প্রবন্ধঃ অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
পর্নোগ্রাফির আশীর্বাদ
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য
এ যেন ভুতের মুখে রাম নাম। পর্ণোগ্রাফি। যে শব্দটার মধ্যেই অশ্লীলতা। নৈতিকতার পতন। মানবতার স্খলন। এরকম হাজার বিশেষণ-বিশেষ্য পদের সমাহার, সমার্থক হয়ে যায় পর্নোগ্রাফি শব্দটার সাথে। সেই পর্নোগ্রাফি কিনা আশীর্বাদ। নারীবাদী দৃষ্টিতে পর্নোগ্রাফি অভিশাপ। সেই অভিশাপই কিনা আশীর্বাদ! এ যেন শাপে বর। রাজা দশরথের সেই উক্তি। পুত্র না হলে পুত্র শোক হবে কি করে। পর্নোগ্রাফি সেরকমই। এটাই বাস্তব, আজ আমরা যে হাই-স্পীড ইন্টারনেট দেখি, সেটা প্রত্যক্ষ ভাবে পর্ণ ইন্ডাস্ট্রির কাছে ঋণী। আজ আমরা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করি। GPS দিয়ে খুঁজে নিই পথের ঠিকানা। এক ক্লিক। ভিডিও লোড। কিন্তু এর জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকতে হবে সেই অশ্লীল পর্নোগ্রাফির কাছে।
একটা প্রবচন আছে - প্রয়োজনীয়তা থেকেই জন্ম নেয় নতুন আবিষ্কার বা উদ্ভাবন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একদিকে যেমন মানব সভ্যতার কলঙ্ক, তেমনি সেই বিশ্বযুদ্ধ এক লাফে প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে কয়েক যোজন। অপারেশন-রিসার্চ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর অবদান। প্রায় হাজার অপারেশন-রিসার্চ বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টা ছিলো সৈন্যবাহিনীর সাফল্য বা ব্যর্থতার পিছনে। প্রযুক্তি বিদ্যা যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছে কতটা কৃতজ্ঞ, সেটা লিখে শেষ করা যাবে না। হেবার প্রসেস পরিপূর্ণতা পেয়েছে সেই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়। রাতারাতি জার্মানি বানিয়ে ফেলে অ্যামোনিয়া। সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট, ইনভেন্টরি কন্ট্রোল, সব কিছুই সৃষ্টি হয়েছে রাতারাতি।
সেরকম আধুনিক ইন্টারনেট বিকাশ লাভ করেছে পর্ণোগ্রাফির হাত ধরে। প্রথম বা আদি রিপুর তাড়নায় এমন এক ব্যবসা, যা বদলে দিল পৃথিবীর জনসংযোগ পদ্ধতি। প্রথম ইন্টারনেট ওয়েবসাইট যেখানে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা শুরু হয় সেটা একটা পর্ণ সাইট। ওয়েবক্যাম পর্নোগ্রাফির হাত ধরেই নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে। সাথে আসে কাস্টমার delight। প্রয়োজন হয় উন্নত ব্যান্ড উইডথ (width)। যাতে ভিডিও সহজেই পৌঁছে যায় গ্রাহকের হাতে। ইন্টারনেট ছাড়াও পর্ণোগ্রাফি প্রযুক্তিকে অনেক আগে থেকেই উন্নত করেছে। লাইব্রেরি কার্ড ক্যাটালগ সিস্টেম, হোম ভিডিও, সব কিছুতেই সেই পর্নোগ্রাফির অবদান। মোবাইল আসার আগে একটা জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল VCR। সেই জনপ্রিয়তাও এসেছিল পর্নোগ্রাফির হাত ধরে। বর্তমান যুগে পর্ণ ইন্ডাস্ট্রি আয়তনে খুব একটা ছোটো নয়। 2014 সালে বিশ্বব্যাপী যে পরিমান পর্ণ ভিডিও দেখা হয়েছে তাতে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ গড়ে 11 টি পর্ণ ভিডিও দেখেছে সারা বছরে। মোবাইল apps এর প্রায় 36% পর্ণ কেন্দ্রিক। ইউ-টিউব খুললে দেখা যাবে কেমন করে পর্ণ সিনেমা তৈরী হয়। টেকনোলজি, অভিনয়, সব কিছুরই সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগ।
কিন্তু পর্নোগ্রাফির অন্ধকার দিক ঢেকে ফেলছে আলোকে। নিষিদ্ধ শিল্পকলা শিল্প কে কলা দেখিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে নারী শরীরের বেসাতি। MMS বানানোর নির্লজ্জ কৌশল নষ্ট করে দিয়েছে মনুষ্যত্বর সমস্ত ব্যাকরণকে। ফলে, যে ইন্টারনেট পর্ণ ইন্ডাস্ট্রির কাছে ঋণী, সেই ইন্টারনেট আজ পর্ণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নাম করা সার্চ ইঞ্জিন তাদের অ্যালগরিদম পরিবর্তন করেছে।পরিবর্তন হয়েছে আইন ব্যবস্থায়। সেফ মোড সার্চ অন অফ অপশন নিয়ে এসেছে গুগল। পর্ণকে অপসারণ করতে এসেছে নতুন প্রোগ্রাম। তাই আজ শতাব্দী প্রাচীন পর্ণ শিল্প হারিয়ে ফেলছে তার আন্তর্জাতিক বাজার। অন্তর্বাস বিজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে নতুন পথ খোঁজার চেষ্টায় এই ইন্ডাস্ট্রি।
শিল্প পরিবর্তনশীল। জন্ম মুহূর্তে মোবাইল আকারে বড় ছিল। তারপর ছোট হতে হতে মিনি, মাইক্রো। আবার আকারে বড়। অথবা ধরা যাক ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। এক দিকে জিরো সাইজ ফ্যাশন। অন্য দিকে প্লাস সাইজ ফ্যাশন কাঁপিয়ে দিচ্ছে রাম্প। সেরকম পর্ণ ইন্ডাস্ট্রি। নতুন পথে ঠিকই খুঁজে নেবে নিজের পরিচয়। অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম আবার চিনিয়ে দেবে নতুন পথ। হয়তো সেই পথেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি। যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন। কেউ হয়ত কোনওদিন ভাবে নি, সভ্য সমাজ যে পর্ণকে সমাজচ্যূত করেছিলো, সেই পর্নের মধ্যেই লুকিয়ে ছিলো জন্ম লগ্নের ভ্রুণ। যা থেকে জন্মেছে আধুনিক ইন্টারনেট। হয়ত ভবিষ্যতের প্রযুক্তির পথও লেখা আছে সেই সামাজিক বঞ্চনার মধ্যে।
তথ্য সূত্র: The Times of India
0 comments: