0

ছোটগল্পঃ মৌসুমী ঘোষ দাস

Posted in


ছোটগল্প


সহযাত্রী 
মৌসুমী ঘোষ দাস



অনেকক্ষণ থেকে শুনছি, বাইশ তেইশ বছরের বউটি তার থেকেও দু বছরের ছোট ভাইকে খানিক বাদে বাদেই বলছে, “অরে ডাইক্যা তোল। টেরেনে উঠনের পর থিক্যা খালি ঘুমাইতাসে। কিছু মুখে না দিলে দুর্বল হইয়া পড়বো।”

শুনে ছেলেটি তার দিদিকে প্রায় ধমক দিয়ে বলছে, “না বুইঝ্যা শুইন্যা তুই মেলা ফ্যাস ফ্যাস করস। ডাক্তারে কইসে অর রেস্ট দরকার। যত ঘুমাইবো তত তাড়াতাড়ি সাইর‍্যা উঠবো। বেশী জ্বালাইলে আমি কিন্তু ট্রেইন থিক্যা নাইম্যা পড়ুম। তখন বুঝবি ঠ্যালা।”

ছেলেটির বয়স কুড়ি/ বাইশ হবে। সে তার দিদি, দুই বছরের ভাগ্নি, ও জামাইবাবুকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে মালদার মহদিপুরের বর্ডার পার হয়ে চেন্নাই গিয়েছিলো জামাইবাবুর চিকিৎসা করাতে। চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে ফিরছে এখন। সেই ট্রেনের এসি কামরাতে ওদের মুখোমুখি আসনে আমি আমার অসুস্থ বাবাকে চিকিৎসা করিয়ে ফিরছি চেন্নাই অ্যাপোলো থেকে। ওদের চেঁচিয়ে কথোপকথন, বাচ্চাটার প্যাঁপ্যাঁ কান্না, যা দেখছে তা হামলে পড়ে খাওয়া, এসব দেখে সারাপথে ওদের সাথে খুব প্রয়োজনের দু একটা কথা ছাড়া বাকি কিছুই তেমন বলতে রুচি হয়নি।

প্রায় সারা পথ নীচের দুটো বার্থের একটিতে আমার অসুস্থ বাবা আর একটিতে ছেলেটির অসুস্থ জামাইবাবু শুয়ে আসছেন। আমার বাবা মাঝে মধ্যে উঠে খাবার খাওয়া বা বাথরুম যাওয়া করে এসে আবার শুয়ে পড়ছেন। কিন্তু সেই ভদ্রলোকটি এতই অসুস্থ যে উঠছেনই না। ছেলেটি খাবার দাবার কিনে বোনকে, ভাগ্নিকে দিচ্ছে, কিন্তু নিজে সারাক্ষণ চিন্তিত ও বিষণ্ণ মুখে বসে থাকছে।

যখন বর্ধমান স্টেশনে আমি বাবাকে নিয়ে নামলাম, তখন দেখি ছেলেটি আমাদের লাগেজপ্ত্র হাতে করে দরজার কাছ পর্যন্ত এগিয়ে এসে আমাদের সাহায্য করলো। আমি শুষ্ক ভদ্রতার খাতিরে ছেলেটার হাত ধরে ধন্যবাদ জানাতেই ছেলেটি হু হু করে কেঁদে অনেক কথা বললো। যার মর্মার্থ এই যে,কাল রাতে নাকি ঘুমের মধ্যে ওর অসুস্থ জামাইবাবু মারা গেছেন। ছেলেটি সব বুঝেও বোনকে বা ট্রেনের কাউকে কিছু বুঝতে দেয় নি। এসিতে থাকার দরুন হয়তো বডি থেকে এখনো গন্ধ ছড়ায় নি। কিন্তু এই মৃত্যুর ব্যাপারটা জানাজানি হলে, এসি তে এইরকম খোলামেলা ডেড বডি নিয়ে যাচ্ছে জানলে, জীবাণু ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ করে যদি আশেপাশের আসনের মানুষরা আপত্তি জানায়, বা আরপিএফ কে ডেকে কোনও অচেনা অজানা ষ্টেশনে ওদের নামিয়ে দেয়! তখন দিদি, দুই বছরের ছোট ভাগ্নি আর মৃত জামাইবাবুকে নিয়ে সে একা এই বিদেশে মহা বিপদে পড়বে। এইটুকু বয়সে সদ্য স্বামী হারা দিদিকে সামলাবে, না অবুঝ পিতৃ হারা ভাগ্নিকে, না মৃত মানুষটাকে? তাই চুপ করে অপেক্ষা করছে আর চার ঘণ্টা পর মালদা স্টেশন আসবার জন্য। সেখানে নেমে গাড়ি ভাড়া করে মহদিপুর গিয়ে না হয় একটা ব্যবস্থা করতে পারবে। আমি এতক্ষণ পাশে ছিলাম বলে ছেলেটি নাকি সাহস পেয়েছিল। এখন যদি অন্য লোক আমাদের খালি জায়গায় ওঠে আর পুরো ব্যাপারটা বুঝে যায়! কি যে হবে ভেবে ছেলেটি আতঙ্কিত! 

শুনে মুহূর্তের জন্য আমি স্পন্দনহীন হয়ে গেলাম। একই সাথে একই কোচে মুখোমুখি সেই চেন্নাই থেকে ভ্রমণ করছি, অথচ আমার থেকেও বয়সে ছোট সহযাত্রী ছেলেটি এই বিদেশে কি অসম্ভব বিপদে পড়েছে তার খবরই রাখিনি এতক্ষণ! সামনের শায়িত মানুষটি জীবিত না মৃত তাও চেয়ে দেখার চেষ্টা করিনি? কেবল নিজের আত্মম্ভরিতা নিয়েই মগ্ন ছিলাম! অথচ সে ছেলেটি কিনা এতক্ষণ আমাকেই ভরসা করে আসছিলো? আজ এ ঘটনা তো আমার সাথেও ঘটতে পারতো! এখন জেনেই বা কি করতে পারবো? সঙ্গে যে আমার অসুস্থ বাবা রয়েছেন।

এসব ভাবতে ভাবতে ট্রেনটা ছেড়ে দিলো। আর দরজার কাছে বিষণ্ণ, ভয়ার্ত ও অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা যুবক ছেলেটি ধীরে ধীরে ট্রেনের সাথে অদৃশ্য হয়ে গেলো। 



0 comments: