রম্যরচনাঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
Posted in রম্যরচনা
রম্যরচনা
সেজদা
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
কিছু ব্যতিক্রমী ব্যক্তিকে বাদ দিলে ফেসবুকের বন্ধুরা সব কেউ ছবি পোস্ট করেন বা কেউ লেখা পোস্ট করেন। উদ্দেশ্য মূলত একটাই – আমাকে দেখুন, আমাকে শুনুন। আমি ব্যতিক্রমী নই। তবে আমার মুখটি কদাকার ও বৈশিষ্ট্যহীন বলে আমি ছবি পোস্ট বড় একটা করি না। তার বদলে নিজের সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা লিখে যাই। বন্ধুরা হয়ত বিশ্বাস যাবেন না, তবে ফেসবুকের দিব্যি, আমি একটা কথাও বানিয়ে লিখি না। দুঃখ একটাই – দু-চার জনের বেশি কেউ আমার লেখা পড়েন না। তাই আজ আর নিজের সম্বন্ধে কিছু না লিখে আমার আপন সেজদার গল্প লিখব বলে ঠিক করলাম।
গল্পটা কথার কথা। আসলে নির্জলা সত্য ঘটনা। আমার সেজদার মাথাটি আমারই মতো কিঞ্চিৎ স্থূল ছিল বলে বাড়ির চাপে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দু-দুবার বসেও পাশ করতে পারেনি। তবে তার চেহারাটি ছিল চমৎকার। উচ্চতা একটু কম হলেও অন্য সব দিকে কোন ঘাটতি বা বাড়তি ছিল না। বৃষস্কন্ধ, প্রশস্ত ছাতি, দৃঢ়-পেশিওয়ালা হস্তপদ, কনকবর্ণ গাত্র। মারাদোনার ছবির কথা ভাবুন। আমার সেজদা ছিল তারই দ্বিতীয় সংস্করণ। কিশোর বয়স থেকেই তার নিজস্বী ছিল। এই নিজস্বী মানে সেলফি নয়। একটি গরু এবং আধ ডজন কুকুর ছিল তার নিজস্বী। গরুটির দুধ সে সরাসরি বাঁট থেকেই পান করত। বাছুরের মতো নয়, গরুর পেটের তলায় চিৎ হয়ে শুয়ে আঙুলের চাপে দোহনধারা নিখুঁত লক্ষ্যে নিজের হাঁ-করা মুখে চালান করে দিত। আর কুকুরগুলি ছিল তার সর্বক্ষণের অনুচর।
ফুটবল প্লেয়ার হিসেবে অঞ্চলময় খ্যাতি ছিল সেজদার। অঞ্চলের বাইরেও তাকে হায়ার করে খেলতে নিয়ে যেত অন্যান্য টিম। সেকালে গ্রামাঞ্চলেও ভালো ভালো ফুটবল টিম ছিল। তাদের দর্শক-সমর্থক-পৃষ্ঠপোষক-এরও অভাব ছিল না। আমার সেজদার যথেষ্ট সংখ্যক অবুঝ ফ্যান ছিল। তার গোলার মতো শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও তারা কম আহ্লাদিত হত না। কিন্তু ক্রমেই সেজদাকে নিয়ে গুরুতর সমস্যা পাকিয়ে উঠতে লাগল খেলার মাঠে। সে যেখানেই খেলতে যাক না কেন, তার সারমেয় অনুচরগণও সেখানে উপস্থিত হত। এমনিতে তাদের নিয়ে বিশেষ সমস্যা ছিল না। তারা মাঠের সাইডলাইনের বাইরে বসে থেকে অন্যান্য দর্শকদের মতোই নিবিষ্ট হয়ে খেলা দেখত। সকলেই জানেন, মাথা মোটা হলে তা অল্পেই গরম হয়ে যায়। আর ফুটবল যেহেতু গা-ধাক্কাধাক্কির খেলা, সেজদা তার সবল শরীরের অ্যাডভান্টেজ নিতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষের কোনও প্লেয়ার যখন বুদ্ধি প্রয়োগে সেজদার শরীরকে এড়িয়ে বল নিয়ে বেরিয়ে যেত, তখনই তার মাথাটি ঘুলিয়ে গিয়ে গরম হয়ে উঠত আর বলের ঠিকানা ভুলে গিয়ে সেই প্লেয়ারটির শরীরই হয়ে উঠত তার পা এবং হাতেরও লক্ষ্যবস্তু। মারপিট একবার শুরু হলে তাতে অংশ গ্রহণ করার লোভ সম্বরণ করা দায়। ফলে তখন খেলার মাঠ রণক্ষেত্রে পরিণত হত। তবে সেকালে গ্রামাঞ্চলের লোকেরা বই-টই তেমন পড়ত না বলে ‘গান্ধারীর আবেদন’-এর দুর্যোধনের ‘যার যাহা বল পিতঃ অস্ত্রের সম্বল’-মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে এখনকার মতো রণক্ষেত্রে হাতিয়ার নিয়ে নেমে পড়ত না। স্ব স্ব হাত-পায়ের যদৃচ্ছা প্রয়োগই ছিল যুদ্ধের প্রকরণ। কিন্তু সেজদার কুকুরগুলিকে সে কথা কে বোঝাবে! তারা দুর্যোধনের ভাবশিষ্য বিধায়ে প্রভুর পক্ষ-বিপক্ষ ভেদ না করে যুযুধান সমস্ত খেলোয়াড়-দর্শকের বিরুদ্ধে দাঁত-নখের ব্যবহারে পিছপা হত না। তবে তাদের কাণ্ডজ্ঞানের কোনও অভাব ছিল না। এমনই পরিমিত ছিল সেসবের ব্যবহার যে কারও শরীরেই আঁচড়টুকুও পড়ত না, কেবল তাদের জার্সি বা জামাকাপড় ফালাফালা হয়ে যেত। ফলে অচিরেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যেত, কেননা যোদ্ধাগণ তখন যুদ্ধ ভুলে যে-যার আব্রু রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত। আর সারমেয়গণ প্রভুকে জটলা থেকে উদ্ধার করার কৃতিত্বে তার আদরের প্রত্যাশায় পালা করে এক এক জন তার বুকে দুটি পা তুলে গাল চাটার চেষ্টা করে যেত। এভাবেই সেজদা ও তার প্রিয় অনুচরদের কৃতিত্বে পরিত্যক্ত ম্যাচের সংখ্যা বাড়তে থাকায় মাঠে তার কদর কমতে কমতে একদিন নিঃশেষই হয়ে গেল।
সেজদার ম্যাচ জেতার ইচ্ছেটা অবশ্যি অদম্যই থেকে গেল। পরবর্তী জীবনে খেলার ধরনটা কেবল পালটে গেল। উদাহরণ স্বরূপ একটা ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট হবে। সেদিন কুড়ুল নিয়ে জ্বালানির কাঠ চেরায় ব্যস্ত ছিল সেজদা। স্থানঃ জঙ্গল-সংলগ্ন নির্জন চাষ-বাড়ি। সময়ঃ ভরা গ্রীষ্মের শুনশান দ্বিপ্রহর। একটু পরেই একজন দর্শক এসে হাজির। এক গরু-বাগাল। জঙ্গলে গরুদের চরার স্বাধীনতা দিয়ে ছায়ায় একটু শরীর জুড়োতে এসেছিল। সেজদা বলল, -- আছে তোদের গাঁয়ে কোনও মরদ এক এক কোপে দু-ফালি করতে পারে এইরম মোটা গুঁড়ি?
বাগাল পাশে পড়ে থাকা একটা মোটা শালের গুঁড়ি দেখিয়ে বলল,-- পারবে ঠাকুর এইটা এক চোটে?
সেজদা ঠোঁট উলটে বলল, -- অনায়াসে। না পারলে তোকে পাঁচ টাকা দেব। পারলে তুই কী দিবি?
বাগাল ভেবেচিন্তে বলল, -- এক কাঁদি তাল পেড়ে দুবো।
-- ফুঃ! তাল তো আমিও পাড়তে পারি। তোর নিজের তো একটা গাই আছে। এক শিশি গাওয়া ঘি দিবি।
বাগাল রাজি হয়। সেজদা গুঁড়িটাকে ডান পায়ে চেপে ধরে কুড়ুল তোলে মাথার ওপরে। কুড়ুল প্রবল বেগে নেমে আসার সময় সেজদার পায়ের চাপে গুঁড়ি বোধ হয় একটু মাথা তুলে ফেলেছিল। ফলে কুড়ুলের বেগ গুঁড়িতে আটকে না গিয়ে পিছলে সরে এল পেছন দিকে। নিমেষে সেজদার ডান পায়ের কড়ে আঙুল পুরোটা আর তার পাশের আঙুলের আদ্ধেকটা ছিটকে বেরিয়ে গেল পা থেকে। রক্তে ভিজতে লাগল মাটি। গতিক দেখে বাগাল পাঁচ টাকার মায়া ত্যাগ করে জঙ্গলের দিকে হাঁটান দিল। সেজদা নির্বিকার চিত্তে দেড়খানা আঙুলের টুকরো বাঁ হাতের মুঠোয় নিয়ে কুড়ুল-কাঁধে রওনা হল পাশের গাঁয়ের দিকে। আফসোস একটাই – -সামান্য ভুলে এক শিশি গাওয়া ঘি হাতছাড়া হয়ে গেল! পাশের গাঁয়ে আছে একজন হাতুড়ে ডাক্তার। সেজদার একরকম বন্ধুই বলা চলে তাকে। এককালে খেলার মাঠে তার সঙ্গে অনেক মারামারি হয়েছে। তার বাড়ি পৌঁছে আঙুল দেড়খানা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, -- দে তো এগুলো পায়ে লাগিয়ে।
ডাক্তার দেখেশুনে বলল, -- এটা তো পারা যাবেনি।
-- তাহলে আর তুই কিসের ডাক্তার! –-বলেই, সম্ভবত ডাক্তারের প্রতি ঘেন্নাবশতই, আঙুলের টুকরোগুলোকে সামনের ডোবায় ছুঁড়ে দিয়েই পেছন ফিরেছিল সেজদা। ডাক্তার অবশ্যি অনেক অনুনয় বিনয় করে তাকে বসিয়ে কাটা পায়ের ধুলোকাদা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে তবে বাড়িতে পাঠায়।
বাড়িতে ফিরেই সেজদা সর্বরোগহর গাওয়া ঘি দিয়ে নিজের কাটা পায়ের চিকিৎসা শুরু করে দেয়। পদ্ধতি অতি সরল। ব্যান্ডেজ-ট্যান্ডেজ খুলে ফেলে কাটা জায়গায় তিনবেলা ঘি-এর প্রলেপ আর ঘি-মাখা ভাত এবং গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি সেবন। বাকি সময় নিশ্ছিদ্র নিদ্রা। টেড ভ্যাক বা অ্যান্টি বায়োটিকের পরোয়া না করে পনের দিনের মধ্যেই সেজদার পায়ের ক্ষত সম্পূর্ণ সেরে উঠল। চাই কি, তার হাড়মোটা চেহারায় একটুখানি ঘি-চুকচুকে লাবণ্যও দেখা গেল।
সেকালে গ্রামাঞ্চলে বিয়ের যুগ্যি মেয়ের বাবারা কেবল ছেলের বাড়িতে ধানের মরাই আর গোয়ালের গরু দেখে জামাই পছন্দ করতেন। সেজদার বাড়তি যোগ্যতা ছিল তার প্রায় রাজপুত্রের মতো চেহারা। কাজেই যথাসময়ে একটি ফর্সা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। সন্তানাদি হতেও দেরি হল না। কিন্তু ম্যাচ জেতার নেশা ছাড়ল না তাকে।
এখনকার মতো না হলেও তখনও ব্যতিক্রম হিসেবে গ্রামসমাজে কিছু চলমানতা দেখা যেত। আমাদের গ্রামের কুণ্ডুদের অতি সামান্য জমিজমা ছিল। পানের বরজ থেকে যেটুকু আয় হত তাতেই কায়ক্লেশে সংসার চলত। অনেকগুলি সন্তান ছিল তাদের। তারা বড় হয়ে টুকটাক ব্যবসা শুরু করে এবং অতি অল্প কালের মধ্যেই তাদের বিবিধ-ব্যবসা মহীরুহ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের সেই সমৃদ্ধি গ্রামাঞ্চলের জোতদারদেরও অকল্পনীয় ছিল। সেজদা ঘোষণা করল, সে অনায়াসেই কুণ্ডুদের ওপরে উঠতে পারে। চাষবাসে কোনও আয় নেই, ব্যবসাই হল লক্ষ্মী। কাজেই চাষবাস ছেড়ে বউদির গয়না হাতফেরি করে একই সঙ্গে সে মিষ্টি ও কাপড়ের দোকান খুলে ফেলল পৈতৃক জমিতে। মিষ্টির আদ্ধেক সে একাই খেতে লাগল আর কাপড় দেদার ধারে বিকোতে থাকল। ওই সামান্য ক্যাপিট্যালে কুণ্ডুদের টেক্কা দেওয়া যায় না। সেই যুক্তিতে সে আত্মীয়বাজার থেকে টাকা তুলতে লাগল। কিন্তু আত্মীয়বাজারে টাটা-বিড়লা কেউ ছিল না বলে কুণ্ডুদের সঙ্গে সেজদার ম্যাচটা তার ওয়াটারলু হয়ে গেল। এইভাবে জ্ঞাতি ও আত্মীয় পরিত্যক্ত হয়ে সে সম্পূর্ণ রিক্ত হাতে মাঝ বয়সের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়। তবে জমিজমা সব বাবা-কাকাদের নামে থাকায় সেগুলি তার ব্যবসার হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায়। তার একান্নবর্তী পরিবার তার পরিণত বয়স সত্ত্বেও বিপজ্জনক খেলোয়াড়ি মনোভাবে চমৎকৃত হয়ে পরিবারকে তার সংস্রবমুক্ত করতে তাকে তার অংশ মোতাবেক জমির ভাগ বুঝিয়ে দিয়ে পরিবার থেকে পৃথক করে দিল। কিন্তু ব্যবসার মসৃণ পথের তুলনায় চাষবাসের বন্ধুর পথে চলাচল তার নেহাতই নিম্নরুচিসুলভ বোধ হওয়ায় তার জমির সিংহভাগই অনাবাদী পড়ে রইল। ফলে অভাব অনটনের চক্রান্তে জেরবার হতে হতেই বাড়তে লাগল সেজদার বয়েস। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছতে না পৌঁছতেই অবশ্যি তার দুই কিশোর পুত্র পড়াশোনা ছেড়ে চাষবাসের জোয়াল নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ায় সংসারের হাল আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে। খাওয়া-পরায় স্বাচ্ছন্দ্য আসার সঙ্গে সঙ্গে সংসারে সেজদার কর্তৃত্বের রাশও হাতছাড়া হতে থাকে। কিন্তু বিশ্বসংসারের সমস্ত খেলায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে তার প্রবল বিশ্বাসটি অমলিনই থেকে যায়।
ঘটনাক্রম অতীত কালের ক্রিয়ারূপে বর্ণনা করলাম বলে কেউ যেন ভেবে না বসেন যে সেজদা অতীতে স্থানান্তরিত হয়েছেন। তিনি বহাল তবিয়তে বর্তমান। বাড়িতে প্রশ্রয় পায় না বলে সারমেয়দের সঙ্গ তাঁকে ত্যাগ করতে হয়েছে, কিন্তু তিনখানি গরুর সেবায় তাঁর সময় মন্দ কাটছে না। তবে কেউ যদি কখনও কোনও ব্যাপারে কারোর সাফল্যের কথা তাঁর সামনে উত্থাপন করে, তখন তাঁর অবধারিত মন্তব্য হবে --ও আর কী এমন ব্যাপার, আমার কাছে কিচ্ছু না – অনায়াসে ওসব করতে পারতাম। ভাগ্য, বুঝলি, আমার হল ভাগ্যের মার...
0 comments: