1

বিশেষ নিবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ নিবন্ধ


নৌকো নিয়ে সাত-সতেরো
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



এক তরুণ কিছুদিন আগে আমাকে বলেছিলো,‘‘জেঠু,তুমি তো লেখো। তা, নৌকো নিয়ে কিছু লেখো না!’’ ঘটনাচক্রে তখন আমরা দুজনেই খেয়া নৌকায়গঙ্গা পার হচ্ছিলাম। হেসে কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিলাম বটে, কিন্তূ নৌকা নিয়ে সাতসতেরো কথা ফাঁদবার ইচ্ছেটা মাথায় থেকে গিয়েছিলো।

সপ্তাহে দিন দুয়েক গঙ্গা পারাপারের জন্য আমাকে নৌকায় চাপতে হয় সেই ছেলেবেলা থেকে।তার মানে এই নয় যে নৌকা সম্পর্কে আমার কিছু বলার অধিকার জন্মেছে। তবে অভিজ্ঞতায় ভর করে আর বইপত্তর নাড়াচাড়া করার সুবাদে এ নিয়ে দু’এক ছত্র লেখা যেতে পারে ভেবেই এই সাত-সতেরো লেখা।গঙ্গার তীরেই তো জন্ম থেকে চুয়াত্তরটা বছর কাটিয়ে দিলাম। মাঝিদের সঙ্গে কত গল্প, ডিঙ্গি নৌকায় জেলেদের ইলিশমাছ ধরা দেখা, কৈশোরে নৌকায় চেপে অনেক দূর যাওয়া, সখের দাঁড় বাওয়া, নৌকায় দুর্গাপ্রতিমা ভাসান,নৌকার ছইয়ে বসে সারা রাত চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা ভাসান দেখা কিংবা গঙ্গার বুকে নৌকার প্রতিযোগিতা (বাইচ) দেখার উত্তেজনা এখনও মনে পড়ে বৈকি!ছোটবেলায় দেখেছি, তখন মালবাহী ছোট বড় গাড়ির চল ছিলো না এখনকার মতন, বড় বড় নৌকা (গাদা বোট) বোঝাই হয়ে মালপত্তর আসতো বড়বাজার থেকে, গঙ্গার ঘাটে খালাস হতো। ইঁট, বালি প্রভৃতি ইমারতী জিনিসও নৌকা বোঝাই করে আসতো।আমার শৈশবটাও তো কেটেছে জেলেপাড়ায়, গঙ্গার ধারে। এখন আর খেয়া নৌকা আগের মতন নেই। হাল আর দাঁড়ের বদলে বসেছে ডিজেল যন্ত্র। নৌকা হয়ে গেছে ভটভটি।আশ্চর্য সমাপতনই বলবো। আমার জন্ম ও তারুণ্য গঙ্গাতীরে খেয়া ঘাটের গায়ে আর জীবনের উপান্তে পৌছে বাসা বেঁধেছি ঠিক তার উলটো পাড়ের গঙ্গাতীরে খেয়াঘাটেরই গায়ে।

আমরাতো সকলেই জানি যে,নৌকা হলো মানব সভ্যতার আদি জলযান।পৃথিবীর প্রায় সব মুখ্য ধর্মকাহিনীর প্রারম্ভিক পর্বের সূত্রপাত হয়েছে প্লাবনের মধ্য দিয়ে এবং সেই প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নৌকা ব্যবহার করতে হয়েছে। তাই সভ্যতার সেই ঊষালগ্নে যাতায়াতের জন্য নৌকার উদ্ভাবন হয়েছিলো, যাকে বলা হত ‘ভেলা’। ভেলারই বিবর্তিত রূপ নৌকা। প্রাগৈতিহাসিককালের মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষে, অজন্তার গুহাচিত্রে এবং সাঁচিস্তুপে নৌকার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। কালের স্রোতে কত স্থলযানের বিলোপ হয়েছে, মানুষ-চালিত যানের স্থান নিয়েছে যন্ত্রচালিত যান, কিন্তু জলযান নৌকার স্বকীয়তার বিলোপ হয়নি, বরং এর ব্যবহার বেড়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে কিংবা এইবাংলায়, বিহারে নৌকা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংবাদ হামেশাই সংবাদপত্রে দেখতে পাই। কিন্তু বোধ করি পথদুর্ঘটনার সংখ্যা বহুগুণ বেশি হয়।

ছেলেবেলায় একটা কথা খুব বলতাম - ‘চল পানসি বেলঘড়িয়া’। কথাটা প্রবাদ হয়ে গেছে। কোনও কাজে দলবদ্ধভাবে এগিয়ে চলার জন্য উৎসাহ-বর্ধক হিসাবে কথাটা বলা হয়। ‘পানসি’ মানে একধরনের নৌকা। কিন্তু পানসি বেলঘড়িয়ায় যাবে কেন, কি করেই বা যাবে? কারণ বেলঘড়িয়া অঞ্চলের অবস্থান তো গঙ্গাতীর থেকে প্রায় সাড়ে তিন/চার কিলোমিটার দূরে! আমি এই প্রবাদের অর্থ কোথাও পাই নি। তবে একটা সূত্র আমার মনে হয়েছে। নিমতা ও অন্যপাশে গঙ্গাতীরের গ্রাম আড়িয়াদহর মধ্যে যে অঞ্চলটার নাম বেলঘড়িয়া, সেটা প্রাচীনকালেছিলো পাট ও তরিতরকারি বানিজ্যের বৃহৎ কেন্দ্র। গঙ্গার তীরে আড়িয়াদহ থেকে নৌকা বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হতো। মাল খালাস ও বোঝাই করার জন্য খালাসিদের ডাকা হতো ঘন্টা বাজিয়ে। একটা বড় আকারের ঘন্টা বা বেল ছিলো, সেই ঘন্টার শব্দে মাল খালাসকারীরা জড়ো হয়ে যেতো।সেই থেকে নাম বেলঘড়িয়া। তো মনে হয় নৌকার মাঝি ও মালখালাসকারীরা ‘চলো পানসি বেলঘড়িয়া’ হাঁক দিতো ঘন্টার শব্দ শুনে।

এতো গেল প্রবাদের কথা। নৌকার কত নাম, কত ধরণ, আর তার কত অঙ্গ, কত সরঞ্জাম, তার ইয়ত্তা নেই। নৌকা, পানসি, বজরা, ডিঙ্গি, সাম্পান, ছিপ,নাও, গয়না,পাতাম, শ্যালো নৌকা, কোশা, গাদা বোট, ভড় ইতাদি। বৈঠা, হাল, পাল, দাঁড়, গলুই, ছই, গুন, লগি, পাটা, মাস্তুল, নোঙ্গর– ইত্যাদি শব্দগুলো যুক্ত নৌকার সঙ্গে – নৌকারই অঙ্গ। রূপকথার ‘ময়ূরপঙ্খী নাও’, কিংবা মনসামঙ্গলে বর্ণিত ধনপতি সওদাগরের ‘সপ্তডিঙ্গা মধুকর’– এইসব সকলেই শিশুকাল থেকেই শুনে আসছে। আমাদের দেশের, বোধহয় সব দেশেরই, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, প্রবাদ, ছড়া, রূপকথা ও ধর্মীয় আচারে নৌকার বিশিষ্ট স্থান আছে যুগ যুগ থেকে। পবিত্রতার প্রতীক হিসাবেই নৌকাকে দেখা হয়।মূলত পূর্ববঙ্গীয় লোকসঙ্গীতের একটা রূপ ‘ভাটিয়ালি’ গান সৃষ্টি হয়েছে নৌকা বাওয়াকে ঘিরে। নদীতে ভাটার টানে নৌকা বাওয়ার সময় নৌকামাঝিদের যে গান তাইই, ভাটিয়ালি গান।‘মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না’, কিংবা ‘নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে / তর তরাইয়া চলুক রে নাও মাঝ দরিয়া বাইয়া রে নাও মাঝ দরিয়া বাইয়া’।পঞ্জিকা বিশারদরা গণনা করে সিদ্ধান্ত জানান দেবী দুর্গার আগমন কোন বছরে নৌকায়।আজকের যন্ত্র-যানের যুগেও যখন সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুর করা নৌকা বাওয়ার গান শুনি ‘ওমাঝি বাইও, বাইওরে নাও বাইও / খরনদীর স্রোতে স্বপ্নের দেশে যাইও / হেঁই রে আকাশে আসে তুফান বড় ভারি, হেঁই রে ঢেউয়ের তালে তুফান নাচে, মরণ মহামারি/ হেঁইও হো, বল মাভৈঃ যাবোই খরনদীর পারে...” তখন যেন নৌকা বাওয়ার গান সব বাধা পেরিয়ে মানুষের লক্ষ্যেপৌঁছানোর প্রতীক হয়ে যায়।এ ভাবেইআমাদের সংস্কৃতিতে ‘নৌকা’ যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, চিরন্তন এক দার্শনিক সত্যের প্রতীকে। নদীতে স্রোতের পক্ষে বা স্রোতের বিরুদ্ধে নৌকা বাওয়া যেন মানবজীবনের ওঠা-পড়া, ভাঙা-গড়াজীবন-নদীর ওপারে পৌছানোর জন্য।

নৌকা নিয়ে দর্শন, রূপকথা, গল্পকথা থাক, এবার ইতিহাসে ফেরা যাক।ইউরোপীয়রা বৃহদাকার নৌকা নির্মাণের কৃৎকৌশল আয়ত্ত করেছিলো তাদের সমুদ্র অভিযানের জন্য। কেমন আকার ছিলো ক্রিস্টোফার কলম্বাস, ভাস্কো-দা-গামাদের সেই বৃহদাকার পাল তোলানৌকা, যাতে চেপে তাঁরা আমেরিকা, ভারতের সমুদ্রপথ আবিষ্কারের সাহসী অভিযানে বেরিয়েছিলেন তা বোঝার উপায় নেই, কল্পনায় আঁকা ছবি ভিন্ন। নব্বই জন সঙ্গী নিয়ে তিনটি নৌকায় দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযানে বেরিয়েছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে। কলম্বাসের নৌকাটির নাম ছিলো ‘সান্তামারিয়া’। কেমন ছিলোকলম্বাসের ‘সান্তামারিয়া’র আকৃতি, তা অনুমান নির্ভর, কিন্তু বিশালাকারবত্রিশ দাঁড়ের আশি ফুট দৈর্ঘ্যের বিস্ময়-নৌকা ‘ভাইকিং’এর নমুনা কয়েকশো বছর পরে আবিষ্কৃত হয়েছে আর আজও তা অসলোর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।

নৌকার সাতসতেরোয় রূপকথার প্রসঙ্গ ছুঁয়েছি, ‘ভাইকিং’এর বৃত্তান্তও রূপকথার মতন। মধ্যযুগে দারিদ্র ও খাদ্যাভাবে জর্জরিত দেশ নরওয়ে জলদস্যুতার উদ্দেশ্যে ‘ভাইকিং’ নির্মাণের কৌশল আয়ত্ত করেছিলো। ইউরোপের সাগরকূলের নানান প্রান্তে অতর্কিত অভিযান চালিয়ে খাদ্য, পণ্য ও সম্পদ লুন্ঠন করতো তারা।

বড় আকারের পালতোলা নৌকা, ইউরোপীয়রা যাকে জাহাজ বলতো, সেইরকম নৌকাতেইমাদ্রাজ থেকে পাড়ি দিয়ে জোব চার্ণক ভাগীরথীর তীরে ‘সুতানূটি’ গ্রামে (এখনকার শোভাবাজার) নোঙ্গর ফেলেছিলেন ১৬৯০এর ২৪শে অগস্ট। এদেশে ইউরোপীয়দের জলদস্যুতা, বানিজ্য বিস্তার আর তারপর উপনিবেশ স্থাপন, সবকিছুরই সূত্রপাত নৌকার সহায়তায়। এ আর এমন কি? মৃত লখিন্দরের শব নিয়ে বেহুলাপৌঁছে গিয়েছিলো স্বর্গের দেবতাদের কাছে নৌকা ভাসিয়ে,আর ইউরোপীয়রা এতবড় ভারত দেশটাকে জিতে নেওয়ার কৌশলের সূত্রপাত করলো সেই নৌকারই সহায়তায়! তারা কলকাতা দিয়েই শুরু করেছিলো। অতএব নৌকার কলকাতার কথাও বলি।

“বালিঘাটা এড়াইল বেনিয়ার বালা।

কালিঘাটে গেলো ডিঙ্গা অবসান বেলা”। 

কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের মনসামঙ্গলে ধনপতি সওদাগরের বানিজ্য যাত্রার বর্ণনা। তাহলে কালীঘাট দিয়ে ভাগীরথীর স্রোতধারা বয়ে চলতো ও নৌচলাচল হতো। এতো ষোড়শ শতাব্দীর বৃত্তান্ত।প্রাচীনকাল কেন, বেশি দিনের কথা নয়, মাত্র তিনশো বছর আগেও এখনকার কলকাতার অনেক ব্যস্ততম রাস্তা তখন রাস্তা ছিলো না, ছিলো খাল বা নদীর স্রোতধারা, যেখানে নৌচলাচল হতো। টাইম মেশিনে চেপে যদি যেতে পারতাম তিনশো বছর আগের ক্রীক রো’তে, হয়তো শুনতে পেতাম কুঁড়ে ঘরের জানালা দিয়ে কোনও গৃহবধু শুধাচ্ছে “কোথা যাও গো মাঝি”? কিংবা সার্কুলার রোডে, পড়ন্ত বিকালে কোনও ক্লান্ত হাটুরে ডাকছে “কুথা যাবেক গো মাঝি? সোঁদর বন যাবো গো, পাটায় একটুন জায়গা দিবা?” হ্যাঁ, এই রকমই তো ছিলো তিনশো বছর আগের কলকাতা। এখনকার অনেক ব্যস্ততম রাস্তা, গলি তৈরি হয়েছে খাল বুজিয়ে।

নৌকা চলতো মানে নৌকাডুবিও হত। সে’কথাও বলা যাক। কলকাতা নগরীর পত্তনের আগে থেকেই “চাঁদপাল ঘাটের কাছে গঙ্গা থেকে একটা খাল বেরিয়ে হেস্টিংস স্ট্রীটের উত্তর দিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের ভেতর দিয়ে সার্কুলার রোড পার হয়ে এন্টালির উত্তর গা হয়ে বেলেঘাটার লবণ হ্রদের ভেতর দিয়ে ধাপায় পড়তো” (তথ্যসূত্র – ‘কলিকাতা দর্পন’ – রথীন্দ্রনাথ মিত্র)। এখান দিয়ে নৌকা চলাচল করতো। এই খালগুলি বুজিয়ে কলকাতাররাস্তা, গলি হয়েছে কলকাতার নগরায়নের পরে। প্রবল ঝড়ের বেগে নাকি একবার অনেক নৌকা ভেঙে গিয়েছিলো, তাই এখন যে গলিটার নাম ক্রীক রো, সেটার নাম ছিলো‘ডিঙ্গা ভাঙা গলি’। এইসব বৃত্তান্ত সঠিক জানার উপায় নেই, কারণ তখন এদেশে সংবাদপত্রতো দূরস্থান, ছাপার অক্ষরই তৈরি হয়নি। সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্যস্যার ফ্রান্সিস রাসেলতাঁর একটা চিঠিতে ১৭৩৭ সালের৩০শে সেপ্টেম্বর রাত্রের এক মহা দুর্যোগের বর্ণনা লিখেছিলেন, যা লন্ডনের ‘জেন্টলম্যান’স ম্যাগাজিন’-এর প্রতিবেদনে বেরিয়েছিলো। সেই রিপোর্ট মতে,‘‘কলকাতা ও আশপাশ মিলে নিহত মানুষের সংখ্যা ত্রিশ হাজার, পশু-পাখি অসংখ্য এবং ছোট বড় জাহাজ নৌকো ইত্যাদি কুড়ি হাজার ...।”(তথ্য সূত্র ‘কলকাতা’ – শ্রী পান্থ )

ইতিহাসের কথা যখন বলছি, তখন উনিশ শতকের অভিজাত মহলের নৌকা ব্যবহারের দু’একটি চমকপ্রদ ঘটনা তুলে আনি।জর্জ এভারেস্ট, যাঁর নামে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম, তিনি ১৮৪৩এর ১লা অক্টোবর দেরাদুন থেকে পুরোটা নদীপথে কলকাতা এসেছিলেন, সময় লেগেছিলো ৩৫ দিন। ১৮০১এর অগস্ট মাসে তখনকার বড়লাট ওয়েলেসলি বারাকপুর থেকে নৌকা চেপে নদীপথে এলাহাবাদ পৌঁছেছিলেন, সময় লেগেছিলো ৫মাস। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী থেকে যানা যায়, ১৮৫৬তে কলকাতা থেকে কাশী গিয়েছিলেন নৌকা চেপে, সময় লেগেছিলো দেড় মাস আর নৌকা ভাড়া একশ’ টাকা। সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়িতে এলাহাবাদ, আগ্রা গিয়ে আগ্রা থেকে নৌকায় দিল্লী পৌঁছেছিলেন এক মাসে। যদিও তখন রেলগাড়ি চালু হয়ে গিয়েছিলো।

উইলিয়াম হিকি এদেশে অ্যাটর্নি জেনারেল হয়ে এসেছিলেন ১৭৭৭এ, তখন কলকাতার নগরায়ন সবে শুরু হয়েছে। ১৮০৯ পর্যন্ত হিকি দীর্ঘ বত্রিশ বছর কলকাতায় ছিলেন। লন্ডনে ফিরে গিয়ে চার খণ্ডে তাঁর স্মৃতিকথা (১৭৪৯ থেকে ১৮০৯ পর্যন্ত)প্রকাশ করেন, যেটি আদি কলকাতার সমাজ জীবন জানার জন্য এক অমূল্য দলিল হিসাবে বিবেচিত হয়। ১৭৪৯-এ, মানে পলাশীর যুদ্ধেরও আট বছর আগে, কলকাতা তখন অজ গ্রাম মাত্র, আর ইংরাজরা সুতানূটিতে ঘাঁটি গাড়া বণিক মাত্র। হিকি তাঁর স্মৃতিকথা শুরু করেছেন এইভাবে - “১লা নভেম্বর, ১৭৭৭ সন। ভোর চারটে থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে বেলা প্রায় দুপুর আন্দাজ সাগরদ্বীপে এসে পৌঁছলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা পানসি নৌকা এল, কর্নেল ওয়াটসন আগেই সেটি ভাড়া করে রেখেছিলেন কলকাতায় যাবার জন্য। বেলা দুটোর সময় আমরা সকলে মিলে পানসিতে করে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করলাম। পানসিতে যেতে আমার আপত্তি ছিলো, কারণ বাংলা দেশের এই বিচিত্র নৌকাটি এমনভাবে তৈরি যে তার মধ্যে সোজা হয়ে বসা যায় না। এমন কি পা ঝুলিয়ে একটু আরাম করে বসাও সম্ভব নয় ... তবু পানসির অভিনবত্বের জন্য এই অসুবিধাটুকু আমাদের সয়ে গেল। ছ’জন কালা আদমি(মাঝি) খুব জোরে জোরে দাঁড় বাইছিলো, পানসিও তরতর করে দুরন্ত বেগে। সন্ধ্যা ছটার সময় আমরা কুলপিতে এসে পৌঁছলাম ......। 

পানসি ভিড়ল...... বহু দূরে – প্রায় নয় মাইল লম্বা ও দু’মাইল চওড়া জলের একটা আস্তরের উপর দিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম ও কলকাতা শহরের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। আগাগোড়া জলের ওপর ছোট বড় শত শত জাহাজ ও নৌকা নোঙর বেঁধে রয়েছে। তারই ভিতর থেকে যেন কলকাতা শহর নদীস্নান করে গাত্রোত্থান করেছে তার বিচিত্র সৌন্দর্য নিয়ে।”

এটা প্রায় তিনশ’ বছর আগেকার বর্ণনা। আজও কি হিকি বর্ণীত এই সৌন্দর্যবোধের কিছুমাত্র কম হয়েছে? এই সৌন্দর্যবোধের উৎস হয়ে মানবসভ্যতার প্রাচীতম জলযান নৌকা ভাসতেই থাকবে মানুষের কল্পনা আর শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-রূপকথা আর আমাদের দার্শনিকবোধ ও বিশ্বাসে। রবীন্দ্রনাথ যেমন ভাসমান নৌকার মধ্যে চলমান মানবজীবনকে দেখেছেন -

“মানুষের মধ্যে এক একটা মাঝি আছে-- তাহাদের না আছে দাঁড়, না আছে পাল, না আছে গুণ; তাহাদের না আছে বুদ্ধি, না আছে প্রবৃত্তি, না আছে অধ্যবসায়। তাহারা ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া স্রোতের জন্য অপেক্ষা করিতে থাকে। মাঝিকে জিজ্ঞাসা কর, "বাপু, বসিয়া আছ কেন?" সে উত্তর দেয়, "আজ্ঞা, এখনো জোয়ার আসে নাই।" "গুণ টানিয়া চলনা কেন?" "আজ্ঞা, সে গুণটি নাই।" "জোয়ার আসিতে আসিতে তোমার কাজ যদি ফুরাইয়া যায়?" "পাল-তুলা, দাঁড়-টানা অনেক নৌকা যাইতেছে, তাহাদের বরাত দিব।" অন্যান্য চলতি নৌকা সকল অনুগ্রহ করিয়া ইহাদিগকে কাছি দিয়া পশ্চাতে বাঁধিয়া লয়, এইরূপে এমন শতশত নৌকা পার পায়। সমাজের স্রোত নাকি একটানা, বিনাশের সমুদ্র মুখেই তাহার স্বাভাবিক গতি। উন্নতির পথে অমরতার পথে যাহাকে যাইতে হয়, তাহাকে উজান বাহিয়া যাইতে হয়। যে সকল দাঁড় ও পালবিহীন নৌকা স্রোতে গা-ভাসান দেয়, প্রায় তাহারা বিনাশ সমুদ্রে গিয়া পড়ে। সমাজের অধিকাংশ নৌকাই এইরূপ, প্রত্যহ রাম শ্যাম প্রভৃতি মাঝিগণ আনন্দে ভাবিতেছে, "যেরূপ বেগে ছুটিয়াছি, না জানি কোথায় গিয়া পৌঁছাইব।’’ একটি একটি করিয়া বিস্মৃতির সাগরে গিয়া পড়ে ও চোখের আড়াল হইয়া যায়। সমুদ্রের গর্ভে ইহাদের সমাধি, স্মরণ স্তম্ভে ইহাদের নাম লিখা থাকেনা।”



[তথ্যসূত্র – ‘ভারতকোষ’, ‘কলিকাতা দর্পন ২য় খন্ড’ – রথীন্দ্রনাথ মিত্র, ‘কলিকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ – বিনয় ঘোষ, ‘কলকাতা’ – শ্রী পান্থ]

1 comment:

  1. সুন্দর লেখা ও তথ্য

    ReplyDelete