ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in ভৌতবাক
ভৌতবাক
অতৃপ্ত অশরীরি
দীপারুণ ভট্টাচার্য
ঘটনাটা ১৯৮৭ সালের। আমি তখন বি এস সি পড়তে ভর্তি হয়েছি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবে ছেড়ে এসেছি জন্মস্থান, দুর্গাপুর। একটা হোস্টেল বিল্ডিংয়ের মেরামতির কাজ চলছিলো। তাই আমরা বেশ কয়েকজন হোস্টেল পেলাম না। মেরামতি শেষ হলেই হোস্টেল পাওয়া যাবে এমন অঙ্গীকার ছিল। তবে মনে হলো, সেটা চার পাঁচ মাসের ধাক্কা। এই সময়টা বাড়ি ভাড়া নিয়েই থাকতে হবে বাইরে কোথাও। তখন ছোট্ট শান্তিনিকেতন অঞ্চলে এক সঙ্গে এত জন ছাত্র ছাত্রীর জন্য বাড়ি ভাড়া পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কাজেই শরণার্থীর মতো গাদাগাদি করে থাকতে শুরু করলাম অন্য বন্ধুদের হোস্টেলের ঘরে।
যাদের যোগাযোগ, বুদ্ধি বা টাকার জোর ছিল, তারা একে একে বাড়ি নিয়ে চলে যেতে লাগলো। শেষ দিকে পড়ে রইলাম আমারাই কয়েকজন বোকা। একদিন হারান একটা বাড়ির সন্ধান আনলো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খানিকটা দূরে বটে, তবে ভাড়াটা খুব কম। কোনও রকম চিন্তা না করেই আমরা চার বন্ধু মিলে বাড়িটা ভাড়া নিয়ে ফেললাম।
সেখানে গিয়ে জানলাম, বাড়িটি এক বিখ্যাত লেখকের। পাঁচিল ঘেরা যত্নহীন বিরাট এক বাগান। তারই একদিকে একখানা দোতলা বাড়ি, লেখক মাঝে মধ্যে ছুটি কাটাতে এলে এই বাড়িতেই থাকেন। অন্যদিকে মাটি আর ইট দিয়ে গাঁথা একটি বিশাল হল ঘর। চালটা খড়ের বটে, তবে মেঝেটি পাকা। সঙ্গে এ্যটাচড্ বাথ, জল আর ইলেকট্রিকের ব্যবস্থা। আমরা ভাড়া নিয়েছি এই ঘরটা।
ঘরের পিছনে সাপ খোপে ভরা এক বিশালকায় গর্ত। আরও পেছনে বড় বড় গাছ আর আগাছার জঙ্গল। ত্রিসীমানায় কোন মানুষের অস্তিত্ব নেই। শুধুমাত্র এক আদিবাসী কেয়ারটেকার ছাড়া। সে থাকে দোতলা বাড়ির পেছনের দিকে ছোট্ট একটা কুঠিতে। বড় লেখকদের উপন্যাসের প্লট ভাবতে বুঝি এমনই নির্জনতার প্রয়োজন হয়।
কেয়ারটেকার রামলালচারটে ফোল্ডিং খাট ঘরটার চারদিকে সেট করে দিয়ে বলল, "যেরকম কইরে দিলাম, এই রকমই রাখবেন বটে। বিছানা লিয়া এদিক ওদিক করবেক লাই বাবুরা।" এমন নির্দেশের কারণ জানতে চাইলে সে খানিকটা আমতা আমতা করে বলল, "সাফাই করতে এসে রোজ বিছানা হ্যাঁচড়া হেঁচড়ি করতে পারবোনা বটে।"
ঘরের একদিকে রান্নার ব্যবস্থা। রাত একটু গড়াতেই আমরা চারজন খাওয়া দাওয়া সেরে, মশারি খাটিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। আকাশ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডাকছে ঝিঁঝিঁ। বেশ গা ছমছমে পরিবেশ। শুধুই মনে হচ্ছে জানলার বাইরে থেকে যদি কেউ হাত ঢুকিয়ে দেয়! বাবা বলেছিলেন, "ভয় করলেই গুরুমন্ত্র জপ করবি।" আমি, গুরুমন্ত্র জপ করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ হারান ডাকলো, "কিরে, শুনতে পাচ্ছিস?" ধড়মড় করে উঠলাম সবাই। তারপর শুনলাম; সমস্ত ঘর জুড়ে যেন একটা খুড়খুড়, খসখস্ শব্দ। উঠে আলোটা জ্বালতেই শব্দটা মিলিয়ে গেল। অনীক বলল, "ঘরের নিচে নিশ্চই ইঁদুরের গর্ত আছে। সাপে ইঁদুরে মারামারি করে বেড়াচ্ছে। একটা ছোট আলো এনে সারারাত জ্বেলে রাখতে হবে।"
পরের দিনই একটা নাইট ল্যাম্প লাগানো হল। তবে শব্দটা বন্ধ হল না। এক এক দিন মনে হতো কেউ বুঝি হেঁটে হেঁটে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে মশারির বাইরে থেকে গভীর মনযোগ দিয়ে দেখছে আমাকে। চোখ খুলে অবশ্য কিছুই খুঁজে পাইনি। এভাবে কিছুদিন চলল। তারপর আমরা চারজনেই এই পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। বেশ আনন্দেই কাটতে লাগলো সময়।
দেখতে দেখতে শুরু হল আমাদের প্রথম পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হলেই যাবো বাড়ি আর ফিরে এসেই পেয়ে যাবো হোস্টেল। আমি একা অংকের ছাত্র। বাকিদের বিষয় আলাদা। তাই তাদের পরীক্ষা শেষ হতেই তারা একে একে পালাল। এমন পরিস্থিতি হল যে, এই বাড়িতে আমাকে একাই থাকতে হবে দিন পাঁচেক। হোস্টেলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে থাকা যায় বটে, কিন্তু সেই ফাঁকে যদি জিনিস পত্র চুরি হয়ে যায়! তাই হোস্টেলের দুই বন্ধুকেই রাজি করলাম আমার সঙ্গে এসে থাকার জন্য। তারা এসে একটা রাত রইল। পরদিন সকালে উঠে দেখি একটা বিছানায় তারা দুজনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে আর ভয়ে কাঁপছে। রাতে ঘরের মধ্যে তারা কি যেন দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। গলা দিয়ে আওয়াজ করে আমাকে ডাকতেও পারেনি। তাদের আর ধরে রাখা গেল না। ঘটনাটা মুহূর্তে রটে গেল। কাজেই আর কেউ আমার সঙ্গে এসে রাত কাটাতে রাজি হলো না। অগত্যা একাই রইলাম বাকি দিনগুলো।
নির্বিঘ্নেই কাটলো দুটো দিন। কোথাও যাওয়ার নেই। সারাদিন পড়াশুনা, খাওয়া আর ঘুম। বলতে নেই, পড়াশুনাতে আমি ভালোই ছিলাম। মোটে একটা পেপার বাকি। আমি তখন পরীক্ষার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি। দুটো রাত কাটলেই পরীক্ষা আর তারপরই দুর্গাপুর ফেরা। মনে বেশ একটা আনন্দের ভাব। সমস্যা ছিল শুধুমাত্র আবহাওয়া। সেবার গরম ছিল মারাত্মক। এতটুকু বৃষ্টি নেই। ঘেমে ঘেমে শরীর অতিষ্ঠ। হঠাৎ মনে হল খাটটা টেনে দুই জানলার মাঝখানে রাখলে একটু বেশিই হওয়া আসবে। তাই করলাম। খাওয়া শেষ করে খাটে বসে পুরনো নোট্সগুলো উল্টে পাল্টে দেখছি, এমন সময় হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন আমার পিছনে এসে বসলো। পিছন ফিরে তাকাতেই ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। যাঃ, লোডশেডিং। টর্চ জ্বেলে অবশ্য কিছুই দেখতে পেলাম না। বাইরে বেরিয়ে এলাম। চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। একটু দাঁড়িয়ে সেই পরিবেশ উপভোগ করছি, এমন সময় আলো এসে গেল। ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে খড়ের চালের কালো কালো বাটামের সংখ্যা গুনতে লাগলাম। তখন ঘরে জ্বলছে সেই নাইট বাল্বটা। কোথায় যেন খসখস করে খানিকটা শব্দ হলো। হঠাৎ দেখলাম একটা কালো ধোঁয়ার মত কুণ্ডলী ঘুরছে মাথার ওপরে। সেটা যে ঠিক কি তা বোঝার আগেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেশ বড়ো আকৃতি ধারণ করে আমার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওপর থেকে মানুষ যে ভাবে লাফিয়ে পড়ে ঠিক সেই ভাবেই। ছায়া মূর্তির এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণে আমি তখন হতবাক; কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মুহূর্তের মধ্যে শরীর আমার ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেল। কানের মধ্যে ভোঁভোঁ শব্দ হচ্ছে। আর চোখের সামনে দেখছি ঘন কালো একটা ধোঁয়ার মতো একটা মানব আকৃতি আমার বুকের উপর বসে আছে। তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে আমার মুখ পুড়ে যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি তার চোখে জ্বলছে ঘৃণার আগুন। সে প্রথমে আমার মুখে তিন চারটে ঘুষি মারার চেষ্টা করল। আমার মাথাটা এদিকে ওদিকে দুলে উঠলো প্রচণ্ড জোরে। তারপর ছায়ামূর্তি আমার গলা টিপে শ্বাস বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলো। কি প্রবল তার আক্রোশ। খাটটা পর্যন্ত শব্দ করে দুলে উঠলো। তাক থেকে পড়ে গেল বাসনপত্র। শ্বাস বন্ধ অবস্থায় কিছুক্ষণ থাকতেই আমার পা দুটো ছটফট করতে লাগলো। আমি বুঝতে পারলাম আমার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসতে লাগলো শরীর। এবার ছায়ামূর্তি তার হাতের জোর বাড়াল। আমি বুঝতে পারলাম আমার শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে। এক শান্ত অনাবিল পুকুরে আমি যেন ক্রমশ ডুবে যাচ্ছি। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল পরিচিত মুখ গুলি। প্রথমে মায়ের শান্ত মুখচ্ছবি। তারপরেই এলেন বাবা। আর তখনই মনে পড়ল বাবার নির্দেশ। শেষ প্রাণশক্তিটুকু দিয়ে আমি মনে মনে গুরুমন্ত্র জপ করতে লাগলাম। আর তারপরই ক্রমশ আলগা হতে থাকলো গলার চাপটা। একটু শক্তি ফিরে পেয়েই আমি তেড়েফুঁড়ে উঠতে গেলাম। যেন এক অসীম শক্তিশালী প্রেতাত্মাকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করছে এক তরুণ বাঙালি। এমন সময় ধোঁয়ার মূর্তিটিকে লাথি মারবো বলে যেই না পা ছুঁড়েছি সঙ্গে সঙ্গেই বোম ফাটার মতো ফেটে ছিটকে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই ছায়ামূর্তি। বাকি রাতটা কিছুতেই ঘুমাতে পারলাম না। সকালেই ঠিক করলাম, আজ থেকে হোস্টেলেই থাকবো। এখানে আর থাকা সম্ভব নয়।
কথাটা রামলালকে বলতেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "চৈলে যাবেন বাবু। আপনারা থাকলে মনডা ভালো থায়ে।" আমি তখন রাগে ফুসছি।
হুমকির স্বরে রামলালকে বললাম, "না, যাবে না! এখানে কি শহীদ হতে এসেছি! ঘরের মধ্যে ভূত পুষে তুমি মানুষ মারার কল পেতেছো। আগে জানলে এই ঘর কখনোই ভাড়া নিতাম না!"
রামলাল ঘরে ঢুকে খাট সরিয়েছি দেখে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। কাঁদো কাঁদো গলায় সে বলল, "আপনি বাঁচি গেছেন বাবু"। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। পরে মনে পড়ল রামলালের সেই সাবধান বাণী, খাট সরাবেন না। কিন্তু কেন? আসল কথাটা কি? সে যা বলল তার মর্মার্থ হলো; বিশ্বভারতী কলাভবনের দুই তরুণ ও তরুণী কয়েক বছর আগে বাড়ির অমতে বিয়ে করে এই বাড়িটি ভাড়া নিয়ে সংসার পেতেছিলো। প্রথমে সব ঠিক থাকলেও পরে সেই তরুণীর সঙ্গে অন্য এক তরুণের প্রেম হয়। কিছুদিন পর মেয়েটি হঠাৎ একদিন তার প্রেমিকের সঙ্গে উধাও হয়ে যায়। ঘটনাটা জানাজানি হতেই মেয়েটির স্বামী গলায় দড়ি দেয়। গতরাতে যেখানে আমি খাট রেখেছিলাম, ঠিক তার উপরের বাটামের থেকে ঝুলছিলো তার নিষ্প্রাণ দেহটা।
দেখতে দেখতে তিন দশক কেটে গেছে। বাড়ির মালিক, স্বনামধন্য সেই লেখক দেহ রেখেছেন অনেকদিন আগেই। আজ সকালের খবরের কাগজে পড়লাম সে বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে বহুতল। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল, এক অতৃপ্ত অশরীরির গৃহহীন হওয়ার আশঙ্কায়।
(নোট: সত্যি ঘটনা অবলম্বনে। অভিজ্ঞতা:আশীষ কুমার সামন্ত। ছবি: সোময়েত্রী ভট্টাচার্য।)
0 comments: