0

প্রবন্ধঃ কৃষ্ণদেব রায়

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙালি হেঁশেলের বনেদীয়ানা
কৃষ্ণদেব রায়


আজ থেকে হাজার বছর আগেও বাঙালী জাতিটা ছিল কিনা, সেটা ঐতিহাসিকেরা বলবেন। আমি শুধু বলবো যে, বাঙালী তার জন্মলগ্ন থেকে অন্তত বছর পঞ্চাশ আগে অবধি কাউকে তার হেঁশেলে ঢুকতে দেয়নি। তখন কি বাঙালি বিয়ের ভুরিভোজে কি রবিবার দুপুরের খাওয়ায় সাবেকি বাঙালী খাবারই পরিবেশিত হতো। যদিও এই সাবেকি বাঙালী খানায় কতটা বিশুদ্ধ বাঙালীয়ানা ছিলো, সেটা বলা খুব মুশকিল। কারণ, এক তো দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বর্হিবাণিজ্য এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি শাসন এবং প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের ফলে খুব সামান্য হলেও কখন যে অজান্তে আমরা কিছু বিদেশি খাবারকেই নিজের ভেবে নিয়েছি, জানিনা। তবে এটা ঠিক যে আমাদের প্রাত্যহিক খাওয়াদাওয়ায় এখনও অবধি যৎসামান্য বিদেশি প্রভাব পড়লেও বাঙালী খানা তার উত্তরাধিকার ছাড়েনি। সুতরাং এটা বলা যেতেই পারে যে, দীর্ঘদিন মুঘলদের এবং ব্রিটিশদের শাসনে থেকেও আজও, এই বিশ্বায়নের যুগেও,বাঙালীর প্রাত্যহিক খাবার একান্তই তার নিজস্ব ঘরানার। তবে, ইদানীং বাঙালী জলখাবারে বা টিফিনে এবং মাঝেমধ্যে শখ করে নতুন বউ-এর রান্না চেখে দেখতে গিয়ে অনেক বাঙালীই এখন মাঝেমধ্যে পাস্তা বা নুড্ল, চাউমিন বা চিলি চিকেন পরখ করছেন। কিন্তু এখনও অবধি সেটা নিত্যনৈমিত্তিক রূপ নেয়নি। 

বাঙালীর প্রভাতী জলখাবারে অবশ্য একটি বিদেশি খাবার জাঁকিয়ে বসেছে বহুদিন। সেটি হল পাঁউরুটি! তবে এই পাঁউরুটি কিন্ত মোগল বা ব্রিটিশদের কাছ থেকে নয়, বরং এসেছে পর্তুগীজদের কাছ থেকে। পর্তুগীজ ভাষায় পাও কথাটার অর্থই হলো লোফ। এরা ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বেশ ভালো সংখ্যার বিদেশীরাও চেষ্টা করে গেছে বাঙালীর খাদ্যাভ্যাস পালটে দিতে। এবং তারা বাঙালীর মধ্যাহ্নভোজন বা নৈশাহারে তেমন থাবা বসাতে না পারলেও, বাঙালীর প্রভাতী জলখাবার বা বিকেলের জলখাবারে বেশ ভালো রকমই প্রভাব ফেলেছে। সকালের টোস্ট-ওমলেট-চা এর তিনটেই কিন্তু একেবারে ব্রিটিশ এবং পর্তুগীজদের কাছ থেকে নেওয়া। আর বাগদাদ থেকে আসা অভিবাসী ইহুদীরা এখানে কেক, পেস্ট্রি, প্যাটিসের বেকারি খুলে বসে। পরে অবশ্য বাঙালীরা সেটাকে আত্মস্থ করে নেয়। নিউ মার্কেটের বিখ্যাত নাহুম-এর দোকান এমনই এক অভিবাসী বাগদাদী ইহুদীর। কিন্তুএখন বাপুজি কেক একান্তভাবেই বাঙালীর। এই সব খাবারের অনুপ্রবেশের ফলে বাঙালীর, বিশেষ করে শহুরে বাঙালীর, জলখাবার থাকে হারিয়ে গেছে মোয়া, নাড়ু, তক্তির মতন খাবারগুলি। বরং সে তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে আসা ডাচ আর ফরাসীরা বাঙালীর খাদ্যাভ্যাসে তেমন কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। পশ্চিমবাংলার কলকাতায় চাইনিজরা এবং পূর্ব বঙ্গে আফগানরা নিজেদের একটা কমিউনিটি গড়ে তুলেছিল। সত্তরের দশকের শেষদিকে বা আশির দশকের প্রথম থেকেই বাঙালী চিনে পাড়ায় গিয়ে চিনে খাবারের আস্বাদ নেওয়া শুরু করে। 

দেড়শো বছর আগে একটি বিদেশী সবজি কিন্তু বাঙালী হেঁশেলে তার পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। সেটি হল আলু! শ’ দেড়েক বছর আগে বাঙালী জানতোই না আলুর শাকটা খায় না কন্দটা খায়। ভাবুন একবার! যে আলুর চপের জন্য বাঙালীর ভুবন জোড়া খ্যাতি, তার চল কিন্তু এই সেদিন। ঠাকুরের ভোগের খিচুড়িতে আলু দেওয়া ছিল চরম ম্লেচ্ছ কাজ।

মনে রাখতে হবে যে, বাঙালীর খাদ্যাভ্যাসের কথা বলতে গিয়ে আমি কিন্তু শুধুমাত্র হিন্দু বাঙালিদের কথা বলছিনা। বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গের আগে পাঁচশো বছরের মোগল শাসন মূলত ঢাকা কেন্দ্রিক ছিল। বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গ সামনে আসে যখন মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলার নবাব হন ১৭১৭ সালে এবং তিনিই ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন মুর্শিদাবাদে। দীর্ঘদিন মুসলিম সংস্পর্শে থাকার ফলে পূর্ববঙ্গীয় রান্নায় মুসলিম প্রভাব বেশ ভালো রকম লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু, ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের কাছে পরাজয়ের পরে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম সংস্পর্শ খুব বেশিদিন স্থায়ী না হওয়ায় এদেশের হেঁশেলে তাদের উপস্থিতির প্রভাব খুবই নগন্য। কিন্তু তবুওকোর্মা, কোপ্তা, কালিয়া প্রভৃতি রান্নাগুলো বাঙালির হেঁশেলে ঢুকে পড়ে মূলত ১৮৫৬ সালে, যখন আওয়াধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে ইংরেজরা নির্বাসিত করে মেটিয়াবুরুজে পাঠালেন। শোনা যায় সেইসময়ে নবাব ওয়াজিদ আলি নাকি সঙ্গে করে বেশ কয়েকশো বাবুর্চি, খানসামা এবং মশলচি (যারা মশলা পেষেন) সঙ্গে নিয়ে আসেন।

স্বাধীনতার পরে যখন পূর্ব বঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ ভাগ হয়ে গেলো দুটি পৃথক দেশে, লক্ষ লক্ষ পূর্ববঙ্গীয় সীমানা পেরিয়ে এদেশে চলে এলেন। তাঁরা প্রায় সবাই হয় হিন্দু বাঙালি নাহয় হিন্দু পাঞ্জাবী। বাঙালীরা মিশে গেলেন এদেশের ঘটিদের সাথে এবং কালক্রমে বিয়ে-শাদীর মাধ্যমে দুটি সংস্কৃতি মিলে এক নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব হলো, যার প্রভাব পড়ল বাঙালীর হেঁশেলেও। স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ একটি ছোটো রাজ্য হলেও এর বন্দর, বাজার, বাসিন্দাদের ধন-দৌলত ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হলো। বাঙালির সাবেকি ছানার মিষ্টির জায়গায় এল হলদিরাম, গাঙ্গুরামের ক্ষীরের মিষ্টি। তবে, ভারতের আর অন্য কোনও রাজ্য যা পারেনি, পাঞ্জাব কিন্তু তা করে দেখিয়েছে। বাঙালি হেঁশেলের মটর পনীর বা পালক পনীর কিংবা তড়কা পাঞ্জাবীদের অবদান। এইসবের মাঝে ১৯৬৬ সালের চরম খাদ্য সংকটের হাত ধরে বাঙালির হেঁশেলে হানা দিলো এক নতুন আগন্তুক। উত্তর ভারত, বিহার, রাজস্থানের রুটি। বাঙালি একবেলা ভাত আর একবেলা রুটি খাওয়া শুরু করলো এবং এখন খাদ্য এবং চালের যথেষ্ট জোগান থাকলেও অনেক বাঙালিই এখন হয় দিনে না হয় রাতে এক বেলা রুটি খান।

মাছে ভাতে বাঙালি। ঘটিরা যেসব মাছ খায়, বাঙালরা তার অনেকগুলিই খায়না। আবার বাঙালরা যে মাছখায়, ঘটিরা তার মধ্যে অনেকগুলিই হেঁশেলে ঢোকায় না। কিন্তু ইলিশ সবাই খায়। আর বাঙালদের আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য রান্না হলো শুঁটকি মাছ। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতন কিন্তু এখানে জাতি বর্ণ অনুসারে খাওয়ার ছল নেই। একজন ব্রাহ্মন বা একজন শূদ্র প্রায় একই ধরণের খাবার খান। যদিও মুরগীর মাংস বেশ কিছুদিন আগেও বাঙালির হেঁশেলে ব্রাত্য ছিলো। মাছ এবং মাংস বাঙালির প্রিয় হলেও বাংলার নিজস্ব ঘরানার নিরামিষ রান্নাগুলিও কিন্তু যথেষ্ট সুস্বাদুও উপাদেয়।বাঙালীর হেঁশেলের এই পরম্পরা টিঁকিয়ে রাখার জন্যে কিন্তু মূলত বাঙালি হিন্দু বিধবাদের অবদান অনেকটাই। ১৮৫৬ সালে বিধবাদের পুনর্বিবাহের আইন চালু হলেও সেটা বাস্তবে পরিণত হতে সময় লেগেছে বহুদিন। আর বাঙালি হিন্দু বিধবাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কঠোর অনুশাসন ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অধিকাংশ বাঙালি যৌথ পরিবারের হেঁশেলের দায়িত্বে কিন্ত একজন বিধবাই থাকতেন। নিরামিষ রান্না তো বটেই, এমন কি আলুর খোসা বা পালং শাকের গোড়া দিয়েও তাঁরা এমন স্বাদু রান্না করতে জানতেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর খাদ্য সম্বন্ধীয় এক গবেষণায় লেখিকা চিত্রিতা ব্যানার্জি এক জায়গায় এই বাঙালি হিন্দু বিধবাদের উল্লেখ করে বলেছেন, “নিরামিষ রান্না যে এত সুস্বাদু হতে পারে সেটা তোমায় বোঝানো অসম্ভব যতক্ষন না তোমার নিজের বউ বিধবা হচ্ছে!”

আসুন, এবারে আমরা এক ঝলক দেখে নিইবাঙালীর চিরন্তন রান্নার পদগুলি, যা এখনও আমাদের নিত্যদিনের আহার্য। এর মধ্যে যে যে খাবারগুলিতে বিদেশী প্রভাব রয়েছে, আমি বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করে দেবো।

অম্বল, আচার, বড়া, ভাজা, ভাপা, ভর্তা, চচ্চড়ি, চপ (ব্রিটিশ প্রভাবিত), কাটলেট (ব্রিটিশ প্রভাবিত, কবিরাজি কাটলেট কথাটি এসেছে Coverage অথবা Cover:egg থেকে), ছ্যাঁচড়া, ছেঁচকি, লাবড়া, চাটনি, ডালনা, দম, দোলমা(একবার কথা উঠেছিলো যে, দোলমা কথাটি গ্রীক শব্দ Dolmathes বা Dolmamades থেকে এসেছে... কিন্তু এটি প্রমণিত নয়), ঘন্ট, ঝাল, ঝোল, কালিয়া, কোফতা, কোর্মা (মোগলাই রান্না), পোলাও, কষা, পাতুড়ি,পোড়া, পোস্ত, তরকারি, শুক্তো, শাক। আর মিষ্টির মধ্যে, পায়েস বা পরমান্ন, রাবড়ি, সন্দেশ, রসগোল্লা,পান্তুয়া, দরবেশ, চমচম, জিলিপি আর পিঠে। এছাড়া মিষ্টি দই, যা একমাত্র বাঙালি ছাড়া আর কেউ খায়না।আমার বলা শেষ হল। আপনাদের যদি কারোর কিছু আরো যোগ করার থাকে, দয়া করে মন্তব্যে জানাবেন।

0 comments: