0

ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in


ধারাবাহিক


পায়ের শব্দ
সোমঙ্কর লাহিড়ী


১৩ 

পরেরদিন রাতে গণেশ যখন ওর সাথে দেখা করতে এলো তখন বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল, 

মাল্টাকে কি একেবারে হাপিস করে দিয়েছিস নাকি? 

কেন? 

একেবারে লা পাতা, কোথায় আছে অবধি বাড়ির পাড়ার লোকে হদিস দিতে পাচ্ছে না, থানা পুলিস করছে। মেরে টেরে দিসনি তো? 

আমি জানি না দাদা। ভালো করে খোঁজ করতে বল না, তোমার পার্টীকে। যাই হোক টাকা পয়সা কিছু দেবে? 

গণেশ হেসে বলল, 

এখন কাজ হয়ে গেছে যদি আর টাকা না দিই? 

সঞ্জয় ওর কাজের টেবিল থেকে মুখটা তুলে শান্ত ভাবে তাকাল। তারপরে আরো শান্ত ভাবে বলল, 

সোনার ডিম দেওয়া হাঁসের গল্পটা জানো? 

ঐ ঠাণ্ডা সাপের দৃষ্টি আর ঐ শান্ত গলার আওয়াজে একটা কিছু ছিল, গণেশের মতো ঘাঘু মাল অবধি একটু নড়ে গেল ভেতর থেকে। বাইরে কোন কিছু প্রকাশ করল না বটে তবে একটা অকারণ আওয়াজ করা হাসি দিয়ে বলল, 

আরে মাজাক করছিলাম, তুই ঐসব সিরিয়াসলি নিস না। এই নে টাকা। 

দুদিন পরে তার পার্টি যখন ফোন করে একেবারে উচ্ছসিত হয়ে গণেশের কাজের প্রশংসা করল তখন গণেশ শুধু কায়দা করে নার্সিংহোমের নামটা জেনে নিল। সেখানে গিয়ে ভিজিটিং আওয়ার্সে সেই লোকটার ঘরে ফুলের বোকে নিয়ে ঢুকে লোকটার অবস্থা দেখে নিজেই শিউরে উঠল, আসিডে মুখটা পুরো জ্বলে গেছে, দুটো চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। 

গণেশ নিজে মস্তানি করেছে, মারামারি, দলবেঁধে এলাকা দখল করতে গিয়ে খুন খারাপি যে করেনি তা নয়, এলাকায় বা সোসাইটিতে নাম ধরে রাখতে গেলে এইগুলো করতেই হয়, কিন্তু এই রকম নৃশংসতা ওর ধারনার বাইরে। শুধু তাই নয় এটা করার পরে ঐ রকম ঠাণ্ডা থাকা। না এ মালকে সামলে রাখলে সুপারীর বাজারে ওকে টপ করতে কোন অসুবিধা হবে না। তবে সাবধানে। একা কি করে যে এত কিছু করল কে জানে। 

সঞ্জয় টাকাটা নির্বিকার মুখে নিল, তারপরে বলল, 

আমাকে যে ফোন থেকে ফোন করবে সেটা থেকে আর কারোকে ফোন কোরো না। আর মালের ঘোরে দলের ছেলেদের কাছে আমার নামটা দয়া করে বলে দিও না। কাজ থাকলে নেওয়ার সময় জানিয়ে দিও যে মিনিমাম দিন পনের টাইম লাগবেই। না হলে হবে না। ঠিক আছে। 

গণেশ একগাল হেসে বললে, 

লক্ষীছেলে। তারপরে চলে গেল। 

ভালোকাজের মতো খারাপ কাজেও নাম খুব তাড়াতাড়ি ফাটে যদি কাজটা নিখঁত ভাবে করা যায়, গণেশেরও ফাটল। দিন দশেক বাদেই আবার কাজ, এবারে কেসটা পাঠিয়েছে সেই দুই উপকৃত লোক। তাদেরই এক সহব্যবসায়ীর অনেকগুলো টাকা প্রায় আশি লাখের মতো হবে আনুমানিক, তার বৌ আর পেয়ারের ড্রাইভার নিয়ে পালিয়েছে। 

গণেশের ফোন এলো, 
শোন একটা কাজ করে দিতে পারবি? 
চেষ্টা করব গণেশদা। 

খুব সোজা কাজ, একজনের বৌ তার অনেক টাকা মেরে দিয়ে ড্রাইভারের সাথে পালিয়েছে। 

কি করতে হবে? টাকা উদ্ধার? না বৌ উদ্ধার? নাকি ড্রাইভার? 

না মানে পার্টি বলল, টাকাটা পেয়ে গেলে আর বাকী দুটো ব্যাপার করতে হবে না। 

পুলিশে যেতে বল, তুমি ঝামেলায় নিজেকে জড়াচ্ছ কেন? 

না মানে... 

দাদা আগে পার্টির কাছে ঠিক করে নাও যে সে কি চায়? না হলে একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলবে পরে সেটা হয়ে গেলে বলবে অন্য আর একটা ব্যাপার, আমি ঐ ভাবে তো কাজ করতে পারব না। 

একটু বাদে ফোন এলো, 
শুধু টাকাটা উদ্ধার করতে হবে, আর কিছু নয়। 
বৌ আর ড্রাইভার? 
মাঝে বাধা দিতে এলে টপকে যদি টপকে যায় তো কোন ব্যাপার নয়। 
অনেকগুলো খবর লাগবে? 
কি? 
পার্টি নিজে কোথায় ফুর্তি করতে যেত? 
ড্রাইভার কলকাতার? নাকি বাইরের? যেখানকারই হোক না কেন পুরো ঠিকানা। 
বৌয়ের আত্মীয় স্বজন আর প্রিয়বন্ধু বান্ধবের নাম ঠিকানার লিস্ট। আর দুজনের ছবি। 
কদিন সময় নেবো? 
দিন পনের। আর জানিয়ে দিও দেরী হলে ঐ টাকার পরিমান কমে যাবে কিন্তু। তখন যেন কাঁদতে না বসে। 
রাতে যখন গণেশ আর সঞ্জয় দেখা করল তখন সব খবরের সাথে সেই বৌয়ের ছবি দেখে সঞ্জয় হেসে ফেলে বলল, 
বাবা একে নিয়েও তবে লোক পালিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে? 
বাদ দে। আগে কত নিবি বল? 
আশী লাখের মামলা, আশি হাজারই দাও, পরে আরো দুই। 
বাব্বা! তোর তো খাঁই বাড়ছে রে? 
তোমার দলে যতগুলো ছেলে আছে সবাই কে লড়িয়ে দাও গণেশদা কেউ যদি টাকাটা বার করতে পারে তবে তোমার জুতো মাথায় নিয়ে ঘুরব। 

লেনদেনের পরের দিন সকালেই নাম আর সম্ভাব্য ঠিকানা নিয়ে সঞ্জয় গেল তার নির্দিষ্ট এজেন্সির কাছে। একদম স্পেসিফিক নির্দেশ দিল যে তার কি কি খবর চাই। 

বৌটার আর ড্রাইভারটার খবর যে এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে সেটা সঞ্জয় নিজেও ভাবেনি। 

ডায়মন্ডহারবার রোডের উপর একটা রিসর্টে দুজনে রয়েছে সেই খবরটা পাওয়ার সাথে সাথেই তাকে পরবর্তী কাজ শুরু করে দিতে হল। 

ঐ একই রিসর্টে একটা ঘর ভাড়া করে সঞ্জয় উপস্থিত হল খবর পাওয়ার পরেরদিন। 

তারপরে ভোর রাতে নির্দিষ্ট ঘরের দরজায় বেল টিপল। 

ড্রাইভারটার পক্ষে ঘুম চোখে আধো আলোতে বোঝা সম্ভব হয়নি পিস্তলটা আসল না নকল। 

ঘাবড়ে গিয়ে দরজাটা খোলার সাথে সাথে বাঁ হাতের ছোটো হাতুড়িটা দিয়ে কপালের ঠিক মাঝখানে সপাটে এক ঘা লাগাল সঞ্জয়। 

খুলি ফাটার শব্দটা বন্ধ ঘরে যে এত জোরে শোনাবে সেটা তার নিজের ও বিশ্বাস হয়নি। 

ড্রাইভারটা কাটা গাছের মতো মেঝেতে পরে গেল। 

পরপর দুটো শব্দ সেই মহিলাকে ঘুম থেকে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। আর ঘুম থেকে ওঠার সাথেসাথে ঘরের মধ্যে অপরিচিত একজনকে দেখে আর ড্রাইভারটাকে মেঝেতে রক্তের মধ্যে পরে ছটফট করতে দেখে সেই মহিলা কি করবে ভেবে পেলো না। 

সঞ্জয় ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল, তারপরে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, টাকাটা কোথায়? 

কাঁপা কাঁপা হাতে সেই মহিলা ওয়াড্রোবের দিকে দেখাল। 

ওয়াড্রোবের নীচের তাকে একটা বড়ো সাইড ব্যাগে টাকাটা রয়েছে। ব্যাগটা নিয়ে খাটের উপর রাখল রক্তাক্ত ড্রাইভারটার পায়ের কাঁপুনি দেখে বুঝতে পারল তাকেও এখুনি নিজেকে শান্ত করার জন্য কিছু করতে হবে। পকেট থেকে ছোটো একটা শিশি বার করে ছিপি খুলে মহিলার নাকের কাছে চেপে ধরল। যখন বুঝল যে মহিলার আর জ্ঞান নেই, তখন নিজের পাজামার দড়িতে হাত দিল। 

রিসর্টের বেয়ারা দারোয়ান ইত্যাদিদের অনেক কিছু দেখেও নির্বিকার থাকতে হয়, না হলে চাকরিটা থাকে না। তাই গেটের সিকিয়োরিটির লোকটা যখন দেখল আগের দিনের আসা লোকটার একরাতে চুলটা কাঁচা পাকা হয়ে গেছে, আর একটা মোটা গোঁফ গজিয়ে গেছে তখন সে ব্যাপারটা মাথায় রাখল, কিন্তু মুখের ভাবে তার প্রকাশ হল না। শুধু জিজ্ঞাসা করল, 

গুডমর্নিং স্যার। এত সকালে তো ট্যাক্সি পাবেন না, গাড়ি আরেঞ্জ করে দেবো কি? 

সঞ্জয় হেসে বলল, 

না না ঠিক আছে। কিছু একটা পেয়ে যাবো। 

এরপরে দুটো ঘটনা হয়েছিল। এক, বেলা বাড়লে রিসর্টের একটা ঘর থেকে একজন পুরুষের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল। সাথে বিছানায় অজ্ঞান এক মহিলাও ছিলেন। দুই, পুলিস যখন আসে তখন সেই সিকিয়োরিটি গার্ডটি রিসর্ট ম্যানেজারকে খুব চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল যে লোকটা খুব ভোরবেলায় চলে গেল তার ব্যাপারে পুলিসকে কিছু বলব কি? 

রিসর্ট চালানো ম্যানেজার তো সে আর এক ঘুঘু, শুধু নানা পাটেকরের মতো তাকিয়ে গার্ডটাকে বুঝিয়ে দিল বললে কি হবে। 

থানার অফিসারকে চেম্বারে বসিয়ে লকার খুলল, এই সবের জন্য একটা আপৎকালীন ফান্ড রাখতেই হয়। আর একটা লোক ঘরের প্লেন মেঝেতে পরে গিয়ে কপালের ঠিক মাঝখানে, মানে দেব দেবীদের তৃতীয় নয়ন যেখানে থাকে সেখানে গর্ত করে ফেলেছে আর শুধু করেওনি নিজেনিজে মরেও গেছে, সে রিপোর্ট কি আর এমনি এমনি লেখা হবে? 

অফিসার ভদ্রলোক সাধারন রেটের থেকে পঞ্চাশ বেশীই নিলেন, নিজের কোন প্রিয়জনের কাঞ্জিভরমের আবদার মেটাতে। আর সব ঠিকঠাকই লিখে দেবেন বললেন, শুধু কতগুলো ব্যাপারে ওনার মনেও একটা খচখচানি ছিল, সেটা হল মৃত লোকটির শরীরের উপর সিমেন মার্ক, মহিলার মুখে ক্লোরোফর্মের গন্ধ। আসলে কি হয়েছে সেটা বুঝতে তো আর বেশী বুদ্ধি লাগাতে হয় না, পুলিসের চাকরির ট্রেনিং এর সময়েই সব শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়। এখন শুধু রিসর্টকে আর ম্যানেজারকে বাঁচিয়ে রিপোর্টটা লিখতে হবে। শুধু যাওয়ার আগে সি সি ক্যামেরার রেকর্ডিংটাও নিয়ে নিলেন। হাজার হোক পুলিস তো। আর কোথাও তো একটা অস্বাস্তি কাজ করে। তাই না? 

এসপ্ল্যানেডের সুলভ শৌচালয়ের লোকটা একটা জিনিস দেখে অবাক হল, কাঁচা পাকা চুলের গোঁফওয়ালা একটা লোক ঢুকল আর কালো চুলের গোঁফ কামানো একটা কম বয়েসই ছেলে বেরিয়ে এলো। 

নেশার খোয়ারি কাটার আগে গণেশ সঞ্জয়ের ফোন পেল, 
সব হয়েগেছে। মাল নিয়ে যাবে কখন? 
টাকাটা নিতে এসে গণেশ এক গাল হেসে জিজ্ঞাসা করল, 
কত আছে? 
গুনে দেখিনি। তুমি দেখে নিতে পারো। 
আশি লাখ!! 
কিছু তো খরচ করে ফেলেছে, দিন কতক কাটিয়েছে না। 

তুই কি করে এত তাড়াতাড়ি ধরলি? মাইরি মাইরি কাউকে বলব না একটু খোলসা করে দে আমাকে। 

আরে বাবা একটা হোৎকা উপোষী বৌ আর একটা মুখ্যু ড্রাইভার, কদ্দুর যাবে? হয় ড্রাইভারটা তার মালিককে নিয়ে যেখানে যেখানে যেত তার আশেপাশে যাবে বৌটাকে নিয়ে ফুর্তি করতে, না হয় তার নিজের দেশের বাড়ি বলে যদি কিছু থেকে থাকে তো সেখানে, তবে এই ক্ষেত্রে দেশের বাড়ি ব্যাপারটা বাদ দেওয়া যেতেই পারে। সাথে একটা বিয়েওয়ালা জলহস্তি নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়ে সামলাতে পারবে না। আর না হলে বৌটার কোন এক বন্ধু বান্ধবীর বাড়ী, সেটাও হওয়ার চান্স এক্ষেত্রে কম, তারাও ওকে থাকতে না দিতে পারে, ড্রাইভারটার যা বিলা থোবনা আর ক্যাংটা চেহারা, যে কেউ বুঝবে ছ্যাঁচড়া ছোটোলোক মাল। তাই পাত্তা দেবে না। তবে হ্যাঁ একশটে ঐ রিসর্টেই যে মাল দুটোকে পেয়ে যাবো সেটা লাক। আবার লাক নাও বলতে পারো ওর মালিক ওর পাশের রিসর্টেই মেয়ে নিয়ে যেত সবচেয়ে বেশী। তাই ওটাই ছিল হয়ত ওর ন্যাচারাল সিলেকশান। 

শালা তোর মাথায় কি আছে রে? 
বদবুদ্ধি। এখন মালটা নিয়ে যাও। 
গণেশ লোভাতুর চোখে ব্যাগটার দিকে চেয়ে বলল, 
ঝেড়ে দেব? 

ছ্যাঁচড়া ক্রিমিনাল থেকে নামি ডন হতে গেলে যে ক্যালমা লাগে তোমার সেটা নেই মনে হচ্ছে গণেশদা। এখন যদি ঐ আট লাখের দুঃখে তোমার পার্টি খুঁজে খুঁজে আমার কাছে এসে তোমায় মারার কথা বলে আমি তখন আবার তোমার পিছনে হাত ধুয়ে পরে যাবো। 

গণেশ একবার কঠিন চোখে সঞ্জয়ের দিকে তাকাল, তারপরে বুঝতে পারল সঞ্জয় তাকে ভয় পাচ্ছে না ওর নিজের মনে হল একটা গোখরো সাপের সামনে বসে আছে। একটা মুহুর্তের মধ্যে দুজনের দৃষ্টির মধ্যে এমন একটা ব্যাপার তৈরী হয়ে গেল যে, যে আগে নরম হবে সে মরবে। 

গণেশ হেসে বলল, 
বাদদে ওসব। 

সঞ্জয় না হেসে খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল, 
আমাকে মারবে মনে করার সাথেসাথে মেরে দিতে পারলে তুমি বেঁচে গেলে। 

না হলে কি হবে গণেশ তার উদাহরণ পেয়ে গেছে। তার দলে দুঃসাহসী হয়ত অনেকে আছে, কিন্তু এর মাথা চলে হাতের আগে।

0 comments: