0

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

Posted in


প্রবন্ধ


কমলাকান্ত উবাচ –মুক্তজীব 
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী 



কমলাকান্ত আমার জীবনে অমাবস্যায় চাঁদের উদয়ের মতো। 

তার সাথে আমার একান্ত গোপনীয় সখ্যতাটা আমাকে,সঠিক ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, ভীষণ ভাবে হ্নট করে। গৌড় বর্ণ, আত্মভোলা, অল্পে তুষ্ট, আফিমসেবী, ভোজনং-যত্রতত্র-শয়নং-হট্টমন্দির বিলাসী, কর্মবিমুখ এই সদালাপী ব্রাহ্মণ আমাকে কেমন যেন সন্মোহিত করে তুলেছে। 

প্রায় প্রতিদিনই আমি মধ্যরাতে তার প্রতীক্ষায় বসে থাকি। কিন্তু সে নিয়মিত দর্শণ দেয় না। উঞ্ছবৃত্তীজিবী এই ব্রাহ্মণ কখন কোথায় যে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে তার সন্ধান পাওয়া এক কথায় অসম্ভব। তাই তিনি দেখা দিলেন তো দিলেন, না দিলেন তো না দিলেন ধরেই আমায় “ধন্য আশা কুহকিনী” রূপে চাতক পাখির ন্যায় বসে থাকতে হয়। আমার গৃহে কখন তার পদধূলি পড়বে এই ভেবে ভেবেই আমার কত যে রাত নিদ্রাহীন অবস্থায় কেটে যায় তার ইয়ত্তা নেই। 

সন্ধ্যের পর থেকেই মন উচাটন হতে থাকে কৃষ্ণ বিরহে রাধার মতো। ব্যাপারটা যে অর্ধাঙ্গিনীর নজর এড়িয়ে গেছেতা নয়, তবে শ্বশুরদুহিতা আমার যে সকল কর্মকাণ্ড ক্ষমা ঘেন্না করে মাফ করে দেন তার মধ্যে আমার এই কমলাকান্ত সিন্ড্রোমটি বিদ্যমান থাকায় আমি আপাতত তাঁর অঙ্কিত লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করিনি। তবে তাঁর শ্যেন দৃষ্টিকে আর কতদিন ডজ করে যেতে পারব সেটা বলা খুব মুশকিল। একবার সাহস করে তাঁর কাছে কমলাকান্তরকথা বলার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম যে আমার স্ত্রী’র মতে আমার জন্য অবিলম্বে একজন সাইকিয়াট্রিষ্টের জরুরি প্রয়োজন। তারপর থেকে ওনার সামনে আমি অত্যন্ত বিরল গাম্ভীর্য নিয়ে চলা ফেরা করে থাকি কেননা আমার কর্মক্ষেত্রে আমার উপরওয়ালা একবার বলেছিলেন যে কোনও সময়ে কৃত্রিম ব্যস্ততা দেখাবার প্রয়োজন হলে জনসমক্ষে চিন্তামগ্ন অবস্থায় দ্রুত চলা ফেরা করাটা অতীব জরুরি। এই টোটকাটা কাজে লাগিয়ে আমি আপাতত স্ত্রী’র কাছে বেশ নিরাপদ দুরত্বে সন্মানিত অবস্থাতেই আছি। 

কিন্তু কমলাকান্ত যেভাবে নিজেকে আমার কাছে অনিয়মিত করে তুলছে তাতে আমার সেই “রাধার কানু বিহনে হা কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ” ভাবটার মতো “হা কমলাকান্ত, হা কমলাকান্ত” অবস্থাটা খুব শীঘ্রই সকলের নজরে এসে পড়বে বলেই মনেহয়। আর তার ফলে যে আমাকে অতি সত্বর প্রখ্যাত সেই শৈল শহরটির বিখ্যাত সেই ফাটকের লৌহ শলাকার পিছনে যেস্থান নিতে হবে সে বিষয়ে আর আমার কোনও দ্বিমত নেই। 

যাইহোক সেই অবশ্যম্ভাবী মহাপ্রস্থানের আগে আমি একবার কমলাকান্তের সৃষ্টির সাথে বিশেষ ভাবে পরিচিত হয়ে নিতে চাই। কেননা আমার মনে হয় কমলাকান্তের পূনর্মূল্যায়ণ হওয়া খুব জরুরি। ভীষ্মদেব খোশনবীস মহাশয় কমলাকান্তকে সঠিক ভাবে না বুঝতে পেরে বেশকিছু তরল মন্তব্য করে ফেলেছেন। 

নিরুদ্দেশ হবার প্রাক্কালে কমলাকান্ত যে দপ্তরটি ভীষ্মদেবকে দান করে গেছিল তার সঠিক রসাস্বাদন করবার ক্ষমতা ভীষ্মদেবের ছিল বলে আমার মনে হয়না। 


(২) 

কারণ সে ক্ষমতা যদি ভীষ্মদেবের থাকতো তবে তিনি কিছুতেই বলতে পারতেন না – 

“এ অমূল্য রত্ন লইইয়া আমি কি করিব? প্রথমে মনে করিলাম অগ্নিদেবকে উপহার দিই। পরে লোকহিতৈষিতা আমার আমার চিত্তে বড় প্রবল হইল। মনে করিলাম যে, যে লোকের উপকার না করে তাহার বৃথায় জন্ম। 

এই দপ্তরটিতে অনিদ্রার অত্যুৎকৃষ্ট ঔষধ আছে – যিনি পড়িবেন, তাঁহারই নিদ্রা আসিবে। যাঁহারা অনিদ্রারোগে পিড়ীত তাঁহাদিগের উপকারার্থে আমি কমলাকান্তের রচনাগুলি প্রচারে প্রবৃত্ত হইলাম।” 

কমলাকান্ত’র সৃষ্টি সম্পর্কে ভীষ্মদেব খোশনবীসের এই অত্যন্ত অম্লময় কটু মন্তব্য যে তাঁর অবিমৃষ্যকারিতাই পরিচয়, এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ হলে খোশনবীস মহাশয় এত সহজে পার পেয়ে যেতেন বলে আমার মনে হয়না। ভীষ্মদেব বাবু তাঁর নিজের শক্তিহীন দন্তকৌমুদীদ্বারা আখের রস আস্বাদনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে ইক্ষুদণ্ড যে বংশদণ্ডে পরিণত হয় না সেটা ভদ্রলোকের বোঝা উচিৎ ছিল। কাজেই আজকের দিনে ওনার ফেবুর দেয়াল যে কমলাকান্ত ভক্তদের অগিবাণে খাণ্ডব দহনে পরিণত হয়ে যেত সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। 

যাইহোক, আমি খোশনবীস মহাশয়কে উপেক্ষা করে কমলাকান্ত’র দপ্তরটিকে নিয়ে রাতের আহারের পরে আমার লেখার টেবিলে এসে বসলাম। বলাবাহুল্য রাতের জোগাড়যন্ত্র সব পুর্ববৎ; যদি কমলাকান্ত’র দেখা মেলে এই আশায়। 

দপ্তরটির পাতা উল্টাতে উল্টাতে সন্দেহাতীত হলামযে দপ্তরটি একটি স্বর্ণখনি। বুঝতে পারলাম, দপ্তরটি খোসনবীস মহাশয়ের গলায় মুক্তোর মালার মতো শোভা পাচ্ছিল। 

দপ্তরটিতে বর্ণিত কমলাকান্ত’র রচনাগুলিকে মোটামুটি ভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় –মোট চতুর্দশ সংখ্যা সম্বলিত “কমলাকান্তের দপ্তর”, মোট পঞ্চম সংখ্যা সম্বলিত“কমলাকান্তের পত্র” এবং “কমলাকান্তের জোবানবন্দী” যেটা খোসনবীস জুনিয়র প্রণীত এবং তার সাথে একটি “পরিশিষ্ট” আছে যেটা “শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী প্রণীত”। 

দপ্তরের যতই গভীরে প্রবেশ করতে লাগলাম ততই যেন দার্শণিক কমলাকান্ত আমার সমস্ত সত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল। অহো, বিষয়ের কি বর্ণময় বৈচিত্রতা আর তার কি অসাধারণ বিশ্লেষন যা কালের গণ্ডি অতিক্রম করে বর্তমান সময়েও ভীষণরকম ভাবে সত্য। তার পলিটিকস, পতঙ্গ, বসন্তের কোকিল, বাঙ্গালীর মনুষ্যত্ব ইত্যাদি রচনাগুলি এককথায় অনবদ্য। 

খোশনবীস মহাশয় কমলাকান্তকে যতই অর্দ্ধোন্মাদ নেশাখোর রূপে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করুন না কেন, কমলাকান্ত সোজাসুজি সজ্ঞানে যে সকল কথা কখনও শর্করাযুক্ত ব্যঙ্গের সাহায্যে আবার কখনও বা ভাষার মাধুর্যে সরস রসিকতার মাধ্যমে পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে যেভাবে সমাজের খামতিগুলো দেখিয়ে দিয়েছে তার তুলনা মেলা ভার। 

শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্ত মহাশয়ের মতে -“কমলাকান্ত একাধারে কবি, দার্শনিক, সমাজশিক্ষক, রাজনীতিজ্ঞ ও স্বদেশপ্রেমিক; অথচ কবির অভিমান, দার্শণিকের আড়ম্বর, সমাজশিক্ষকের অরসজ্ঞতা, রাজনৈতিকের কল্পনাহীনতা, স্বদেশপ্রেমিকের গোঁড়ামি নাই। হাসির সঙ্গে করুণের, অদ্ভুতের সঙ্গে সত্যের, তরলতার সহিত মর্মদাহিনী জ্বালার, নেশার সঙ্গে তত্ত্ববোধের, ভাবুকতার সহিত বস্তুতন্ত্রতার, শ্লেষের সহিত উদারতার এমন মনোমোহন সমন্বয় কে কবে দেখিয়াছে?” 


(৩) 

ভীষ্মদেববাবু, আপনি যাই লিখে থাকুন কেন, এটাই কিন্তু কমলাকান্তের সঠিক মূল্যায়ন। 

নেশাগ্রস্তের ন্যায় দপ্তরটি পড়ার ঝোঁকে সহসা তেষ্টা অনুভব করলাম। চোখ তুলে আমার পাণীয় পূর্ণ গেলাসের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে দেখি কমলাকান্ত’র জন্য বরাদ্দ পুর্ণকুম্ভটি অর্ধকুম্ভরূপে বিরাজমান। কাঁসার ঘটিটির ঢাকাটি পাশে রাখা আছে।

অত্যন্ত অবাক হয়ে পাশে রাখা দাদামশায়ের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখি তার ওপর স্বয়ং কমলাকান্ত সুখাসনে বিরাজমান। মুখে তার সেই বিখ্যাত রহস্যময় হাসির রেখা যা দেখলে আমি নিশ্চিত যে স্বয়ং দ্য-ভিঞ্চি সাহেব একটি পুরুষ মোনালিসা সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত হতেন। 

আর তাহলে আজ প্যারিস শহরের ল্যুভের যাদুঘরে তাঁর বিশ্ববিখ্যাত সৃষ্টি মোনালিসা’র পাশে আমাদের কমলাকান্ত’র ছবিও ল্যুভের যাদুঘরের মর্যাদা আরও সহস্রগুণ বাড়িয়ে তুলতো। 

যাইহোক, কমলাকান্তকে দেখে আমি যারপরনাই আনন্দিত এবং উত্তেজিত হয়ে তাকে কিছু বলতে যাবার চেষ্টা করতে যেতেই সে অভয়মুদ্রার সাহায্যে আমাকে সেই কার্য থেকে বিরত করল। 

আমি ঢোঁক গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে নিশ্চুপ থাকলাম। বলা যায়না, তার আদেশ অমান্য করলে যদি আবার হিতে বিপরীত হয়ে যায়! 

আমি মুখে কোনও কথা না বলে তার পরবর্তী কার্যক্রম দেখতে লাগলাম। একটি আফিমের গুলি সে তার রূপোর ডিবে থেকে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে নিয়ে, গুঁড়ো দুধের নীলবর্ণ প্যাকেটটা ফট করে তার হাঁ-করা মুখের ওপর ছিঁড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে অর্ধকুম্ভের জল তার প্রসারিত মুখে নিঃশেষিত করে পরম আয়েশে কুলকুচো করে গিলে ফেলে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ সে ঝিম মেরে বসে থাকল। 

তারপর একসময় চোখ খুলে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকল। 

“লেখক, বহুদিন তোমার কোনওপ্রকার সংবাদ লইনাই। স্থির করিলাম আজি রাত্রিতে তোমার দর্শণ করিব। এইস্থলে আসিয়া দেখিলাম তুমি আমার দপ্তরটি খুলিয়া স্থির চিত্রের ন্যায় বসিয়া আছ। আমি এই কারণেই তোমার তপস্বী ভাবে বিধ্ন ঘটাই নাই।” কমলাকান্ত আমায় তার নিঃশব্দ উপস্থিতির কারণ জানায়। 

“তোমার দপ্তরটি পড়তে পড়তে একেবারে বুঁদ গেছিলাম। তা সেটা হঠাৎ করে বন্ধ করলে কেন?” আমি কমলাকান্ত’র কাছে জানতে আগ্রহী হই। 

আমার কথা শুনে কমলাকান্ত কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। আবার সেই অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ ঘর জুড়ে বিরাজ করে। টেবিল ল্যাম্পের নরম আলো তার চোখে সজল একটা ভাব এনেছে মনে হলো। মাঝরাতে আমার রাত জাগা চোখে ভুল দেখছি কিনা সেটা বুঝে উঠবার আগেই দেখলাম কমলাকান্ত ধুতির কোঁচা দিয়ে তার মুখমণ্ডলের পরিচর্যা করে নিল। 

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কমলাকান্ত বলে ওঠে,“একদা হঠাৎ-ই লিখিবার ইচ্ছা ত্যাগ করিয়াছিলাম। ‘কমলাকান্তের বিদায়’ ছিল ‘কমলাকান্তের পত্র’-এর সর্বশেষ পঞ্চমসংখ্যা। সম্পাদক মহাশয়কে বলিয়াছিলাম যে কমলাকান্তের আর সে রস নাই। বলিয়াছিলাম কমলাকান্ত অন্তরের অন্তরে সন্ন্যাসী – তাহার এত বন্ধন কেন?” 

“তাই বলে এরকম ভাবে লেখা বন্ধ করে দেওয়া যায় নাকি?” আমি জোর করে চেপে ধরি,“তোমার লেখার যাঁরা নিয়মিত পাঠক ছিলেন, যাঁদের কাছে তোমার লেখার একটা মর্যাদা ছিল, তাঁদের কাছে তো তোমার একটা দায়বদ্ধতা থেকে যায় নাকি?”


(৪) 

নিমরাজি হয়েও কমলাকান্ত বলে, “আসলে আমি নিরুদ্দেশ যাত্রা সম্পূর্ণ করিয়া ফিরিয়া আসিয়া যখন দেখিলাম খোশনবীস মহাশয় আমার দপ্তরটি বঙ্গদর্শণ সম্পাদক মহাশয়কে বিক্রয় করিয়া শুধু দু-পয়সা কামাইয়াই লন নাই তৎসহিত কিছু নামও কামাইয়াছেন আমার বদনাম করিয়া তখন আমি সপ্তম রিপু বিষাদ দ্বারা ভীষণ ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হই। এই অবস্থাটি আমায় বড়ই ব্যথাতুর করিয়া তোলে। বলিতে পার তখন আমার শ্রীমদভাগবদ গীতায় বর্ণিত “অর্জুন বিষাদযোগ” অবস্থা। কিন্তু আমার তো কোন শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন না তাই আমি নিজেই নিজেকে বিষাদের কৃষ্ণগহ্বর হইতে উদ্ধার করিতে সচেষ্ট হইলাম। পরে অবশ্য ভাবিয়া দেখিলাম ইহাই বেশ হইয়াছে। আমার তো এখন সেই নসীবাবু নাই – অহিফেনের অনাটন – সে প্রসন্ন কোথায় জানি না – তাহার মঙ্গলা কোথায় জানি না। সত্য বটে, আমি তখনও একা – এখনও একা – কিন্তু তখন আমি একায় এক সহস্র – এখন আমি একায় আধখানা। কিন্তু একার এত বন্ধন কেন? কাজেই দপ্তর লেখার কর্মকাণ্ড বিসর্জন দেওয়াই শ্রেয় বলিয়া বোধ হইল। তোমরা লেখকেরা যাহাকে রাইটার্স ব্লক বলিয়া থাক, আমি মানসিক দিক হইতে সেই বাধারই সম্মুখীন হইলাম বলিতে পার।” 

আমি থাকতে না পেরে বললাম, “তুমি দেখছি একেবারেই শিশুসুলভ মনোবৃত্তির অধিকারি। চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খেতে শুরু করে দিলে?” 

“দেখ লেখক, আমি দার পরিগ্রহ করি নাই। সংসারে বাঁধা পড়িতে চাহি নাই। আমি আপনার মর্জি মতো জীবন ধারণ করিতে চাহিয়াছি, তবে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করি নাই। আমি আপন বুদ্ধি দ্বারা সমাজ, জীবন, প্রকৃতিকে যেরূপ প্রত্যক্ষ করিয়াছি এবং যাহা উপলবদ্ধি করিয়াছি তাহার দ্বারাই আমি আমার দপ্তর সৃষ্টি করিয়াছি। ইহাতে কোনওরূপ তঞ্চকতা নাই। আমি সম্পূর্ণ নিজজ্ঞানে জীবন হইতে যে রং-রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দের সন্ধান পাইয়াছি তাহার দ্বারাই আমি আমার লেখনীকে সচল রাখিয়াছি। অপরের জীবন অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত করি নাই। বিদেশী ভাষায় বলিতে গেলে বলিতে হয় যে ইহা একেবারেই আমার firsthand experience.” 

আমি কমলাকান্তকে বাধা দিলাম না। তার সঙ্গে আমার আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু যখন সে নিজে তখন তার মনের জানালা-দরজাগুলো খোলা থাকা খুবই জরুরি। অতএব আমাকে আজ তার কাছে এক ঐকান্তিক শ্রোতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারলেই আজ কমলাকান্তের হৃদয় স্পর্শ করা সম্ভব হবে। আমি সেই চেষ্টাতেই ব্রতী হলাম। 

আর তার ফলে কমলাকান্ত আমাকে তার একজন নিষ্ঠাবান শ্রোতা পেয়ে নিজের বক্তব্য জারি রাখে। 

“জীবনের চরৈবতিতে যখন কোনও প্রকার বন্ধনেই বাঁধা পড়ি নাই তখন এই ক্ষুদ্র দপ্তর লইয়া এত চিন্তিত হইব কেন? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করিতে গিয়া দেখিলাম আমি আমার অজান্তেই কখন যেন আমার দপ্তরের সহিত এক অদৃশ্য বন্ধনে নিজেকে জড়াইয়া ফেলিয়াছি। এবং এই বন্ধনই যেন আমায় অক্টোপাসের ন্যায় আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়াইয়া ধরিতে চলিতেছে। কিন্তু আমি তো চিরকাল জীবনের সর্বপ্রকার অষ্টপাস হইতেই মুক্ত হইতে চাহিয়াছি। তাহা হইলে আর এই ক্ষুদ্র দপ্তরের বন্ধনে ধরা পড়িব কেন? কেন খোশনবীস মহাশয়ের কথা ভাবিয়া আমার মন নিম্নগামী হইবে? এতদিনকার পরিশ্রম লব্ধ আমার সকল অনুশাসন কি আমার দপ্তরের পরিচিতি প্রাপ্তির আশায় বালির বাঁধের ন্যায় ধ্বসিয়া পড়িবে আর আমি তাহা অর্বাচীনের ন্যায় প্রত্যক্ষ করিতে থাকিব? না, ইহা কখনই ঘটিতে দেওয়া 


(৫) 

যাইতে পারে না। অতএব আমি দপ্তরটির উপর হইতে আমার সমস্ত স্বত্ত্বসকল তৎকাল ত্যাগ করিয়া 

দিলাম। অহো, কি প্রশান্তি যে পাইলাম, লেখক, তাহা আমি তোমাকে সঠিক বুঝাইয়া বলিতে পারিব না।” 

বহুক্ষণ হয়ে গেছে আমার মুখে কোন কথা নেই। তবে আমার মন বলছে কি অসাধারণ সমসাময়িক জ্ঞানের ভাণ্ডারি এই মুক্তজীবরুপী ব্রাহ্মণ! ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যে চার প্রকার সংসারী জীবের কথা বলে গিয়েছেন সেই সুপ্ত, বদ্ধ, নিত্য এবং মুক্তজীবগনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব আজ আমি প্রত্যক্ষ করলাম। অসূয়ারহিত, পরশ্রীকাতরতাহীন এই সদালাপী নির্লোভ দার্শনিক ব্রাহ্মণ প্রকৃত অর্থেই মুক্তজীবই বটে। ভীষ্মদেব খোশনবীস মহাশয়ের ওপর নিজের মনের নিম্নগামী গতিরোধ করবার জন্য কমলাকান্ত সকলের চোখের আড়ালে যেন ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসেছিল; প্রথমত তার দপ্তরের ওপর থেকে শুধুমাত্র সমস্ত স্বত্ত্ব ত্যাগ করেই বসে থাকে নি, সেইসঙ্গে নিজের সৃষ্টির সাথে যে বন্ধনে জড়িয়ে পড়ছিল তার মূলে কুঠারাঘাত করার জন্য নিজস্ব সৃষ্টির আনন্দ থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল পুনর্বার আর লেখনী ধারন না করে। 

বাঃ, কমলাকান্ত বাঃ কি অসাধারণ মানসিক স্থিতি তোমার...সত্যি, you really deserve a standing ovation with thousand gun salutes!

0 comments: