প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
উত্তরাপথের পথে
সৌরেন চট্টোপাধ্যায়
= অষ্টম পর্ব =
দ্রুত ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠে মালতির যন্ত্রনায় কাতর সুকোমল শরীরটি বৃক্ষচ্যূত লতিকার মত অর্ধচেতন অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার হাতদুটি পিছন দিকে ঘুরিয়ে বাঁধা, মুখ এবং চোখও একটা অত্যন্ত দুর্গন্ধ গাত্রমার্জনী দিয়ে ঢাকা। এমতাবস্থায়ও সে বুঝতে পারছে, এই অশ্বারোহী একা নয়, একাধিক অশ্ব পাশাপাশি ও সামনে-পিছনে ছুটে চলেছে একই গতিতে। ঘোড়সওয়ারদের বিজয়-উল্লাস এবং অশ্বখুরধ্বনির সঙ্গে আরও কয়েকটি নারীকন্ঠের তীব্র আর্তনাদ অস্পষ্ট ভাবে তার কানে আসছে। সে বুঝতে পারল, তার মত আরো কয়েকজনমেয়েকেএই দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে নিয়ে চলেছে; কিন্তু কোথায় যে এই দুঃসহ যন্ত্রনাময় পথের শেষ, সে জানে না। তাদের অনেকটা পিছনে অশ্বের গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দুষ্কর জেনেও দুই অনার্য যুবক বিধু ও বিহান তিলার্ধও না থেমে প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে।
রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট কয়েকটি কৃষকপল্লীর মাঝখান দিয়ে মেঠো পথের ধূলি উড়িয়ে ছুটে চলেছে সামন্তরাজা দুর্জয়ের ঘোড়সওয়ারেরা, ঘোড়াগুলির পিঠে চারটি অসহায় বন্দিনীর যন্ত্রনাকাতর আর্তস্বর ও অশ্বখুরধ্বনি শুনে কর্মরত পল্লীর নারীপুরুষেরা শুধু মুখ তুলে চেয়েছে মাত্র, তাদের মনে বিন্দুমাত্র কৌতূহলের উদ্রেক হয় নি, এমন দৃশ্য তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। পুরুষানুক্রমে আজন্ম ধনিকশ্রেণীর হাতে নির্বিচারে শোষিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার জন্যই যে তাদের জন্ম, একথা কে না জানে! রাজা ও সামন্তদের বিকৃত ভোগ-লালসার বলি হওয়াই যেরূপলাবণ্যবতী হতভাগিনী মেয়েগুলির ললাট-লিখন!
দেশের রাজা থাকেন অনেক দূরবর্তী তাঁর রাজধানী-নগরে। তাঁরা শুধু তাঁদেরঅধীনস্থ সামন্তপ্রভুদের কাছ থেকে সংগৃহীত করের অর্থ সম্পদ ও উপঢৌকন পেয়ে এবং ভোগ-লালসায় দিনযাপন করেই তাঁদের রাজধর্ম পালন করেন। রাজার প্রাপ্য দিতে এবং নিজেদের ভোগতৃষ্ণা মেটাতে সামন্ত-জমিদাররা নিরীহ প্রজাদের যথেচ্ছভাবে শাসন, শোষণ ও সম্ভোগ করে চলে। ধনিক উচ্চবর্ণ শ্রেণী-শাসিত এই সমাজে দরিদ্ররা উপেক্ষিত হলেও রূপসী মেয়েদের বিশেষ কদর। তাদের যৌবনবতী শরীর জাত-পাত, ধনী-দরিদ্রের শত প্রভেদ সত্ত্বেও নির্বিচারে ভোগ্যবস্তু হতে কোনও বাধাই নেই।
গ্রামাঞ্চলের মানুষ রাজার কাছে তাদের অভাব অভিযোগ জানানো তো দূরের কথা,তাঁর সাক্ষাৎ বা সান্নিধ্যলাভের কোনও সুযোগ পেতো না। প্রজারা বংশপরম্পরায় শুধু রাজার নাম ও ঐশ্বর্য-সম্পদের সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে কাহিনী শুনে যায়। এই ভাবেই যুগ যুগ ধরে রাজ-রাজড়াদের সঙ্গে কাল্পনিক কোনও এক স্বর্গলোকের দেব-দেবীদের সম্পর্ক মিশিয়ে বিচিত্র সব অলীক যশ-কীর্তি-বীরত্বের গল্প-গাথা লোকমুখে প্রচারিত হয়ে নানা অলৌকিক পৌরাণিক কাহিনীর জন্ম দেয়।
কয়েকটি পরগণার একজন সামন্ত-জমিদারের অধিকারে প্রীতিকূটের মত স্বয়ংসম্পূর্ণ সচ্ছল গ্রাম যেমন আছে, তেমনি অতি সাধারণ কৃষকপল্লীও আছে। গ্রামগুলিতে সব বর্ণ ও পেশার মানুষের বাস, তবে গ্রামে ধনীর সংখ্যা মুষ্টিমেয়, হতদরিদ্র কৃষক এবংশ্রমজীবি মানুষের সংখ্যাই বেশী। জনপদের সীমান্তে অনার্য অধ্যুষিত অরণ্য অঞ্চল।অনার্যরা বেশির ভাগই শিকার ও পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ ভাগ্যান্বেষণে বা বাধ্য হয়ে জনপদবাসীদের সংস্পর্শে এসে কায়িক শ্রমের বিনিময়ে শূদ্রের জীবিকা পালন করে। সেই সব অনার্য ও শূদ্রদের রূপবতী কন্যারা অনেক ক্ষেত্রে অভিজাত উচ্চবর্ণের পুরুষদের সঙ্গে প্রণয়ঘটিত দৌর্বল্যে বা ধর্ষণের ফলে জারজ সংকর-শিশুর জন্ম হয়, সেই সব শিশুরা বড় হয়ে পিতৃনামহীন শ্রমিক রূপে উচ্চবর্ণের সেবা পরিচর্যা করে অথবা ক্রীতদাস-দাসীরূপে অন্যত্র বিক্রি হয়ে যায়।
দুর্জয় নিজেকে রাজা বললেও আসলে সে একজন ক্ষুদ্র সামন্ত-জমিদার, তার অধীনে দুটি পরগণার দেড়শতর মত গ্রামের আবালবৃদ্ধ নরনারীর সে-ই হর্তাকর্তা বিধাতা। প্রীতিকূট থেকে প্রায় পাঁচ ক্রোশ দূরে দুইশত বিঘা পরিমাণ জায়গায় তার সামন্তনিবাসটি একটি বিরাট খামার-বাড়ির সদৃশ।
খামারবাড়ির মধ্যস্থলে তিন-মানুষ সমান প্রাচীর বেষ্টিত অনেকটা স্থান জুড়ে ইষ্টক-প্রস্তর নির্মিত ও চুন এবং বালুকার প্রলেপ দেওয়া একটি সুরম্য ও বৃহৎ ত্রিতলপ্রাসাদের একদিকে অনেকগুলি দুই বা তিন কক্ষবিশিষ্ট ছোট-বড় গৃহ। নীচের জমি থেকে অনেকটা উপরে গৃহগুলির দাওয়া অবধি পাথরের সোপান নেমে এসেছে, মাঝে সংকীর্ণ লালমাটির পথ। অপেক্ষাকৃত বড়গুলি দুর্জয়ের রক্ষিতাদের বাসস্থান, ছোটগুলির একাংশে ভৃত্য-দাসী ও ক্রীতদাসরা থাকে, অপর অংশে ভ্রাম্যমান সাধু, শ্রমণ ও অনাহূত-রবাহূত অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট। অন্যদিকে সারিবদ্ধ ভাবে অশ্ব ও হস্তিশালা এবং পানীয় জলের কয়েকটি কূপ। প্রাসাদের বাইরে একটি বিশাল দীর্ঘিকা, তার চতুষ্কোণে চারটি শ্বেতমর্মর-নির্মিত ঘাটের পাশে ভগবান পুরারাতির চারটি ছোট মন্দির।প্রাসাদ সংলগ্ন ঘাটটি কেবলমাত্র রাজবাড়ির বাসিন্দারাই ব্যবহার করে। অন্যগুলি প্রায় অব্যবহৃতই পড়ে থাকে।
প্রাসাদের ঠিক সম্মুখে চত্বরের উপর একটি বাঁধানো উঁচু বেদী। এখানে বসে দুর্জয় সামন্ত তার রাজকার্য চালায়। তার রাজকার্য বলতে কোনও বিবাদের মীমাংসা, অবাধ্য প্রজাদের শাস্তিদান আর বিশেষ করে রাজকোষে আরও ধনাগমের জন্য বেতনভুক বশংবদ নায়েক ও সৈনিকদের নিজের অধিকৃত বা পার্শ্ববর্তী কোনও দুর্বল পরগণার কোনও জনপদ লুন্ঠনের আদেশ দেওয়া ও কর-আদায়কারিদের আরও নির্মম হওয়ার নির্দেশ দেওয়া।
বিধু ও বিহান, দুই অনার্য যুবক অশ্বের পিছনে ছুটতে ছুটতে যখন ধূমলপ্রদেশে দুর্জয়ের প্রাসাদের কাছে পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা হতে কিছুটা দেরি আছে।প্রাসাদের সিংহদ্বারে মুক্ত কৃপাণ হাতে অন্তত দশ জন ভীষণ-দর্শন প্রহরী প্রহরায় নিযুক্ত, তাদের চোখ এড়িয়ে একটি মক্ষিকাও ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না।
এতটা পথ অবিশ্রান্তে ছুটে এসে বিধু ও বিহান স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত। প্রাসাদ-প্রাচীরের বাহিরে ও ভিতরে বিভিন্ন ধরণের প্রচুর গাছ থাকায় দূর থেকে স্থানটিকে একটি ছায়াচ্ছন্ন বনভূমি বলে ভ্রম হয়। অনার্য যুবকদ্বয় এমন জায়গায় আগে কখনও আসেনি, পথঘাট সম্পূর্ণ অপরিচিত। আপাতত প্রথমে কিছু খাদ্য ও পানীয়ের খুবই প্রয়োজন, তারপর সামনের প্রচণ্ড শীতের রাত্রিতে মাথা গোঁজার জন্য একটু ঠাঁই চাই। কিন্তু কি করবে, কোথায় যাবে, কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না। প্রাসাদের লৌহ-নির্মিত বিশাল সিংহদ্বার হয়তো সন্ধ্যার পরেই বন্ধ হয়ে যাবে, আর সম্ভবত কাল সকালের আগে খুলবে না, আর ওই তিন মানুষ সমান প্রাচীরই বা কি করে লঙ্ঘন করা যায়!
সামন্তরাজার সৈন্যদের গ্রামের চারটি মেয়েকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে আসতে দেখে তাদের যৌবন রক্ত স্থির থাকতে পারেনি, অথচ ওই যুবতীদের সঙ্গে তাদের বিশেষকোনও পরিচয়ও নেই, কোনওদিন তাদের সঙ্গে বিশেষ বাক্যালাপও হয়নি। একটা অসম্ভব জেদ আর ঝোঁকের বশে তারা ঘোড়সওয়ারদের অনুসরণ করে এতদূর ছুটে এসেছে। যদিও ‘ভয়’ শব্দটি এই দুই যুবকের অভিধানে নেই, তবুও এভাবে নিঃসম্বল ও নিরস্ত্র অবস্থায় এখানে আসা যে বিষম অবিমৃশ্যকারিতা হয়েছে, তা এখন ভালই উপলব্ধি হচ্ছে। কিন্তু এতদূর এসে শেষ পর্যন্ত উদ্ধারের চেষ্টা না করে ফিরে যেতেও মন চাইছে না।
প্রাসাদের প্রাচীর ঘুরে দীর্ঘিকার দূরপ্রান্তের ঘাটের সোপানে বসে দুই বন্ধু নিজেদের মধ্যে এই সব নানা আলোচনা করছে, এমন সময় পিছনে মন্দিরের পাশ থেকে শুষ্ক পত্রমর্মর ধ্বনি শুনে দুজনেই সচকিত হয়ে পিছনে ফিরে তাকালো। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় একজন বৃদ্ধ মানুষের অবয়ব, যষ্টিতে ভর দিয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন।পরণে ধুতি, উর্দ্ধাঙ্গে কর্পট ও একটি ধূসর কম্বল। তাঁর তাম্রাভগাত্রবর্ণ, শুভ্র চামরের ন্যায় প্রলম্বিত কেশ ও শ্মশ্রু সমন্বিত চেহারা ও পোশাক দেখে অনুমান হয় তিনি কোনও রাজপুরুষ বা অভিজাত শ্রেনীর মানুষ নন, নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। তিনি যে কখন নিঃশব্দে এসে পিছনে দাঁড়িয়েছেন, তারা বুঝতে পারেনি। ওরা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে প্রণাম জানালে বৃদ্ধ হাতের ইশারায় বারণ করে নিজেই তাদের পাশে বসে সহৃদয় কন্ঠে বললেন, ‘‘তোমাদের কথা শুনে বুঝেছি তোমরা অনেক দূর পথ অতিক্রম করে এসেছো, এবং ক্ষুধার্ত।তোমরা কে? এখানে কেন এসেছো? আর এই শীতের সন্ধ্যায় এখানেই বা কি করছ?’’
‘‘আমরা অতি সামান্য মানুষ প্রভু,’’বিহান সবিনয়ে বলল, ‘‘প্রীতিকূট গ্রামের নাম শুনেছেন আপনি? সেই গ্রামের গোপালক আমরা।’’
‘‘কি নাম বললে? প্রীতিকূট!!’’ বৃদ্ধ যেন নামটা শুনে একটু চমকে উঠলেন, বিড়বিড় করে কয়েকবার নামটা মন্ত্রের মত জপ করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘গো-বাথান উৎসব হয়ে গিয়েছে তোমাদের?’’
‘‘আপনি জানেন আমাদের গো-বাথান মোচ্ছবের কথা?’’বিধু অবাক হয়ে শুধালো।
‘‘হ্যাঁ জানি, খুব ভালো করেই জানি,’’বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, একটু থেমে বললেন, ‘‘এক সময় আমার ওখানেই বাড়ি ছিল, সে অনেক কাল আগের কথা। সে সব কথা পরে হবে।তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত; আর তোমরা যে বিনা কারণে প্রীতিকূট থেকে ধূমলে আসোনি, সেটাও বুঝেছি।পরে তোমাদের কথাও শুনবো সব, এখন এসো আমার সঙ্গে।’’বলতে বলতে যষ্টিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ মানুষটি।
বিধু ও বিহান প্রৌঢ়ের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সামন্তরাজার প্রাসাদ থেকে অনেকটা দূরে বেশ জমজমাট জনবসতি এলাকায় এসে পৌঁছালো। চারিদিকে ইষ্টক-প্রস্তর-নির্মিত ছোট-বড় অট্টালিকা, পরিচ্ছন্ন পথঘাট, পথের পাশে পাশে প্রপা, মাঝে মাঝে ছোট ছোট চবুতরে বিভিন্ন দ্রব্য-সজ্জিত বিপণি, মদিরালয়, রণ্ডাগৃহ, এবং অশ্ব ও গো-শকট রাখার স্থান।
সঙ্গী মানুষটি জানালেন, এই জায়গাটিতে বেশীরভাগই অবস্থাপন্ন ধনী বৈশ্য ও অভিজাত ক্ষত্রিয়দের বাস; আরো কিছুটা দূরে মধ্যবিত্ত ও শূদ্রশ্রেণীর মানুষের পল্লী এবং জনপদের সীমান্তে পাহাড়ি অরণ্য অঞ্চলে অনার্যদের বাসভূমি। কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ যুবকদের নিয়ে একটি মিষ্টান্ন বিপণির সামনে দাঁড়ালেন। বিপণিটিতে বড় বড় কটাহে ও বারকোশে নানা ধরণের মিষ্টদ্রব্য সজ্জিত রয়েছে। বৃদ্ধের নির্দেশে পশারিপিটক ও সর্জবৃক্ষের পত্রে তাদের নানা রসনাতৃপ্তিকর খাদ্য পরিবেশন করতেই ক্ষুধার্ত যুবকেরা দ্বিরুক্তি না করে সেগুলি গোগ্রাসে উদরস্থ করল।এমন সুখাদ্য তারা জীবনে কখনও খায়নি। ভোজন সাঙ্গ হলে বিক্রেতাকে মূল্য দিয়ে বৃদ্ধ আবার তাদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর গিয়ে একটি সাধারণ গ্রাম্য-পল্লীতে উপস্থিত হলেন।
ইতিমধ্যে শীতঋতুর অল্পস্থায়ী দিনের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে, পথের দুপাশে গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ইতস্তত ছড়ানো মৃন্ময় গৃহগুলিতে সন্ধ্যাদীপ জ্বলে উঠেছে, পথ প্রায় জনশূন্য। অবশেষে পল্লীর শেষ প্রান্তে এসে বৃদ্ধ একটি কপাটবিহীন মৃন্ময় গৃহের সামনে থামলেন।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়িয়ে উদিত হচ্ছে। বৃক্ষপত্রের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে ভূমিতে অদ্ভুত নকশা অঙ্কিত করেছে। পাশাপাশি দুটি কক্ষবিশিষ্ট গৃহটি চারিদিকে নীচু প্রাচীরবেষ্টিত, মধ্যস্থলে একটি ছোট অঙ্গন, দু-চারটি গাছ ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। অঙ্গনটি গাছের শুষ্ক পত্র ও ধূলায় পূর্ণ, গৃহে কোন দেবমন্দির, এমনকি তুলসীমঞ্চও নেই। সর্বত্র অমার্জিত ও অপরিচ্ছন্নতার ছাপ; কোন রমণীর কল্যাণময়ী হস্ত যে এস্থান স্পর্শ করে না, তা সুনিশ্চিত। পথশ্রান্ত বিধু আর বিহান ধুলিময় দাওয়ায় শরীর এলিয়ে ক্লান্তিতে চোখ বুজলো। বৃদ্ধ ওদের দিকে মায়াময় দৃষ্টিতে ক্ষণকাল চেয়ে থেকে মৃদু হাসলেন।
************
একটি একটি করে কুসুমকলি ফুটে উঠছে, সপ্তাশ্ববাহিত রথে দিনাধিপতির আকাশ পরিক্রমার শেষ-পথে সেই নামগোত্রহীন কলিরা তাদের রূপ-রস-গন্ধ অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে একসময় ঝরে পড়ে পরমাকাঙ্খিত ধরিত্রীর স্নেহময়ী অঞ্চলে। স্মৃতির মুকুর তাদের প্রতিবিম্ব ধরে রাখে না। নিত্য নূতন বিচিত্র ছবির মাঝে বিস্মৃতির অনন্ত সাগরে বুদবুদের মতই তারা ক্ষণকালের জন্য প্রতিভাত হয়, আবার মিলিয়ে যায়। জীবন থেমে থাকে না, সতত প্রবাহিনীর মতই সে মোহপাশমুক্ত; তার ফেলে আসা স্রোতপথের সমস্ত আনন্দ-বেদনার অসংখ্য মুহূর্তগুলিকে সে আপন তরঙ্গে ভাসিয়ে আপন গতিতে কালরূপ সাগরের অভিমুখে চির-বহমান।
নিত্যপ্রথামত অতি প্রত্যুষেই শয্যা ত্যাগ করে আচার্য চিত্রভানু পুত্র বাণকে সঙ্গে নিয়ে তমসা নদীর তীর ধরে অনেক দূর পর্যন্ত পাদচারণা শেষ করে এক জায়গায় প্রস্তরাসনে উপবিষ্ট হলেন।
প্রস্ফুটিত জবাকুসুমনিভ ভগবান বিবস্বান অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছেন আলোক ও উত্তাপ, কেটে যাচ্ছে হিমেল রাত্রির শৈত্য-প্রকোপ, ভোরের ঘন কুয়াশার যবনিকা সরে গিয়ে ধীরে ধীরে অনেক দূরের ধূসরবর্ণা নাতিউচ্চ পর্বতশ্রেণী আর ঘন হরিৎ বর্ণের বনভূমির দিগন্তুরেখা দৃশ্যমান হচ্ছে। বিশ্বচরাচরের সুগম্ভীর সুর ধারায় আপ্লুত হয়ে এক অপার্থিব ভাব-জগতে বিচরণ করতে করতে আত্মসমাহিত আচার্যদেব ভাবগম্ভীর স্বরে উপনিষদের মহতী শ্লোকের আবৃত্তি করলেন।
উর্ধ্বমূলোহবাকশাখ এষোহশ্বত্থঃ সনাতনঃ।
তদেব শুক্রং তদব্রহ্ম তদেবামৃতমুচ্যতে।
তস্মিল্লোকাঃ শ্রিতাঃ সর্বে তদু নাত্যোতি কশচন। এতদ্বৈ তৎ।। (কঠোপনিষদ)
এই যে সংসার-বৃক্ষ, ইহা অশ্বত্থের ন্যায় অচিরস্থায়ী, সর্বোচ্চ ব্রহ্মরূপ মূল হইতে ইহার উদ্ভব, ইহার শাখাগুলি গীবাদিরূপে নিম্নদিকে বিস্তৃত, ইহা সনাতন, অর্থাৎ প্রবাহক্রমে নিত্য। এই সংসার-বৃক্ষের যিনি মূল, তিনিই ব্রহ্ম --- তিনি শুদ্ধ, তিনিই অমৃত বলিয়া কথিত। তাঁহাতেই পৃথিবী সহ সমস্ত লোক আশ্রিত আছে, কেহই তাঁহাকে অতিক্রম করিতে পারে না। ইনিই সেই (আত্মা)।
বাণ তন্ময় হয়ে ব্রহ্মজ্ঞানী পিতার আবৃত্তি ও ব্যাখ্যা শুনে পরম প্রীতি লাভ করলো। তারপর তমসার স্নিগ্ধ-শীতল জলে অবগাহন করে পিতা-পুত্র গৃহে প্রত্যাগমণ করলেন।
প্রীতিকূটের মধ্যস্থিত ব্রাহ্মণাধিবাসে প্রীতিকূটের সর্বজনশ্রদ্ধেয় আচার্য চিত্রভানুর নিবিড় ছায়াচ্ছন্ন ও শান্তিময় আশ্রমসদৃশ গৃহ। গৃহ-সম্মুখস্ত প্রশস্ত-কংকরসমাচ্ছন্ন রাঙা মাটির পথটির অন্যদিকে স্বর্ণাভ পক্কশস্যের ভারে আনমিত বিস্তীর্ণ গোধূম ক্ষেত্রে সৈরিকগণ কর্মব্যস্ত, পাশের স্বচ্ছ জলের তড়াগ থেকে ব্রাহ্মণাধিবাসের কূলবধুরা মৃন্ময় কলস ভরে জল নিয়ে যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে সবই স্বাভাবিক মনে হলেও আনন্দময় ও কর্মচঞ্চল প্রীতিকূট এখন গভীর বিষাদে নিমগ্ন। গো-বাথান উৎসবের সেই ভয়ংকর ঘটনায় সমস্ত জনপদের মানুষ ভয়ার্তচিত্তে দিনযাপন করছে।
আচার্যের গৃহপ্রাঙ্গণের একদিকে একটি ছোট আটচালায় আচার্যের চতুষ্পাঠী, অন্যদিকে পাশাপাশি দুটি শয়নকক্ষের মধ্য দিয়ে যে সঙ্কীর্ণ পথটি বাটীর পিছনের দিকে চলে গিয়েছে, সেখানে অনেকখানি জায়গা জুড়ে নানা বৃক্ষের সমারোহে বড় বাগিচাটি নিয়মিত পরিচর্যায় বেশ পরিচ্ছন্ন। আচার্য চিত্রভানু ধীর পদবিক্ষেপে গোময়লিপ্ত পরিচ্ছন্ন প্রাঙ্গণের এক কোণে বৃক্ষতলের প্রস্তর ও মৃত্তিকা-নির্মিত বেদীতে তাঁর প্রিয় আসনটিতে এসে বসলেন। সাধারণত স্থিতপ্রজ্ঞ ভট্টদেবের মনে জাগতিক চিন্তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, কিন্তু আজ তাঁর চিত্ত বড়ই বিক্ষিপ্ত।
আচার্যদেব বংশপরম্পরায় ও স্বোপার্জিত প্রচুর ভূসম্পত্তির অধিকারী হওয়ায় তাঁর সংসার সচ্ছল হলেও তা ছিল নিতান্তই আড়ম্বরহীন। বহুশ্রুত ঋষিবংশে চিরদিনই ছিল বিদ্যার মর্যাদা এবং আলোচিত হত নানা বিদ্যা প্রসঙ্গ। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবেশে তাঁর প্রিয় পুত্র বাণের স্বভাব-চরিত্র অন্য সাধারণ কিশোরদের মত বস্তুবাদী না হয়ে জ্ঞান এবং ভাব জগতের মানুষরূপে প্রতিভাত হয়ে উঠেছিল, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার মেধা ও প্রতিভা।
স্বাধীনচেতা বাণ নিজেকে মেলে ধরতে চায় প্রকৃতির অসীম অঙ্গন মাঝে। নিজের মনে রচনা করে সুললিত কাব্য-আলেখ্য। এই সব সময়ে সে যেন সামান্য এক কিশোর নয়, এক ভাবগম্ভীর কবি! আর হবে নাই বা কেন! মহর্ষি বাৎস্যায়নের শোনিতধারা বহে চলেছে তার ধমনিতে, তার সঙ্গে মিশেছে ঋষিপ্রতিম পিতা চিত্রভানুর অসীম জ্ঞানের ঐশ্বর্যরাশি! পিতা অন্যান্য বটুকদের সঙ্গে তাকেও যথারীতি শিক্ষা দেওয়া ছাড়াও সময় পেলেই আলাদা ভাবে নানা শাস্ত্র ও বিদ্যা দান করেন।
বাণের শিশু বয়সেই জননী রাজদেবী গত হয়েছেন, পিতা চিত্রভানু পিতা-মাতা উভয়ের স্নেহে লালন করেছেন তাঁকে। পিতৃস্নেহে পুষ্ট হয়ে বাণের ধৃতিশক্তি চন্দ্রকলার মতই বিকশিত হয়েছে। অসম্ভব ধীশক্তির অধিকারী বাণ তার আচার্য-পিতার বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার থেকে সাধ্যমত জ্ঞানাহরণ করে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বিষয়ে যথেষ্ট পারঙ্গম হয়ে উঠেছে। ক্রীড়া-কৌতুকের সঙ্গে সঙ্গে অধীত ও আহৃত জ্ঞান তাকে এই চতুর্দশ বছর বয়সেও বেশ চিন্তাশীল করে তুলেছে। দিনের মধ্যে কিছুটা সময় সে নিজের সঙ্গে কাটায়। কখনও উচ্ছল-স্রোতা তমসা নদীর উপল-সংকুল তটভূমিতে, তন্বী নদীর নূপুরনিক্বণে তার মনের মধ্যে বেজে ওঠে একের পর এক সুরের লহরী। আবার কখনও একাকী আপন মনে সে হেঁটে চলে স্নিগ্ধ-শীতল ছায়াঢাকা ছোট্ট জনপদটির কংকর-সমাচ্ছন্ন রাঙ্গা মাটির বীথিকা ধরে, দুচোখ ভরে দেখে আশপাশের স্বচ্ছ জলের তরাগ ও দীর্ঘিকাগুলিতে পাদপশ্রেণীর প্রতিবিম্বর মাঝে প্রস্ফুটিত কুবলয়ের শোভা, পত্র-পুষ্প-ফলভারে আনত তরুশোভিত মনোরম উদ্যানে ঘেরা প্রস্তর-নির্মিত দেবদেউলে সকাল-সন্ধ্যা শঙ্খ-ঘন্টাধ্বনি আর সমবেত কন্ঠের সন্ধ্যা সামগীতের সুর তাকে পৌঁছে দেয় তারই স্বরচিত অন্য এক ভুবনে, যা একান্তই তার নিজস্ব।
অন্যান্য দিনের মতই কিছুক্ষণ আগেই বটুকগণ মুখরিত কলহংসের ন্যায় তাদের প্রভাতী-পাঠ সমাপন করে বিদায় নিয়েছে। আচার্যদেব কখনই বিদ্যাদানের বিনিময়ে কোন কিছু গ্রহণ করেন না।
প্রভাতকালীন অধ্যয়নের শেষে অন্যরা চলে গেলে বাণ ও তার সমবয়সী কয়েকজনসঙ্গী প্রায় প্রতিদিনই নিত্য-নতুন ক্রীড়া উদ্ভাবন করে মেতে ওঠে খেলায়। তার প্রিয় সঙ্গী ব্রাহ্মণ পিতার ঔরসে ও শূদ্রাণী মাতার গর্ভজাত দুই ভাই চন্দ্রসেন ও মাতৃষেণ ছাড়াও ভিষকপুত্র মন্দারক এবং আরও দুই নিত্যসহচর রুদ্র ও নারায়ণ।
পিতা ছাড়া পিতৃস্বসা মালতি ছিল এই সংসারে মাতৃহীন বাণের একমাত্র অভিভাবিকা ও আপনজন। তার ওই ভাবে অপহৃতা হওয়ার পর শুধুমাত্র পিতা চিত্রভানুর সান্নিধ্যে যেটুকু সময় থাকে, তা ছাড়া বাণের আর কোনওকিছুতেই মন বসে না। বাণের মন ভাল নেই তাই এই কয়দিন ক্রীড়াকৌতুকও বন্ধ।
আজ পাঠ সাঙ্গ হলে বাণ তার নিত্যসঙ্গীদের নিয়ে বাথানেএল।গোপালকদের কুটির থেকে মেয়েদের কথা ও রন্ধনের শব্দ ছাড়া চারিদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। রাখাল বালকেরাও গত দিনের ভয়ংকর বিপদের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তারা একস্থানে জড়ো হয়ে নিজেদের মধ্যে নিম্নস্বরে কথা বলছে।শুধু গোপালকরানিত্যনৈমিত্তিক দীর্ঘিকার জলে গরুগুলিকে স্নান করাচ্ছে, তারা সকলেই আচার্য চিত্রভানুর প্রিয়দর্শী এই কিশোর পুত্রটিকে চেনে, ভালোবাসে।
গোপালকদের দলপতি শ্রীনিবাস বাণকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, ‘‘প্রণাম ঠাকুর, আচার্যদেব ও অন্যান্য সকলের কুশল তো!’’
‘‘আচ্ছা যে দুজন সেই লুন্ঠকদের পিছনে পিছনে ছুটে গিয়েছিল, তারা কি ফিরেছে?’’বাণ সে কথার উত্তর না দিয়ে শুধালো।
‘‘না গো ঠাকুর, সেই থেকে তাদেরও আর কেউ দেখেনি।’’হতাশ গলায় বলল শ্রীনিবাস, ‘‘তারা যে কোথায় গেল, কি অবস্থায় আছে, জানতে পারিনি।’’
‘‘আমি পিতার মুখে শুনেছি, ওই দুর্বৃত্তরা সামন্তরাজা দুর্জয়ের লোক।’’ মাতৃষেণ পাশ থেকে বলে উঠল।
‘‘তারা তো সেই ঘোড়সওয়ারদের পিছনেই ছুটেছিল দেখেছি,’’নারায়ণ বলল, ‘‘নিশ্চয়ই ওরা ধূমল প্রদেশেই গিয়েছে।’’
‘‘সে তো আমিও জানি।’’শ্রীনিবাস বলল, ‘‘কিন্তু আমরা কেউই কখনও সে জায়গায় যাইনি, কি যে করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। এদিকে বিধু আর বিহানের বাপ-মা তো খাওয়া-ঘুম ছেড়ে দিনরাত কেঁদে ভাসাচ্ছে।’’
ওদের কথার মাঝেই দূর থেকে ধানুক তার চিরসঙ্গী তৈল-চিক্কণ মোটা বেত্রযষ্টিটি হাতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ধানুক অত্যন্ত দক্ষ লাঠিয়াল, তার মেদহীন, পেশী ও শিরাবহুল কালো কষ্টি পাথরে খোদাই করা দেহে প্রচণ্ড শক্তি। সবাই জানে ধানুকের হাতে ঐ বেত্রদণ্ডটি থাকলে সে অনায়াসেবিশ-ত্রিশজন পুরুষের সম্মুখীণ হতে পারে।
‘‘দ্যাখো নিবাস, আমি বলি কি, এভাবে পুরুষ মানুষ হয়ে হাত-পা কোলে নিয়ে বসে না থেকে কিছু একটা করা দরকার।’’ধানুক তার একমাথা অবিন্যস্ত বাবরি চুল নাড়িয়ে বলল, ‘‘বিধু আর বিহানের মত দুটো ছোকরার এত সাহস আর মনের জোর, আর আমরা শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি!’’
‘‘আমিও ঠিক এই কথাটাই বলতে এসেছি তোমাদের।’’বাণ খুশি হয়ে বলল।
‘‘তাহলে চল, আমরা এখনি গ্রামে গিয়ে আচার্যদেব আর অন্যদের ডেকে পরামর্শ নিই, তাঁরা যা বলবেন তাই করব।’’ শ্রীনিবাস সঙ্গে সঙ্গেই রাজি।
শ্রীনিবাসের ডাকে আরও জনা দশেক জোয়ান এগিয়ে এল।তারপর সবাই মিলে প্রীতিকূটের দিকে চলল।কিছু একটা যে করতেই হবে!(ক্রমশ প্রকাশ্য)
কয়েকটি স্বল্প প্রচলিত শব্দের অর্থ ---বিবস্বান – সূর্য / বটুক – বিদ্যার্থী / প্রপা- জলসত্র / পিটক – মাটির ভাঁড় / সর্জবৃক্ষ- শাল গাছ / পুরারাতি – শিব / রণ্ডাগৃহ – বেশ্যালয়
0 comments: