গল্প - উত্তম বিশ্বাস
Posted in গল্পএকটা কদর্য কলসী! এমন একটা অসুন্দর বস্তুকে গলায় বেঁধে ডুবে মরতে ঘোরতর আপত্তি অহল্যার। নির্জন দুপুরে নদীঘাটে রোজ আসে, আর কলসীটা পাঁড়ে রেখে জলে ঝাঁপ দেয় অহল্যা। শোলার মতো শরীরটা ডুবেও যেন ডুবতে চায় না ওর! কিন্তু আজ সে মরিয়া! কলমি আর কচুরিপানার নিচে পানকৌড়ির মতো একটানা ডুব দিচ্ছিল অহল্যা। আজও সেই অনেকটা জল গিলে, চোখ ফুলিয়ে যখন ডাঙায় উঠে এল, দেখল পাঁড়ে বসে এক চিত্রকর তার কানাউঁচু কলসীটার গায়ে একমনে কীসব চিত্র এঁকে চলেছে। ব্যর্থতায় বিস্ময়ে অহল্যা আধপোড়া খইয়ের হাসিতে ফেটে পড়ল, “হা আমার মরণ রে!”
অহল্যার হাসিতে আরও একটু হলুদ রঙ মিশিয়ে চিত্রকর জিজ্ঞাসা করল, “আঁচল ভর্তি এত বালি কেন তোমার?”
চিত্রকরের কথায় অহল্যা উত্তর করল না। ঘরে গিয়ে স্বামী বাসবকে কলকা করা কলসীটি দেখাতেই বাসব ছোঁ মেরে কেড়ে নিল, “এখন এর দাম কত জান! দাও এষণায় দিয়ে আসি!”
অহল্যার স্বামী এখন প্রায়ই পাল পাড়া থেকে গরম গরম পোড়ামাটির পাত্র কিনে আনে। আর ওটা নিয়ে ঘাটে যায় অহল্যা। চিত্রকরও তাঁর সাধনসিদ্ধ ভঙ্গিতে অহল্যার আবদার মতো ওর গায়ে এঁকে দেয় ফুল, পাখি, শঙ্খ, শালুক আর সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো উঁচু উঁচু ভাতের থালা।
এখন অহল্যার ছোট্ট মাটির ঘরখানা রীতিমত আর্ট গ্যালারি। সংসারের আর পাঁচটা দরকারি জিনিস চোখের সামনে বাধলেই ছুঁড়ে ফেলে দেয় বাসব। অহল্যাও কলসী ফেলে কাঁখে কলসী তোলে। ইদানিং বাসবও চিত্রকরের সাক্ষাৎ পাবার জন্যে কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর ঠিক তখন অহল্যা তার কাপড় আলগা করে কোমরের ক্ষতস্থান দেখায়। বালির ঘষা খেয়ে খেয়ে কী বিশ্রী কালশিটে পড়ে গেছে! বাসব কলসীর নিচে চুন আর হলুদ পুড়িয়ে মোটা করে প্রলেপ লাগিয়ে দেয়। ইদানিং একই কাজ বারবার করে বাসব। সুযোগ পেলেই নরম ঝাড়ু দিয়ে মাটির পাত্রগুলোর গা থেকে ধুলো ঝেড়ে দেয়, সাজিয়ে রাখে। কখনো বা জঙ্গল ফেড়ে পাখির পালক ফুল পাতা এনে গুঁজে দেয় কলসীগুলোর মুখে। বাসবের এমন পাগলামিতে অহল্যা মরমে মরে যেতে চায়! অথচ বাসবের মতো সেও আজকাল ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা বেমালুম ভুলে যাচ্ছে। দিন যত যায়, কোমর ছাপিয়ে ঘাগুলো সব চ্যালার মতো বুকের দিকে ঠেলে উঠতে অহল্যার। গরম চুন হলুদের ভাপ খেয়ে খেয়ে ওর এমন অবস্থা হয়েছে, এখন কলসী তো দূরঅস্ত,... কোমরের ব্যথায় ভালো করে পাশফিরে শুতেও পারে না অহল্যা! গভীর রাতে কুপি জ্বেলে সেও বাসবের মতো কলসীর গায়ের আঁকজোকগুলো দ্যাখে, আর পোড়া পেটের প্রদাহ নিয়ে একা একা হাসে!
অনেকদিন হলো অহল্যা আর নদীতে আসে না। চিত্রকর চাতক চোখে চেয়ে থাকে। একেক সময় ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। দিন ফুরোয়। সন্ধ্যায় নদীস্রোতে কালি ঢেলে ফিরে যায় চিত্রকর। পরদিন আবার আসে।
হঠাৎ একদিন ঈশান মেঘের পাহাড় মাথায় করে অহল্যা এসে দাঁড়াল চিত্রকরের সামনে। চিত্রকর দেখেও যেন দেখতে পেল না। এবার ইচ্ছে করেই অহল্যা ওর সামনে নগ্ন হলো, “কী হে, চিত্র আঁক না আর?”
-“কে অহল্যা?....তোমার পাত্র?”
অহল্যা তার ঘা ভর্তি পেটের ওপর চিত্রকরের হাতখানি চেপে ধরে বলল, “এই তো সেই রাক্ষুসী! ....এবার এর মুখে একগোছা বিশল্যকরণী গুঁজে দাও শিল্পী!”
-“এটা তো পেট। একমাত্র মৃৎপাত্র ছাড়া আর কোথাও আমি আমার রঙের প্রলেপ দিতে পারি না!”
অহল্যা অভিযোগ করে বলে উঠল, “আমার সুন্দরের পাত্রগুলো সব লুঠ হয়ে গেছে শিল্পী!”
চিত্রকর অহল্যার হাত ধরে জলের ধারে নিয়ে এসে বলল, “দেখত ওইগুলো কিনা?”
অহল্যা দেখল সেই সুন্দর আঁকজোক করা কলসীগুলো ঢেউএর মধ্যে একে অপরের সাথে টোকাঠুকি করে ভাসছে।
অহেতুক উদেবেগে অহল্যা উতলা হয়ে উঠল, “কলসীগুলো অমন বিশ্রীভাবে কাৎ হয়ে আছে কেন শিল্পী?”
-“প্রতিটার সাথে একজন করে বিষয় বাসনা বিবাগী বাসবের লাশ বাঁধা আছে। ওর থেকে একটা খুলে নিয়ে এসো!.... পারবে?”
অহল্যা সড়াৎ করে জলের ধার থেকে সরে দাঁড়াল। চিত্রকর আবারও বলল, “কী হলো, পারবে না? যদি ওর গায়ে আজ গুপ্তঘাতককে এঁকে দিই?”
অহল্যা এবার হিড়িম্বার হাসি হেসে বলল, “পাগল! আজকাল জল ছুঁলে আমার শরীর সিসার মতো হয়ে আসে। তাছাড়া এসব অবছেদ্দার মড়া মেরে পাতকের ভাগী আমি হতে যাব কোন দুঃখে শুনি?”
0 comments: