প্রাচীনকথা - দোলা সেন
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীনকথা
পঞ্চকন্যার একজন
দোলা সেন
অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরীস্তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাপম বিনাশনম॥
প্রাতঃস্মরণীয়া পাঁচ নারী। সকালে উঠে স্মরণ করলে পাপক্ষয়। এই পাপক্ষয় নিয়ে এই অভাজনের মনে এক সন্দেহ আছে। বিষয়টা অনেকটা ‘মার কথা না শুনলে ঠাকুর পাপ দেবে’ জাতীয় কী? পাশ করার লোভে যেমন পড়া, পুণ্যের লোভ দেখিয়ে এই নামগুলি জনমানসে গেঁথে দেবার প্রচেষ্টা হলেও হতে পারে। কিন্তু কেন? আমাদের পুরাণের বিবিধ রূপ। রূপক, অলংকার, দর্শন, ধর্ম – বিভিন্ন আলোয় তা ভিন্ন ভিন্ন রঙ ছড়ায়। আর এখানেই এই মহাকাব্য দুটি অন্য সবার থেকে আলাদা। আবার যুগ যুগ ধরে এর একটি সহজ সাধারণ আটপৌরে রূপও চলে আসছে। চণ্ডীমণ্ডপ, কথকতার আসর, ঠাকুমা-দিদিমার গল্পের ঝুলি আলো করে এর উপস্থিতি। বস্তুতঃ এই রূপটির জন্যই মহাভারত আর রামায়ণ আজও জনজীবনের অঙ্গ। ইলিয়াড ওডেসির মতো তা গবেষকের সংগ্রহশালায় বাস করেনি।
আচ্ছা, যদি সব কিছু সরিয়ে রেখে সহজ মানবী হিসেবে দেখি এই পাঁচটি মেয়েকে? ফিরে দেখি তাদের আজকের এক মেয়ের চোখ দিয়ে? খুব কি অনধিকার চর্চা হবে? সহজ গল্পের সহজ মানেটুকু দেখতে গিয়ে পেতেও তো পারি অন্য কোনও স্পেকট্রাম? তারই খোঁজে চলতে গিয়ে আজকের নারীর নাম হোক অহল্যা।
॥অহল্যা॥
পঞ্চকন্যার এক কন্যার নাম অহল্যা। দ্রৌপদীর মতো ইনিও অযোনিসম্ভবা অলোকসামান্যা রূপসী। কথিত আছে উর্বশীর রূপের গর্ব খর্ব করার জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল ঘুরে সব জায়গার শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য চয়ন করে সৃষ্টি করেন এই মানসকন্যাকে। পুরুষের বহু জন্মের কামনার ধন এই রমণী। কোনও অসুন্দরতার স্পর্শ নেই যে নারীর অঙ্গে – তিনিই অহল্যা। এই অনিন্দ্যসুন্দরী কন্যাকে সৃষ্টি করে পিতামহ পড়লেন মহা চিন্তায়। কোথায় রেখে নিরাপদে বড় করবেন এই মেয়েকে? অনেক ভাবনাচিন্তার পরে তাঁর মনে পড়ল মহাঋষি গৌতমের কথা। কঠোর ব্রহ্মচারী এই তাপসের কাছেই অহল্যা একমাত্র নিরাপদ বলে মনে হলো তাঁর। একটু দুষ্টু হাসিও ফুটে উঠল প্রজাপতির মুখে। এই সুযোগে ব্রহ্মচারীর অগ্নিপরীক্ষাটাও হয়ে যাবে। অতএব একদিন তিনি মহর্ষির কাছে গিয়ে বললেন, - “দেখ হে, আমি ক’দিনের জন্য একটু বাইরে যাচ্ছি। ততদিন তুমি যদি মেয়েটিকে তোমার আশ্রয়ে সুরক্ষিত রাখ, তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হই। আমি ফিরে এসে ওকে নিয়ে যাব।“
গৌতম রাজি হয়ে গেলেন। অহল্যা তাঁর আশ্রমে থেকে গেল। ঋষির কোন হেলদোল হলো না। তিনি সারাদিন তাঁর জপতপ, পূজার্চনা নিয়েই থাকেন। অহল্যা তাঁর তপোবনে সবার চোখের আড়ালে ফুলের মতো, পাখির মতো, হরিণশিশুর মতো বড়ো হতে থাকে। ভারি লক্ষ্মী মেয়ে। রোজ গৌতমের ঘরদুয়ার পরিষ্কার করে দেয়। সাজিয়ে রাখে পূজার উপকরণ, ফুলের মালা। তুলে আনে বনের ফল – সুন্দর করে সাজিয়ে খেতে দেয় মহর্ষিকে। সুরভি গাইয়ের দুধ দিয়ে কোনওদিন বানিয়ে দেয় পরমান্ন। কুটিরের সামনে লাগায় বনফুলের চারা। দেখতে দেখতে মহর্ষির মাথা গোঁজার কুটিরটি এক সুন্দর গৃহ হয়ে উঠল।
ব্রহ্মা আড়াল থেকে খেয়াল রাখছিলেন সবই। গৌতমের সংযমে তিনি অভিভূত। বেশ কিছু বছর অতিক্রান্ত। কিশোরী অহল্যা যৌবনপ্রান্তে উপনীত। এবার তাকে প্রাত্রস্থ করার সময় এসেছে। তিনি আবার এসে দাঁড়ালেন গৌতমের দুয়ারে। পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতো ঋষিও বিনা বাক্যব্যয়ে ফিরিয়ে দিলেন গচ্ছিত সম্পদ।
কিন্তু এ মেয়ে তো সাধারণী নয়! একমাত্র ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষই পারে এর যোগ্য জীবনসঙ্গী হতে। বড় চিন্তায় পড়লেন প্রজাপতি। অনেক ভেবে স্থির করলেন সবচেয়ে কম সময়ে যে মহাবীর প্রদক্ষিণ করতে পারবেন ত্রিভুবন, তিনিই হবেন অহল্যার স্বামী।
এদিকে অহল্যা ব্রহ্মলোকে ফিরে যাওয়ায় গৌতম তাঁর কুটিরে আগের মতোই একা। কিন্তু সত্যি কি আগের মতোই? এতগুলো বছরে তাঁরও তো বয়েস বেড়েছে অনেকটাই। এই দীর্ঘ দিনযাপনে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন গৃহসুখে, সযত্নচর্চিত শয্যায়,হাতের কাছে সাজিয়ে দেওয়া পূজার উপাচারে, এগিয়ে দেওয়া খাদ্যে। এছাড়া অহল্যার প্রতি অনুরাগও কি সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর মধ্যে? হয়েও যদি থাকে, আজীবন ব্রহ্মচারীর পক্ষে তার স্বরূপ অনুধাবন করা সম্ভব নয়। তবুও অহল্যাকে ফিরিয়ে আনতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। ব্রহ্মার কন্যাপণ শুনে তাই তাঁর মুখে একটুকরো হাসি খেলে গেল। গোহাল থেকে সুরভিকে বাইরে এনে তাকে প্রদক্ষিণ ও প্রণাম করে তিনি রওনা দিলেন ব্রহ্মলোকে।
এদিকে অহল্যার রূপে ত্রিজগৎ মোহিত। দেবাসুর-মনুষ্যের সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। কিন্তু এসে দেখলেন ত্রিলোকপ্রতিভূ গোমাতা সুরভিকে প্রদক্ষিণ করে পণ জিতে কন্যা নিয়ে চলে গেছেন মহর্ষি গৌতম।
ইন্দ্রের অহমিকায় বড্ড লাগল। তিনি দেবরাজ। স্বর্গ- মর্ত্য-পাতালে সমস্ত শ্রেষ্ঠ জিনিসে তাঁরই অগ্রাধিকার – এ জাতীয় একটা ধারণা তাঁর আছে। তাছাড়া অহল্যার রূপ তাঁকে পাগল করেছে। যেনতেনপ্রকারেণ এ রমণীরত্ন তাঁকে পেতেই হবে, - এই ধারণা থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছেন না তিনি।
এদিকে অহল্যা ফিরে এসেছে গৌতমগৃহে। চিরকাল একলা আশ্রমে পালিত হবার কারণে বিবাহ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা তার ছিল না। সে হয়ত খুশিই হয়েছিল তার শৈশবের পরিচিত আশ্রয়ে ফিরে এসে। সে তার নিত্যকর্মে যোগ দিল আগের মতোই।
আর গৌতম? আজীবন কঠোর ব্রহ্মচারী তিনি। কিন্তু জাগতিক রীতি সম্পর্কে তিনি অবহিত। বিবাহিতা স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে তাঁর সম্যক ধারণা আছে। কিন্তু দীর্ঘ ব্রহ্মচর্য এবং উপাসনার যে জীবনকে এতদিন শ্রেয় বলে মেনে এসেছেন, এই প্রায় প্রৌঢ় বয়সে সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়া তাঁর পক্ষে সুকঠিন। হয়ত প্রর্থিতও নয়। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে দীর্ণ হতে থাকেন ঋষি। চিরসৌম্য শান্ত মানুষটি তাই মাঝে মাঝেই মেজাজ হারান। সামান্য ত্রুটিতেই অহল্যার কপালে জোটে তীব্র তিরস্কার।
অহল্যা বোঝে না তার কী অপরাধ। তবে আজকাল তারও বড় ভুল বেড়েছে। জলে নিজের ছায়া দেখে নিজেই আনমনা হয়ে যায়। জল ভরে আনতে দেরি হয়ে যায় প্রায়ই। পুজোর ফুল সাজাতে গিয়ে কখন যেন দু একটি ফুলে তার কেশদাম সেজে ওঠে। অবসর সময়ে হয়ত গড়ে নেয় ফুলের মালা কিংবা পুষ্পকঙ্গন। যতই সুন্দতরা হয়ে ওঠে অহল্যা, ততই তিরস্কারে ধিক্কৃত হয় বেচারী।
ইন্দ্র রোজ চলে আসেন তপোবনে। গোপনে লক্ষ্য করেন অহল্যাকে। তার সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে আরও মোহাবিষ্ট হন। অহল্যা-গৌতমের বিচিত্র দাম্পত্যও চোখ এড়ায় না তাঁর। দিন দিন চঞ্চল হয়ে ওঠেন দেবরাজ। ঋষির অভিশাপের ভয় তাঁকে সামনে আসতে দেয় না, আর অহল্যার অমোঘ আকর্ষণ তাঁকে ফিরে যেতে দেয় না।
এই দোলাচলে দুলতে দুলতে ইন্দ্র একদিন মরিয়া হয়ে উঠলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন রোজ সকালে নদীতে স্নান আহ্নিক সেরে তবে প্রাত্যহিক পূজায় বসেন ঋষি। আর নদীতীরে অনেকখানি সময় তিনি নির্জনে জপতপ করেন। এই সময়টাই কাজে লাগালেন দেবরাজ। একদিন সকালে মহর্ষি নদীর দিকে রওয়ানা হবার পরে গৌতমের ছদ্মবেশ ধরে তিনি কুটিরে প্রবেশ করলেন। অহল্যা অসময়ে স্বামীকে দেখে অবাক ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল – মুনিবর অসুস্থ হয়ে পড়লেন কি? গৌতমরূপী ইন্দ্র জানালেন, শরীর নয়, চঞ্চল হয়েছে তাঁর মন। অহল্যার পদ্মপলাশের মতো চোখ, ভ্রুয়ের বিভঙ্গ, ক্ষীণ কটি তাঁকে নদীপথ থেকে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করেছে। চমকে ওঠে অহল্যা। গৌতম বলছেন একথা! “ঈশ্বরের চেয়েও প্রাপণীয় অহল্যা”- একথা বলছেন সেই মহান ঋষি? সন্দেহে তীব্র হয় অহল্যার চোখ। আর সেই সরল সত্য চোখে ধরা পড়ে যায় ইন্দ্রের ছদ্মবেশ। কঠোর তিরস্কারে বিদ্ধ করে তাঁকে। কিন্তু চৌষট্টি কলাভিজ্ঞ দেবরাজকে কিভাবে প্রতিহত করবে এই সরলা নারী? জীবনে যে এই প্রথম সে শুনছে যৌবনের জয়গান।
“তোমার পরশ অমৃতসরস, নয়নে তোমার দিব্য বিভা” – নদীর জলে নিজের যে ছবি দেখতে দেখতে সে আনমনা হয়ে যেত, ইন্দ্রের চোখে, তার বাচনিতে সেই রূপমুগ্ধতার প্রকাশ তাকে নির্বাক করে দিল। জীবনে প্রথম পাওয়া অনুরাগের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল তার তনুদেহ। শুধু তাকে একবার চোখের দেখা দেখতে, তার কাছে আসতে প্রতীক্ষারত যে প্রেমিক, তাকে ফেরাতে পারল না অহল্যা। সমস্ত দেহ-মন-প্রাণ দিয়ে সে অনুভব করল জীবনের অন্য এক সত্যরূপ।
সময়ের টুকরোগুলো ছোট্ট ছোট্ট বলের মতো গড়িয়ে গেল এদিক ওদিক। তবু কোনও এক সময় ঝড় থামল। ইন্দ্র জানেন এবার তাঁকে যেতে হবে। কিন্তু বহু প্রতীক্ষিত মিলনে সময়ের হিসেবে কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। চলে যাবার পথে তিনি মুখোমুখি হলেন গৌতমের। সত্যদ্রষ্ট্রা ঋষির অগোচর কিছুই রইল না। ক্রুদ্ধ ঋষির অভিশাপে লিঙ্গ স্খলিত হলো তাঁর। আর সারাদেহে এক হাজার স্ত্রীযোনিচিহ্ন ফুটে উঠল। লজ্জায় ইন্দ্র অজ্ঞাতবাসে মুখ লুকোলেন।
আর অহল্যা? সরল সত্যভাষিণী মেয়েটি সত্যি কথাই বলেছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করবে কে? স্বেচ্ছায় এক প্রণয়ীকে গ্রহণ করার মতো দুঃসাহস করতে পারে যে নারী, তাকে আর কিই বা তিনি করতে পারেন পাষাণ করে দেওয়া ছাড়া? এই অনিন্দ্যসুন্দর রূপরাশি দেখতে পাবে না আর কেউ। এই সত্যযুগ পার হয়ে ত্রেতাযুগে সেই কবে শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে আসবেন, তাঁর পাদস্পর্শে মুক্তি ঘটবে এই পাপীয়সীর। ততদিন শুধু বায়ুভক্ষণ করে প্রতীক্ষা করবে হতভাগিনী।
রাজসিংহাসন খালি থাকলে বড় বিপদ। দেবকুল ধরে পড়লেন গৌতমকে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে ইন্দ্রকে ক্ষমা করলেন ঋষি। হাজার যোনি হাজার চক্ষুতে পরিবর্তিত হলো। পুরুষত্বও ফিরে পেলেন সহস্রলোচন। শাপে বরই হলো বরং তাঁর।
আর অহল্যা? সে তো সামান্য এক নারী মাত্র। তাই সে অপেক্ষা করে রইল। একযুগ শেষ হলো। নতুন যুগপুরুষ জন্ম নিলেন। তিনি বড় হবেন, বনবাসে যাবেন, তবে না তাঁর পাদস্পর্শে অহল্যার মুক্তি?
তাই হলো। পাষাণরূপী অহল্যার গায়ে পা ঘষলেন শ্রীরাম। কি জানি, হয়ত বনপথে চলতে গিয়ে কোনও ময়লা লেগেছিল তাঁর পায়ে! সেই পায়ের ছোঁয়ায় মানুষীরূপ ফিরে পেল অহল্যা। শ্রীরামচন্দ্রের বন্দনা করল সে। এবার তাকে ফিরে যেতে হবে ঋষি গৌতমের কাছে। মহান ঋষি বিষ্ণুর আদেশে তাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়েছেন!
ভাগ্যের কি পরিহাস! পরপুরুষকে স্পর্শ করার জন্য পাথর হয়েছিল যে নারী তাকে জীবনছন্দে ফিরিয়ে আনতে সেই পুরুষেরই ছোঁয়ার প্রয়োজন হলো। প্রেমের স্পর্শে পাথর মেয়ে প্রাণ ফিরে পেল অবহেলার পাদস্পর্শে!
তৎকালীন সমাজে নারীর অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য এই কাহিনী আমার চোখে একটি দিগ্দর্শকের কাজ করে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, পাষাণী অহল্যা কি মনুষ্যরূপ ফিরে পেয়ে সত্যি বেঁচেছিল? নাকি অন্যের ইচ্ছের এক চলমান পুতুল হলো বলেই সে ফিরে যেতে পারল তার পতিগৃহে? ইন্দ্রের কামনা আর গৌতমের রোষ – এ দুয়ের মাঝে পড়ে অহল্যার নিয়তি পাষাণ হয়ে যাওয়া।
0 comments: