0

ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


বানরায়ণ ১৩
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



চারদিকে থই থই করছে রক্ত, মাংস, ঘিলু, চর্বি! পচাগলা শবদেহের গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসছে! কাটা হাত-পা-মুণ্ডু ছড়িয়ে আছে চারপাশে, আর সেই সব রক্তস্রাবী প্রত্যঙ্গগুলোর ভিতর থেকে বীভৎস আর্তনাদ ভেসে আসছে! ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে! পিছিয়ে আসতে আসতে কিসে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। একটা কাটা হাত আর মুণ্ডুর স্তূপ! আমি ওঠার চেষ্টা করলাম প্রাণপণে... কিন্তু হাতগুলো লম্বা হয়ে এসে আমায় সাপটে ধরলো...

ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায়! গলগল করে ঘামছি। উফ্! কি সাংঘাতিক স্বপ্ন! গত তিন দিনের দেখা দৃশ্যগুলো সব একসঙ্গে জট পাকিয়ে স্বপ্নে এসে জুটেছে। যুদ্ধ যে এমন ভয়াবহ হয়, এত নিষ্ঠুর হয়, আমার ধারণা ছিলো না। কেমন একটা উত্তেজনা, একটা খেলা খেলা ভাব নিয়ে এসেছিলাম এখানে। মাত্র তিন দিনের অভিজ্ঞতায় সে সব তালগোল পাকিয়ে গেছে... যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা হাজার হাজার দেহ আর তাদের ছিন্ন অংশগুলোর মতন।

চারদিকে তাকালাম। সার দিয়ে পোঁতা বাঁশের বেড়ার উপর খড় আর নারকোল পাতার চাল দিয়ে ঢাকা অস্থায়ী চিকিৎসাশিবিরের মেঝের উপর সারবদ্ধ বিছানাতে ঘুমে অচেতন আমার সহকর্মীরা। যুদ্ধের যে কি অমানুষিক পরিশ্রম, সে ধারণাও আমার ছিলোনা। যারা যুদ্ধ করছে, তাদের কথা ছেড়েই দিলাম। আমরা, যারা আহতদের পরিচর্যা করছি, তাদেরও নিঃশ্বাস নেওয়ার অবকাশ থাকেনা প্রায়। একের পর এক আহত যোদ্ধা আসতে থাকে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে, কাতরাতে কাতরাতে। সাধারণ সৈনিক থেকে আরম্ভ করে সেনাপতি পর্যন্ত, সবাই। কারও কারও আঘাত অল্প। অল্প শুশ্রুষাতেই কাজ হয়। কেউ কেউ শক্ত লোক। পোড় খাওয়া যোদ্ধা। আঘাতে বিশেষ বিচলিত হয়না। ক্ষতস্থান ধুয়ে, ওষুধের প্রলেপ লাগিয়ে ফিরে যায় যুদ্ধক্ষেত্রে। কেউ কেউ গুরুতর আহত হয়ে আসে। কোনওক্রমে চিকিৎসাশিবির অবধি পৌঁছে মূর্ছিত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিরাময় হয়। কেউ কেউ হয়না। চিকিৎসাশিবির অবধি পৌঁছনোর সৌভাগ্যও হয় না কারও কারও।

এই শেষের দুই দলে তাম্বলি গ্রামের দু’জন ইতিমধ্যেই যোগ দিয়েছে। বুগা আর চম্বুক। দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধের মাঝামাঝি অচেতন বুগাকে ধরাধরি করে চিকিৎসাশিবিরে নিয়ে এসেছিলো পাহান আর আমার অচেনা অরেকজন। বুগার ডান হাতটা কাঁধের কাছ থেকে নেই। ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসা রক্ত ভিজিয়ে দিয়েছে ওর নিজের এবং ওর ডান দিকে থাকা পাহানের কাপড়চোপর, বর্মচর্ম। বুগার সংজ্ঞাহীন মুখটা ফ্যাকাশে, রক্তহীন।

ওকে একবার দেখেই দুঃখিত মুখে দু’দিকে মাথা নেড়েছিলেন সুষেণ। বলেছিলেন, ‘‘প্রচুর রক্তক্ষয় হয়ে গেছে। অনেক দেরি করে ফেলেছো তোমরা ওকে আনতে।’’

আমার বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠলো! আমাদের বুগা! তাম্বলি গ্রামের সেরা তীরন্দাজ! এই ক’দিন আগে অবধিও হাসিখুশি, প্রাণবন্ত মানুষটা! বউ আর তিনটে কচি কচি বাচ্চাকে রেখে চলে এলো আমাদের সঙ্গে অনিশ্চিতের টানে... অমর কীর্তি স্থাপন করে সদর্পে গ্রামে ফিরবে বলে। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনও পেরলো না...

শিবিরে নিয়ে আসার দণ্ড দুয়েকের মধ্যে বুগা বার কয়েক হিক্কা তুলে স্থির হয়ে গেলো। পাহান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলো ওর দিকে। গ্রামে ওদের কুটীর দু’টো পাশাপাশি ছিলো, একটা জাম গাছের তলায়। ছিলো কেন... এখনও আছে। হয়তো পাহানের ছোট মেয়েটার সঙ্গে বুগার যমজ ছেলে দু’টো খেলছে সেই গাছের ছায়ায়... আমরা গ্রাম ছাড়ার আগের দিন বিকেলবেলা যেমন খেলছিলো।

সেদিনই সূর্যাস্তের পর পেলাম চম্বুককে। রামচন্দ্র নিয়ম করেছেন, দিনের শেষে যোদ্ধারা শিবিরে ফিরে আসার পর চিকিৎসাকর্মীরা যাবে যুদ্ধক্ষেত্রে... যেসব আহত যোদ্ধারা সেখানে পড়ে আছে, শুশ্রুষা পেলে যারা হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে, তাদের খুঁজে বার করে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধের শেষে, অর্থাৎ গতকাল সন্ধ্যাবেলা সেই রকম নিয়ম মাফিক গিয়ে খুঁজে পেলাম চম্বুককে। লঙ্কার এক সৈনিকের মৃতদেহ জড়িয়ে পড়ে আছে। যেন পরমাত্মীয়... মৃত্যুর ওপারে গিয়ে মহামিলন হয়েছে।

কাছে গিয়ে বুঝলাম, লঙ্কার সৈনিকের ভল্ল চম্বুকের পেট ফুটো করে দিয়েছে... আর চম্বুকের কুঠার আমূল গেঁথে আছে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাঁধে। কোন জন্মের ঋণ পরস্পরকে শোধ করেছে, কে জানে!

চম্বুকের সাহায্যের প্রয়োজন ছিলো না। ও সব চিকিৎসা-পরিচর্যার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। তাই ওকে বেশিক্ষণ সময়ও দেওয়া গেলো না। যাদের সাহায্য প্রয়োজন, তাদের খুঁজতে হবে। খুঁজে পাওয়া গেলো জনা বিশেককে। তাদের মধ্যে ছিলো ছিম্বু গাঁয়ের দুরন। ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় অচেতন হয়ে পড়েছিলো। আমিই দেখতে পাই। তুলে নিয়ে আসার সময় বুঝলাম, কোনও ভারি অস্ত্রের আঘাতে ডান পা’টা ভেঙে গেছে। সুতরাং, দুরনের বীরগাথারও আপাতত এখানেই সমাপ্তি।

আজও গেছিলাম সূর্যাস্তের পর, মশাল হাতে। আজও শিবিরে নিয়ে আসা হয়েছে তেইশজন আহত সৈনিককে। যুদ্ধক্ষেত্রেই পরিচর্যা করা হয়েছে আরও অনেকের। সবাইকে শিবিরে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। এত জায়গা নেই এখানে। যাদের চিকিৎসা নিতান্তই যুদ্ধক্ষেত্রের মতন খোলা জায়গায় করা যাবে না, বা যাদের নিয়মিত বিরতিতে পরিচর্যা লাগবে, শুধু তাদের আনা হয় শিবিরে। যারা যুদ্ধক্ষেত্রেই রয়ে গেলো, তাদের চাইতে এদের আঘাত গুরুতর হলেও এরা ভাগ্যবান। অন্তত শিবিরের আরামটুকু এদের কপালে জোটে।

হাজার হাজার লঙ্কার সৈনিককেও দেখেছি যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে কাতরাতে। বুড়ো সোমুকের কথা মনে পড়েছে। সে বলেছিলো, ‘‘...তুই মানুষকে বাঁচাস। আমার কাছে যা শিখেছিস, সে সব উজাড় করে দিস সেথায়। শত্রু-মিত্র ভাবিস না... মনে রাখিস, আমাদের জন্য সব মানুষ সমান...।’’ কিন্তু কিছু করার নেই। বিপক্ষীয় আহত সৈনিককে সাহায্য করার নিয়ম নেই যুদ্ধে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সর্বগকে। সুষেণের প্রধান সহকারীদের মধ্যে একজন সে। আমার প্রশ্ন শুনে এমন ভাবে তাকিয়েছিলো আমার দিকে, মনে হয়েছিলো আমি যেন প্রলাপ বকছি! তারপর আর ওদিকে মন দিইনি।

কিন্তু সে তো তখনকার মতন। শিবিরে ফিরে এসে বারবার মনে পড়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা মানুষগুলোর কথা। মনে পড়েছে ঠাকুর্দার কথা... ‘‘...আমাদের কেউ শত্রু হয় না। হলেও তার অসুখে-আঘাতে সে কথা মনে রাখতে হয় না...।’’ যাদের সংজ্ঞা ছিলো, তারা অসহায় চোখে চেয়েছিলো আমাদের দিকে। জল চাইছিলো। জল দিয়েওছি কয়েকজনকে... সর্বগদের দৃষ্টি এড়িয়ে। বা হয়তো ওরা দেখেও দেখেনি। আমার ওইটুকু রীতিলঙ্ঘনকে ছাড় দিয়ে দিয়েছে।

খোলা মাঠে পড়ে থাকা মানুষগুলোর কথা মনে হচ্ছিলো বার বার। ঘুম আসছিলো না। আস্তে আস্তে উঠে বাঁশের বেড়ার চৌহদ্দি পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সামনে দিগন্তজোড়া উন্মুক্ত মাঠ। চিকিৎসাশিবির যুদ্ধক্ষেত্র সংলগ্ন। আহতদের বয়ে আনতে সুবিধার জন্য এই ব্যবস্থা।

মশাল হাতে রক্ষীরা শিবিরের কিনারে টহল দিয়ে ফিরছে। ওরা এই ক’দিনে আমাদের, মানে চিকিৎসাদলের কর্মীদর সবাইকে মোটামুটি চিনে গেছে। তাই আমি যখন আস্তে আস্তে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগোলাম, ওদের একজনের আমাকে দেখে শুধু একটা বিষন্ন হাসি ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়া হলো না।

কিসের যেন অমোঘ টানে, প্রায় নিজের অজ্ঞাতসারেই আমি এগিয়ে চললাম যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। অন্ধকারে দূরে দূরে কিছু ছায়ামূর্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু মানুষের... কিছু মনুষ্যেতর অবয়ব। মনুষ্যেতররা এসেছে খাদ্যের সন্ধানে, আর মানুষ এসেছে নিজের আত্মীয়, বন্ধুকে সেই খাদ্যে পরিণত হতে না দেওয়ার জন্য। এরা বেশির ভাগ লঙ্কার অধিবাসী।

কেমন একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে চলেছিলাম মৃতদেহগুলোর পাশ দিয়ে। সঙ্গে একটা চামড়ার থলেতে খাবার জল ছিলো। কিন্তু কেউ চাইছিলো না। দু’তিন জায়গায় দেখলাম, শেয়ালের দল মৃতদেহ নিয়ে টানাটানি করছে। আমি হুশ্ হুশ্ করে তাদের তাড়া দিলাম। পশুগুলো কিছুটা হটে গেলো বটে, কিন্তু আমি একটু দূরে গেলেই ওরা ফিরে আসবে, আমি জানি। তাজা মাংসের লোভ ক্ষুধার্ত মাংসাশীর পক্ষে সামলানো কঠিন।

শেয়ালের জটলাটা পেরিয়ে এসে হঠাৎ একটু দূরে কিছু অস্বাভাবিক নড়াচড়া চোখে পড়লো। চার’পাঁচজন মিলে কি যেন একটা করছে ওখানে। একটা হাসির আওয়াজও পেলাম মনে হলো। কি হচ্ছে ওখানে এত রাতে?

এগিয়ে গেলাম ঘটনাটা যেখানে ঘটছে, সেদিকে। কাছে গিয়ে দেখলাম, যা ঘটছে, সেটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। পাঁচ জন কিষ্কিন্ধ্যার সৈনিক ঘিরে ধরেছে একটি মেয়েকে। বোধহয় আমারই বয়সী। লঙ্কাবাসিনী, বলা বাহুল্য। গত তিন দিনই যুদ্ধের পর দেখেছি এরকম অনেককে, ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহের স্তূপের মধ্যে মশাল হাতে নিজেদের হতাহত আত্মীয়-স্বজনের সন্ধান করে ফিরতে। এও তাই করতেই এসেছিলো, নিঃসন্দেহে। ফিরতে একটু বেশি দেরি করে ফেলেছে। কিন্তু এই লোকগুলো করতে কি চাইছে?

আরেকটু কাছে গিয়ে বুঝলাম, এরা মেয়েটাকে ধরার চেষ্টা করছে। ধরতে পারছে না, কারণ মেয়েটা হাতের মশালটাকে বিপজ্জনকভাবে ঘোরাচ্ছে। পালাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু এরা এমন ভাবে ঘিরে ধরেছে, যে ফাঁক পাচ্ছে না গলে বেরনোর... আর এরা ক্রমশ বৃত্তটাকে ছোট করে আনছে। ওদের দু’জনের হাতে দু’টো বর্শা জাতীয় অস্ত্র আছে। তাই দিয়ে চাইলেই মেয়েটাকে আঘাত করতে পারে। কিন্তু করছে না। খেলাচ্ছে। ভয় দেখাচ্ছে। লোকগুলো হাসছে। শিকারকে বাগে পাওয়ার লোভী, লালাসিক্ত হাসি।

মহারাণী তারার কথা মনে পড়লো আমার। ‘‘...কোনও নারীর অবমাননা কোরো না কখনও। ...যদি সত্যিকারের পুরুষ হও, কখনও কোনও নারীকে অপমান কোরো না। চরম শত্রুর স্ত্রী-কন্যা-ভগিনীকেও না।...’’ 

এই ক’মাসের উপোসী শরীরের খিদের তাড়নায় এরা সে কথা ভুলে গেছে। ভুলে গেছে রামচন্দ্রের সাবধানবাণী। যুদ্ধযাত্রার আগের দিন সমগ্র বহিনীকে সম্বোধন করার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘‘যে অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে, যে দুষ্কর্মের শাস্তি দিতে আমরা এতদূর এসেছি, আমরা নিজেরা যেন কখনও সেই অন্যায় না করি!’’

এগোতে এগোতে আমি এদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছিলাম। নিজেদের উন্মত্ত উল্লাসে এরা আমার উপস্থিতি টের পায়নি। হঠাৎ একজন তার বর্শাটা দিয়ে মেয়েটির হাতের মশালের উপর মারলো এক ঘা, আর সেটা ওর হাত থেকে ছিটকে পড়লো এক পাশে। মেয়েটার মুহূর্তের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে এবার পাঁচজন সৈনিক পুরুষ একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর... আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো, ‘‘কি করছো কি তোমরা?’’

লোকগুলো একটু চমকে তাকালো আমার দিকে। একজনকে চিনতে পারলাম। নিয়োগশিবিরে পাহানের সঙ্গে যাদের ঝামেলা হয়েছিলো, তাদের একজন। আমাকে দেখে ওদের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। একজন বললো, ‘‘ঠিক সময় মতন এসে হাজির হয়েছে শালা!’’

হো হো করে হেসে উঠে আরেকজন বললো, ‘‘আয়, চলে আয়। তুই-ই বা বাদ পড়িস কেন?’’

বিরক্তিতে, বিতৃষ্ণায় আমার সারা শরীর রি রি করে উঠলো। বললাম, ‘‘তোমরা কি রামচন্দ্রের কথা, মহারাণী তারার কথা ভুলে গেছো?’’

‘‘ওরে, ঠাকুর্দা এসেছে রে আমাদের, জ্ঞানের কথা মনে করাতে!’’ একজন বললো। তিনজন ততক্ষণে মেয়েটার কাপড়-চোপড় ছিঁড়তে ব্যস্ত। যে লোকটা মেয়েটার হাতে মেরেছিলো, সে তার বর্শাটা বাগিয়ে ধরে আমার দিকে এগিয়ে এলো কয়েক পা। দাঁতে দাঁত চেপে একটা অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে বললো, ‘‘চুপচাপ কেটে পড় এখান থেকে। নইলে ওই লাশের ঢিবিতে পড়ে থাকবি।’’

মেয়েটা চিৎকার করছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে বাঁচানোর। আমি কি করবো ভাবছি। এদের সঙ্গে গায়ের জোরে পারার কোনও সম্ভাবনা নেই আমার। বুঝতে পারছি, আমার কথায় এদের কিছু তারতম্য হবে না। তাহলে কি পালাবো? যেমন লোকটা বলছে? নাহলে হয়তো সত্যিই মেরে ফেলবে। দেহটা পড়ে থাকবে এখানে। কেউ টেরও পাবে না...

কিন্তু পালাতে পারলাম না। পা দু’টো যেন আটকে রইলো। তারপর লোকটা যখন আবার একটা বিশ্রী গালাগাল দিয়ে বর্শা তুলে এগিয়ে এলো আমার দিকে, তখন কেমন যেন আমার শরীরটা আপনা থেকেই ডান দিকে নীচু হয়ে একটু ঝুঁকলো, আর ডান হাতটা পাশে পড়ে থাকা একটা লোহার শিরস্ত্রাণ তুলে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে লোকটার মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো।

লোকটা প্রস্তুত ছিলো না। ভাবতে পারেনি আমি এটা করবো। তাই আঘাতটা ঠিক করে এড়াতে পারলো না। ভারি শিরস্ত্রাণটা গিয়ে লাগলো ওর মাথার এক পাশে। আর্তনাদ করে লোকটা বর্শা ফেলে মাথা চেপে ধরে বসে পড়লো মাটিতে।

এবার অন্য লোকগুলোও ঘুরে দাঁড়ালো। মেয়েটাকে ছেড়ে দিলো না। দু’জন ওকে ধরে রইলো, আর বাকি দু’জন হিংস্র মুখে আমার দিকে দৌড়ে এলো।

শরীর শক্ত করে প্রস্তুত হলাম। ক্ষিপ্রতায় এরা আমার সঙ্গে পারবে না। তার উপর পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, নেশা করে আছে। তাই প্রাথমিক আঘাতটা এড়িয়ে যেতে পারবো। কিন্তু তারপর...?

লোকদু’টো প্রায় ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে... আমিও লাফানোর জন্য তৈরি... হঠাৎ পিছন থেকে একটা জলদগম্ভীর স্বর ভেসে এলো...

‘‘কি হচ্ছে এখানে?’’








0 comments: