0

ছোটগল্পঃ তুষার সরদার

Posted in


ছোটগল্প


সমাধান
তুষার সরদার



‘‘গণপতিদা! গণপতিদা!’’

ডাকতে ডাকতে হাঁপাতে হাঁপাতে পেটো কার্তিক ঢুকে পড়ে এলাকার জবরদস্ত মহান নেতা গণপতি দত্তের বাসভবনে। বাসভবনের বাইরের দিকটা একেবারে ধবধপে সাদা রঙের। দোতলায় আর তিনতলায় এখানে ওখানে মন্দিরের মত আর্চ করা হয়েছে। দেবালয় স্টাইলের সাদারঙের বিশাল বাড়িটা দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। ভেতরে ঢুকে পেটো কার্তিক গণপতিকে দেখতে পেয়ে কঁকিয়ে ওঠে – ‘‘দাদা গো! মহা সব্বোনেশে কেস ঘটে গেছে দু-নম্বর ওয়ার্ডে! এবার কী...?’’

সকাল পৌনে সাতটা। গণপতিবাবু অনেক আগেই শয্যাত্যাগ করেছেন। লেট নাইট – লেট রাইজ, এসব হচ্ছে উঠতি নেতাদের রেওয়াজ। গণপতিবাবু সেসব স্টেজ অনেক আগে পেরিয়ে এসেছেন। পেটো কার্তিক যখন তাঁর কাছে হাজির হল তখন তিনি সবে ধ্যান প্রাণায়াম সেরে উঠেছেন। চোখে মুখে তখনও সুগভীর প্রশান্তির রেশ লেগে রয়েছে। পেটো কার্তিকের গভীর উদ্বেগ আর চাঞ্চল্য তাঁকে স্পর্শ করতেই পারলো না। খুব শান্ত স্বরে তিনি বললেন, ‘‘বোস। একগ্লাস জল খা। তারপর চাস তো বাইরে গিয়ে খানিক বিড়ি টেনে আয়। তার পরে সব শুনছি।’’

‘‘দাদা! তোমার নিজের এলাকাতেই রেপ কেস হয়ে গেছে আজ ভোরে। তাও আবার নাবালিকা! ভোরের দিকে মনে হয় হাগা সারতে একা একা মাঠের দিকে গিয়েছিলো....’’

গণপতিবাবু প্রত্যহ প্রাতঃকালে তুলসীপত্র, বিল্বপত্র এবং নিম্বপত্র ভেজানো জল পান করেন। এতে শরীরস্থ বায়ু পিত্ত ও কফ – মানবদেহের সমগ্র ব্যাধির মূলস্থ কারণ এই ত্রিবিধ দোষ নিবারিত হয়। সেই সাত্ত্বিক পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘‘নাবালিকা? ধুস্‌!’’ পানীয়ের খালি গ্লাসটা ধীরে সুস্থে নামিয়ে রেখে সাদা নরম তোয়ালে দিয়ে হালকা ছোঁয়ায় নিজের ঠোঁট মুছে নিয়ে বললেন, ‘‘তার মানে সে তো কোনওরকম ভোটারই নয়। তার ব্যাপার নিয়ে তুই এত মাথা গরম কচ্ছিস!’’

‘‘কিন্তু মেয়েটার বাবা তো থানায় কেস করতে যাবে বলে!’’

‘‘থানা-ফানার কথা ছাড়। আগে বল, সবশুদ্ধ ক’টা ভোটার আছে ওই ফ্যামিলিতে?’’

‘‘সাত... না না, মেয়েটার তো ভোটার কার্ড হয়নি এখনও। তাহলে ছ’টা... ছ’টা ভোটার।’’

‘‘আর যে মালটি রেপ করেছে সে কি এখন ভোটার?’’

‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সে ব্যাটা তো এই গত ইলেকশনের আগেই ভোটার হয়েছে।’’

‘‘তাদের ফ্যামিলিতে মোট ভোটার ক’টা?’’ 

‘‘ওদের সব মিলিয়ে পাঁচটা ভোটার।’’

‘‘হুঁ।’’ সামনের দেওয়ালে রামকৃষ্ণদেবের প্রমাণ-সাইজ বাঁধানো ছবি টাঙানো। সেদিকে তাকিয়ে থেকে গণপতিবাবু বললেন, ‘‘কাদের?’’

‘‘আমাদের। সবগুলোই আমাদের ভোটার।’’

‘‘ষাঁড়ের বাচ্চাটাকে তুলে আন। ঠেসে ক্যালানি দে।’’ তারপর রামকৃষ্ণদেবের ছবি থেকে সরে গিয়ে একটু ওপাশে টাঙানো স্বামী বিবেকানন্দের ছবিতে খানিক থেমে তারপর আরো এগিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবির উপর নজর দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি বলে উঠলেন, ‘‘ক্যালানোর পর আমি নিজে মালটাকেথানায় নিয়ে যাবো। ওদিকে মেয়েটার মেডিক্যাল টেস্টের ব্যবস্থা কর। আইন চলবে আইনের পথে।’’

‘‘এখানে একটা কথা বলার আছে, দাদা...’’ 

‘‘এর উপর আর কোনও কথা-ফতা নেই।’’ কর্কশভাবে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, ‘‘আইনের উর্ধে কেউই নয়। আইন অনুযায়ী যেটা হওয়া উচিত ঠিক সেটাই হবে, সেটাই করতে হবে।’’

‘‘দাদা, ওরা হলো আমাদের পুরনো পকেট-ভোটার। তার উপর সবসময় বেশ ভালোরকম চাঁদাপত্তর এমনিতে দেয়, ওমনিতেও দেয়।’’

‘‘হুঁ! আর এরা, রেপ খাওয়া পার্টিরা? এদের পজিশনটা কী রকম?’’

‘‘এরা গত ইলেকশান থেকে আমাদের ভোটার। তবে অবস্থা ভালো নয়। খুব টানাটানির সংসার।’’

‘‘তবে এই সেকেন্ড পার্টি, এরা তো কোর্ট কেসের খরচ এমনিতেই টানতে পারবে না। তবু থানায় যাবার বাতিক চাগলো কেন? এর মধ্যে কোনো অপোনেন্ট ঢুকে পড়েছে কিনা সেটা খেয়াল করেছিস?’’

‘‘না না, ওদের কেউ এখনও পিকচারে ঢোকে নি। কিন্তু এদিকে তাহলে এখন কী করা হবে দাদা?’’

‘‘দ্যাখ কাত্তিক, এখানে কয়েকটা পয়েন্ট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তা থেকে কয়েকটা কোশ্চেনও উঠে আসছে।’’ ডান হাতের মধ্যমায় পরা সোনার তৈরি ‘ওঁ’ সেট করা আংটিটা খুব মন দিয়ে দেখতে দেখতে গণপতিবাবু বললেন, ‘‘নাম্বার ওয়ান, মেয়েটা অত ভোরের দিকে উইদাউট প্রপার গার্জেন প্রোটেকশন একা একা মাঠের দিকে কেন গেলো? প্রকৃতির ডাকেই যদি যায় তাহলে তার মা অন্তত সঙ্গে থাকতে পারতো। প্রকৃতির ডাক ছাড়া অন্য কোন কিছুর ডাকে সেদিকে গিয়েছিলো কিনা, সে প্রশ্নটাও উঠবেই উঠবে। নাম্বার টু, ওই ছেলেটা আর মেয়েটা একই পাড়ায় থাকে। সেক্ষেত্রে ওই ছেলেটার সঙ্গে মেয়েটার প্রিভিয়াস কোনো কানেকশান আছে বা ছিলো এমন সম্ভাবনা কিন্তু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নাম্বার থ্রি, মেয়েটা ওই সময়ে, অর্থাৎ রেপের আগে বা রেপের সময়ে খুব জোরে চিৎকার-চেঁচামেচি করলো না কেন?’’

‘‘ঠিক কথা বলেছো দাদা। এই সাইডগুলো ভেবে দেখার কথা আমার মাথাতেই আসেনি।’’

‘‘তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার, মেয়েটা ঠিক কীভাবে কতটা রেপড্‌ হয়েছে তা জানার জন্য শুধু মেয়েটাকে আলাদাভাবে ডেকে একটা স্টেটমেন্ট নিতে হবে আমাকে। তারপর ফাইনাল ডিসিশনে আসতে হবে।’’

‘‘ঠিক আছে। সেসব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু এখন কী করা হবে সেইটা বল। একটা সমাধানে তো আসতে হবে।’’

‘‘সার্টেন্‌লি। এইরকম একটা গুরুতর সমস্যা তো আর ঝুলিয়ে রাখা কোনওমতেই সম্ভব নয়। একটা সবদিক বাঁচানো সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। দ্যাখ, আমার যতদূর মনে হয়, ছেলেটা নেহাৎ ছেলেমানুষি ঝোঁকেই তখনকার মত এই ভুল কাজটা করে ফেলেছে। তবে আর কখনও করবে বলে মনে হয় না। কিন্তু মেয়েটার দিকটাও তো দেখতে হবে। মেয়েটার ব্যাপারে কিন্তু কোনওরকম অবহেলা করা চলবে না। তাকে ভালোমতন ক্ষতিপূরণ দিতেই হবে। দলের ফান্ডেও ডোনেট করতে হবে। মোটকথা, একটা ফেয়ার অ্যান্ড ক্লিন সমাধানে আসতে হবে। এক কাজ কর কাত্তিক, তুই দুটো ফ্যামিলিকেই এখুনি ডেকে আন আমার কাছে।’’

পেটো কার্তিক উর্দ্ধশ্বাসে ছুটলো সম্ভাব্য সমাধানের সন্ধানে...



0 comments: