0

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


গীতারহস্যামৃতম
(দ্বিতীয় পর্ব)
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী


(৪) 
মহাগ্রন্থ গীতা ভক্তের জন্য ভক্তিযোগ, কর্মীর জন্য কর্মযোগ, রাজপুরুষদের জন্য রাজধর্ম-রাজগুহ্যযোগ, সন্ন্যাসীদের জন্য সন্ন্যাসযোগ, দার্শনিকদের জন্য সাংখ্যযোগ, অনুশীলনকারীদের জন্য অভ্যাসযোগ, আদর্শ পুরুষদের জন্য পুরুষোত্তমযোগ ইত্যাদি প্রায় সর্বসাধারণের জন্য এক কথায় এক অসামান্য হাতে গরম রেডিমেড হ্যান্ডবুক হিসেবে মহাকালের দরবারে চিরকালীন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। 

এত স্বল্প পরিধিতে এত ব্যপকতা আর কোনও গ্রন্থে নেই বললে নিশ্চয় অতুক্তি করা হবে না বলেই আমার মনে হয়। 

গীতা মহাগ্রন্থটি দার্শনিক তথ্যের স্বর্ণখনি। তবু এই মহাগ্রন্থটি ভীষণভাবে ইউসার ফ্রেন্ডলি। মহাগ্রন্থ গীতা কেবল নীতিজ্ঞানের শাস্ত্র নয়; নীতিশাস্ত্রের মতো শুধু ভালো আর খারাপের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেই ক্ষান্ত হয় না বরং গীতা মহাগ্রন্থে যেটা মহাপ্রাপ্তি সেটা হলো মানুষ যদি গীতা নির্দেশিত পথ অনুযায়ী জীবনযাত্রা নির্বাহ করে তবে তার যা ভালো তার ওপর তোমার মন বসবে আর যা খারাপ সেই অকর্ম সম্পাদন থেকে বিরত থাকবে। আর তার ফলে সে একটি সুখী, শান্তিময়, উদ্বেগহীন জীবন যাপন করতে সমর্থ হবে। 

গীতাকে ধর্মগ্রন্থের থেকেও আরও উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে তাকে মহাগ্রন্থের শংসাপত্র দিতে চাইবার এটি আর একটি কারণ বলেই আমার কাছে বিবেচিত হয়েছে। 

রাজশেখর বসুর মতে গীতা মহাগ্রন্থ পাঠে সর্বসাধারনের মোক্ষ লাভ হবে কিনা, তা আমার জানা নেই বটে, তবে এই মহাগ্রন্থে Self-upliftmentএর জন্য একটা পথের সন্ধান দেওয়া আছে।সে পথে ক্রমে-ক্রমে অল্পে-অল্পে অনুশীলনের মাধ্যমে অগ্রস্রর হতে পারলে আপনআপন চরম লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।আর সেই লক্ষ্য যদি ব্যক্তি বিশেষে মোক্ষ লাভ হয়, তবে তাও প্রাপ্ত হতে পারে। 

সর্বসাধারণ সব সময়ে এই পথের চরম লক্ষে পৌঁছতে পারবে কিনা, তা জানা নেই তবে এই পথে অন্তত কিছুটা অগ্রসর হতে পারলেও মানুষ কৃতার্থ হতে পারে... স্বল্পমপাস্য ধর্মস্যত্রায়তে মহতো ভয়াৎ” (সাংখ্য্যোগ – ৪০তম শ্লোকের অন্ত) – এই ধর্মের অতি অল্পও মহাভয় থেকে ত্রাণ করে। 

মনে রাখতে হবে উদ্বেগই উপভোগের প্রধান অন্তরায়। যেহেতু জাতি-ধর্ম, উচ-নীচ সর্বস্তরের মানুষের-ই উদ্বেগহীন শান্তিময় সুখী জীবন উপভোগই একমাত্র কাম্য, সেহেতু গীতা মহাগ্রন্থটি মানবজীবন যাপনের একটি অতীব জরুরি পাথেয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। 

পটলবাবুসহ আম জনতার গীতামহা গ্রন্থটি পাঠের এটাই একমাত্র কারণ হিসেবে ধরা যায়। 

জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে… এই আপ্তবাক্যটি গীতা মহাগ্রন্থটিতে অতি সরলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এই মহাভয় থেকে পরিত্রাণের সোপান গীতা মহাগ্রন্থে বহুভাবে বর্ণিত হয়েছে। জন্ম-মৃত্যুর এই দুই দ্বারের মধ্যবর্তী গমনপথেই জীবন এবং তা সদাই মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত। জন্মাবার পর থেকেই মানুষ যদি সদাসর্বদা মৃত্যুভয় নিয়ে জীবনযাপন করে চলে তবে সেই জীবন বিষময় হতে বাধ্য। এই মহাভয় থেকে নিস্তার পাবার জন্য মহাগ্রন্থ গীতাতে যেমন বহু তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে, তেমনই মৃত্যুভয় থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কি ধরনের জীবনযাত্রা অবলম্বন করা উচিৎ, তাও গীতা মহাগ্রন্থে বলা হয়েছে। 

(৫) 
এই প্রসঙ্গে গীতায় বর্ণিত কয়েকটি শ্লোকের দিকে নজর দেওয়া যাক। 

মৃত্যু অবসম্ভাবী প্রসঙ্গে সাংখ্যযোগের ২৭তম শ্লোকে দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, 

“জাতস্যহি ধ্রূবো মৃত্যু ধ্রূবং জন্মমৃতস্য। 
তস্মাদ পরিহার্যেহর্থেনতং শোচিতুমর্হসি।। 
(জাতব্যক্তির মৃত্যু ধ্রূব এবং মৃতের জন্ম ধ্রূব। 
অতএব অনিবার্য বিষয়ে তুমি শোক করতে পার না।। ) 

তার আগে শ্রীকৃষ্ণ আত্মার অবিনশ্বরতা নিয়ে অনেক বক্তব্য রেখেছেন। যেমন – 

(সাংখ্যযোগের ২০তম শ্লোক) 

নজায়তে ম্রিয়তেবাকদাচিন্নায়ং ভূত্বা ভবিতাবান ভূয়ঃ। 
অজোনিত্যঃ শাশ্বতোয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।। 

(ইনি কদাচ জন্মেন না বা মরেন না; অথবা এখন উৎপন্ন হয়ে পুর্নবার হবেন না–এও নয়। 
ইনি জন্মহীন, নিত্য, অক্ষয় অনাদি; শরীর হত হলে হত না।।) 

(সাংখ্যযোগের ২৩তম শ্লোক) 

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ। 
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।। 

(কোনও অস্ত্র এঁকে ছিন্ন করে না, আগুন এঁকে দগ্ধ করে না, 
জলও এঁকে আদ্র করে না, বায়ু শুষ্ক করে না।) 

এইবার দেখা যাক জন্ম-মৃত্যু এই দুই দ্বারের মধবর্তী গমন পথের জীবনযাত্রায় অবসম্ভাবি মৃত্যু ভয় থেকে নিস্তার পেতে হলে কি ধরনের মানসিক স্থিতির প্রয়োজন। 

এই প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেনঃ (সাংখ্যযোগ-১৫নং শ্লোকের অন্ত) 

“সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে” 

(দুখঃ ও সুখে সমভাবাপন্ন ধীর পুরুষই অমৃত লাভের যোগ্য) 

এই প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির গুন বর্ণনা করেছেন। আরও বলেছেন যে বিষয় সমূহের চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়। আসক্তি থেকে কামনা আর কামনা পূর্ণ না হলে ক্রোধ জন্মায়, ক্রোধ থেকে ভ্রান্তধারণা আর তাই থেকে বুদ্ধিনাশ হয় এবং সর্বশেষে বুদ্ধিনাশ হলে মানুষ বিনষ্ট হয় (সাংখ্য যোগ-শ্লোক নং ৬২/৬৩– অনুবাদক রাজশেখর বসু))। 

(বিষয়চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি হয়; আসক্তি হতে বিষয় প্রাপ্তির ইচ্ছা জন্মে; আবার সেই কামনা প্রতিহত হলে তা ক্রোধের আকার ধারণ করে, ঐ ক্রোধ হতে বিবেকনাশরূপ মোহের উৎপত্তি হয়; মোহ হতে স্মৃতিবিলোপ সাধিত হয়; স্মৃতিভ্রংশের ফলে হয় বুদ্ধিভ্রংশ এবং বিবেক বুদ্ধির নাশ হতে প্রকৃত বিনাশ সংঘটিত হয়। - আনুবাদক স্বামী অপূর্বানন্দ – শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ –ভুবনেশ্বর।) 

দুই আনুবাদকেরই বক্তব্য যখন একই তখন একথা বলতে দ্বিধা নেই যে এই সকল আত্মনিধনকারী শক্তি থেকে মনকে অচঞ্চল রেখে অনুশীলনের মাধ্যমে কর্ম বন্ধনে না পড়ে সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে সমান মনোভাব নিয়ে বুদ্ধির সাহায্যে ফলের আশা ত্যাগ করে কর্ম করে উদ্বেগহীন জীবন যাপনই স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির লক্ষ্য। 


(৬) 
এইখানে পটলবাবু তো কোন ছাড়, শ্রীকৃষ্ণের অতবড় সখা অর্জুন পর্যন্ত টাল খেয়ে গেছেন। বলে ফেলেছেন, (কর্মযোগ-২নং শ্লোক)- 

“ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে। 
তদেতং বদ নিশ্চিন্ত যেন শ্রেয়োহমাপ্লুয়াম।।” 

যার মোটা বাংলা মানে হচ্ছে “গোলমেলে কথা বলে আমাকে কনফিউজ করছ; যাতে আমার ভাল হয় সেটা ঠিকঠাক করে বলো।” 

আবার মনকে অচঞ্চল রাখার প্রসঙ্গে ম্যাঙ্গোম্যান পটলবাবুদের মতো অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে একেবারে বেসিক প্রশ্ন করে একটু বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিলেন। প্রশ্নটা একটু শোনা যাক (ধ্যানযোগ-৩৪নং শ্লোক) – 

“চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্ । 
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুস্করম ।।”  

(হে কৃষ্ণ, মন চঞ্চল, বিক্ষোভকর, প্রবল,দৃঢ় । 
আমি তার সংযম বায়ুরতুল্য সুদুষ্কর মনে করি।।) 

তবে শ্রীকৃষ্ণ অতি কুশলতার সঙ্গে এই প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন। এই জন্যই শ্রীকৃষ্ণ পুরো মহাভারতে মোস্ট ইন্টেলিজেন্ট এবং ক্ষুরধার বুদ্ধি সম্পন্ন চরিত্র হিসেবে মান্যতা পেয়েছেন। উত্তরে তিনি কি বলেছেন দেখা যাকঃ (ধ্যানযোগ-৩৫নং শ্লোক) – 

অশংশয় মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম। 
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বইরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।। 

(হে মহাবাহো, মন দুর্নিগ্রহ, চঞ্চল – নিঃসন্দেহ। 
কিন্তু, হে কৌন্তেয়, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা সংযত হয়।।) 

অতি দুরূহ একটি সমস্যার একটি অসাধারণ সমাধান! 

মনে পড়ে যায়, অঙ্কের খাতা নিয়ে কঠিন অঙ্কটার সমাধান না করতে পেরে ছেলে বা মেয়ে যখন বাবা-মা বা শিক্ষকের সামনে এসে হাজির হয়, তখন তাঁরা সন্তান বা ছাত্র-ছাত্রীদের এই উপদেশটাই দিয়ে থাকেন –মন দিয়ে অভ্যাসকর। প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস এন্ড প্র্যাকটিস অর্থাৎ অভ্যাস কর। 

তাই শুরুতেই যা বলেছিলাম তাই এখন আবার বলছি, গীতা মনুষ্য জীবনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। 

এবার একটু তার্কিকের দৃষ্টিকোন থেকে গীতাকে বিশ্লেষণ করা যাক।

শ্রীকৃষ্ণকে যদি তৎকালীন কোন এক মানব গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে ধরা যায় যিনি নিজের আধিপত্য সমস্ত পৃথিবীতে (সেকালে পৃথিবী বলতে ভারতবর্ষ এবং তার আশেপাশের দেশ গান্ধার ইত্যাদিকে ধরা যেতে পারে) বিস্তার করার ভাবনা-চিন্তা মাথায় নিয়ে একটি সূক্ষ সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা করেছেন। 

এই ছকে নিজ রাজ্য শাসণকালে তিনি পাণ্ডবদের বীরত্বের খবর পান এবং তাঁদের সাহায্যে পৃথিবীতে নিজের আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এই স্বপ্নপূরণের রাস্তাটা সহজ করেদেনস্ম্রাট ধৃতরাষ্ট্র যখন তিনি নিজের অজান্তে কৃষ্ণের পাতা ফাঁদে পা বাড়ান। কৃষ্ণ অন্ধ রাজার অন্ধ পুত্রপ্রেমের পুরো ফয়দাটা তুলে নেন। অবশ্য তার আগে জরাসন্ধ, কীচক ইত্যাদি কিছু প্রতিদ্বন্দীদের কুরুক্ষেত্রে একত্রিত হবার আগেই কৃষ্ণ পাণ্ডবদের সাহায্যে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেন। ওই সব মহাযোদ্ধারা যদি কুরুক্ষেত্রে একত্রিত হবার সুযোগ পেতেন তবে হয়ত পাণ্ডবদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারতেন। 

0 comments: