ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
II২৯II
এই মধুর মুক্তি এ্যাতো আনন্দ এই ভালো লাগার মুক্ত বাতায়নে
পেরো
আত্মীয় বন্ধুদের সাথে দেখা করতেই সন্ধ্যে নেমে এল। ইতিমধ্যে কয়েকজন বড় বড় পাথর দিয়ে চারটি অগ্নিকুণ্ড সাজিয়েছে। শুকনো কাঠের জোগাড় হয়েছে। উনুনের দুপাশে কাঠের লগ পুঁতে খাঁচার উপর তিনটে দাঁতালো বন শুয়োর মেরে নাড়িভুঁড়ি বের করে ঝোলানো হল। পাথরে পাথর ঘষে উনুন জ্বালানো হলো। প্রত্যেক পরিবারের কাছে ভাত ও পচাই বানানোর চাল রয়েছে কিন্ত পর্যাপ্ত মাংস থাকায় পেরো বারণ করল। একটা বিশাল হাঁড়িতে মহূল সিদ্ধ হচ্ছে। দুজন মহুয়া গাছ থেকে মধুচাক পেড়ে এনেছে। মহুল সিদ্ধের সাথে মধু খেলে বেশ নেশা হয়। এছাড়া বনমুরগির পাথর খোঁয়াড় থেকে প্রচুর ডিম কুড়িয়ে এনে সেগুলো পোড়ানো হচ্ছে। প্রচুর খাবার আয়োজন। এই মুক্ত সবুজ শিবিরে একসময় অবাধ খাওয়া দাওয়া ও পান পর্ব শেষ হল। এবার আগুনের চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে কোমর জড়িয়ে নাচ। কয়েকজন জংলি মোষের শিং দিয়ে তৈরি শিঙে নিয়ে এসেছে বাজাবে বলে। জেরেকা মানা করল। ওগুলোর আওয়াজ বিউগলের চেয়ে বেশি। ওই শব্দ অনেক দূর যায়। অতএব কাঁসি ও হাঁড়ি বাজানো শুরু হল। মেয়ে ছেলে একসাথে আগুন ঘিরে শুরু করল উদ্দাম নাচ। নাচের আনন্দ থেকে একটু দূরে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ গোল হয়ে বসে। ওরা প্রত্যেকে এক একটি বস্তির ওঝা। ঝাড়ফুঁক করে ডাইনি ভুত তাড়ায় রোগের জড়িবুটি দেয়।শহরে কখনো যায় কাছারির বাইরে রুজি রোজগারের সন্ধানে। বছরের এইরকম সেনা মহড়াতে যৌন উত্তেজনা জাগানোর ওষুধ সৈনিকেরা কেনে। পেরো ও জোহা এগিয়ে এসে দেখল প্রত্যেকের কাছে বড় প্লাস্টিকের বয়ামে তেলে চোবানো ধনেশ পাখির চঞ্চু, শেয়ালের দাঁতশুদ্ধু চোয়াল, বাঘের নখ।ওই তেলগুলি তিসি, নিম, করঞ্জ ও রেড়ির তেল। সবার কাছেই বিচিত্র আকারের জড়িবুটি। বন পলাশের ছাল কৌটোতে চিতল পাথরের ঘাম গোখরো সাপের মুণ্ডু সমেত দাঁত। আর একজনের কাছে কয়েকটা কৌটোতে রাখা তেলে চোবানো বড় বড় জোঁক। জোহা এগিয়ে এসে আঙুল বাড়িয়ে বলল, - যেখানে তোমরা যাচ্ছ সেখানে এগুলো নিয়ে যাওয়া যাবে না। ওগুলো এখানে কোনো পাথরের খাঁজে লুকিয়ে রাখতে হবে। যদিও আমার মনে হয় ওগুলো পরে তোমাদের দরকার নাও পড়তে পারে।
আনন্দ উচ্ছ্বাসে অনেক রাত হলো। কিন্তু কারো তোয়াক্কা নেই। পূর্ণ চাঁদ যেন ছুঁই ছুঁই। তারা ভরা আকাশে হীরে খচিত দীপ্ত। নাচ ছেড়ে জোড়া যুবক যুবতী পেরো ও জোহাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল নাচের আসরে। সবার সাথে কোমর জড়িয়ে জোহার সাথে নাচতে নাচতে পেরোর সারা অঙ্গে এক সুখ শিহরণ জাগতে লাগলো। এতো জনের সমবেত নাচের তালে মাটি কাঁপতে আগুনের ফুলকি উঠতে লাগল যেন রোশনাই। এত দ্রুত ছন্দ... মাটিতে যেন পা পড়ে না । শরীর যেন তুলো। কয়েকজন নাচ ছেড়ে কাঁসি ও মাটির হাঁড়ি পিটিয়ে তাল দিয়ে সমবেত গাইছিল।
জোঁহা চামেইলি ফুলা তোড়ালি গে
সাঁওরো সেহ ফুলা
সেহ ফুলা পিয়াকে রিঝাবো গে...
একসময় এক একজোড়া যুবক যুবতী নাচ থেকে খসে পড়ে দূরে একান্তে চিকন ঘাসভূমিতে রতি মিলনের শয্যা খুঁজে নিল। যেন বহু জীবন যুদ্ধের পর এবার বিশ্রামের পালা। জোহা পেরোকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে হাত রেখে বলল, - আমি তোমার জন্যে ফুলের বিছানা পেতে রেখেছি ওই শ্বেত পাথরের আড়ালে। বিছানার চারদিকে গোবর মাটিতে জোনাকি পুঁতে আলো করে রেখেছি তোমাকে সারারাত জেগে দেখবো বলে। এসো না। ওখানে যাই।
পেরো সেখানে গিয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। শ্বেত পাথরে জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়ছে।ফুলের গন্ধে ম ম করছে। পাশে দুটো বিশাল রজনী ফুলের গাছের নিচে গোল জোনাকি আলোর বলয়ের মাঝে ফিট সাদা রজনী ফুলের বিছানা। জোহা পেরোর হাত ধরে ফুলের বিছানায় বসালো। মুখে হাত বুলিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। এমন স্বর্গীয় মাদকতা পেরোর কখনো হয়নি। সে নিজের শরীর ছেড়ে দিল জোহার হাতে। পুষ্প গন্ধের মাদকতায় তুমুল মেতে উঠল দুজনে। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
শেষ প্রহরে পেরো স্বপ্ন দেখে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে বসল। অনেক অশ্বারোহী সৈনিক আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ওদের মারতে আসছে। ক্ষুরের দাপটে ছিন্ন ভিন্ন হচ্ছে সমতল ঘাসভূমি। জমি ভয়ানক কাঁপছে। বারুদের আঘাতে পাহাড়ের পাথর গড়িয়ে পড়ছে। পেরো জেগে উঠে কিন্ত সত্যিই শুনতে পেল স্পষ্ট ক্ষুরের শব্দ। একসাথে অনেক। মাটিও কাঁপছে। শেষ রাতের অন্ধকার। ম্লান আকাশ। পেরো দেখল দূর থেকে একটা বড়ো কালো ছায়া মেঘ ভূমি সংলগ্ন উড়ে আসছে কাছে। পেরো কিছু বুঝতে না বুঝতেই দেখল জোহার সঙ্গিসাথী সমেত জেরেকা ও তার লোকেরা পড়িমরি করে ওর দিকে দৌড়ে আসছে। সবার সমবেত চিৎকার চেঁচামেচিতে বোঝা গেল বনমহিষের একটা বিশাল দল ধেয়ে আসছে । ইতিমধ্যে দেখা গেল কালো মেঘের মধ্যে অনেক লাল ফুটকি আলো জ্বলছে। লাল সবুজ আলো গুলো উপর নিচে নাচছে। একটু কাছাকাছি আসতে দেখা গেল খাড়া শি মোষগুলোর পিছনে উঁচু লাফ দিয়ে বেশ কয়েকটি বাঘ। মোষের দল এদিকে এসেই যখন গোল হয়ে ঘুরে গেল তখন জোহা লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাঘ বাঘ করে চেঁচিয়ে উঠল। বাঘ ওদের তাড়া করেছে। সবাই পাহাড় চাট্টানের আড়ালে থেকে দেখল বেশ কয়েকটি বাঘ মোষের পিছনে ধাওয়া করছে। জোহা একটা উঁচু পাথরে চেপে চিৎকার করে বলতে লাগল, - আমাদের এখন ভীষণ বিপদ। এখন বাঁচতে চাও তো সব জিনিস পত্র এখানে ফেলে আমার পিছন পিছন দৌড়ে এস। আমি নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাব। জোহা লাফ দিয়ে নেমে পাথরের কোল দিয়ে দৌড়তে লাগল। আলো আঁধারেই উদ্ভ্রান্ত হয়ে সবাই তার পিছনে পিছনে ছুটে চলল। কখনো পাথরের উপর চেপে কখনো পাহাড়ের ফাটল দিয়ে গলে। একসময় জোহা ও তার লোকেরা কিভাবে যে একটা গোপন গুহাপথের ভিতরে ঢুকে নিচে নামতে লাগলো, জেরেকা, পেরো ও সব জনজাতিরা বুঝতেই পারলো না পাহাড়ের কোনখান দিয়ে এই নিষ্ক্রমণ।
0 comments: