0

মুক্তগদ্য - নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


মুক্তগদ্য


সিলি সিলি সিলসিলা 
নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় 



অনেক চেষ্টা করেছিলুম; ব্যাঁকা-সোজা-উত্তর-দক্ষিণ-পাহাড়-সমুদ্র-ডায়াক্রনি-সিনক্রনি... 

১. 
ইস্টগেট থেকে ধুনোমাখা পথ, নোনাদেওয়ালে মোহিত-শিল্পা তির-হৃৎপিণ্ড, আগুন রঙা ফুটপাথের তীরে তীরে টাঙ্গাওলার খেউড়ক্ষেত্র, পথচিহ্নে ছাগলের নাদি, গাজরের হালুয়া, ইঁটের অন্তস্থলে রেচনভূমি পেরিয়ে কেল্লা। কেল্লার ফটকের ফুট বেয়ে হাঁটতে থাকলে ডানদিকে পড়ে রামলীলা ময়দান। গোলাপী, হলুদ, আকাশী, মাংসল, রুগ্ন হরেক বাস ময়দান জুড়ে ভিড় জমিয়ে থাকে। তারই পাশে চুমকিবসানো সাড়ির জমায়েতে চোখা বিতরণ। এরা কেল্লা হয়ে একইদিনে অন্য কোথাও যাবে। আগুনে ফুটের কিনারার দিকে যত যাওয়া যায়, রঙ তত গাঢ়। দু'একজন মানুষ, পঞ্চাশোর্ধ, রোগা মোটা, তেলতেলে কপালের নীচে সমকোণে গর্ত করা চেরাচোখ; সাদাকালোকমলা খোঁচাচুল মাথার পেছনে একটা ঘূর্ণি তৈরি করেছে; ভুঁড়ির অর্ধাংশ সোয়েটারে উন্মুক্ত; টেরিকটে অবহেলিত প্রস্রাবচিহ্ন; ডাক দিচ্ছে "আঁটো লে লিজিয়ে, সিধে ভগওয়ান টাঁকিজ"। অটো যায় গলিপথ ধরে। ন্যাড়া দেওয়ালে ডক্টর শাস্ত্রী, টোঁপি পেহেন লে, মজা লেলে, শুয়োরের চারণভূমি মহিষের জাবনা পেরিয়ে গলি ঢোকে নিবান্দা টাউনশিপে। টাউনশিপ চিরে কিছু বিক্ষিপ্ত পশ বাড়ি চেয়ে রয়েছে। এরপরেই কোনও একখানে ভগবান টকিজ। মাথার ওপর চারমুখো ফ্লাইওভারে নদীর এপার ওপার থেকে গাড়ি, ট্রাক, অটোর সমাগম। লোহা, লক্কড়, সিমেন্ট, বিচুলি, মার্বেলস্ল্যাব, রেপ্লিকা এবং সর্বোপরি মানুষ বোঝাই অটো ছাড়ছে বাসস্ট্যান্ডগামী। হাইওয়ের বাঁপাশে জংলাজমি, পাতাপোড়া গন্ধ, ডানপাশে রাজপুত ছজ্জায় সমাধি ঢাকা পড়েছে। জংলাজমি পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে সরকারি বাস টার্মিনাস। যে বাস কেল্লা থেকে ছাড়েনা, সে বাস এখানে এসে ধরতে হয়। বাস তার নাম্বারপ্লেট ধরে রাখতেই অক্ষম, আর মানুষ। আকাশী সিটে আগের ট্রিপের শিশুর গুয়ের ছোপ, খাটো পাদানিতে পা রাখলে মাছিরা বমি ছেড়ে ভনভনিয়ে পালায়। পেছনে, সামনে, শালমুড়ি, জ্যাকেটচাপা তেলামাথা যুবা, প্রৌঢ়, প্রবীণ। এই বাস সোজা যাবে। টুওয়ার্ডস সভ্যতা। 

২. 
আকাশে পাহাড় গেঁথেছে। বিভাজিকায় অস্পষ্ট ভিজিএ-প্রায় চীরগাছ বা কিছু। যে কাঁচ দিয়ে বাঙলা সিনেমা নর্থবেঙ্গল দেখে, সে কাঁচ পরশু দুপুরে নদীর জলে ধোয়া হয়েছে। তারই মধ্যে কিছু নাছোড় জলকণা সারাগায়ে ধুলোভরে উল্কি হয়ে রয়েছে, কোনোক্রমে টিঁকে যাওয়ার ছুতোয়। বাঙালি বরফ ফ্রিজে দেখতেই অভ্যস্থ। খয়েরি পাথরের ওপরে সোলার চাঙড়ের মতন প্রৌঢ় বরফ, গতসপ্তাতেও একযৌবন জুতো বয়েছে। এখন তার ওই ছাপসর্বস্ব জৌলুস, আকাশী ফিল্টার দিলেও বয়েস লুকোবার জো নেই। হোটেলের পাশে গাঢ় নীল নদী। এ অঞ্চলে রাত কীর’ম দেখতে হয় জানা নেই। দেখা যায়না। হোটেলের আলো জানলার কাঁচ ঠেলে খুব বেশি হলে তুষারপাত-অবধি পৌঁছতে পারে, গ্রামের ওপরের ঢাল অবধি যেতে আলোরও শীত করে। মেরুন সাদা হলদে উলে বোনা কচিহাত বেয়ে ঝাপসা আলোয় খোবানিকাঠ চলে নদীর ধার দিয়ে দিয়ে। পাথরের খোঁদলে পা ফেলে বাড়ির বারান্দা উঁকি মারে। বরফেপোড়া ছিটেধরা মুখ তাহান দেখেনি, ফেসবুকও দেখেনি, ট্যুরিস্ট দেখেছে। দেখেছে কালো-চৌখুপ্পি-অগ্রচর্ম-লেদারজ্যাকেট, কাল সকালে থুকপা খাবে। ইস্কুল অনতিদূরে, চিবুকে তার ক্ষেতজমি। ক্ষেতজমির ওপর পুরু বরফ। পুরু বরফের ওপর জুতোর ছাপ। 

৩. 
চৌকো টাইলের আকাশী বাসস্টপ; লোহার বেঞ্চির ওপর আগের মানুষটার গন্ধ উষ্ণতা ইত্যাদি। বেঞ্চির পেছনের ওই ঘিঞ্জি জায়গাটুকুতেই মাথা গুঁজে শুয়ে থাকে কেউ। বাঁহাত দুপায়ের ফাঁকে জড়ো করে আনা, ডানহাত বেয়ে মুখফিরতি গ্যাঁজলা। সোজা চলার পথে খৈনির দোকানের মুখে উপুড় হয়ে বমি করতে থাকা ট্যাক্সিড্রাইভার, বমি শেষে টাল খেতে থাকে, থমকে যায়, আবার টাল খেতে থাকে। একটু এগোলে বাঁহাতে হলদে রঙের একটা শাটার ফেলা ঘর, শাটার খোলা থাকলে মিন্সড পর্ক ও তার সামনে খানচারেক কুকুর। আরো খানিক এগোলে লুঙ্গির ওপরে স্যান্ডো গেঞ্জি পেট থেকে বুকে তুলে পায়ের ছাল খুঁটছে কেউ, সামনের হুকে ছাড়ানো পাঁঠা। বাঁপাশে মন্দির, ট্রাপিজিয়ম ফুটপাথের খোপে দুধ জমেছে। রোজ ধোয়, রোজ জমে। লোহালক্কড়ের, রাবার শিটের ওপর লজেন্স, বিড়ি, দেশলাই সাজানো, ডাঙা থেকে নেমে পড়লে আনাজবাজারের ভিড়টুকু এড়ানো যায়। পাতালপথ ধরার মুখে কাদা জমে। তার সামনে ঠেলাগাড়ি। চালকের গায়ে মেরুন গেঞ্জি, রাস্তা থেকে কোল-ভরে আনারসের ছিবড়ে, সবুজকাচের বোতল, ছালে জড়ানো মাছের কাঁটা, তুলে তার গাড়িতে জমায়। সে চলে আগে আগে। আড়াই মিনিটের বাস-স্ট্যান্ড, সরে দাঁড়ান পেরিয়ে বাদামভাজা, চিঁড়ে, মুড়ির কোণে হেদিয়ে যাওয়া এটিয়েম; ভেতরে কালচে বালতি, এসির জল জমে শ্যাওলা ধরেছে। উলটো ফুটে আধাপরিত্যক্ত বায়োস্কোপের আড়ালে মিটমিটে কেবিন, পাশে থানরঙা দেয়ালে ডিম-আলো ধরা ওষুধঘর। ঠেলাগাড়ি এদ্দূর এসে মোচড় নেয়, ক্যাসেটের দোকান ধুনোয় ঝাপসা। ভেড়ার চামড়া, বাঁধাকপির খোসা, ম্যানিকুইনের আত্মা ঠাসা হয় ঠেলাগাড়িতে। তারই মধ্যে ছেতরে বসে মাথা গুঁজে দিয়েছে এক ন্যাড়ামাথা কিশোর। গোড়ালিতে ব্যান্ডেড। একটা পা বাইরের দিকে ঠিকরে। মুখটুকু ডিমের খোলায় ঢুকে এসেছে। বুকের কাছের জামাটুকু অর্ধচন্দ্রাকারে ভেজা। নাকের কোণায় গ্যাঁজলা। 

৪. 
কালচে কাচের ওপর লেপে দেওয়া নোনা রোদ, অনুবাতে অন্ধকার। রাস্তার আধা-আঁধারি এপ্রিলমাস মুড়ুক্কুর দোকানে ছাউনি টেনেছে। এমাসে অস্বস্তিসূচক অনাচ্ছন্নাবস্থায় মাঝারি থেকে কমের দিকে। কাঁচা সবুজ, ছাইছাই, মেরুন রঙের শার্টের উড়ুক্কু অপাবৃত হাতা, চুড়িদারের ওড়নাবাওয়া কিছু অনভ্যস্থ চোখ, ইতি-উতি বেরিয়েছে পথে, সন্তর্পণে পা ফেলছে সিগ্ন্যাল মেপে, অপরিচিত। সোজা গেলে অটোপথ শিরিষফুলে বিছানা পেতেছে। হাত-ছয়েক বাঁদিকে আয়তাকার কাচের দোকান, হিম দিয়ে চুষে নিচ্ছে কপালে জমা নোনা বালি, চুলে জমা তাপ। মোড়েরমাথায় চশমা চকচক করে। এপ্রান্তে প্রতি বর্গকিলোমিটার অন্তর সে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে খসড়া হাতে, বুলি-বোবা-সাহিত্য-চীৎকার ব্যাতিরেকে; মৃত স্পোক্সপার্সনকে অটোকারেক্টে ইতিহাস বলে। মিশকালো যৌবনঘেঁষেচলা মোপেডচালক। তার এক মাথা দুপুরে জবজবে চানের জল, কানের লতিতে নারকোল তেল। চড়াই, উতরাই গড়িয়ে অটো এনে নামায় একটা প্রকাণ্ড গ্রন্থির মুখে। নাকের সামনে লাল টিউনিকবাঁধা খুকি, মস্ত গোরিলা আর আরো প্রকাণ্ড একটা কিছু; বিনোদন। দুদিক থেকে দুটো পিষেফেলা বিপরীতমুখী রাস্তা, মাঝদুপুরের ঝাঁঝে সুবিপুল, বা নয়, মধ্যিখানে যা আসছে আছড়ে তুবড়ে থেঁতলে ফেলছে। গাঢ় আসমানি আকাশের তলায় এলোপাথাড়ি হাওয়া। আলজিভ ছুঁয়ে সিলিকন, কাঁকড়া, ইউরিনাল, মুমফলি, মাখিয়ে, বুকের ওপর অবধি জ্বালা ধরিয়ে হাওয়া আরও পশ্চিমে সরে যায়। সমুদ্রবায়ু। 

৫. 
ধাতুর আঁশে গতিদীর্ণ সময়। কাদাগোলা জলে গামছা চুবিয়ে মুছে নেওয়া দুটো কাচ; তারই আধ ইঞ্চি ব্যবধানে জমা হয়েছে মরা উচ্ছিষ্ট, কখনও সোনালী, কখনও ছায়া রঙের। অভিমুখন এমন একটা ব্যাপার, যার ভেতর বাহির আবছা; স্থানানুক্রমিক। ভেদ নেই এমন নয়, তবে একটা অন্যটার প্রতিস্থাপকের মতন, অফুট। জানলা পেছনে ফেলে যায় অভিমুখ, চ্যুইংগামে আটকে পড়া, হাওয়ায় ফুলে ওঠা কালো প্লাস্টিক, মাঝরাস্তায়। শহরের পরিসীমায় প্লাস্টিকের সুবিপুল ইমারতগুলো। সেখানে কেউ থাকেনা। কেবল সেগুলিই থাকে। চিকন ঘাসের ওপর লোহার, আরো বিচিত্র শংকরের আলপনায় অতিপৃক্ত সভ্যতা। ইতস্তত ওঠানামায় বাসস্ট্যান্ড ছোটবড়ো। ঢলা সূর্যের বিপরীতে অন্ধকার মুখ বাস পাচ্ছেনা। বাগান, ঝিল, সব নকল? এই মাস্তুল থেকে ডলফিন, ডলফিন থেকে ফুটবল, ফুটবল থেকে পেট্রোল পাম্প, এর মধ্যেগুলো? এর অভিমুখ কোথায়? জানলার ভাঁজ থেকে তুলে নেওয়া হাতে বাসা নেওয়া ছাপ, তার অভিমুখ কোথায়? এই যে কিছু হবেনা, এই যে পেটের ডান পাশ থেকে ঘূর্ণির মতন নেমে আসা কুঁকড়ে দেওয়া যন্ত্রণা, এই যে কানের মধ্যে ঠেলতে থাকা ইয়ারফোন, শুনতে পাচ্ছিনা, এই যে প্রচণ্ড পাঘামানো দুশ্চিন্তা, এর অভিমুখ কোথায়? এই যে কাচের মধ্যে থেকে ঠিকরে থাকা অর্ধেক চোখের কানা প্রতি সিগ্ন্যালে পরাবাস্তব ফ্রেম তৈরি করার চেষ্টা করে যায়; এই যে পরের মুহূর্তেই তা টুকরো হয়ে যায়, এসবের অভিমুখন বাধ্যতামূলক? আনত সোয়েটারের হাতায় ব্যাগ গলিয়ে সময় নেমে যায়; অভিমুখ অভিমুখের মতন।

0 comments: