প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সুশীল সাহা
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
বাংলা ভাষা নিয়ে দু’কথা
সুশীল সাহা
বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনার শেষ নেই। বাংলাদেশে এবং আসামে দু’দুটো বড় রকমের ভাষা আন্দোলন ঘটে গেছে। একুশে ফেব্রুয়ারির জেরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় আমরা বাঙ্গালিরা পরম গৌরবান্বিত। তবু এই ভাষা নিয়ে আমাদের সংশয় আর আশঙ্কা কিছুতেই যেন কাটতে চায় না। শিক্ষার সর্বস্তরে, প্রশাসনিক কাজকর্মে এই ভাষার ব্যবহার নিয়ে আজও আমাদের দ্বিধা কাটলো না। তাই ভাষা দিবসের সম্বৎসরের আয়োজনে কিছু প্রশ্ন আমাদের বিদ্ধ করে। আমরা উৎসব আর অতীত গৌরবের আত্ম কণ্ডুয়নের বিলাসিতায় সময় কাটাতে কাটাতে একসময় কেমন যেন এক আশঙ্কার ভয়ার্ত অন্ধকারে নিমজ্জিত হই। এর যে কিছু সঙ্গত কারণ আছেই। অনেকেই গোড়ায় গলদ বলে এক অব্যর্থ অভিযোগ করে থাকেন। কেন একুশে বা উনিশে? গোড়াতেই আমরা বাংলা সাল ও মাসের কথা ভুলে বসে আছি। আমদের ব্যবহারিক জীবনে বাংলা সাল ও মাসকে আমরা কবে থেকেই তো বর্জন করেছি! কেবল পয়লা বৈশাখ এলে কেমন যেন একটু নড়েচড়ে বসি। কিন্তু তা তো ওই একটা দিনের জন্যেই। পরদিন থেকেই আমরা ভুলে যাই সব। আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ইংরেজি কেতা। দীর্ঘ দুশো বছরের গোলামির সংস্কার কবে যে দূর হবে কে জানে! তাই ভাষা দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে কিছু নেতিবাচক কথা আমাদের শুনতেই হয়। এই পশ্চিমবঙ্গেই বিভিন্ন স্কুলে বাংলা ভাষার কোনও চর্চাই প্রায় নেই। যেটুকু আছে সেটুকু না থাকারই শামিল। গোটা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বাংলা ভাষাকে বিতাড়ণের নানা চক্রান্তের আয়োজন আমরা নিয়ত প্রত্যক্ষ করছি। ইংরেজি মাধ্যমের দাপটে বহু ছাত্রই বাংলা পড়তে পারে না। যেটুকু কষ্ট করে বলে তাও কেমন বিদেশি কেতায় আচ্ছন্ন। বাংলা ভাষার চর্চা মানে পিছিয়ে পড়া, এমন একটা ভাবনা খুব সুচতুরভাবে আমাদের মাথার মধ্যে কে বা কারা যেন ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেই ঘোর থেকে আমাদের যেন মুক্তি নেই। আমাদের তরুণদের মুখের ভাষার অনেকটা ভুল ইংরেজি আর হিন্দি আর বাকিটা বিকৃত উচ্চারণের বাংলা। প্রচারের যে কোনও মাধ্যমের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই আমাদের চেনা বাংলাকে নানাভাবে উদ্ভট করে তোলা হচ্ছে। এফ এম রেডিওতে ব্যবহৃত কথাগুলোকে কি প্রমিত বাংলা বলা যায়! এই চরম যথেচ্ছাচার থেকে উদ্ধারের জন্যে আমাদের নিত্য হাহুতাশ শুনতে হয়, কিন্তু এ থেকে উদ্ধার পাবার কোনও সুসংহত চেষ্টা আমাদের নেই। তাই প্রতি বছর ভাষা দিবস পালনের প্রাক্কালে কিছু নেতিবাচক অভিযোগে আমরা বিদ্ধ হই। প্রশ্ন হল, এই অভিযোগগুলোর প্রকৃত ময়নাতদন্ত করব নাকি একে চিরাচরিত উপেক্ষার আড়ালে ফেলে দেব?
নোয়াম চমস্কি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘…সর্বজনীন ব্যাকরণকে লঙ্ঘিত করে যে কৃত্রিম ভাষা, তা একজন তত তাড়াতাড়ি শিখতে পারে না যতটা সে সহজ ভাষার মধ্যে ডুব দিয়ে পারে। ওই ধরনের ভাষাচর্চা অনেকটা ধাঁধা বা হেঁয়ালি আয়ত্ত করার মতো। একইভাবে এমন সমাজে কোনও মানুষ সামাজিকভাবে অবস্থান করতেই পারেনা, যা তার জৈব নির্ধারিত ধারণা বা সামাজিক চাহিদাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।’’এই আপ্ত বাক্যটির মধ্যে অনেক গূঢ় সন্দেশ লুকিয়ে আছে। আমাদের চারপাশের ভাষা ব্যবহারের যে স্বেচ্ছাচারিতায় আমরা বিষাদ্গ্রস্ত হই, তা এক ধরনের সাময়িক ধোঁয়াশা ছাড়া আর কিছু নয়। আজন্মলব্ধ ভাষার এক ধরনের মাধুর্য আছে, বিকৃত বিকল্পের সন্ধানে ভাষা ব্যবহারে যে লঘু ও তরল কিছু উপাদান মিশ্রিত হয়ে যুগে যুগে তৈরি হয় যে অপভাষা, তা কিন্তু খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তাৎক্ষণিক ঘোরের প্রকোপ আপাত ভয়াবহ হলেও এতে কোনও আশঙ্কার কারণ আছে বলে অনেকেই মনে করেন না। কিন্তু প্রমিত বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের সংশয় কিন্তু থেকেই যায়। আপামর বাঙ্গালির মুখের ভাষার এক এবং অভিন্ন প্রমিত অবয়বের কথা আমরা প্রায়শ বলে থাকি। কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে তার প্রয়োগের ভিন্নতা দেখতে পাই এবং তা নিয়ে আমরা মাঝে মাঝেই ক্ষোভ প্রকাশ করি। তবু লিখিত ভাষা প্রয়োগের একটা গ্রহণযোগ্য রূপ আমরাকিছু কিছু ভিন্নতা সত্ত্বেও মেনে নিয়েছি। কিন্তু একদিকে আঞ্চলিক ভাষার অসংখ্য ভিন্নতা আর অন্যদিকে প্রচারমাধ্যমের কিছু কিছু অপকৌশলে ভাষা ব্যবহারের এক ধরনের যথেচ্ছাচার নিত্য দেখতে পাচ্ছি। সাময়িকভাবে হলেও বহু মানুষই তাতে আকৃষ্ট হচ্ছেনও।তাই আমাদের চারপাশে নিত্য ঘটে যাওয়া ভাষা ব্যবহারের স্বেচ্ছাচারিতা আমাদের বিষণ্ণ করে। টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে সঞ্চালক হিসেবে এক বিশিষ্ট বাঙ্গালি যখন বলেন, ‘একটা চটপটা ব্রেক নোব’ কিংবা কারো মৃত্যুসংবাদ দিয়ে সংবাদ পাঠিকা যখন বলেন আমরা তাঁর ‘রুহের মাগ ফেরাত কামনা করি’ তখন ভাষা ব্যবহারে এক ধরনের ‘গাজোয়ারি’ মনোভাব আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। পশ্চিমবঙ্গও বাংলাদেশের সংবাদ পত্রের ভাষাও নানা ক্ষেত্রে ভিন্ন। শোক জ্ঞাপনের অন্য শব্দ যে ‘আহাজারি’ এটা পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই জানেন না। ‘ঘাপলা’, ‘পিচ্চি’ ইত্যাদি শব্দ বাংলাদেশে আকছার ব্যবহৃত হয়। এই শব্দগুলোও এই বঙ্গে একেবারেই অপরিচিত। বাংলাদেশে কিছু কিছু সাহিত্যিক আবার মনে করেন ওখানকার লিখিত বা মুখের ভাষা পশ্চিমবঙ্গ থেকে নানাকারণে ভিন্ন। এর সপক্ষে তাঁরা নানাভাবে নানারকম ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে অনেক নড়বড়ে যুক্তি খাড়া করেন। তাঁদের সেইসব সাহিত্য রচনার নমুনা আমাদের কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত করে বৈ কি !
কিন্তু এতসব নেতিবাচক আশঙ্কার বাতাবরণ থাকা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আমাদের গৌরব কিছুই ক্ষুন্ন হয় না। ভাবতে ভাল লাগে সারা বিশ্বের তেত্রিশ কোটি মানুষ আজ এই ভাষায় কথা বলে। পৃথিবীর মধুরতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃত এই ভাষার স্থান ষষ্ঠ। বহির্ভারতে প্রায় একশোটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাষার পঠনপাঠন ও গবেষণা হচ্ছে। বিদেশের বহু মানুষ নানাভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্যে নিরলস কাজ করে চলেছেন। একজন ক্লিন্টন বি সিলি বা উইলিয়াম রাদিচে কেবল নয়, সারা পৃথিবীতে অসংখ্য গুণী মানুষ আছেন, যাঁরা নিরন্তর এই ভাষার জন্যে কাজ করছেন।
মনে রাখা দরকার, ভাষার ভিতরে আছে এক ধরনের দুর্মর রক্ষণশীলতা, ভাষা নিজেই তার উপর চাপানো সংস্কারের প্রতিকূলতা প্রতিরোধ করে, অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে ভাষা জাতির জীবন-ক্রিয়ার সঙ্গে মিশে থাকে। তার ভিতরের বর্ম ভেদ করে তাকে বিলুপ্ত করা অত সহজ ব্যাপার নয়। পৃথিবী থেকে নানা ভাষার বিলুপ্তির কারণ কেবল সেই জাতি বা গোষ্ঠীর ঔদাসীন্য নয়, এর পিছনে আছে অনেক নৃতাত্ত্বিক অভিঘাত। উপর থেকে চাপানো শক্তিশেল নয়, অন্তর্গত দীনতা ও সংশয় এর জন্যে অনেকটাই দায়ী।
তবু সম্বৎসরের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপনের সময় নানা সংশয় ও দ্বিধা, আশঙ্কা ও পিছুটান আমাদের গ্রাস করে। তবে ভাষা হল এক ধরনের চলমান স্রোত। সেই স্রোতের তোড়ে নানা আবর্জনার সঙ্গে হয়তো কিছু সুমিত অনুধ্যান ভেসে যায়। কিন্তু যে ভাষায় এত মানুষ কথা বলেন, যে ভাষায় প্রতি বছর অসংখ্য গল্প কবিতা উপন্যাস প্রকাশিত হয়, যে ভাষায় এত পত্রিকা, এত বই লক্ষ লক্ষ মানুষের মনোযোগের কারণ,তা কি এত সহজে বিনষ্ট হতে পারে! ভাষার এই প্রবহমান স্রোত যাতে বাধা না পায়, যাতে আমাদের এই মধুরতম ভাষার সম্পদগুলি হারিয়ে না যায়, তার দিকে সচেতন লক্ষ্য রাখতে হবে। আর বাইরের আক্রমণ ও আগ্রাসনের জন্য ভীত হবার তেমন কারণ নেই। কেননা কেবল মুষ্টিমেয় শহরবাসীই শুধু নয়, এই ভাষায় কথা বলেন বিপুল পরিমাণ মানুষ, যাঁরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন গ্রামাঞ্চলে, মফসসলে, দেশবিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিপুল প্রান্তিক মানুষের ভাব বিনিময়ের এই একমাত্র মাধ্যমকে বিনষ্ট করা কি অত সহজ?
পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি দিয়ে এই লেখার ইতি টানতে চাই। কেননা কেবল ভাষা নয়, জীবনের নানা কর্ম ও উদযাপনে, আরোপ ও উদ্ভাবনে তিনি যে আমাদের মনের আনন্দ, প্রাণের আরাম ও আত্মার শান্তি!
“পথহীন মাঠের মধ্যে দিয়ে যখন একজন বা দু’চারজন মানুষ কোনো-এক সময়ে চলে গেছে, তখন তাদের পায়ের চাপে মাটি ও ঘাস চাপা পড়ে একটা আকস্মিক সংকেত তৈরি হয়েছে। পরবর্তী পথিকেরা তারই আহ্বান পায়। এমনি করে পদক্ষেপের প্রবাহে এ পথ চিহ্নিত হতে পারে। যদি পরিশ্রম বাঁচাবার জন্যে মানুষ এ পথ বানাতে বিশেষ চেষ্টা করত তাহলে রাস্তা হত সিধে; কিন্তু দেখতে পাই, মেঠো পথ চলেছে বেঁকেচুরে। তাতে রাস্তা দীর্ঘ হয়েছে কিনা সে কেউ বিচার করে নি।
ভাষার আকস্মিক সংকেত এমনি করে অলক্ষ্যেটেনে নিয়ে চলেছে যে পথে সেটা আঁকাবাঁকা পথ হিসেব করে তৈরি হয় নি, হয়েছে ইশারা থেকে ইশারায়। পুরোনো রাস্তা কিছু কিছু জীর্ণ হয়েছে, আবার তার উপরে নতুন সংস্কারেরও হাত পড়েছে। অনেক খুঁত আছে তার মধ্যে,নানা স্থানেই সে যুক্তিসংগত নয়। না হোক তবু সে প্রাণের জিনিস, সমস্ত জাতের প্রাণ–মনের সঙ্গে সে গেছে এক হয়ে।’’ (বাংলাভাষা পরিচয়, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ম খণ্ড,পৃষ্ঠা ১০২১-২২, প ব সরকার, ‘৮৯)
ভাষা নিয়ে এমন অসাধারণ বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় কী! জল এবং বাতাসের মতো জীবনধারণের প্রধানতম উপকরণের ন্যায় ভাষাও আমাদের অলক্ষ্যে নিজেই নিজের পথ তৈরি করে নিয়ে হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবলম্বন, তাকে খুব সহজে বিনষ্ট করা যাবে না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে তাই আমাদের ‘আমরি বাংলাভাষা’র জন্যে কিছু আবেগ, কিছু ভালবাসা এবং কিছু প্রতিজ্ঞা নেবার অবকাশ থেকেই যাবে। এবং তা থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকা আত্মহত্যার নামান্তর হবে!
0 comments: