ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
আহিরণ
নদী সব জানে
রঞ্জন রায়
(৩)
তারপর কেটে গেছে দশ-দশটি বছর।
কাঠঘোরা থেকে কোরবা যাওয়ার মোরাম ঢালা পথটি পাকা পিচঢালা হয়েছে। মোটরবাস চলছে বিলাসপুর থেকে বারুদ ফ্যাক্টরি হয়ে কোরবা আর কাঠঘোরা থেকে আরেকটি পথ ইংরেজি ‘ওয়াই’ অক্ষর বা গুলতির বাঁদিকের মত চলে গেছে প্রায় দু’শো কিলোমিটার এঁকেবেঁকে অম্বিকাপুর, সরগুজা জেলার সদর। প্রথমটি গেছে আহিরণ নদীর বুকের উপর দিয়ে, অন্যটি হসদেও নদী পেরিয়ে।
বারুদ ফ্যাক্টরির সুবাদে গাঁয়ের জনাতিনেক ছোকরা চাকরি পেয়েছে। ওরা বাপ-ঠাকুর্দার পেশা চাষ করা ছেড়ে শহুরে কায়দাকানুন রপ্ত করেছে। ধুতি পাজামা ছেড়ে ওরা ধরেছে টেরেলিনের চকচকে জামা আর কোরবা থেকে কেনা জীন্সের প্যান্ট, পায়ে বুটজুতো, তবে মোজা ছাড়া। ওদের মোটা ফ্রেমের গো-গো রোদচশমায় নানান রঙের ঝিলিক।
ওরা মাসিক কিস্তিতে হারকিউলিস সাইকেল কিনেছে, আর কিনেছে কোরবাবাজারের কপুর এন্ড সন্স থেকে ট্রানজিস্টার রেডিও,চার ব্যান্ডের। সকাল সকাল ‘বাসি’ (পান্তাভাত) খেয়ে টিফিন কৌটোয় রুটি তরকারি বেঁধে নিয়ে ওরা যখন একসাথে পাঁচ কিলোমিটার দূরের বারুদকারখানার উদ্দেশে রওনা দেয় তখন পুকুর থেকে কলসি ভরে জল নিয়ে ফেরা রাইকিশোরীর দল লজ্জালজ্জা মুখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।
ছেলেগুলো টের পায়, গর্বে পেখম মেলে সামনে তাকিয়ে যেন কাউকে চেনে না ভাব করে এগিয়ে যায়। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে কোন একজনকে ছুটির দিনে সাইকেলে বসিয়ে সিনেমা দেখিয়ে আনা সম্ভব কি না !
ও হ্যাঁ, কোরবা শহরে সিনেমা হলো খুলেছে—পবন টাকিজ। তাতে চলছে শত্রুঘ্ন সিনহার সিনেমা ‘বগুলা ভগত’। ওরা দু’বার দেখে ফেলেছে।
চলতে চলতে এদের কেউ মেয়েগুলোকে শুনিয়ে শত্রুঘ্ন সিনহার নকল করে ডায়লাগ মারে –“ বাবু এইসে তো বোলতা নেহি, পর জব বোলতা, তো এইসা বোলতা কি আচ্ছে আচ্ছে বোলনেওয়ালে কী বোলতী বন্দ হো জাতী”।
কেউ কেউ হেসে ফেলে। কেউ কেউ মুখ বেঁকিয়ে বলে—এমন কে কা হোইস? দিমাগ সঠিয়া গয়ে কা?
এদের হলো কী? মাথাটাথা একেবারে গ্যাছে নাকি?
ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে মেয়েদের ভাগাভাগি করে নেয়।
ওই উঁচু করে খোঁপা বাঁধা, ও কিন্তু আমার, ওদিকে কেউ তাকাবে না।
আর চোখে ঘন করে কাজলটানা?
দূর! ও তো কেলেকুষ্টি।
তাতে কী? আমিই বা কোন জিতেন্দর! আর ফিগারটা! ফিগারটা দেখেছিস?
এঃ ! তোর দেখি একেবারে এক্স-রে চোখ! চাদরজড়ানো মেয়েটার ফিগারও মেপে নিলি?
ভাগ শালা! এ মেরে পটে হুয়ে হ্যাঁয়! নো গন্দী বাত!
পটে হুয়ে হ্যাঁয়? শুনে গার্ডেন-গার্ডেন হয়ে গেলাম। কখনও হাত ধরতে দিয়েছে?
ও হলো পঞ্চ সমারসায়ের বেটি। সাবধান।
ধেত্তেরি যত্তসব! খালি পিলি হাওয়াপানি কী বাত। আসল ফিগার তো আমি চিনি। তোদের মত ন্যাকা নই।
সবাই চুপ। সবাই বোঝে দাউ শ্যামলাল কী বলছে! ও সম্পন্ন ঘরের ছেলে। ওকে ওর বাড়ি থেকে বিলাসপুরে পাঠিয়ে ওখানকার নর্মাল স্কুলে পড়িয়েছে। সরকারি স্কুল হলে কী হবে, এখনও মরা হাতি লাখ টাকা! ইংরেজ জমানার স্কুল। ওখান থেকে পাশ করে কত লোক জজ-ম্যাজস্টর হয়েছে।
শ্যামলাল বিলাসপুর থেকে ফিরল ডাঙ্গর হয়ে; শুধু স্কুলই নয়, অনেকগুলো বেড়া টপকে। খুঁটির জোর আর বলিয়ে কইয়ে। ব্যস, নাইট্রোগ্লিসারিনের ফ্যাক্টরিতে সুপারভাইজারের চাকরি জুটে গেল।
প্রতি সপ্তাহে যায় পবন টকিজ, সিনেমা দেখতে। কিন্তু ও এক সিনেমা বারবার দেখার বান্দা নয়। টিকিট কাটে দুটো করে, বুকিং ক্লার্ককে চা খাওয়ায়। সিট পায় সবচেয়ে পেছনে, দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসা যায়। সঙ্গিনী রেললাইনের পাড়ে এক দশক থেকে বেজা-কব্জা করা জমিতে ছাউনি তুলে বসবাস করা পরিবারের কোন মেয়ে। সিনেমার টিকিট মাথা পিছু দু’টাকা। মেয়েটি নেয় জামা খুললে পাঁচটাকা, নইলে দু’টাকা। আর আছে চা এবং ভাজিয়া মানে বেগুনি-ফুলুরির দাম।
এইখানে শ্যামলালের সঙ্গে তফাত হয়ে যায় অন্যদের। এরা এখনও পারিবারিক বাঁধনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর সাহস পায় নি।
তবে ছুরিকলাঁ গ্রাম ও ঠিক আগের মতন নেই। এখানে খুলেছে মিনি পিএইচ সি, পাব্লিক হেলথ সেন্টার,অর্থাৎ সরকারি ছোট দাওয়াখানা। এখানে আপাততঃ একজন ডাক্তার আছেন, তিনি আয়ুর্বেদরত্ন সার্টিফিকেটধারী। তাতে গাঁয়ের লোকের কিছু যায় আসে না। উনি গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে কালো ব্যাগ হাতে নিয়ে ভটভটি চড়ে রোগি দেখতে যান, কালো ব্যাগ থেকে ব্লাডপ্রেসার মাপার যন্ত্র বের করেন, দরকার মত সুঁই লাগাতে পারেন। আর কী চাই!
তবে ডাক্তার কাশ্যপের পসারে খুব একটা ভাটা পরে নি। ভগবান একচোখো ন’ন। কথায় বলে জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি।
এই সোজা কথাটা বোঝে না বনরাজ সিংয়ের বৌ বুধবারিন বাঈ।
সকাল থেকেই ওর গোটা চার আন্ডাবাচ্চা খিদেয় চেঁচাতে থাকে।
--বাসি দে, বাসি দে ও ! দাই বাসি দে।
--খায়ে দে, খায়ে দে না ও!
আর সইতে পারে না বুধবারিন। গলা তুলে শাপ-শাপান্ত করতে থাকে ওর স্বামী ওর চার বাচ্চার বাপ বনরাজ সিং কে। ও কাল কাজে যায় নি। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়িয়েছে, ধনরাস গাঁয়ের ভাটাজমিনে নতুন গজিয়ে ওঠা দারুভাট্টিতে মহুয়া খেয়ে বাড়ি ফিরে বিছানায় চিত হয়ে ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছে। গত সপ্তাহে অমনি একদিন জুয়ো খেলে চাল কেনার পয়সা খুইয়ে চোর-চোর মুখ করে সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরেছে।
বনরাজ ছুরিকলাঁ গাঁয়ের রাজবাড়ির দূর সম্পর্কের তুতো ভাই। কিন্তু ছোটবেলা থেকে ওর পড়ায় মন নেই। গতপ্রজন্মের সবাই আট কিলোমিটার হেঁটে মহকুমা সদর কাঠঘোরায় পড়তে যেত। এখন তো ছুরি গাঁয়েই সরকারি স্কুল খুলেছে, দশ ক্লাস পর্য্যন্ত পড়ানো হয়। স্কুলটি রাজবাড়ির পুরনো জেলখানায়। খালি পড়ে ছিল, যুবরাজ সাহেব সরকারকে দান করে দিলেন, সবাই ধন্য ধন্য করল।
এত সুবিধে পেয়েও বনরাজ সিং চৌথির বেড়া পেরোতে পারেনি। তবে ভাই বলে কথা, তায় জাতে রাজপুত, তাই যুবরাজ সাহাব ওকে স্কুলের চাপরাশির কাজে বহাল করেছেন। ওর কাজ স্কুল ঝাঁট দেওয়া, আর ঘন্টা বাজানো। এছাড়া ও পঞ্চায়েত ভবনেও ঝাঁট দেয়। আর কাঞ্জি হাউসে বেওয়ারিশ গরুবাছুর রাখা থাকলে তাদের জলটল দেয়। কষ্টেসৃষ্টে ঘর চলে। ওর বৌ বুধবারিন ঘরের কাজ ছাড়া সিন্ধি শেঠের দোকানে গিয়ে একবেলা চাল-গম পরিষ্কার করে।
বনরাজ হাসিমুখে নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। ওর কারো প্রতি কোন নালিশ নেই। গাঁয়ের লোকের চোখে ও নিরীহ ভালমানুষ। বাড়িতেও বৌ-বাচ্চা কারও গায়ে হাত তোলে না। মদ খেয়ে টুন হয়ে ফিরলেও নয়। দোষের মধ্যে ওর কোন কাজে মন নেই। মাঝেমধ্যেই কামাই করে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়।
এতক্ষণ ও কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে ছিল। কিন্ত এবার বাচ্চাদের চিৎকার তারসপ্তকে পৌঁছেচে। বোতাম ছেড়া হাফপ্যান্ট ও ইজের পরা বাচ্চা গুলো এবার মা-বাবার উদ্দেশে অশালীন শব্দ ও বাক্যবন্ধ প্রয়োগের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
দেয়ালের ও পাশে চুন-সুরকির দেয়াল ও টালির চালের ব্যারাকঘর। তাতে কয়েকজন অল্পবয়েসি স্কুলটিচার ভাড়ায় এসেছে।
--সক্কাল সক্কাল রামায়ণ শুরু হয়ে গেল। কেন যে এমন বাচ্চা পয়দা করে!
-- ভাত জোটাতে পারে না এদিকে বছর বছর ‘ক্যালেন্ডার ছাপ রহা হ্যাঁয়’।
বনরাজ চাটাই থেকে ওঠে। ছেলেদের উদ্দেশে হাঁক পাড়ে-- এ গা মহারাজ! অবে এ গজরাজ! চুপ হো যা! চুপ হো যা! ইয়ে শরীফোঁ কা মুহল্লা হ্যাঁয়।
বাচ্চারা দ্বিগুণ উৎসাহে কোরাসে গলা মেলায়।
--অবে শুয়ার কে অউলাদ! অবে চুতিয়োঁ কে পিল্লে! দুঁ কা এক ঝাপড়!
পাশের ভাড়াটেদের ঘর থেকে খিল খিল হাসির আওয়াজ। এঃ,রাজপরিবারের রিস্তেদার বোঝাই যাচ্ছে। নামের কী বাহার ! গজরাজ! মহারাজ!
এবার শোনা যায় বাচ্চাদের মায়ের গলা।
ওর সারমর্ম হচ্ছে বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলার আগে একটু ভাবা উচিত। ভাত দেওয়ার কেউ নয় কিল মারবার গোঁসাই!
রাজওয়াড়ার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক দেখে আমার বাপ কসরেঙ্গা গাঁয়ের নকুল সিং আমার বিয়ে দিয়েছিল। আমার বাপকে ঠকানো হয়েছে। কে জানত যে জামাই এমন হাড়হাভাতে, কামচোর! সকাল বেলায় পা দিয়ে ভাতের হাঁড়ি ঠেলে দেখে যদি দেখে গড়িয়ে পড়ল তবেই কাজে বেরোয়। যুবরাজ সায়েবের দয়ায় এত কামাই করেও চাকরিটা টিঁকে আছে ওইটুকুই রাজবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক।
কথাগুলো নতুন নয়। বনরাজ জানে এই গান শুরু হলে কোথায় গিয়ে শেষ হবে, এর স্থায়ী অন্তরা সবটাই।
ও হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙে, তারপর কাঁধের গামছা আর খেঁটে লাঠিটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আয়নায় তাকালে দেখতে পেত চোখের অক্ষম পিঁচুটি অনেকটা জমে আছে।
0 comments: