0

গল্প - রঞ্জন রায়

Posted in

গল্প


ভালোবাসা কারে কয়! 
রঞ্জন রায় 


[এই কাহিনীর সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবে কারো সাথে মিল চোখে পড়লে বুঝতে হবে তা নেহাতই কাকতালীয়।] 

কয়েক দশক আগের কথা। তখনও দেশের রাজনৈতিক আকাশে রাজীব গান্ধী নামক নক্ষত্রের উদয় হয় নি। স্যাম পিত্রোদা কোন গোকুলে একটু একটু করে বেড়ে উঠছেন। ট্রাই -বিপ্লব ভবিষ্যতের গর্ভে ভ্রুণ মাত্র। 

তখন ট্রাংককল হত তিন রকমের। সাধারণ কলে সারাদিন বসে থাকতে হত-- সকালে বুক করলে লাইন পেতে পেতে সন্ধে। এক্সপ্রেস বুক করলে আধা-এক ঘন্টা আর লাইটনিং কল করলে এক থেকে পাঁচ মিনিটে লাইন। 

সেই সময়ে ছত্তিশগড়ের এক উঠতি শিল্পনগরীতে বিপদে পড়লে অগতির গতি মধুসূদন দাদা ছিলেন আমাদের ভটচাজ জেঠু। হিন্দিভাষীদের জিভে 'দাদা ভট্টাচারি'। কারও কোন এমার্জেন্সিতে পতিতপাবন হরি ভট্টাচারি দাদাকে ধরলেই হল। ওনার নাম করে নাগপুর অব্দি বিশেষ লাইনে ফোন লাগালে বিদ্যুতের গতিতে কল লেগে যেত। 

এইসব কাজে ওঁর আমদানী হত লোকের কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা। বিজনেস ম্যাগনেটদের জন্যে উনি থাকতেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু মধ্যবিত্ত আকুলচিত্তদের দেখলে গলে যেতেন। 

ওঁর এই দিব্যশক্তির উৎস আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম। পেশায় একটি পাবলিক সেক্টর কোম্পানির টেলিকম ইঞ্জিনিয়র হয়েও উনি আর একটি গোপন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। তাহল কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও গুপ্তচর সংস্থাকে নিয়মিত খবর সরবরাহ করা। বিনিময়ে পেতেন খামবন্ধ নিশ্চিত পারিশ্রমিক। 

ওঁর বিনোদন ছিল পুলিশ অফিসারদের মেসে মদ্যপান ও তাসের বাজি। বড় বড় পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে 'ইয়ারানা-দোস্তানা' ছিল দেখবার মত। কোথাও কোনও আন্তঃরাজ্য অপরাধ সংঘটিত হলে বিশেষ তদন্তকারী দলের সঙ্গে ওনাকে যেতে হত। উনি নাকি টায়ারের দাগ ধরে অপরাধীরা কোন দিক থেকে এসে কোন দিকে গেছে সেসব চিহ্নিত করতে দক্ষ ছিলেন। 

কে জানত ওঁর দিব্যশক্তির সাহায্য একদিন আমাকেও নিতে হবে! 

তখন ইন্দিরা গান্ধী গোটা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। চারদিকে বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের জেলে পোরা হল। জর্জ ফার্নান্ডেজের মত দু'এক জন ছাড়া সবাই লৌহশলাকার পেছনে। 

এবার সমর্থকদের পালা। 

আমার মাসতুতো দাদা তখন আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থায়। গতমাসে একরাত আমাদের বাড়িতে কাটিয়ে সামান্য কিছু টাকাপয়সা ও জামাকাপড় নিয়ে গেছেন। কিন্তু কে- দেখেছে- কে-দেখেছে-দাদা-দেখেছে কেস হল। 

এক বিকেলে একটি কালোগাড়ি এসে বাড়ির বাইরে থামল। আর তার থেকে একজন উর্দিপরা অফিসার সঙ্গে জনা দুই সাদা পোষাকের লোক নেমে এসে বাবাকে কিসব জিজ্ঞেস করল। সামান্য কথা কাটাকাটি। 

তারপর যা হল তা একেবারে সাঁওতাল পল্লীর উৎসবের কেষ্টযাত্রার রকমফের। 

বৃন্দাবন থেকে দূত এসেছে মথুরার রাজা কৃষ্ণকে ফেরত নিয়ে যাবে বলে। 

দূত-- হাঁ হে কৃষ্ণ, তু কে যাইতে হবেক। 

কৃষ্ণ--- যাবক নাই। 

দূত--যাবি না? 

কৃষ্ণ-- না, যাবক নাই। 

দূত--তুই যদি না যাবি তো তুকে প্রেমডোরে বাইন্ধে হড়হড়ায়ে টাইনে হুই বৃন্দাবন লিয়ে যাব। 

বাবা বুঝলেন ডাক এসেছে। 

পুলিশ অফিসারকে সবিনয়ে বললেন-- শেভ টেভ করে ফিটফাট হয়ে নিই? 

তারপর দাড়ি কাটতে কাটতে আমাকে নীচুগলায় বললেন-- কালো গাড়ি আমাকে নিয়ে চলে গেলে পাঁচমিনিটের মধ্যে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়বি। মিঃ ভটচাজকে সব খুলে বলবি। 

গাড়িতে ওঠার সময় মাকে বললেন-- ভেব না, আজই ফিরে আসব। এঁরা একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতে ডেকেছেন। কাজ মিটে গেলে পৌঁছে দেবেন। 

পুলিশ অফিসারের গোঁফের ফাঁকে মুচকি হাসি মায়ের চোখ এড়ায় নি। 

প্রায় দশ মিনিট হল কালোগাড়ি চলে গেছে। আমি সাইকেল চালাচ্ছি প্রাণপণে। খাড়া প্যাডল মারছি রিকশাওয়ালাদের মত। ভটচাজ জেঠ্যুর বাড়ির দুরত্ব যে চার কিলোমিটারের মত। খাড়াই রাস্তা। 

হাঁফাতে হাঁফাতে ওঁর ডুপ্লে কোয়ার্টারের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। উনি অবিন্যস্ত বিছানায় আধশোয়া হয়ে একা একা পেশেন্স খেলছেন। পাশের ছোট টেবিলে একটি আধখাওয়া রামের বোতল। 

আমার একশ্বাসে বলা রিপোর্টিং শুনে ক্লান্তস্বরে বললেন-- বাবা, আমার আজ জ্বর হয়েছে। ১০১ ডিগ্রি। আমি তো এখন সিটি কোতওয়ালিতে যেতে পারব না। ফোন করে দিচ্ছি, মনে হয় কাজ হয়ে যাবে। তুমি ভেব না, বাড়ি যাও। বৌদিকে বল চিন্তা না করতে। 

অগত্যা। 

বাড়ি ফিরছি। এবারে রাস্তাটা উতরাই। কিন্তু আমি সাইকেল চালাচ্ছি দায়সারা ভাবে। আর কোথায় কোথায় যেতে পারি? এ লাইনে তো কাউকেই জানি না। উকিলের কাছে যাব? কিন্তু এমার্জেন্সিতে নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। উকিলদের পেশা তো বন্ধ হওয়ার মুখে! তবে? 

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন বাড়ি পৌঁছে গেছি। সাইকেলটা বাগানের পেয়ারা গাছের নীচে দাঁড় করাই। 

মাকে কী বলে বোঝাব? আমি পারলাম না? এখনও যথেষ্ট বড় হইনি? 

পা টেনে টেনে তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে একমিনিট দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর নিতান্ত অনিচ্ছায় হাত বাড়িয়ে কলিং বেলে চাপ দিই। 

দরজা খুলে যায়। 

দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে বাবা। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। 

--আয়, ভেতরে আয়। ওভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি? 

-- কখন এলে? 

--এই মিনিট পাঁচেক হবে। 

মার হাতের ট্রে তে ধোঁয়া ওঠা তিন কাপ চা। বাবা বলতে থাকেন। 

-- বুঝলি, আমাকে অপমান করার জন্যে কালো গাড়িটা গোটা বাজারে ঘোরাল। তারপর মদের দোকানে দাঁড় করিয়ে মদ কিনে টিনে আরো দুটো চোর-ছ্যাঁচড়কে তুলে কোতওয়ালি থানায় নিয়ে গিয়ে বারান্দায় বসিয়ে রাখল। 

আমি থানার স্টেশন অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম তো খেঁকিয়ে উঠল-- এটা আপনার অফিস নয় যে যা বলবেন তাই হবে। চুপচাপ বসে থাকুন, সময়ে দেখা হবে। 

মনে হল দু'একদিন শ্রীঘরে রেখে তোদের থেকে পয়সাকড়ি চাইবে। 

এমন সময় তোর ভটচাজ জেঠুর ফোন এল। কী কথা হল জানিনে। 

আমাকে ডেকে বলল-- যান, বাড়ি যান। আর আজেবাজে লোকজন এলে ঘরে জায়গা দেবেন না। আমাদের খবর দেবেন। 

আমি বাইরে এসে রিকশা নিয়ে ফিরে এলাম। 

সেদিন থেকে জেঠু আমার মনে স্থায়ী জায়গা করে নিলেন। ওঁর আসন ভগবানের ঠিক পরেই। 

আমাদের কোয়ার্টারের পাশে একটি সাপ্তাহিক হাট বসে। তাতে নদীর টাটকা মাছ ওঠে। মাঝে মাঝে জেঠু এসে মাকে বলতেন-- বৌদি, একটা থলি দিন তো! মাছের থলিটা আনা হয় নি। মা দিতেন সবচেয়ে ভাল থলিটা। সে থলি আর কখনও ফেরত আসত না। সে নিয়ে মা একবার বাবার কাছে অনুযোগ করায় শুনতে হল- তোমার মন এত ছোট কেন? একটা সামান্য মাছের থলি! 

বাবা-মার কথা কাটাকাটিতে আমি বরাবর মায়ের পক্ষে থেকেছি। ফিস ফিস করে প্রম্প্ট করেছি- আরে এই পয়েন্টটা বল। উঃ, ওটা ভুলে গেলে? 

কিন্তু ভটচাজ জেঠুর ব্যাপারে কোনও কথা উঠলে আমি ওঁর পক্ষে দাঁড়িয়ে গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে তৈরি। 

উনি আমাদের বাড়িতে আসতেন ধূমকেতুর মত। এসেই হৈ-চৈ বাধিয়ে দিতেন। 

-- বৌদি, এসে গেছি। এবার --। 

মা হাসি মুখে পর পর দুকাপ কড়া লিকার চা বানিয়ে দিত। উনি বাবার সিগারেটের টিন থেকে অনায়াসে তুলে নিতেন সিগারেট। বয়স্ক মানুষটির মুখে লেগে থাকত এক অনাবিল হাসি। তারপর খুলে বসতেন অদ্ভূত সব গল্পের ঝাঁপি। 

হয়ত আমাকে জিগ্যেস করতেন-- কী পড়ছ বাবা? 

-- ডোভার বীচ কবিতাটার নোটস তৈরি করছি, সামনে পরীক্ষা। 

না, উনি ম্যাথু আর্নল্ড নিয়ে কোন প্রশ্ন করতেন না। সমাজে কবিতা কা ক্যায়া কাম হ্যায় জিজ্ঞেস করে বিব্রত করতেন না। 

বলতেন,--তা ডোভার বীচ দেখেছ বাবা? 

যাচ্চলে! আমি কোত্থেকে দেখব! হাসিমুখে মাথা নাড়ি। 

পরক্ষণেই উনি ডুবে যান ডোভার বীচ কবে গেছলেন, কার কার সঙ্গে, সেইসব মজাদার গল্পে। সেখানে আমার কবিতার ডোভার বীচ কোথায় হারিয়ে যায়! জেগে ওঠে এক জীবনপিয়াসী আমুদে মানুষের ছবি। 

জেঠুকে হিংসে করতে থাকি। জানতে পারি, উনি বহুদিন ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন। না, প্রথাগত কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেই, কিন্তু সেখানকার কোন শহরে জর্জ টেলিগ্রাফ না অমনি কী এক ইন্স্টিটুটের ডিপ্লোমা আছে। আর আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে ইংরেজ ফৌজের টেলিকমুনিকেশনে কাজের অভিজ্ঞতা। সেই পুঁজির জোরে উনি আজ এই পাবলিক সেক্টর কোম্পানির টেলিকম ইঞ্জিনিয়র। 

স্বাধীন ভারতের নামী কলেজগুলোর থেকে ডিগ্রি পাওয়া তরুণ প্রজন্মের প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে উনি সমানে সমানে পাল্লা দিচ্ছেন এতে বেশ গর্ব অনুভব করতাম। 

আর টের পেতাম বৃটিশ ফৌজের টেকনিশিয়ান থেকে স্বাধীন ভারতে পাবলিক সেক্টরে প্রযুক্তিবিদের চাকরি করার সুবাদে আমার বাবার সঙ্গে ওঁর একটা আলাদা বন্ডিং গড়ে উঠেছে। 

উনি মাঝে মাঝেই গুনগুন করতেন--উই আর অন দ্য সেম বোট ব্রাদার! 

বাবার মুচকি হেসে মার উদ্দেশে গলা চড়াতেন-- কই গো! আর এক রাউন্ড চা হইব নি? 

আমার সবচেয়ে ভাল লাগত শিকারের গল্প। মধ্যপ্রদেশের গোণ্ডিয়া-বালাঘাটের জঙ্গল বা মহাকোশল অঞ্চলের জবলপুর-শাহডোল জেলার জঙ্গলে শিকার। তাতে চিতল হরিণ, সম্ভর, গউর, লেপার্ড আর নানারকম পাখি শিকার। কখনও বুনো শুয়োরের আক্রমণ কখনও দাঁতাল হাতির ঝুন্ড। আর কখনও উইনচেস্টার বা ম্যানলিকারের লক্ষ্য ফস্কে যাওয়া। 

অধিকাংশ গল্পই কয়েক দশক আগের। তখনও কান্হা-কিশলী বা বান্ধবগড়ের বিখ্যাত অভয়ারণ্য গড়ে ওঠেনি আর বন্যপ্রাণী শিকার নিয়ে এত কড়াকড়ি ছিল না। 

উনি এসেছেন টের পেলেই আমি কলেজের পড়ার বই খোলা ফেলে গুটি গুটি বাইরের ঘরে এসে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়তাম। বাবা দেখেও দেখতেন না আর মার কড়া চোখের দিকে আমি তাকাতাম না। 

কিন্তু খারাপ লাগত একটা জিনিস। উনি স্ত্রীকে ডাকতেন 'কালা' বলে। 

আমি ভাবতাম জেঠিমা বোধহয় কালো। বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোন না। মা নেমন্তন্ন করলে একবার এলেন। 

আরে! উনি তো টকটকে ফর্সা, বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্না; হুগলী জেলার বনেদি পরিবারের মেয়ে। 

পরে বুঝলাম জেঠিমা কানে কম শোনেন। তাই জেঠু হরদম ওঁকে নিয়ে তামাশা করেন। 

-- আজকে একটা ব্যাপার হয়েছে। কালা ধান শুনতে কান শোনে। কিছুতেই কানে যন্তরটা লাগাবে না। ফলে আজ-- 

এইসব। 

ওঁদের দুই ছেলে একমেয়ে বাবা-মার টকটকে রং ও হাইট পেয়েছে। বড়ছেলেকে গ্র্যাজুয়েট হতেই চাকরিতে লাগিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। 

এমন সময় নকশাল আন্দোলনের ঢেউ মধ্যপ্রদেশেও এসে পৌঁছল। একদিন স্থানীয় হিন্দি দৈনিকের প্রথম পাতায় আমাদের শহরের পাঁচজন কর্মচারিকে ভোররাতে গ্রেফতার করার খবর বেরোল। শহরে তুমুল হৈ-চৈ। ওরা নাকি তত নিরীহ নয়। একজন বাইরের নেতাগোছের লোকও নাকি ধরা পড়েছে। 

'গোপন রাতে অচলগড়ে নফর যারে এনেছে ধরে 

বন্দী তিনি আমার ঘরে শিরোহীপতি সুলতান।' 

বাবা সন্ধ্যেবেলায় অফিস থেকে ফিরে জানালেন যে ওই অপারেশনটি নাকি ভটচাজ্জি জ্যেঠুর ব্রেন-চাইল্ড! 

রোববারের দিন জ্যেঠু এলে যথারীতি আমিও বাইরের ঘরে হাজির। অ্যান্টি-নকশাল অপারেশনের গল্প শুনবো। কিন্তু বাবা একটু কড়া সুরে বললেন-- যাও, ও ঘরে গিয়ে পড়তে বস। সামনে পার্ট ওয়ান পরীক্ষা না? 

পা টেনে টেনে ফিরে গেলাম বটে, কিন্তু পড়াতে মন বসে কই! দরজাটা খোলাই রেখেছিলাম, পর্দাটা ফেলে দিয়ে তার আড়ালে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বললে পেত্যয় যাবেন না, গোটা জীবনে ওই একবারই আড়ি পেতেছি। 

-- কী বলব ভাই! এই সব ছেলেছোকরাগুলো যেন বিপ্লব বিপ্লব খেলা পেয়েছে। পুলিশের সঙ্গে মাজাখি! হে পুলিশ তোর জলকে নেমেছি? 

-- হয়েছেটা কী? 

-- কী আর হবে? ওই প্রবীর সমাদ্দার! যদি আগুন নিয়ে খেলবি তো বিয়ে করতে গেলি কেন? গত মাসে? 

-- সে কী? 

-- হ্যাঁ, ভাল ঘরের মেয়ে মশায়। বয়েস প্রায় আমার মেয়ের মতই। ভোর চারটেয় যখন দরজা ভেঙে ঢুকলাম তক্ষুণি উল্টো পায়ে বেরিয়ে আসতে হল। নতুন বিয়ে, স্বামী স্ত্রী যেভাবে শুয়েছিল-- বুঝলেন কি না! ওকে হাতকড়া লাগিয়ে গাড়িতে তুলতে কালঘাম ছুটে গেল। আর আমি বাঙালী বুঝতে পেরে মেয়েটি আমার পা জড়িয়ে ধরল। সে কি কান্না মশাই! কাকু, ওকে ছেড়ে দিন। ও সব ছেড়ে দেবে। আমি ঠিক বুঝিয়ে সুজিয়ে নেব। আর কক্ষণো যদি ওসব রেইড-এ যাই! 

কেটে গেছে আরও বছর ছয়। আমি কলেজ পেরিয়ে চাকরি সূত্রে অন্য জেলায়। মাসের গোড়ায় মাইনে পেয়ে একবার বাড়ি আসি। সংসারের দায়িত্ব একটু একটু করে আমার কাঁধে চেপে বসছে। বাবা আগামী বছর রিটায়ার করবেন। 

জেঠুর সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়। 

উনি রিটায়ার করেছেন তিন বছর আগে। হ্যাঁ, মেয়ে এবং বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন, ছোটটি এখনও নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি। জ্যেঠিমা বাতে শয্যাগত। কিন্তু জেঠুর কথা ওঠায় মা একটু মুখ বেঁকালেন। 

-- জানিস, প্রত্যেক মাসে তোর বাবার থেকে টাকা নেয়, আমাকে লুকিয়ে। 

বাবা অপ্রস্তুত। 

--আহা, সে তো ধার নেন। হাত হাওলাত। 

-- বাজে কথা বোলো না। ধার? কোনও দিন একপয়সা ফেরত দিয়েছেন? বরাবর অমন ইল্লুতে স্বভাব। পরের পয়সায় মদ গেলা। 

--- কেন বাবা? উনি তো পুলিশ অফিসার্স মেসে মদ খেতে যেতেন। 

বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বল্লেন-- কী জানিস, সব দিন সমান যায় না তো। উনি কেন্দ্রীয় সরকারের সেই কাজটার থেকেও ছুটি পেয়েছেন। সবকিছুরই একটা বয়েস আছে তো! এখন কেউ ওঁকে কোনও তদন্তে ডাকে না। ওঁর সময়ের অফিসাররাও হয় রিটায়ার্ড, নয় বদলি হয়ে গিয়েছে। এখনকার ছোকরারা কেউ 'দাদা ভট্টাচারি' বললে চিনতে পারে না। তাই উনি পুলিশ অফিসার্স মেসেও পার্সোনা নন গ্রেটা! 

-- কিন্তু বড় ছেলে তো চাকরি করে। আর ওঁর পেনশন? 

-- সে হিসেবে কোনও বড় দায়িত্ব নেই বটে, কিন্তু সেভিংস বলতে বিশেষ কিছুই নেই। আমাদের কোম্পানিতে পেনশন নেই। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সামান্য মাসোহারা পান। অসুস্থ স্ত্রীর জন্যে নার্স রাখতে হয়েছে। আর সারাজীবনের মদের নেশা কি এককথায় ছাড়া যায়? না ওর জন্যে ছেলের কাছে হাত পাতা যায়? 

সেদিনটা ছিল রোববার। 

আমি বাজার করে গলদঘর্ম হয়ে হাতের ব্যাগ মাত্র নামিয়েছি; মা মাছের আর তরকারির থলে আলাদা করে গুছিয়ে রাখছেন-- এমন সময় জ্যেঠুর আবির্ভাব।

আবির্ভাবই বটে। 

কচি কলাপাতা রঙের বাফতার শার্ট, মাখন জিনের সাদা প্যান্ট। টাকমাথায় সামান্য চুলগুলো বেশ কায়দা করে ছাঁটা। 

-- কী ভায়া! তৈরি তো? আর দু'ঘন্টার মধ্যে জীপ এসে পড়বে। 

আমরা অবাক, বাবা মাথা চুলকোচ্ছেন। 

মা মুখ খুললেন,-- কী ব্যাপার দাদা? কোথায় যাচ্ছেন? 

-- সে কি বৌদি! ও আপনাকে কিছু বলেনি? আপনার কত্তাটিকে দিন তিনেকের জন্যে বোম্বাই নিয়ে যাচ্ছি। উড়োজাহাজে করে। সব খরচ আমার, যাতায়াত-থাকা-খাওয়া সব। 

কিছুই বুঝলাম না। বাবার দিকে মা তাকাতেই বাবা গড়গড় করে তোতাপাখির মত বলে চললেন -- ইংল্যান্ড থেকে ওঁর পুরনো বন্ধু এসেছেন, উঠেছেন বোম্বাইয়ের হোটেলে। উনি দাদার সঙ্গে দেখা করতেই সাতসমুদ্দূর পাড়ি দিয়ে এসেছেন। দাদার বয়স হয়েছে দেখে সঙ্গী হিসেবে আমার জন্যেও প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি তিনদিনের ক্যাজুয়াল লীভ নিয়েছি। 

মার অপ্রসন্ন মুখ। 

--সব বুঝলাম। তলে তলে সব গোছানো হয়েছে। কিন্তু আমাকে কিছু বলা হয়নি কেন? 

বাবা বাগানের গেটের বোগেনভিলিয়ার পাতা গুণছেন। 

হা-হা করে হেসে উঠলেন জেঠু -- ওর দোষ নেই বৌদি। আমার ওই বিলিতি বন্ধুটি একজন বুড়ি মেমসায়েব। ভায়া একটু বেম্মজ্ঞানী টাইপের তো, বলতে লজ্জা পেয়েছে। 

মায়ের মুখের মেঘ কাটল না। 

পরের রোববারে আমি আবার হাজির। 

জেঠুর বুড়ি মেমসায়েবের গল্প শুনবো। ইংল্যান্ড থেকে কেন এসেছিলেন? জেঠুকে কিছু সম্পত্তি-টম্পত্তি দিতে চান নাকি? আমাদের চোখে তো সায়েব-মেমসায়েব সবই বিরাট পয়সাওলা। 

আমি কথা তুলতেই মা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলেন। 

-- ও আবার শোনার মত নাকি? যত সব ইল্লুতে হাঘরে স্বভাব! 

বাবা নতুন সিগ্রেট খেতে শেখা ছেলেদের মত ছাদের দিকে ধোঁয়ার রিং ছাড়ছেন। 

বিকেলবেলা। বাবা ছেলে চা নিয়ে বসেছি। মা সেজেগুজে মজুমদার কাকিমার বাড়ি হয়ে আসছি বলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাবার দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ ঢঙে মাথা নাড়লেন। বাবার চোখের পাতা কাঁপল, স্পষ্ট দেখলাম। 

-- শোন, দেখলাম সেই বিলিতি মেমসায়েব মহিলাকে। ন্যান্সি ইভান্স। একমাথা সাদা চুল। চোখে চশমা। অত্যন্ত ডিগনিফায়েড চেহারা। আলাপ পরিচয়ের পর আমি বললাম-- আপনারা পুরনো বন্ধু, কথা বলুন। কত কথা জমে আছে। আমি কোলাবার দিকে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে একটু দেখা করে আসি। 

ইচ্ছে করে সন্ধ্যে নাগাদ ফিরলাম। রাত্তিরের প্লেন। 

ফিরে দেখি তোর জেঠু লাউঞ্জে বসে আছেন। মেমসায়েবের রুমের দরজা বন্ধ। 

আমরা ফিরে এলাম। 

বাকিটা আমার ফেরার পথে ভটচাজদার মুখ থেকে শোনা। তোকে যা বলছি শুনে ভুলে যাস কিন্তু। 

বঙ্গদেশের নৈহাটি-ভট্টপল্লি এলাকার বৈদিক ব্রাহ্মণ কুলের বিশিষ্ট পণ্ডিত বংশে জন্মানো দিব্যজ্যোতি ভট্টাচার্যের বিদ্যাস্থানে বিধাতা বিরাট ঢ্যাঁড়া কেটে রেখেছিলেন। 

ছোটবেলা থেকেই গঙ্গার পাড়ে জেলেবস্তির ডানপিটে ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, নৌকো খুলে নিয়ে ভেসে পড়া, মাছ চুরি, মারপিট করে পোক্ত দেবুর স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না। 

পিতৃদেব সত্যধন ভট্টাচার্যি বিশুদ্ধ গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার অনুমোদিত পণ্ডিতমন্ডলীর একজন। উনি পূর্বজন্মের কর্মফলে বিশ্বাসী। ছেলেকে বকাঝকা না করে তার হস্তরেখা অভিনিবেশ সহকারে দেখে বল্লেন- নিয়তি কেন বাধ্যতে! এ আমাদের মত টুলো পণ্ডিত হবে না। একে জীবন নিজের হাতে গড়ে পিটে নেবে। 

সে যা হোক, এই অবাধ্য একবগ্গা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় দিব্যজ্যোতি বা দেবু ভটচাজ প্রথম সুযোগেই বাড়ি থেকে পালালেন। কোলকাতা-খিদিরপুর ডকে মালজাহাজের খালাসী; শেষে ভেসে পড়লেন কোন গোরাজাহাজে। 

ভাগ্যের থাপ্পড় খেয়ে লিভারপুলের রাস্তায় ঠাণ্ডায় অচেতন হয়ে পড়ে থাকা কপর্দকহীন দেবুকে হাসপাতালে দিয়ে বাঁচিয়ে তুললেন এক দয়াবতী। 

ন্যান্সি ইভান্স। 

বয়সে বছর তিন বা আরো একটু বড়। মধ্যবিত্ত। সন্তানহীন ডিভোর্সি। 

স্নেহে ভালোবাসায় বুনো পশুও বশ মানে। 

এই নারীকে ফ্রেন্ড ফিলজফার গাইড হিসেবে পেয়ে দেবুর জীবন বদলে গেল। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। 

জর্জ টেলিগ্রাফ বা অমনি কোন প্রফেশনাল ইনস্টিট্যুট থেকে টেলিকম ডিপ্লোমা প্রাপ্ত ডেভ ভট্টার সহজেই বৃটিশ আর্মির টেকনিক্যাল কোরে চাকরি পেলেন। পোস্টিং মধ্যপ্রাচ্যে। মরুভূমির যুদ্ধে রোমেলের মহড়া নেওয়া বৃটিশ বাহিনীর অধীনে। কীভাবে ওকে বৃটিশ ইনটেলিজেন্স গুপ্তচরবৃত্তিতে নিযুক্ত করল, প্রশিক্ষণ দিল-- সে গল্প কোনওদিনই জানা যাবে না। 

যুদ্ধ শেষ। 

দিব্যজ্যোতি ফিরে এলেন ভারতে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। অনেক কিছু বদলে গেছে। নৈহাটি রয়ে গেছে বঙ্কিমের 'রাজমোহনস্‌ ওয়াইফ' এর যুগেই। 

পিতা গত হয়েছেন। ভাটপাড়ার ব্রাহ্মণ সমাজে ম্লেচ্ছ আচার-বিচারে অভ্যস্ত দেবুর স্থান প্রান্তিক। আঁতে ঘা লাগল। 

নৈহাটির সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দেবু এলেন মধ্যপ্রদেশের ওই পাবলিক সেক্টর কোম্পানির টেলিকম ইঞ্জিনিয়ারের চাকরিতে। 

কিন্তু লিভারপুলের একটি অধ্যায় সবার কাছে গোপন রয়ে গেল। 

ন্যান্সি সবই জানতেন। দেবুর নিজের দেশে ফিরে যাওয়া, সংসার পেতে বসার মধ্যে কোন অসংগতি দেখেন নি উনি। মেনে নিয়েছেন বিধাতার বিধান। কিন্তু খবর রাখতেন। সময় অসময়ে অর্থসাহায্যও করেছেন গোপনে। 

আজ জীবন সায়াহ্নে এসে ডেকে পাঠালেন ডেভ ভট্টারকে, বোম্বাইয়ের এক হোটেলে, প্লেনের টিকিট ও আনুষঙ্গিক খরচা সমেত। দেবু যেন কুলীন ব্রাহ্মণ। 

-- ডেভ, তোমার চেহারায় একটা প্রশান্তি, একটা পীস দেখতে পাচ্ছি। সব কিছুই পেয়েছ। 

-- হ্যাঁ, ন্যান্সি। বাই দ্য গ্রেস অফ গড। 

-- বেশ, আমার কথাটা মনে আছে তো? যে কথা দিয়েছিলে? 

দেবু চুপ। 

-- ভুলে গেলে? তোমার ছেলে মেয়েদের বিয়ে থা দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে আমার সঙ্গে ফিরে যাবে? কথা দিয়েছিলে না? 

-- হ্যাঁ, দিয়েছিলাম। 

-- সেসব টাস্ক তো কম্প্লিট, ইজ’ন্ট ইট? 

-- ও ইয়েস, ন্যান্সি, বাই দ্য গ্রেস অফ গড। 

-- তবে চল আমার সঙ্গে, বাকি জীবনটা বুড়োবুড়ি একসঙ্গে কাটাব। 

-- তা হয় না ন্যান্সি। 

-- কেন? কেন হয় না? আমি যে সারাজীবন অপেক্ষায় আছি। 

-- তোমাকে বোঝাতে পারব না, হয় না-ব্যস্‌! 

-- ইজ ইট সো? আচ্ছা, এক কাজ কর। তোমার ছোট ছেলেটিকে আমায় দাও। ওকে তেমনি করে দাঁড় করিয়ে দেব, যেমন কয়েক যুগ আগে করেছিলাম। 

-- তাও হয় না। 

-- হয় না? হয় না ডেভ? 

-- নো নো। ইট ইজ ইম্পসিবল। আই কান্ট ইম্পোজ ইট অন মাই সন। 

-- বেশ, লেট দ্য ম্যাটার এন্ড হিয়র। এই আংটিটা ফেরত নাও। 

পরের দিন বোম্বাইয়ের সব ইংরেজি পত্রিকায় ছোট করে একটি খবর বেরোল। 

গতকাল মিডল্যান্ড হোটেলের একটি সুইটে এক বয়স্কা বিদেশি মহিলাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পাসপোর্ট অনুযায়ী তিনি লিভারপুল নিবাসী ন্যান্সি ইভান্স। মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক বলে ডাক্তারেরা মনে করছেন। 

দেহটি বৃটিশ হাই কমিশনকে সঁপে দেওয়া হয়েছে।

0 comments: