0

ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক



জল রেখা ২
নন্দিনী সেনগুপ্ত



বেশী দূরে নয়, ঐ তো সামনেই... আরও কয়েকটা সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে গেলেই দেখা যাবে। অনেকে হাঁটছে, কেউ হাঁপাচ্ছে, কেউ বা থেমে গিয়ে বসে পড়ছে চড়াই ঢালে পাহাড়ের সিঁড়িগুলির উপর। নীরদা একটুও থামছে না। ওর ছোট্ট ছোট্ট পায়ে অশেষ স্ফূর্তি। এক্ষুনি দেখা যাবে মন্দিরের মাথায় সোনার কলস। লাফ দিয়ে দিয়ে উঠে যাচ্ছে ও। পিছন থেকে কে যেন ডাকছে ‘নীরু, নীরু, আস্তে আস্তে... অত তাড়াহুড়ো করিসনা, হাঁপিয়ে যাবি।’ নীরদা শুনছে না। সামনে অনেকগুলি মেঘ। ও জানে, এখনি মেঘগুলো সরে যাবে। দূরে ঘণ্টা বেজে উঠছে। আবছা আবছা শোনা যাচ্ছে, কে যেন মন্ত্রোচারণ করছে। কিন্তু মেঘগুলো এভাবে ওকে ঘিরে ধরছে কেন? ও কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না। রাস্তা কোথায়? পাহাড়ের সিঁড়ির ধাপগুলো আর দেখা যাচ্ছেনা। মেঘের মধ্যে দাঁড়িয়ে নীরদা ভিজে চুপ্পুস। পিছন থেকে কে যেন ডাকছিল, সেই ডাকটাও আর শোনা যাচ্ছেনা। কিন্তু মন্ত্র আরও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। কে যেন ওকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে। মেঘগুলো, না কি কোনও মানুষ? নীরদা বুঝতে পারছিলনা। আবার শোনা গেল ডাকটা... ‘‘নীরু, নীরু, আমি, আমি... চোখ খোল, দেখ।’ নীরদা চোখ খোলে, দেখে... হে ভগবান, কোথায় গেল পাহাড়, মন্দির, মেঘ, ও ত শুয়ে রয়েছে ঠাম্মার বিছানায়। ঠাম্মাই ওকে ডাকছিল এতক্ষণ। মন্ত্রের আওয়াজ স্পষ্ট হয়ে ভেসে এল দাদুর কণ্ঠস্বরে। কোষাকুষিতে গঙ্গাজল নিয়ে সারা বাড়িতে ছিটিয়ে ছিটিয়ে বলে যাচ্ছেন... 

ওঁ নমো অপবিত্রো পবিত্রোবা সর্বাবস্থা গতোহপিবা।। 

যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং সঃ বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।। 



ঠাম্মা গজর গজর করে উঠছিল, ‘হঃ, তোমার ঐ কৃষ্ণস্মরণে যদি সব শুচি হয়, তয় আর এত জল ছিটাইয়া বাড়িঘরদুয়ার ভিজাও ক্যান?’ দাদু কোনও কথা না বলে এবং মন্ত্র না থামিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে থাকত বাড়ির এক ঘর থেকে অন্য ঘরে। নীরদার মাথায় সত্যিই এক দুফোঁটা জল পড়েছিল, তবে মেঘের থেকে নয়, দাদুর কুষি থেকেই। 



নীরদার অদ্ভুত লাগছিল। হ্যাঁ, এই ঘটনা সেই শিশুকাল থেকে শুরু হয়েছে। সেই মেঘ, পাহাড়, চড়াই ঢাল আর মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ফিরে ফিরে আসে ওর স্বপ্নের মধ্যে। মোট কতবার ও এই স্বপ্নটাই দেখেছে, তার হিসেব নেই। কোনওবার নীরদা পাহাড়ের চূড়ায় থাকা সেই মন্দিরটা স্বপ্নে দেখতে পায়না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে স্বপ্নের ভিতরে বুঝতে পারে পাহাড়ের চূড়ায় একটা মন্দির আছে। এখন এই নীরদা, এই আঠেরোর দোরগোড়ায় দাঁড়ানো নীরদাও মাঝে মধ্যে দেখে এই স্বপ্নটা। বিশেষ কোনও মানসিক চাপে বা পরীক্ষার আগে ফিরে আসে এই স্বপ্ন। ও ভাবার চেষ্টা করেছে অনেক। কেন দেখে ও বার বার একই স্বপ্ন? কেন মন্দিরের মাথায় স্বর্ণকলস দেখবার জন্য এক অদ্ভুত আকুলতা কাজ করে ওর স্বপ্নের মধ্যেও? হঠাৎ মনে হল নীরদার যে, ও তো কখনও স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে দেখতে পায়না। ছোট্টবেলায় যেরকম দেখত ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ভাঙছে পাহাড়ের চড়াই ঢালের সিঁড়ি, এখনও কি তেমনটাই দেখে? নাকি স্বপ্নের অন্য জিনিসগুলো, বিশেষত মেঘ, এভাবে ওকে ঘিরে ধরে যে ও নিজেকে ঐ স্বপ্নের মধ্যে দেখতেই পায়না। কেমন হয় যদি আরেকবার, আরেকবার আসে ঐ স্বপ্নটা, ও তখন অন্য কোনওদিকে না তাকিয়ে নিজের হাত পায়ের দিকে তাকাবার চেষ্টা করবে। তাহলে, হ্যাঁ, ঠিক তাহলেই ও বুঝতে পারবে যে স্বপ্নটা একই রকম ঘ্যানঘেনে ধরণের হলেও, ও নিজে বড় হয়ে গেছে আগের থেকে। সেই শিশুটি আর নয় ও। কিভাবে হাঁটে ও ঐ স্বপ্নটার মধ্যে? সেই শিশুবেলার মত দৌড়ে দৌড়ে, নাকি এখন যেমন অনেক ধীর-স্থির ভাব এসেছে ওর হাঁটাচলায়, সেরকমভাবে? এতদূর ভেবে ও নিজের মনেই হেসে ফেলে। ভেবে দেখলে স্বপ্নটা ঠিক ততটা ঘ্যানঘেনেও নয়। প্রথমদিকে তো বেশ একটা আবিষ্কারের উত্তেজনার মত লাগে। কিন্তু তারপর, মেঘগুলো ঘিরে ধরলেই, একটা চাপা ভয় কাজ করতে শুরু করে। বহুদিন এরকম হয়েছে যে ঐ স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙে গিয়ে আর বাকি রাতটুকু ঘুমাতে পারেনি নীরদা। এটা কি ওর মানসিক অসুখ? কিন্তু এটা ও কাকে বলবে? যদি লোকজন হেসে উড়িয়ে দেয়? এই যেমন এতকিছু ভেবে ও নিজের মনে একা একাই হাসছে...? 





হ্যাঁ, সত্যিই শিশুকালে ও সবসময় দৌড়ে দৌড়ে চলাফেরা করত। হাঁটত না। বলা চলে, হাঁটতে জানতোই না নীরদা। শিশুবেলায় ওকে আর ওর ছোট ভাই নীলকে নিয়ে বাড়ির কাজের লোক দেবলামাসি পার্কে যেত। নীল ওর চেয়ে ছোট অনেক। হ্যাঁ, প্রায় সাত বছরের ছোট। নীরদা ‘খুড়তুতো ভাই’ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতোই না। ও জানতো নীল ওর ভাই। একদম আপন। একদম নিজের সম্পত্তি যেরকম। আগলে আগলে রাখতে চাইত সবসময়। দেবলামাসিকে ও ডাকত ‘দেয়াসি’ বলে। এখনও তাইই ডাকে। দেয়াসি একদিন খুব রেগে গেলো, বলল, ‘ও মেয়ে, তুমি আস্তে হেঁটে চলতে পার না? খালি খালি দৌড় লাগাচ্ছ। এদিকে ভাইয়ের গাড়ি নিয়ে কি আমি দৌড়াতে পারি! আজ যদি না হেঁটে আমার সঙ্গে একসাথে ধীরে সুস্থে না যাও, --- চলো বাড়ি। ঠাম্মার পাখার ডাঁট দিয়ে তোমার পায়ে এমন একটা বাড়ি দেবো, বুঝবে দৌড়োবার মজা।’নীরদা জানত এসব হল কথার কথা। দেয়াসি মুখে যতই চীৎকার করুক না কেন, নিজে তো দূরের কথা, অন্য কেউ যাতে নীরদাকে ছুঁতেও না পারে, সেদিকে থাকতো দেয়াসির কড়া নজর। দেয়াসির বিশাল লম্বা চওড়া চেহারা ছিল। সবাই ভয় পেত। কোনও দুষ্টু বাচ্চা নীরদা এবং নীলের ধারেকাছে ঘেঁষত না পার্কে। একবার দেয়াসি দেশে গেলো কিছুদিনের ছুটিতে। ব্যস, দাদুর উপর ভার পড়েছিল পার্কে বাচ্চাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসার। উফ, সে কি কাণ্ড! এখনও মনে পড়লে নীরদা হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায়না। দাদু ধীরস্থির মানুষ। চুপ করে নীলের প্র্যাম নিয়ে পার্কের এক কোণায় একটা বেঞ্চিতে বসেছিলেন। পাশে বসা পাড়ারই কোনও মানুষের সাথে দেশ এবং দশ নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন। নীরদা বনবন করে পার্কময় দৌড়াচ্ছিল। হঠাৎ ও চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ্য করলো পাড়ার ডাকসাইটে বদমাশ ব্যাদড়া বাচ্চা বুতান – নীলের প্র্যামের খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বুতান নীলের নাক ধরে ঝাঁকাচ্ছিল, আবার বলছিল, ‘এটা কি সত্যিকারের বাচ্চা? না কি পুতুল? কোনও আওয়াজ করে না, কাঁদেও না। দেখি রোজ আসে, আজ বুঝে নেবো একবার।’ নীল সত্যি খুব শান্ত বাচ্চা ছিল। নীরদা প্রায় উড়ে পৌঁছে গিয়েছিল নীলের কাছে। তারপর লাফ দিয়ে পড়েছিল বুতানের ওপর। কিল, চড়, ঘুঁষি একনাগাড়ে চালিয়ে যাচ্ছিল। বুতান ওর থেকে বেশ কিছুটা বড় হলেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল এই হঠাৎ আক্রমণে। কারণ, বুতানের বিশেষ খ্যাতি ছিল দুষ্টু বাচ্চা বলে। কেউ উল্টে ওকে কখনও আক্রমণ করত না। সবাই বুতানের কাছে মার খেয়ে আসত। আক্রমণ করা ত দূরের কথা, কেউ পাল্টা মারও দিত না। নীরদা ঐ মুহূর্তে করেছিল সেই বিরল কাজটা। নীলকে বাঁচানোর জন্য। নীরদার দাদু, আরও এক দুজন পাড়ার মানুষ যারা পার্কে হাঁটছিলেন বিকেলে – সবাই এসে ওদের মারামারি থামিয়েছিলেন। বুতানের মা, সর্বদাই যিনি সন্ত্রস্ত থাকতেন কখন কোথা থেকে ছেলের নামে কি নালিশ আসে এই ভয়ে, তিনিও চলে এসেছিলেন দৌড়ে। দাদু স্বভাবসুলভ ভদ্রতায় বুতানের মাকে বলছিলেন, ‘আমার দিদিভাই ত কখনও এরকম করে না। সে ত অশিষ্ট বালিকা নয়। আজ সম্ভবত... যাই হোক, আমি ক্ষমাপ্রার্থী! শিশুদের বাদানুবাদে বিশেষ গুরুত্ব না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।’ বুতানের মা বোধহয় হাঁফ ছেড়েছিলেন দাদুর আশ্বাসবাণী পেয়ে। আজও মনে পড়লে নীরদার আফশোষ হয় যে, সে কেন ঐদিন মেরে বুতানের নাকটা ফাটিয়ে দিতে পারেনি। তাহলে আর দাদুর ভদ্রতাটা এত অসহ্য লাগত না ঐসময়। নীলের নাকে এক-দুটো আঁচড় লেগেছিল বুতানের নখ থেকে, তখন যদি ও না দেখত, হয়তো আরও কিছু করে বসত ঐ অপরিণামদর্শী বালক। জানে না নীরদা এখনও, কেন, কিভাবে ঐ মুহূর্তে অতখানি হিংস্র হয়ে উঠতে পেরেছিল সে! নীলের জন্য? শুধুই কি তাই? নাকি তার নিজের জলের মত ঠাণ্ডা স্বভাবের নিচে খেলা করছে কোনও হিংস্র চোরা স্রোত!

0 comments: