প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
পাথর খুঁড়ে স্মৃতি, জীবন ভরে গান
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার ঠাকুরদা রেলে কাজ করতেন। দিল্লীর অফিসে। রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লী চলে গেলে উনিও সংসার নিয়ে দিল্লী চলে যান। ব্রিটিশ আমলে সিমলা হয়ে যেত প্রশাসনের গরমকালের রাজধানী। তাই গরম পড়লেই রেলের অফিসও দিল্লী থেকে চলে যেত সিমলা। কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে মিলে সিমলার কালীবাড়ী প্রতিষ্ঠা করেন ঠাকুরদা। একবার শীতে নিউমোনিয়া হয়ে ঠাকুরদা মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে মারা যান সিমলাতেই। ঠাকুমা ছেলেমেয়ে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। দিল্লী-সিমলার সেই স্মৃতি ঠাকুমা সুন্দর গল্প করে আমাকে বলতেন ছোটবেলায় আর আমি তাঁর কোলে মাথা রেখে সেই গল্প গিলতাম। বেড়ানোর নেশা বোধহয় সেই থেকে মনে ঢুকে গেছে। স্মৃতিতে নেই, বড়দের মুখে শোনা, আমাকে নাকি হাঁটা শেখানো হয়েছে রাজস্থানের পুষ্করে সাবিত্রী পাহাড়ে। ঠাকুমার নামও ছিল সাবিত্রী। তাই ঠাকুমা বলতেন, তুই আমার ঘাড়ে চড়ে হাঁটতে শিখেছিস।
বাঙালি ভবঘুরে বলে একটা কথা চালু ছিল আমাদের ছোটবেলায়। পরে জেনেছি মানুষই ভবঘুরে। আর মানুষের এই স্বভাব এসেছে প্রাক-মানুষ মানবের থেকে। বানরকুল থেকে বিবর্তনের ধারা মেনে মানবের উদ্ভব পূর্ব আফ্রিকাতে। সেখানেই ঘোরাঘুরি করত। পনেরো লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেকটাস নামে এক মানব প্রজাতি আফ্রিকার বাইরে বেরোয় এবং সমুদ্রের উপকূল ধরে ইওরোপ ও এশিয়াতে চলে আসে। ইরেকটাসেরও আগের মানবেরা পাথর ঘসে অস্ত্র বানিয়ে আক্রমণকারী পশুদের থেকে নিজেদের আত্মরক্ষা ও খাবার জন্যে ছোট জন্তু শিকার করত। ইরেকটাস আগুন জ্বালালো। নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে রাতে আগুন জ্বালিয়ে পশুদের ভয় দেখিয়ে দূরে রাখত, মৃত পশুর মাংস আগুনে ঝলসিয়ে খেত। মানুষ মানবের শেষ প্রজাতি, আফ্রিকাতেই বিবর্তন, দু লক্ষ বছর আগে। তারা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বেরানোর এই নেশা মানুষের জিনে। আমার বোধহয় একটু বেশি। মফস্বলে বাড়ি। পুকুর ও গঙ্গা দুটোই বাড়ির খুব কাছে। সেখান থেকে বেরিয়ে প্রথম সমুদ্র দেখলাম পুরীতে গিয়ে পাঁচ বছর বয়সে। প্রকৃতি ভয়ঙ্কর, সুন্দর, বিস্ময় এবং আনন্দময়, বুঝেছিলাম ওই বয়সেই। মাধ্যাকর্ষণের মত সুযোগ এলেই ‘চরৈবেতি’। এখনও। শর্তহীন, ঠিকানাবিহীন।
ক্লাস নাইনে বাবা বিবেকানন্দ প্রদত্ত ভাষণের সংকলন পড়তে দিলেন। আর সেটা হলো কাল। বাবাকে ধরলাম কন্যাকুমারী যাব। কেউ রাজি না হওয়ায় আমি একাই চলে গেলাম একটা পিজবোর্ডের সুটকেস আর সতরঞ্চি মোড়া বালিশ নিয়ে ট্রেনে। পকেটে চল্লিশ টাকা। তখন আমি চোদ্দ। ট্রেনে সহযাত্রীদের থেকে টিকিট চেকার সকলে অবাক হয়ে আমার সাথে গল্প করেছিল। মাদ্রাজে ট্রেন বদলে অন্য ট্রেন এবং কয়েমবাটুর থেকে বাসে চেপে কন্যাকুমারী। বইয়ের বিবেকানন্দ সামনে। ধ্যানমগ্ন। সারা শরীরে শিহরণ! ওই তো তিনটে সমুদ্র আর তার তিনটে আলাদা রঙ। জলের রঙ মিলিয়ে বালি, লাল, কালো, সাদা। বাস্তবের সাথে কল্পনা মিশিয়ে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করছি। খিদে পেয়েছে। সবুজ ঘাসের গালচে পেরিয়ে কয়েক সারি ঘর। গিয়ে বললুম কয়েকজন নেড়া মাথা গেরুয়াধারী সাধুকে। তাদের আশ্চর্য হবার অনেক কিছু ছিল। স্কুলের পরিচয়-পত্র আর আমার আসার কারণ তাদের উৎফুল্ল করে এবং চার আনা ঘর-ভাড়া মুকুব করে আমার জন্য একটা ঘর। সকালে ও দুপুরের খাওয়া রামকৃষ্ণ আশ্রমের ‘প্রসাদ’। রাতে কাছেই গুজরাটি চটিতে চার আনায় পেটচুক্তি।
একদিন এক মাঝিকে ধরলাম। তার নৌকোয় সমুদ্রের বিশাল ঢেউ পেরিয়ে, যেন আমিই বিবেকানন্দ সাঁতরে যাচ্ছি (তখন কেন, এখনও সাঁতার জানি না), সেই পাথরে। তখনও মন্দির হয়নি। মাঝি সাবধানে নামিয়ে দিল, আমি তিন ঘন্টা সমুদ্র ঘেরা পাথরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে সূর্যের তাপে পুড়তে পুড়তে বসে থাকলাম। শুধু অনুভূতি, অপার আনন্দ। আমিও পারি, অবশ্যই কিছুটা। আজও ওই কিছুটাতেই আমার আনন্দ। ছাত্রজীবনে, কর্মজীবনে, সংসারজীবনে, লেখালেখিজীবনে। দামোদরও নই, শেঠও নই, অল্পেতেই খুশি।
জীবনে বেশিরভাগ পারাটাই তো নকল বিদ্যায়। এপ-দের বংশজাত বলে কথা। সামাজিক শিক্ষা, সমাজ বলে দিচ্ছে ছোটবেলা থেকে এইভাবে শৃঙ্খলা মেনে চলো, যা অন্য মানুষকে অসম্মান হেয় করতে শেখায়। নিজেদের দুষ্কর্ম যাতে অন্যেরা না করে তার জন্যে সমাজের পায়ে বেড়ি। মানিনি। পুরোহিতেরা বলছে এটা তোমার ধর্ম।কাঁচকলা, ধর্ম না ছাই। কতকগুলো কুসংস্কার। পাঁচ বছর বয়সেই কালিঘাটে গিয়ে অসততার শিক্ষা পেয়েছি। যত অধর্ম ওই জায়গাগুলোতেই। দেবতার সামনে, পেছনে কুকর্ম। সারা দিনের পাপ স্খালন গঙ্গায়, রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গয়ি। তাঁতি-বাড়ির বৌকে টেনে তুলে অষ্টমীর দিন দুর্গার চরণ স্পর্শ করিয়েছিলেন ঠাকুমা। হৈ হৈ। পুরুত মশাই রেগে গেলে ঠাকুমার হুঙ্কার, মানতে না পারলে চলে যাও। আনন্দে তালি দিয়ে উঠেছিলাম। আমি তখন নয়। ব্যক্তিগত শিক্ষা অনেক দুঃখ-কষ্ট সয়ে অর্জন করতে হয়, করেছি। স্রোতে ভেসে যাই নি। কোনওরকমে চারিদিকের উচ্ছৃংখল সমাজ-জীবনের বিপরীত টানে টিকে আছি।
তবে কেন ভোর হবার আগে অন্ধকার গভীর কুয়োয় নেমে তিনটে সমুদ্রের মিলনক্ষেত্র থেকে জল তুলে এনেছিলাম দেবী কুমারীর অভিষেকের জন্যে? ঠিক যেমন যাওয়া কন্যাকুমারী। ভক্তি নয়, শ্রদ্ধা। পুজো নয়, ব্যক্তিপুজো তো নয়ই। অপার কৌতুহল, অজানাকে জানা, অন্ধকারের মধ্যে আলোর বিন্দু দেখা। বিস্মিত হওয়ার উত্তেজনাকে উপভোগ করা। হেডস্যার শুনে বললেন, ‘একখান এসে লিখখ্যা ফ্যাল’। লিখলাম। পরের দিন এসে জড়িয়ে ধরলেন। পরের দুটো উচ্চতর ক্লাসে আমায় দিয়ে পড়ালেন। এত ভালোবাসা, সম্মান। শিক্ষক গুরু, পিতৃসম। এতদিন শুনতাম, এবার শিখলাম।
সত্তর সালে হায়ার সেকেন্ডারি। পাইপগান, পেটো, রক্ত। সরকার গড়ছে, ভাঙছে। মানুষ তাড়ানো, পরীক্ষা, টোকাটুকি। শ্রমিকের স্বার্থে কারখানা বন্ধ। মালগাড়িতে লাশের পাহাড়। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভবিষ্যৎ নেই। ‘এখানে জিওলজিতে নকশাল আছে?’প্রেসিডেন্সির প্রিন্সিপালকে বাবার ভয়ার্ত প্রশ্ন। উত্তর শুনে হাত ধরে টানতে টানতে আশুতোষ। ‘না, না, এখানে ডি এস ও’, প্রিন্সিপালের আশ্বাসবাণী। ট্রামে করে চৌরঙ্গী ধরে ফেরার পথে মিউজিয়ামের আগের বাড়িটা দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে তোর ভবিষ্যৎ’। জিওলজিকাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়াতেই কাটলো সারা কর্মজীবন এবং অবসরও ওই সেদিনের দেখানো বাড়িটা থেকেই। ক্লাস শুরুর প্রথম দিনেই বোম, চারতলা থেকে বেঞ্চি নীচে। আজও বাবাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। পৃথিবীকে জানতে, বুঝতে, প্রকৃতির সাথে একাত্ম হতে জিওলজিই একমাত্র বিষয়। অল্প সময়েই ভালোবেসে ফেললাম। ক্লাসরুম ছেড়ে মাঠে জঙ্গলে পাহাড়ে হাতেনাতে শিক্ষা। ‘চরৈবেতি’। প্রথম বছর বাঁকুড়া। পরের বছর ডালটনগঞ্জ, কোয়েলের কাছে। পাহাড়, নদী, জঙ্গল আমার হৃদয়, শহর আমার বেঁচে থাকার উপাদান জোগায়। প্রফেসারেরা বইয়ের পড়া শেখান। জিওলজি শেখালো রাজস্থানের আজমীঢ় জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া এক যুবক। আরাবল্লী পর্বতের উপত্যকা জঙ্গলে হারিয়ে তার শরণাপন্ন, ফিল্ডের গাইড। ‘আপ তো পাত্থর কা ডক্টর’। চমকে গেছিলাম। স্টেথোস্কোপের বদলে হাতুড়ি, লেন্স দিয়ে পাথরের শরীর পরীক্ষা করি, তাই পাথরের ডাক্তার। সহজ মানুষ কত সহজে বুঝে ফেললো যা চার বছরেও প্রফেসরেরা বোঝাতে পারেননি। পৃথিবীর পাথর পরীক্ষা করে তার ইতিহাস জেনে সহজ করে সাধারণকে বোঝানোর দায়িত্ব যে জিওলজিস্টের, তা শিখলাম। সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছি। কীসের দায়? আমার শিক্ষা অর্জনের টাকা কে জোগালো? স্কুলের মাইনে চার থেকে বেড়ে ছ টাকা। কলেজের মাইনে বারো। ইউনিভার্সিটিতে ষোল। তার ওপর হাফ কনসেশন। বাবা রিটায়ার্ড। ভারতের গ্রামের সহজ সরল গরীবের আশা ভরসা শিক্ষিতদের ওপর। ভুলি কী করে? না, ফেরত দেবার অহংকার নেই। মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে আলোকিত করার সামান্য প্রয়াস। মানুষের ভেতর মৌলিক মহৎ আবেগ যদি সক্রিয় হয়, গান গেয়ে উঠবে আমার হৃদয়।
তখনও ছাত্র। মাস্টার্স করছি। ডেসার্টেশনের কাজে রাজস্থান, আজমীঢ় – বেওয়ারের মাঝে খরোয়া গ্রামের পঞ্চায়েত অফিসে একটা ঘরে ক্যাম্প। হিন্দুর ঘরে জন্মেছি বলে হিন্দু, তাহলে মুসলমানের ঘরে গরু জন্মালে তার জাত কি? প্রশ্নটা মাথায় এসেছিল সেই রাতেই যেদিন সারাদিন পাহাড়ে জঙ্গলে পাথর দেখার কাজ সেরে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে সাইকেলে বিছানা বাক্স পাথরের বস্তা চাপিয়ে খরোয়া থেকে চোদ্দ ‘মিল’ হেঁটে পৌঁছলাম শামগড় নামে এক গ্রামে। আমি হিন্দু বলে মুসলমান গ্রামে কেউ থাকতে দেবে না। শেষে এক ব্যক্তি আমাকে পথ দেখায় এক মাস্টারের। বাড়ির সামনে সাইকেল থেকে মাল নামিয়ে চলে গেল সাইকেলওলা। আমি বেডিং-এর ওপর বসে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে মাস্টারের হাতে দিয়ে শুধু বলতে পেরেছিলাম, আর পারছি না। আমাকে দড়ির খাটিয়ায় শুইয়ে ওনার স্ত্রী এক বড় ঘটিতে দুধ এনে দিলেন। মাথায় আব্রু নেই দেখে চমকে গেছিলাম। আমাকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল তার পাশের ঘরেই গরু থাকতো। সেদিনই আমার এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন মাস্টার, জন্মসূত্রে নয়, জীবনপালন ধর্ম। সেদিন আরো একবার দেখেছিলাম আমার ভারতবর্ষকে। ভারতের ধর্মকে চিনেছিলাম। প্রকৃত সংস্কৃতি কী তা জেনেছিলাম। এই সংস্কৃতি যৌথভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ থাকার সংস্কৃতি যা শুরু হয়েছিল পনেরো লক্ষ বছর আগে। মানুষের আগের মানব প্রজাতির ইরেকটাসরাই প্রথম বুঝেছিল একসাথে থাকার উপকারিতা। অত্যাধুনিক মানুষ জমি, দেশ, রাজনীতি, ধর্মের নামে সেই প্রাচীন সংস্কৃতি ভেঙে ছাড়খাড় করে দিচ্ছে। একাধিক আইডেনটিটি। একেই কি বলে সভ্যতা? না, সভ্যতা হলো একসাথে থাকা। বিভাজন নয়, সংযোজন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার না করা, সংযত ব্যবহারিক শিক্ষা যা আগুনের ব্যবহারের থেকে উৎপত্তি। কেন এত রাজনৈতিক সীমানা? বসুন্ধরার সম্পত্তি এভাবে ভাগ করার অধিকার কে দিয়েছে মানুষকে?
শামগড় থেকে দশ মাইল দূরে মাসুদা গ্রামের হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। স্কুল দেখাতে নিয়ে গেলেন। চমৎকার উচ্চমানের ল্যাবরেটরি। অভিভূত। অন্য শিক্ষকদের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে পড়াতে চলে গেলেন। টিফিনের সময়ে আমার ডাক। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক স্কুলের গাছতলা, বেদী দিয়ে ঘেরা। মাটিতে ছাত্রছাত্রী, মাস্টারদের সাথে আমার বসার আসন বেদীর ওপর। কলকাতা থেকে এতদূরে এক ছাত্র এসেছে পড়ার জন্য এই নিয়ে বলা শুরু হতে লজ্জায় সংকোচে আমার মাথা প্রায় মাটিতে। তার ওপর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আমায় কিছু বলতে বলা। পরকে মুহূর্তে আপন করে নেওয়াই তো ভারতের সনাতন ধর্ম ও শিক্ষা যা উপনিষদেও আছে। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে প্রতি পদে শিক্ষা, ব্যক্তিগত, অর্জন করতে হয়। মানুষের একটাই ধর্ম, মনুষ্যত্ব। মানবিকতায় যার প্রকাশ। আরাবল্লীর প্রকৃতি ও মানুষ পুরোটাই যেন প্রাচীন আশ্রম। প্রকৃতিই তো প্রথম ও প্রধান শিক্ষাগুরু। মানব ও মানুষের যা কিছু শিক্ষা সে তো তার কাছ থেকেই। প্রকৃতির কোলে যাদের বাস তারাই বয়ে নিয়ে চলে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি। শহরে আমরা শিক্ষা মুখস্থ করি, চাকরির জন্যে। বিজ্ঞানের ছাত্ররা তর্ক করে, ‘পূজো আমার ব্যক্তিগত ব্যপার’। আরে, ব্যক্তিত্বটাই তো তৈরি হলো না, তাতে আবার ব্যক্তিগত! বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করতে অপারগ মেরুদণ্ডহীন দুর্বল। বিজ্ঞানের অসম্মান। সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতির অসম্মান। দশ আঙুলে নবগ্রহকে ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গ্রহ কারা? সূর্য, চন্দ্র, রাহু, কেতু! পৃথিবী কেন্দ্রে! প্রাক-কোপারনিকাস যুগে মনটাকে রেখে বিজ্ঞান মুখস্থ করছে। এল ই ডি আলোয় বাইরেটা ঝলমলে, মনটা গহীন অন্ধকার। অসম শিক্ষা ব্যবস্থা পৃথিবীজুড়ে। উন্নতির সেতু এখানেই ভেঙে পড়েছে। মানুষের বিবর্তন কি অধোমুখী হবে? ফিরে যাবে মধ্যযুগের অন্ধকারে?
‘হল্ট’। খরোয়ার কাছে মাথা নীচু করে মন দিয়ে পাথর পরীক্ষা করছি, বাজখাঁই আওয়াজে চমকে উঠে দাঁড়াই। সামনে দুটো অ্যালসেশিয়ান দু পা তুলে আমার দুপাশে। কুকুরে আমার বড় ভয়, চোদ্দটা ইঞ্জেকশন। চকচকে বাদামী ঘোড়ায় আসীন মোম-তা দেওয়া ইয়া মোটা গোঁফ নিয়ে পরেরপর প্রশ্নবাণ। আমি কে, কেন, কবে, কোথায় ইত্যাদি। কথা বলব কি, কাঁপছি রীতিমত। প্রাক-মানুষ মানবের যোগাযোগের ভাষা চোখের ইশারায় বললাম কুকুর সরাতে। এখনও এই ভাষা কথ্য ভাষার সাথে ব্যবহার হয়। বললাম সব। আমন্ত্রণ জানালেন বাড়িতে, বন্দুক উঁচিয়ে বাড়ি দেখালেন। কয়েকদিন পর গেলাম। অনেকগুলো সিঁড়ি। বিশাল সিংহ দরজা। ভেতরে মস্ত ‘চক’। দোতলা প্রাসাদ। ওপরের তলার সামনেটা চারদিকে টানা বারান্দা, অনেকটা চিক দিয়ে ঘেরা। চিকের ফাঁক দিয়ে মহিলাদের উঁকিঝুঁকি। বেরিয়ে এলেন প্রৌঢ়। ‘মেরা নাম লকখণ সিং’। লম্বা বসার ঘর। পুরনো কাঠ ও গদির সোফা-মত বসার জায়গা। মস্ত গোল ও চৌকো দুটো টেবিল, গ্র্যান্ডফাদার ক্লক, কাচের জারে বিদেশি পুতুল ইত্যাদি। শরবত ও চুরমা দিয়ে আপ্যায়ন। কথার ফাঁকে রোমহর্ষক গল্প। বাবা ছিলেন আরাবল্লীর নামকরা ডাকাত। ডাকাতি করে তার কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দিতেন। স্বাধীনতার পর নেহেরু আজমীঢ় থেকে বেওয়ার যাচ্ছেন। বাবা ফায়ার করে নেহেরুর গাড়ি থামিয়ে দিলেন। বন্দুক ও একটা লাল থলিতে গয়না টাকা সব নেহেরুর পায়ে রেখে ডাকাতি করা ছেড়ে দিলেন বলে জানালেন। দুজনের আলিঙ্গন চিরবন্ধুতায় পরিণত হোল। গল্প শুনতে শুনতে ঘরের জিনিস দেখছিলাম। বেরোনোর মুখে বললাম, মেঝেতে যত মূর্তি আছে তার মধ্যে একটা বহুমূল্য পাথরের এবং সেটা চুরি করা। মুহূর্তে চোয়াল শক্ত করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আপ জাসুস ভি হো কেয়া?’উঠোনে এসে ওনার স্ত্রীর সাথে আলাপ করালেন এবং আমার ‘জাসুসি’র প্রশংসা করলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন এটা বাবার আনা, আমি রক্ষা করছি মাত্র। আমি জায়গার নাম বলাতে উনি লজ্জা পেলেন। সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে, গোঁফ বা বুকের মাপে নয়।
এক জীবনে, জীবন কই, যৌবনের দোরগোড়ায় এত কিছু দেখলাম, শিখলাম। আমার এক পিসি, মানসিক অসুস্থ। পরে জেনেছি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। বড় মেয়ের বিয়ে না দিলে পরের মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে না। সমাজের বিধান। ঘুষ দিয়ে পাড়ার এক ছেলের সাথে ‘নামমাত্র’ বিয়ে দেওয়া হলো প্রচূর যৌতুকের বিনিময়ে মাত্র দু দিনের জন্যে। ফুলশয্যার পরের দিন ঠাকুমা মেয়েকে নিয়ে আসে। এসব আমাদের জন্মের অনেক আগের ঘটনা। পিসির আদর খাওয়া, কোলে চড়া সবই করেছি। একটু বুদ্ধি বাড়তে পিসির সাথে বাইরের রকে বসে আছি, হঠাৎ পিসি মাথায় ঘোমটা তুলে দিলেন। ‘কেন পিসি?’‘ওই দেখ আমার বর’। পিসির মাথায় কখনো সখনো সিঁদুর দেখেছি কিন্তু একদিন ঠাকুমা সিঁদুর লাগিয়ে মুছে দিয়ে বললেন, ‘তোর বর মরেছে, তুই বিধবা হলি।’ পিসি কেঁদেছিলেন। কেন কেঁদেছিলেন? অমানবিক নিষ্ঠুর এই ধরনের সামাজিক বিধান আজও সমাজে বহাল। কেন মানবো এই সমাজের বিধান? প্রশ্ন করার শিক্ষাটাও ‘অমেরুদণ্ডী’ মানুষের আজও হলো না। আসলে শিক্ষাটাই তো হয় নি। যা জিন বহন করে এনেছিল সেটাকেও জোর করে আটকে রেখে মেকি মান্যতার একটা আবহ তৈরি করে রেখেছে। জীবন কী? শুধু কি কীটের মত বেঁচে থাকা? প্রাণী বিজ্ঞানের মতে কোনও পরমাণু যখন নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে সক্ষম হয়, তখন প্রাণের স্পন্দন দেখা দেয়। প্রাণের জন্য মৌলিক উপাদান অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন এবং নাইট্রোজেন আরও কিছু সাধারণ মৌলিক উপাদানের সাথে মিশে প্রোটিন ও নিউক্লীক অ্যাসিড তৈরি করে। এরা যে কোন প্রাণীর মূল উপাদান। তার মানে প্রতিটা প্রাণী এক একটা রাসায়নিক গুদামঘর। পাথরের পরমাণু নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে অক্ষম, তাই পাথর। আর প্রাণীদের আর এন এ, ডি এন এ থেকে জিন যা বংশানুক্রমিকভাবে প্রজন্ম ও প্রজাতি ধরে বয়ে চলে। এককোষী প্রাণী প্রোক্যারিয়ট ৩৬০ কোটি বছর আগে শুরু হয়েছে। সেই থেকে বিবর্তন হতে হতে ছ কোটি বছর আগে সর্বোৎকৃষ্ট প্রাণী প্রাইমেট বা বানরকুলের আবির্ভাব, শ্রেষ্ঠ মানব প্রজাতি ২৫ লক্ষ বছর আগে আসে। মানুষ তার আগের সবকটা প্রাণীর জিন সঙ্গে নিয়ে জন্মায়। মানুষের নিজস্বতা বলতে খুবই সামান্য, শতকরা এক ভাগ বা তারও কম। বিবর্তন ও উন্নতিতে মানুষের মস্তিষ্ক উন্নততম।
তাহলে আবার সেই প্রশ্ন, জীবন কী? প্রায় সব ধর্মই জীবনের সাথে আত্মাকে জড়িয়ে দিয়েছে। এই আত্মা কি? ঋগ্বেদ বলছে প্রাণীর মধ্যে সমস্ত উপাদান জোটবদ্ধ এবং এটাই চূড়ান্ত তত্ত্ব। উপাদান মানে elements। মুণ্ডক উপনিষদ আণবিক আত্মার কথা বলছে, যার বাস হৃদয়ে এবং সারা শরীরে তার প্রভাব। ছান্দোগ্য উপনিষদ আরও পরিস্কার করে বলছে মৃত্যুর পর আত্মা দেহ ছেড়ে যায়, প্রবেশের পথ পায় না। তার মানে আত্মা জীবনের উপাদান। ওল্ড টেস্টামেন্টেও আত্মা মানে জীবন। সংস্কৃতে ‘আত্মা’ মানে শ্বাস, জীবন। সব দর্শনেই আত্মা সম্পর্কিত অধিবিদ্যা আধ্যাত্মিক রূপ পেয়েছে। পরিশেষে একটা উপাদানকে স্বীকার করে নেওয়া হলো যা হৃদযন্ত্র সচল রাখে। কী সেই উপাদান? প্রাণবায়ু বা শ্বাসবায়ু। পরে নামকরণ হয়েছে অক্সিজেন। ফলে আত্মা অক্সিজেন, অবিনশ্বর। তাহলেও, শুধু বেঁচে থাকাটাই জীবন? না, একেবারেই না। অর্থপূর্ণ বাঁচাটাই অর্থাৎ আমরা যাকে বলি বাঁচার মত বাঁচাটাই জীবন। সেটা কী?
জিওলজি পড়তে এসে ডালটনগঞ্জের মাঠে জঙ্গলে প্রশিক্ষণ। কোয়েল দেখে তো খুশিতে আত্মহারা। কাজ করব কি! প্রথম কদিন প্রফেসরেরা চিনিয়ে দিলেন কি ভাবে কাজ করতে হয়। এবার নিজেদের কাজ, প্রতি দুজনের টীম করে এলাকা চিহ্নিত। একদিন দেখি রাস্তার পাশে অনেক কুলের গাছ। বেশ বড় ও মিষ্টি। পাড়তে পাড়তে খেতে খেতে কাজ করছি। একটা গাছে কুল একদিকে মিষ্টি আর অন্য দিকে কষা। কাজ শেষে ক্যাম্পে ফিরে গল্প করছি কুল গাছটার। একজন টিচার বললেন, এটা জিওবোটানি অর্থাৎ মাটির চরিত্র ওখানে দুরকম, শেকড় দুদিকেই ছড়িয়েছে এবং ভিন্ন মাটির রস শেকড়ে ঢুকছে। তাই দুদিকের কুলের স্বাদ আলাদা। প্রাথমিকভাবে সব মানুষের জিন এক কিন্তু ডি এন এ-র গঠন আলাদা বলে সব মানুষ এক রকম দেখতে নয়। এছাড়া মানব প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যমস্তিষ্কের ওপরে থাকে গোলাকৃতি গুরুমস্তিষ্ক বা সেরিব্রাম, মস্তিষ্কের বৃহত্তর সম্মুখভাগ। মানুষের মস্তিষ্কের ওজনের চল্লিশ ভাগ গুরুমস্তিষ্ক। এর ওপরের স্তরে বহিরাবরণ বা মগজের ধূসর বাহ্যাংশ ১০০ বিলিয়ন বা দশ হাজার কোটি নিউরন, মস্তিষ্ক কোষের শতকরা ৭৫ ভাগ দিয়ে তৈরি। এখানেই যাবতীয় কল্পনাপ্রসূত চিন্তা, ভাষা, ভাব-আবেগ, স্মৃতি, পরিকল্পনা, বিচার, দোষ, গুণ এবং যত জটিল ক্ষমতার আঁতুড়ঘর। আর এখানেই মানুষকে আলাদা করেছে অন্য প্রাণীর থেকে। দ্বিধা বিভক্ত মস্তিষ্ক মগজের কাজকে ভাগ করেছে। বাম মগজ ভাষা ক্ষমতা, যুক্তি ও বিশ্লেষণ নিয়ন্ত্রণ করে আর ডান মগজ গান, স্মৃতি, ভাবাবেগ সামলায়। এরা অখণ্ডভাবে সম্পূর্ণ মানুষের কাজ করে। ধূসর পদার্থের সামনের অংশ মাংসপেশি সঞ্চালন, হাত পা সঞ্চালন প্রভৃতি স্নায়ু নিয়ন্ত্রিত মোটর কাজ সামলায় এবং পেছনের অংশ ইন্দ্রিয়ের সংকেত গ্রহণ করে সামনের অংশকে নির্দেশ পাঠায় মোটর সঞ্চালনের। মস্তিষ্কের দুপাশে কানের ওপরের অংশ শ্রবণ ও পেছনের অংশ দৃষ্টির ইন্দ্রিয়। স্বাদ ও গন্ধের ইন্দ্রিয়ের গ্রন্থি শ্রবণ গ্রন্থির পাশে। মস্তিষ্কের বাম গোলার্ধে দুটো জায়গা ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে। একটা ভাষাকে বুঝতে আর অন্যটা ঠোঁট, জিব, গলা ও চোয়ালের মাংসপেশিদের নিয়ন্ত্রণ করে স্বর বেরোতে সাহায্য করে। গাছের মত মানুষের চরিত্রও পরিবেশ নির্ভর। একই পিতামাতার একাধিক সন্তান থাকলে সম-চরিত্রের হয় না। এমনকি যমজেরাও নয়। আলাদা পরিবেশে বেড়ে উঠলেও হয় আবার একই বাড়িতে বড় হলেও হয়। কেউ লেখাপড়ায় ভাল, কেউ গানে আগ্রহী, কেউ খেলোয়ার তো অন্যটা সমাজবিরোধী। সেই আরাবল্লীতেই আবার ফিরে যাই। প্রকৃতির মানুষ, মানুষের প্রকৃতি। দুটোই সরলতার প্রতীক। শামগড় থেকে আরও কিছুটা দূরে বাসাবদল। গ্রামে মুসলমানদের বাস। দশ-বারো ঘর হবে। শীতের রাতে পৌঁছে ঘর পাই না। রেগে গিয়ে ছাগলদের তাড়িয়ে তাদের ঘর দখল করলাম। মাটির মেঝেয় খড় ওলোট-পালোট করে বেডিং পেতে দিলাম। খিদে পেয়েছে। কেউ খাবার করে দেবে না। সঙ্গে আটা আর ভেলিগুড়। তিনটে পাথর দিয়ে কাঠ জ্বেলে উনুন করলাম। ছাগলের খাওয়ার লোহার গামলা উপুড় করে উনুনে দিয়ে রুটি বানালাম। শোব কি, জানলা দরজা আছে বন্ধ করার কিছু নেই। এক মহিলা চট লাগিয়ে দিলেন। কোটি তারার নীচে চারমিনার জ্বলছে। সেই মহিলা সামনে বসে, মাথা বেআবরু। স্বামী মারা গেছেন। এক মেয়ে ডাক্তার, শহরে। এক ছেলে স্কুলে পড়ায় আর অন্য ছেলে ডাকাতি করে জেলে। একই বীজে কেন এমন হয়? আমি নাকি শিক্ষিত। কী জবাব দেব? পরে জেনেছি, মানুষের মনে দু ধরনের চিন্তার জগত – একটা প্রাথমিক বা মৌলিক, অন্যটা সম্ভ্রান্ত, উদার মহৎ। এই দুটোই আত্মসচেতনতার অনুগত এবং জিনবাহিত। মননের মৌলিক উপাদান ছটি রিপু – কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য্য, অর্থাৎ ঈর্ষা। প্রতিহিংসা, বিতৃষ্ণা, গর্ব, অহং ইত্যাদি সবই মানুষের মধ্যে আছে। আর মহৎ আবেগের মধ্যে আসে প্রেম, করুণা, সহানুভূতি, বন্ধুতা, সহযোগিতা, শান্তি ও এই ধরনের ভাবাবেগ। প্রত্যেক মানুষের ভেতরে এই দু ধরনের আবেগ কাজ করে চলেছে এবং তাদের মধ্যে চলে দ্বন্দ্ব। এইবার কোনও একটা কাজে কার কোন আবেগ এই যুদ্ধে জিতবে, তা নির্ণয় করে বাইরের পরিবেশও অন্দরের রাসায়নিক মৌল বা যৌগিক পদার্থ মিশ্রিত নির্যাস। মূলত মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন সেই অবস্থায় যে পদার্থ বয়ে নিয়ে আসবে, সেটাই নির্দেশের ট্রিগার পয়েন্ট। কেন কী হয়, মস্তিষ্কের জগত বেশিটাই এখনও অধরা।
বিশ্বকর্মা একবার ভালোবাসা আর শান্তি দিয়ে এক নগর গড়বেন বলে ঠিক করেন। আদর্শ দেশ। অন্যের রাজ্যে লোভ করবে না, নিজের রাজ্যকেও বাঁচাবে। সব মানুষের জন্যে নিজস্ব ঘর। নগরের একদিকে সাগর, অন্যদিকে পর্বতপ্রহরী। অনেক ভ্রমণের পরও কোন জায়গা পেলেন না বলে আক্ষেপ করছেন কৃষ্ণকে। যেদিকেই তাকান শুধু দম্ভ আর দেখনদারি ঐশ্বর্যের দামামা বাজছে। কৃষ্ণ সব শুনে বলেন, এসব নির্বোধ লোকের আদর্শ। কেড়েকুড়ে খাওয়া, ভোগলালসা, অহং আর রক্ত। মানুষের বীজে ঢুকে গেছে অকারণ হত্যার ভয়ঙ্কর আনন্দ। সেই তিরিশ হাজার বছর আগে প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহের সময় মানুষ তার সমগোত্রের নিকট প্রজাতির সাথে খাদ্যসম্পদ ভাগ করে নিতে অস্বীকার করে এবং নির্বিবাদে হত্যা করে পুরো প্রজাতিটাকেই শেষ করে দেয়। অথচ তার আগেই তারা নাকি যৌন মিলন করত। সেই জিনই তো বহন করছি আমরা। রাতে যাকে আদর করে চুমু খায় সকালে তাকেই চাবুক দিয়ে মারে। আবেগের দ্বন্দ্ব হয়েই চলেছে।
পাথর পৃথিবীর আ-জন্ম ইতিহাস ধরে রাখে তার স্মৃতিতে, খাঁজে খাঁজে। জিওলজিস্ট তা পড়তে পারে। জানতে পারে প্রাণীর জন্ম থেকে মৃত্যুর ইতিহাস। আর মানুষ ধরে রাখে স্মৃতি আ-মৃত্যু, পরতে পরতে। কিন্তু জিওলজিস্ট পারে না আবেগের ইতিহাস উন্মোচন করতে, কারণ আবেগের ফসিল হয় না। আবেগের প্রকাশ ধরা থাকে ভাষায়, সাহিত্যে ও শিল্পকর্মে। সেই আবেগ সুখ-অসুখ, আনন্দ-দুঃখ, ব্যাথা-বেদনা যাই হোক, তা গান হয়ে ওঠে সর্বদাই। জীবনটাই একটা গান – অনেক রকম সুর ও তান দিয়ে ভরিয়ে তোলে শোক-আনন্দের দীপমালা।
ছোটবেলায় গরমকালে ছাতে রাতের বিছানা, মশারি। চোখের সামনে লক্ষ মানিক, জ্বলজ্বল করছে। কৃত্রিম স্যাটেলাইটগুলো তারাদের পাশ দিয়ে চলে যায়। পাশের বাড়ির রেডিওয় বাজে ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’। ঠাকুমা বলেন, রবিঠাকুরের গান। আরাবল্লীর খরোয়া গ্রামে বাঙালি ডাক্তারের সংসার। অমায়িক। প্রায়ই রাতে খাওয়া ওবাড়ি। নিকষ অন্ধকারে ছাতে প্রায় সমবয়সী বড়মেয়ের কোলে মাথা রেখে দেখি আকাশভরা তারা। হৃদয় থেকে বেরিয়ে এল আপনিই –‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’।
Khub bhalo laglo.
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে
Delete