প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ সুবর্ণ হাজরা
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আর্য মানসে ক্ষুধা, খাদ্য ও ঈশ্বর
সুবর্ণ হাজরা
বাঙালি কবি লিখেছেন, ‘‘পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’’... আর গান্ধীজি বলেছেন, ‘‘ক্ষুধার্তের সামনে রুটি ছাড়া স্বয়ং ভগবানও অন্য চেহারায় আসতে সাহস পান না।’’ এসব না হয় আধুনিক কালের ভারতবর্ষের কথা। কিন্তু যখন সুদূর অতীতের কথা ওঠে, তখনকার সময়কে আজকের ভারতবর্ষের একপাল দুর্বুদ্ধিজীবি যখন স্বর্ণযুগ বলে বর্ণনা করেন, বলেন আর্যভূমি ভারতবর্ষে ‘‘সে ছিলো বড়ই সুখের সময়’’, তখন সেইসময়কার অবস্থা সত্যিই কেমন ছিলো জানতে ইচ্ছে করে। অবশ্য সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে আর্যদের ভারতে আগমন সম্পর্কে একটু বলা দরকার।
আর্যদের এদেশে আগমন পর্ব অনেকটাই কুয়াশাচ্ছন্ন একারণে যে, পরবর্তী কালের ইতিহাসের মতন সেই পর্বের কোনও লিখিত প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্রই যেসব প্রমাণের উপর ভিত্তি করে সেই সময় বা তার চেয়েও বেশী অতীতের ইতিহাস (প্রাক-ইতিহাস) রচিত হয়, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যে আর্যরা এদেশে এসেছিলো তারা যে একবারেই এসেছিলো তা নয়, এসেছিলো দফায় দফায়। প্রায় হাজার দেড় হাজার বছর ধরে। শেষ বড় দলটি এসেছিলো খ্রীষ্ট জন্মের প্রায় দু হাজার বছর আগে। এরা আর্যদেরই দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলো----আলপীয়ান আর নর্ডিক। এর মধ্যে আলপীয়ানরা ছিলো জীবনযাত্রায় তুলনামূলক ভাবে অগ্রসর। তারা শুধুমাত্র পশুপালন নয়, কৃষিকাজও শুরু করে দিয়েছিলো। এমন কি বাণিজ্য পথেও চলতে আরম্ভ করেছিলো। তাদের পরবর্তী সময়ে আসা নর্ডিক আর্যরা ছিলো প্রধানত পশুপালক। তারা পশুর দুধ খেতো, পশুর মাংস খেতো, পশুর চামড়া গায়ে জড়াতো। এরাই আজ আদি হিন্দু শাস্ত্র বলে যা পরিচিত সেই বেদ-উপনিষদের রচয়িতা। ডঃ অতুল সুর এই নর্ডিক আর্যদের সম্পর্কে “বর্বর জাতি” অভিধাটি ব্যবহার করেছেন। উভয় গোষ্ঠীই এসেছিলো মোটামুটি একই জায়গা থেকে।ভাষাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের ভিত্তিতে ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্ত এই যে, বর্তমান রাশিয়ার উরাল পর্বতমালার দক্ষিণদিকের শুকনো ঘাসে ঢাকা সমতল ভূখণ্ডই আর্যদের আদি বাসস্থান। এখানে নর্ডিক ও আলপীয়ান দুই গোষ্ঠীই বসবাস করতো।‘আর্য’ শব্দটি সেইসময়ে জাতিবাচক না হয়ে ভাষাবাচক পরিচিতির শব্দ ছিলো, অর্থাৎ ‘আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী’বলে তারা চিহ্নিত হতো। এরা পূর্বদিকে যাত্রা করে ইরানের ভেতর দিয়ে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়ে এদেশে ঢুকে আসে। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা আর্যদের ইন্দো-ইরানীয় বা ইন্দো-আর্যভাষী বলে চিহ্নিত করেছেন। ইরান থেকে যে গোষ্ঠী পূর্বদিকে ভারতে না এসে ইউরোপে চলে গেলো, তারা চিহ্নিত হলো ইন্দো-ইউরোপীয়ান বলে। ইন্দো-ইরানীয় বা ইন্দো-আর্যদের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো ইরানে থেকে যাওয়া আর্যদের। ভাষাও এত কাছাকাছি ছিলো যে ইরানের আবেস্তা আর ঋগবেদের গোড়ার দিকের ভাষা প্রায় এক। সেটি ছিলো আর্যভাষা। পরবর্তীকালের ঋগবেদের ভাষা মার্জিত হয়ে প্রথমে দেবভাষা ও পরে সংস্কৃত বলে পরিচিত হয়। দেবভাষা হওয়ার কারণ এই যে, ঋগবেদের এই পর্যায়ের সমস্তটাই ছিলো দেবতাদের কাছে, বিশেষতঃ ইন্দ্র, অগ্নি, মিত্র, বরুণ ইত্যাদি দেবতাদের কাছে প্রার্থনার ভাষা। ‘সংস্কৃত’শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভাষাটির উন্নতির কথা — যার সংস্কার করা হয়ে গেছে, তাই সংস্কৃত।
আর্যরা যখন এদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) এসে প্রথম ডেরা বসালো, তখন তারা কৃষিকাজ জানতোনা। ছিলো মূলত মাংসখেকো যাযাবর। তাদের খাদ্যাভ্যাস শতপথ ব্রাহ্মণে প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে “প্রথমে দেবতারা একজন মানুষকে বলি স্বরূপ উৎসর্গ করলেন। তার উৎসর্গীকৃত আত্মা অশ্বদেহে প্রবেশ করলো।দেবতারা অশ্বকে উৎসর্গ করলেন। উৎসর্গীকৃত আত্মা বৃষদেহে প্রবেশ করলো। বৃষ উৎসর্গীকৃত হলে তার আত্মা মেষদেহে প্রবেশ করলো। মেষ উৎসর্গীকৃত হলে তা ছাগদেহে প্রবেশ করলো। ছাগ উৎসর্গীকৃত হলে তার আত্মা পৃথিবীতে প্রবেশ করলো। দেবতারা পৃথিবী খনন করে গম ও যব আকারে ঐ আত্মাকে পেলেন।” এই কাহিনীটি জানাচ্ছে আর্যদের খাদ্যাভ্যাসের বিবর্তন তথা সামাজিক পরিবর্তনের কথা। এর থেকেই প্রমাণিত হয়, তাঁরা যখন এদেশে এসেছিলেন, তখন ছিলেন মাংসাশী, এমন কি হয়তো বা অন্যান্য আদিম মানুষের মতন নরখাদক। পরবর্তীকালের রচনাগুলিতেও অনেক জায়গায় যজ্ঞে কিম্পুরুষ বলি দিয়ে তার মাংস খাবার কথা উল্লিখিত আছে। পরবর্তী কালে এঁরা কৃষিকাজ শিখেছিলেন। এঁরাই এদেশে অশ্ব নিয়ে এসেছিলেন, তার আগে এদেশে অশ্ব ছিলোনা। যদিও গাধা ছিলো। এদেশের প্রাগার্য মানুষ যাতে অশ্ব না পায় তার জন্য আর্যরা সচেষ্ট ছিলেন। এর প্রমাণ ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলেই ব্যাকুল প্রার্থনা “ইন্দ্র, অসুরদের অশ্ব দিওনা।” এই ঘোড়ার মাংস খাওয়ার একটা বড় অনুষ্ঠান ছিলো অশ্বমেধ যজ্ঞ। ঋগবেদের মণ্ডলে মণ্ডলে তো বটেই, উপনিষদেও বার বার বর্ণিত আছে শুধু অশ্ব নয়,বৃষ,গাভী,গোবৎস,মহিষ, গাধা সমেত প্রায় সমস্ত প্রাণীর মাংস তাঁরা খেতেন। এমন কি চিতাবাঘ ও গণ্ডারও বাদ যেতোনা। অতিথি এলে সমাদর করে তাঁকে গোরুর মাংস খাওয়াতেন। এই জন্যই অতিথির অন্য পরিচয় ছিলো ‘গোঘ্ন’ অর্থাৎ যাঁর জন্য গোহত্যা করা হয়।পরবর্তীকালে পাণিনি এই বিশেষণটির উল্লেখ করেছেন। গোঘ্নর মতই আরেকটি শব্দ ‘অতিথিনীর্জা’র উল্লেখ ঋগবেদে আছে, যার অর্থ অতিথির খাদ্যের উপযোগী গোরু। গোরু বা গো-বৎস ভক্ষণ করতে না পারলে বেদ-উপনিষদের রচয়িতা ব্রহ্মজ্ঞানী মুনি ঋষিরাও রুষ্ট হতেন। অশ্বমেধের অশ্বমাংসের মতই গোমাংস ভোজনের বড় যজ্ঞগুলি ছিলো রাজসূয়, গোমেধ, বাজপেয় ইত্যাদি।প্রসঙ্গত, বাজপেয় যজ্ঞের পুরোহিতদের বলা হতো বাজপেয়ী (অটল বিহারী মাফ করবেন)! কিন্তু এই নিবন্ধ যেহেতু ‘গোরুর রচনা’ নয়, তাই এবার প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক।
আর্যরা খাদ্যাভাবে পীড়িত ছিলেন, এ সত্য গোপন রাখার কোনও জায়গা নেই। ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলেই পাঁচ এর সূক্তে ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে, “অন্ন নিয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত হোন।” এছাড়াও অজস্রবার অন্নের জন্যে প্রার্থনা করতে দেখা যাচ্ছে। এঁরা ক্ষুধার্ত হয়েই প্রার্থনা করতেন অবশ্যই। কিন্তু এঁদের কাছে ক্ষুধার রূপ কি ছিলো ? খাদ্যের বা জলের মহিমাই বা কি ছিলো?
আর্যদের কাছে ক্ষুধার শেষ পরিণতি অজানা ছিলোনা। বেদ এবং উপনিষদ উভয়েতেই এ বিষয়টি একধিকবার আলোচিত হয়েছে, যাতে প্রমাণিত হয় আর্য জনসমাজে ক্ষুধা তার ভয়াবহতার ছাপ রেখেছিলো। উপনিষদে তাই বলা হয়েছে “ক্ষুধাই মৃত্যু।” একটি উপাখ্যানেও বলা হয়েছে, প্রাণীর ক্ষুধা নিবৃত্তির দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তার। ব্রহ্মা দেখলেন ক্ষুধার জন্য তাঁর সৃষ্ট প্রাণীকুল বিনষ্ট হচ্ছে।তখন তিনি স্তনের সৃষ্টি করলেন।
আর্যদের কাছে ব্রহ্মই আদি, তিনিই সর্বোচ্চ অজ্ঞেয়, অবাঙমানসগোচর। ব্রহ্মর স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে। যেমন শব্দই ব্রহ্ম, আলোই ব্রহ্ম, ইত্যাদি। কিন্তু ক্ষুধার বিষয়ে বলতে গিয়ে সেখানেও ব্রহ্মকে টেনে আনা হয়েছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে স্পষ্ট ভাবেই বলা হয়েছে, “প্রথমে কিছুই ছিলোনা, সব মৃত্যু দিয়ে আবৃত ছিলো, ক্ষুধা দিয়ে—ক্ষুধাই মৃত্যু।” আবার “ক্ষুধা মানুষের শত্রু একথা যে জানে সে ক্ষুধারূপ শত্রুকে হণন করে”, এও বলা হয়েছে। অন্ন শব্দের প্রকৃত অর্থ খাদ্য। কিন্তু আজ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাত। যদিও আর্যদের কাছে মাংস, গম, যব সবই ছিলো অন্ন। উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে অন্নই জীবন। অন্নই ব্রত। অন্নই ভদ্র। জলের প্রয়োজনীয়তার কথা বার বার বলা হয়েছে। বলা হয়েছে জল (অপ বা আপ) অন্নের জন্মদাত্রী।
ছান্দোগ্য উপনিষদের ‘অন্নব্রহ্ম’ অধ্যায়টি উল্লেখযোগ্য। এখানে বলা হয়েছে অন্নকে উপাসনা করো। অন্নই ব্রহ্ম। এবার আর্য মুনিঋষিদের ব্রহ্মবিদ্যা মাটিতে নেমে এলো প্রাগার্যদের চাষাবাদে। সকল দেবতার উপরে যেমন ব্রহ্মের স্থান (গার্গী- যাজ্ঞবল্ক সংলাপ স্মর্তব্য), তেমনই সকল বস্তুর উপরেই অন্নের স্থান। এই অন্ন কেবলমাত্র ফসল নয়। যা সাধারণ ভাবে অখাদ্য, ক্ষুধাপীড়িত আর্যদের দৃষ্টিতে প্রাণ বাঁচাতে তাও খাদ্য—অন্ন। ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রাণকে সর্বেন্দ্রিয়ের উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রাণ ইন্দ্রিয়দের কাছে জানতে চেয়েছে তার রক্ষার উপায় কি? উত্তরে সর্বেন্দ্রিয় জানাচ্ছে, কুকুর, শকুনি সহ সর্বজীবের যা কিছু অন্ন আছে, সেই সব।‘অন’শব্দটি প্রাণের অন্য নাম। যে তা জানে তার কাছে কোনও অন্নই অনন্ন হয়না। অর্থাৎ কুকুর বা শকুনের মাংসই শুধু নয়, তারা যা খায় তাও অন্ন। ‘অন’কে রক্ষা করার জন্য যা খাওয়া হয়, তাই অন্ন।
ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের উষন্তি উপাখ্যান মনে করা যাক। স্থানাভাবের জন্যে এখানে সম্পূর্ণ বর্ণনা করা গেলোনা। উষন্তি বলেছিলেন,প্রাণই মূল দেবতা। অন্নই দেবতা। সেজন্য মাহুতের এঁটো মাষকলাই খেতেও উষন্তির বাধেনি, কারণ সেই প্রাণরূপ দেবতার উপাসনা। মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে“তপস্যার দ্বারা ব্রহ্ম পাওয়া যায়। তার থেকে অন্ন জাত হয়। অন্ন থেকে প্রাণ,মন,সত্য।আর ব্রহ্ম যদি পরম সত্য হন, তবে অন্নই পরম সত্য।” উষন্তির ঘটনা তবু একরকম। কিন্তু ঋষি বামদেবের কাহিনী এবং বক্তব্য বেদের স্বর্ণ যুগে প্রকৃত অবস্থা কি ছিলো তা তুলে ধরেছে। ঋষি বামদেব বলেছেন, “অভাবের জন্য আমি কুকুরের নাড়ীভুঁড়ি খেয়েছি। দেবতারাও কেউ সাহায্য করেন নি। স্ত্রীকে চূড়ান্ত অবমানিতা হতে দেখেছি।” খাদ্যাভাব ও ক্ষুধা কতটা তীব্র হলে সেই “স্বর্ণযুগে” এই অবস্থা হয়! এ প্রসঙ্গে উপনিষদে বর্ণিত মহর্ষি বিশ্বামিত্রের কুকুরের মাংস খাওয়া এবং অগ্নিতে সেই মাংস আহূতি দেওয়ার কথাও মনে করা যায়।
আর্যদের উদর চিন্তায় কখনও নিরামিষ ভোজনের কথা ছিলোনা। শতপথ ব্রাহ্মণেও বলা হয়েছে, “সব খাবারের সেরা খাবার মাংস।” আর মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক যেটুকু বাকী ছিলো, তারও পাদপূরণ করে দিয়েছেন এই বলে যে, সব মাংসই খাবার, কিন্তু তিনি পছন্দ করেন গো-মাংস। গোরু নেহাৎ ই খাদ্য। আর্য সাহিত্যে, ঋগবেদ থেকে শুরু করে সর্বত্রই, এমন কি অনেক পরের মহাভারতেও গোমাংস ভোজনের উল্লেখ করা আছে। দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন রচনায় গোমাংস ভোজনের কথা অস্বীকার করা হয়নি। যে সত্য এখন অস্বীকার করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে যে আর্যরা গোরু বলতে গাভী, ষাঁড়, বলদ সবই ধরতেন।গুহ্যসূত্রগুলিতে কোন অনুষ্ঠানে কটি ষাঁড় বা কটি বলদ বা কটি গাভী বলি দিতে হবে, তাও নির্দিষ্ট করা আছে। এমন কি তার মধ্যে কটি বাঁজা হতে হবে, তাও। উপনিষদগুলিতে বার বার বলা হয়েছে, যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে গোবধ এবং তার মাংসাহার ছিলো খুব সাধারণ ব্যাপার। এমন কি শ্রাদ্ধেও গোবধের কথা গুহ্যসূত্রগুলিতে বলা আছে। আজও ‘বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ’করে থাকেন নানা শ্রাদ্ধাধিকারীরা। এই ‘বৃষ- উৎসর্গ’ যে প্রকৃতপক্ষে আর্যদের সময়কালীন ষাঁড় বা বৃষ বলি, তা আজ পুরোহিতকে মূল্য ধরে দিয়ে আসল সত্যকে ঢেকে দেওয়ার অপচেষ্টা। শ্রাদ্ধের মত বিবাহ, সীমন্তোন্নয়ন, সন্তান জন্মের মতন সব উৎসবেই বৃষ বলি দেওয়া হতো। উদাহরণ স্বরূপ সম্পূর্ণতই ব্রাহ্মণদের‘গবাময়ন যজ্ঞ’। এই যজ্ঞে তিনটি বন্ধ্যা গোরু বলি দেওয়া হতো।বশিষ্ঠ ধর্ম সূত্রানুযায়ী কোনও কারণে অন্য মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হলেও গাভী ও ষাঁড়ের মাংস খাওয়া অনুমোদিত। গোরুকে আর্য সাহিত্যে ‘গোধন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যদিও পশুপালক আর্যদের অন্যান্য পশুও ছিলো। দুধ-মাংস ছাড়াও গোরুর কোনওকিছুই ফেলা যেতোনা। গোবধ পরবর্তীতেও গোরুর চামড়া যোদ্ধা আর্যদের গুরুত্বপূর্ণ কাজে আসতো।যেমন,গোরুর চামড়া দিয়ে ধনুকের ছিলা তৈরী হতো। রথের সংযোগকারী অংশ গোরুর চামড়া দিয়ে তৈরী রশি দিয়ে বাঁধা হতো। অস্ত্রশস্ত্র শরীরের সঙ্গে বা রথের সঙ্গে অথবা ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে রাখার জন্যও গোরুর চামড়া থেকে বানানো রশি ব্যবহার করা হতো। অঙ্কুশ বা চাবুক তৈরী হতোগোরুর চামড়া ও লেজ দিয়ে। এছাড়া গোরুর চামড়া দিয়ে তৈরী হতো পরিধেয় ও তাঁবু। স্মর্তব্য, সেই স্থান বা সময়ে তুলোর ব্যবহার ছিলোনা। গোরুর চামড়ার এতরকম ব্যবহারও কিন্তু গোহত্যাকেই নির্দেশ করে। মনুস্মৃতিতে ভক্ষণযোগ্য পোষা প্রাণীদের তালিকায় হস্তী এবং উট ছাড়া গোরু সমেত সমস্ত প্রাণীকেই ভক্ষ্য বলা হয়েছে। তাঁর টীকাকার মেধাতিথি বৈদিক ও বৈদিকোত্তর যুগে গোরু ও অন্যান্য পোষা প্রাণীর মাংস (গব্যজমাংসম) ভক্ষণ আর্যরীতি ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন। এরকম উদাহরণ দ্বাদশ শতকের সংস্কৃত সাহিত্যেও পাওয়া যায়। হাজারে হাজারে এই রকম উদাহরণ থেকে দেখা যায় আর্য মানসে গোরু সমেত প্রায় সমস্ত প্রাণীর মাংস ভক্ষণ আর্যরীতির অঙ্গ ছিলো।
স্মৃতি থেকে উপনিষদের একটি ছোটো কাহিনীর উল্লেখ করে এই প্রসঙ্গের ইতি টানব। মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে গেছেন মহর্ষি জমদগ্নি। বশিষ্ঠ তাঁর দুই শিষ্যকে বললেন, “গব্যজমাংসম” সহ মুনির উপযুক্ত সৎকার করতে। বিলম্ব দেখে এবং মহর্ষি জমদগ্নিকে ক্ষুধায় কাতর দেখে বশিষ্ঠ শিষ্যদের ডেকে পাঠালেন। শিষ্যরা এল রুধিরাক্ত। বশিষ্ঠ বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে তারা জানাল যে সবচেয়ে বড় বৃষটিকে কবজা করে কাটতে সময় লেগেছে। বশিষ্ঠ তিরস্কার করে বললেন, “তোমরা দেখছো মুনি বয়োবৃদ্ধ। তোমাদের উচিৎ ছিলো একটি নধর বাছুর কাটা।” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। মহাভারতেও উল্লেখ আছে চর্মণ্বতী নগরীর রাজা মহাত্মা রন্তিদেবের পাকশালায় প্রতিদিন অন্তত দুহাজার পশুবধ হতো, যার বহমান রক্ত নদীর সৃষ্টি করেছিলো। এর অধিকাংশই হতো গাভী, বৃষ বা বলদ। লোককথা অনুযায়ী এই চর্মণ্বতী আজকের চম্বল। রক্ত নদীর ধারাও আজকের চম্বল নদী।
চরক, সুশ্রুত ও বাণভট্ট, আয়ুর্বেদের তিন দিকপাল বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য গোমাংস ভক্ষণের নিদান দিয়েছেন। শেষ করার আগে স্বামী বিবেকানন্দের কথা মনে করিয়ে দিই- “এই ভারতের এমন এক সময় ছিলো যখন গোমাংস ভোজন না করিলে ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব থাকিতনা। বেদ পাঠ করিলে দেখিতে পাইবে কোনও বড়ো সন্ন্যাসী বা রাজা কিংবা অন্য কোনও বড়লোক আসিলে...গোহত্যা করিয়া তাঁহাদিগকে ভোজন করাইবার প্রথা ছিলো।”
বলার অনেকই আছে। বিস্তারিত বলারও। কিন্তু নেহাৎই স্থানাভাব। পাঠকের ধৈর্যের কথাও ভাবা দরকার। তাই এখানেই দাঁড়ি টানি। অলমিতি বিস্তারেন।
আরো পড়ুনঃ-
১) The Myth of the Holy Cow—D. N. Jha
২) Advent of the Aryans in India—R.S.Sharma
৩) The Prehistoric Background of Indian Civilization—D.H. Gordon
৪) Looking for the Aryans —R.S. Sharma
৫) The Vedic People—Rajesh Kochhar
৬) Material Culture & Social Formations in Ancient India—R . S. Sharma
৭) সিন্ধুসভ্যতার স্বরূপ ও অবদান—অতুল সুর
৮) হিন্দু সত্তায় গোমাংস— দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা
৯) বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য —সুকুমারী ভট্টাচার্য
১০) বৈদিক সভ্যতা—ইরফান হাবিব, বিজয় কুমার ঠাকুর।
পরিশ্রমী লেখা । সবটাই পড়লাম । ভালোই লেগেছে ।
ReplyDelete