতা ব্যাকাস টাউরিফর্মিস বা টাউরিকর্ণিসের কথা। এছাড়া গ্রিক সূর্য দেবতা মিথ্‌রা, তার ছিল অতিকায় ষাঁড়ের মূর্তি।’ 

লুডোভিকো বলে যায়,... ‘আদিম সভ্যতায় তো মানুষ এদেরি পূজা করতো। যাকে দেখতে পাচ্ছে, যার শক্তিকে সে অনুভব করতে পারছে, তাকেই বিশ্বাস করবে মানুষ, তাকেই শ্রদ্ধা করবে, তাই নয় কি? শক্তিই সমস্ত কর্মের উৎস। শক্তি না থাকলে কিছুই সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এখনকার অদ্ভুত সাধুসন্ত আর সন্ন্যাসিনীদের মত ন্যাতানো ম্যাদামারা পূজা এবং উপাসনার ব্যাপার ছিলনা সেসব।’ 

‘আমি একসময় সীতাকে স্বপ্নে দেখেছিলাম!’ সে আরও বলতে থাকে... ‘সীতা রামের স্ত্রী ছিলেন। রাম নামক এক মানুষের অবতার হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণু। সব সাধুসন্ত রামের নাম করে জীবন বলিদান দিয়ে দিচ্ছে দেখুন গিয়ে। সীতাকে দেখে আমার রহস্যময়ী বলে মনে হয়েছিল; যেন জগতের সমস্ত শক্তি, সব বর্ণ, গন্ধ, রূপ, রস প্রাণ পেয়েছে তার মূর্তিতে। সব ফুল ফোটানোর রহস্য, ফল ফলাবার তৃপ্তি, ফসল- বীজের অঙ্কুরিত হয়ে ওঠার বিস্ময়, সবকিছুই মূর্ত হয়েছে সেই দেবীর শরীরে। সত্যি বলতে কি, স্বপ্নের মধ্যেই হঠাৎ আমার শরীরে-মনে কামনা জেগে উঠেছিল। জেগে উঠে তাকে না পাওয়ার কষ্টে আমি আরেকটু হলেই হয়তো বা চিৎকার করে উঠতাম!’ 

সে যখন এসব অদ্ভুত একতরফা কথাবার্তা বলছিল, আমি চুপ করে শুনছিলাম। সেই মুহূর্তে আমি ছিলাম এক অনিচ্ছুক শ্রোতা। আমি একদুটো টুকিটাকি কথা বলে উঠে পড়েছিলাম। চলে আসবো ভেবেছিলাম। কিন্তু সে আসতে দিলে তো! অগত্যা আরও একপ্রস্থ আতিথেয়তার পালা শুরু হল সেই পাহাড়ের চাতালে এবং সেই পালা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেবার যা হয়েছিল তা জীবনেও ভুলবোনা। চাতালের গায়ে যে ছোট কুটিরটা ছিল, সেটার ভিতরে আমি আগে কোনোদিন ঢুকিনি। সেদিন লুডোভিকো আমায় সেই ঘরটার বর্গাকৃতি চার দেয়ালের ভেতরে নিয়ে গেলো। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, সাজানো গোছানো, ঘরটা গরম রাখবার জন্য ফায়ারপ্লেস— এসব দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সেটা একেবারেই কোনো চাষাভুষো মেষপালকের ঘর হতে পারেনা। ঘরের মধ্যে টেবিলে কাগজ, কলম, কালি, আলমারিতে সাজানো বই, ছোটখাট একটা লাইব্রেরি- যেখানে গ্রিক আর ল্যাটিন লেখকদের বই রাখা আছে। মনে হচ্ছিল কোনো সংস্কৃতিবান বিদগ্ধ শিক্ষিত মানুষের বসবার ঘর। 
-‘হ্যাঁ, আপনার কাছে আর লুকিয়ে রাখবার মানে নেই কোনো!’ বলে উঠল সে... ‘বুঝতে পারছেন তো যে আমি সম্পন্ন শিক্ষিত পরিবারের এক বিপথগামী সন্তান। আপনার কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক যে কীভাবে আমি শহুরে থেকে একদম গাঁইয়া, প্রাকৃতিক হয়ে উঠলাম! কিংবা বন্দীদশা থেকে কীভাবে মুক্তি পেলাম, ধ্বংস হয়ে যাওয়া হতভাগ্য একটা মানুষ থেকে কীভাবে ফিরে পেলাম নিজের ছন্দ, কীভাবে হয়ে উঠলাম এখনকার মত সুখী, পরিতৃপ্ত একটা মানুষ, এসব ভাবনা যে কারো মনে আসতে পারে। কিংবা কীভাবে এবং কেন আমি নিজেকে এখনকার বুর্জোয়া সমাজ এবং ক্রিশ্চান ধর্মভাবনা থেকে সরিয়ে রেখেছি, এটাও খুব চিন্তার বিষয় হয়ে উঠতে পারে!’ একনিঃশ্বাসে এতগুলি কথা বলে সে হাহাহাহা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। তারপর মুচকি হেসে আবার বলে উঠলো, ‘হয়তো কোনো একদিন আমি গল্প লিখবো, হ্যাঁ, আমার জীবনের গল্প, আমার রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার গল্প।’ 
আমার কৌতূহল এবং টানটান উত্তেজনা কিছুটা হলেও আপনা থেকেই প্রশমিত হয়ে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম যে হয়তো প্রকৃতিই ওর রূপান্তরিত হয়ে যাবার অন্যতম কারণ। ও প্রধানত প্রকৃতি, প্রাকৃতিক চিহ্ন, শক্তি এসবের উপাসক। এগুলোকেই যে ও শ্রদ্ধাভক্তি করে, সেটা তো ওর কথাবার্তা থেকেই পরিষ্কার। 
সেইদিনের সান্ধ্যভোজ বিশেষ উপভোগ্য ছিল; সেই পাথরের টেবিলে, জলভর্তি পাথরের আধারের পাশে চাতালের উপরে বসেছিলাম আমরা। আগের থেকেও অনেক বেশি সুস্বাদু এবং নানারকমের পদ পরিবেশন করেছিল লুডোভিকো। পোড়া মাংসের রাং, চীজ, রুটি, খোবানি, আঙুর, মদ এসব তো ছিলই। আরও অনেকরকমের টুকিটাকি পদ ছিল। ওকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিলাম আমি। নাহ, ওর কথাবার্তার মধ্যে কোনো উদ্ধতভাব ছিলনা কোথাও, বরং ও বেশ প্রসন্ন, শান্ত ভাবে কথা বলছিল। 
খাবার পরে পাথরের টেবিলটা পরিষ্কার করে বসেছিল ও আমার সামনে। সেসময়ের প্রতিটি মুহূর্ত এভাবে মনে আছে আমার, যেন গতকাল ঘটেছিল সব। আগেই বলেছি যে প্রায় কাঁধ অবধি লম্বা ঢেউখেলানো চুল ছিল ওর, দাড়িও বেশ লম্বা আর পশুর চামড়ার পোশাক পরতো সবসময়। হঠাৎ দেখলে বন্য প্রকৃতির বা গ্রাম্য চাষাভুষো বা মেষপালক মনে হওয়াই স্বাভাবিক। গায়ের রং ছিল রোদে পোড়া, ব্রোঞ্জের মত। তবে ওর মুখের দিকে তাকালে দোনাতেল্লোর ভাস্কর্যের জনকে মনে পড়বে। ওর মুখের গড়ন, অভিব্যক্তি সবকিছুর সঙ্গেই জনের অদ্ভুত মিল। একনজরে দেখে যে কেউ বলবে যে লুডোভিকোকে দেখতে ভারি সুন্দর। ওর মুখের খুশিখুশি ভাবের আড়ালে একটা অদ্ভুত রহস্যময় ভাব ছিল, এটা খুব লক্ষ্য করলে বোঝা যেত। সব মিলিয়ে ওকে একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বলে মনে হত আমার। 
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সেই মুহূর্তটার কথা। হঠাৎ মনে হল লুডোভিকোর চেহারাটা যেন বদলে গেছে। আগের মুহূর্তেও ওকে ভীষণ প্রাণচঞ্চল, আমুদে বলে মনে হচ্ছিল। হঠাৎ যেন মনে হল ও একটা পাথরের, না না, ব্রোঞ্জের মূর্তিতে পরিণত হয়েছে। স্থির, স্থাণু হয়ে বসেছিল ও। আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো সে। কেমন ছেলেমানুষি সারল্য সেই হাসিতে! 
‘আসলে এই কথাটা আমি আগে কাউকে বলিনি!’ ও ধীরে ধীরে বলছিল... ‘আমার এসব বলবার সাহস কোত্থেকে এলো, জানি না। পুরনো অভ্যেসে আমি এখনও বই পড়ি; মাঝেমধ্যে কালিকলম নিয়ে নাড়াচাড়া করি। শীতের সময় যখন বিশেষ কাজকর্ম ছিলনা, তখন ঘরে বসে আমি একটা গপ্পো লিখে ফেলেছিলাম। গল্প ঠিক নয়, ঘটনা... ঘটনাটা সত্যি। এখানে, মানে সোয়ানাতেই ঘটেছিল, আমার জীবনেই ঘটেছিল অনেকদিন আগে।’ ও আবার একটু অপ্রস্তুত হাসি হাসলো... ‘আপনার হয়তো ঘটনাটা মামুলি সাদামাটা বলে মনে হবে। কিন্তু আমি, মানে আমার কাছে ব্যাপারটা একটু... একটু আলাদা, একটু বিশেষ! সেটা কেন, সেটা এখনই বলছিনা।’ 
এবারে ও সরাসরি আমাকে অনুরোধ করলো, ‘আপনি কি আরেকবার আমার বসার ঘরে আসবেন একটু? হয়তো আপনার কিছু মুল্যবান সময় নষ্ট হবে গল্পটা শুনতে। হয়তো আপনার কোনো লাভই হবেনা এরকম মামুলি একটা গল্প শুনে। তবুও... অবশ্য যদি আপনি চান, তাহলে গল্পের পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো সব আমি এই পাহাড়ের উপর থেকে ফেলে উপত্যকার বাতাসে ছড়িয়ে দিতে পারি।’ 
বলা বাহুল্য, ও সেরকম অদ্ভুত কিছু করেনি। একটা মদিরার বড় জাগ হাতে নিলো ও। আমাকে আবার নিয়ে গেলো ঐ কুটিরের ভেতরে। পাহাড়িয়া মেষপালক সে, তাই তার পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছে ছাগলের চামড়ার উপরে; ধারালো টানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। আমাকে উৎসাহ দেবার জন্য লুডোভিকো প্রথমেই আমাকে একপাত্র মদ খাইয়ে দিলো যাতে অন্তত একটিবার গল্পের নদীতে ঝাঁপ দিয়ে একখানা ডুব দিই আমি, যাতে গল্পের নদীর তীর থেকেই ফেরত না আসি। তারপর নরম কণ্ঠস্বরে সে শুরু করলে আখ্যান... 



(চলবে) 

গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 

1 comment: