0
undefined undefined undefined

অনুবাদ সাহিত্য - সুলগ্না মুখোপাধ্যায়

Posted in



দেবদূত

বড়দিনের কেনাকাটার পর্ব শেষ করে আমি গাড়ি চালিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম বৃদ্ধাবাসে। কাফেটারিয়ায় কয়েকটি পরিবার তাঁদের পরিবারের বয়োবৃদ্ধদের ঘিরে বসে ছিলেন। কয়েকজন বসার ঘরে বসেছিলেন, আর একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন খালি টেবিলের দিকে। একজন নার্সের গায়ে ছিল কার্ডবোর্ডের ডানা আর কপালে হলদে তারা। আমার মা-বাবা বসেছিলেন তাঁদের ঘরে। আমি বাবার সঙ্গে করমর্দন করলাম আর মায়ের গালে চুমু খেলাম।
ছোট্ট ক্রিসমাস-ট্রি-টা রাখলাম আমি টেবিলের ওপরে, আর ড্রয়ারের ওপরে রাখলাম লাল ওয়াইনের বোতলটা। দেবদূতটি ঘরের দরজায় টোকা মেরে ঢুকল, তারপর বাবার উরুতে একটা ইনজেকশন দিল। প্যান্টের বোতাম লাগিয়েই বাবা তক্ষুনি বড়দিনের সাজানোর জিনিসপত্র আনতে তাঁর ফেলে আসা শূন্য বাড়িতে যেতে চাইলেন। 
“শুধু বরফ আর আপেলগুলো”, কড়া সুরে মা বললেন। 
“আমরা জানি সেটা। ক্রিসমাস-ট্রি সাজানোর মালাগুলো আর বলগুলো তোমার কাজের ঘরের আলমারিতে আছে, তাই না?”
মা মাথা নাড়লেনঃ “এরা ফুল আনতে আমাদের বারণ করেছেন …”
“এই বৃদ্ধাবাসে মোমও বারণ। তোমার মতন সবাই এখানে সব জিনিস সামলাতে পারে না।”
বাবাকে আমি কোটটা পরতে সাহায্য করলাম।কাফেটারিয়া পার হয়ে যাওয়ার সময় পরিচিতদের উদ্দেশে আমরা সম্ভাষণ জানালাম। যখন আমি গাড়িটা আনতে গেলাম, বাবা দরজার কাছে নীচে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাঁপা হাঁটু আর স্থির দৃষ্টি নিয়ে বাবা গাড়িতে উঠলেন। সন্ধ্যা নামার মুখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
গাড়িতে করে যাওয়ার সময়ে এক রাতের একটি যাত্রার কথা আমার মনে পড়ল, মা-বাবা তখন বাড়িতেই থাকতেন। প্রায় মাঝরাতে মায়ের ফোন আসে। স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে যেটুকু কথা তিনি বলতে পারতেন, তার সাহায্যে মা আমাকে বঝাতে চাইলেন যে অনেকক্ষণ ধরে বাবার নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। এই খবর শোনার পরে যে রাস্তা দিয়ে আমি গাড়ি চালিয়ে যাই, সেটা ছিল বরফে ঢাকা। বাবা বসার ঘরের টেবিলে বসেছিলেন। চেষ্টা করছিলেন একটা রুমাল দিয়ে নাকের রক্তটা বন্ধ করতে। শোয়ার ঘর, বাথরুম আর বসার ঘরে বাবার যাতায়াতের রাস্তাটা রক্তের দাগে ভর্তি। আমি সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করলাম, পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলাকে জাগালাম আর রক্তের দাগগুলো মুছে ফেললাম। আমি বাবাকে জুতো পরতে সাহায্য করলাম।পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা এসে পড়লেন আর মায়ের দেখাশোনা করতে লাগলেন। গাড়ির স্তিয়ারিং-এ হাত রেখে আর প্যাডেলে পা রেখে আমি ওই পিছল রাস্তা দিয়ে কোনোরকমে গাড়িটাকে চালানোর চেষ্টা করলাম। একইসঙ্গে বাবার রক্তক্ষরণের দিকে নজরে রাখলাম। অনুমান করা সম্ভব ছিল না কতটা রক্তপাত হচ্ছিল। ইমার্জেন্সিতে তড়িঘড়ি ধকার সময় বাবা আমাকে সাবধান করলেনঃ “আমার শরীরের অবস্থা ভাল নয়।” বাস্তবটাকে বাবা খুব সহজেই মেনে নিতেন। আর সেটা সহজে সবাইকে বলতেও পারতেন। আমি বাবার হাতটা শক্ত করে ধরি। রেজিস্ট্রেশন করার সময় বাবার পা কাঁপছিল, আমি একটা চেয়ার টেনে বসতে দিলাম। দৃঢ় গলায় তিনি কম বয়সী মহিলাটিকে নাম, ঠিকানা, মেডিকেল ইন্স্যুরেন্সের সবকিছু বললেন। রক্ত বন্ধ করার জন্যে বাবার নাকে যে তুলো দেওয়া ছিল, এমার্জেন্সির মহিলা ডাক্তারটি সেটা সরিয়ে দিলেন। তার বদলে তিনি বাবাকে বললেন, চিবুকের কাছে একটা বাতি ধরতে, রক্তটাকে ধরার জন্য। বাবা মাথাটা পিছন দিকে ঝুঁকিয়ে দিলেন, আর ডাক্তারটি বাবার যেখান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সেখানে আলো ফেললেন। বাবার চোয়ালের হাড়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। বাবার চোখে ফুটে ওঠা শঙ্কা আমার মাথায় ঢুকে গেল। এক মুহূর্তের জন্য আমি মস্তিষ্কের ভেতরে রক্তক্ষরণের একটা ছবি দেখতে পেলাম। পরমুহূর্তেই আমি আমার দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম।
বাবা বাড়ির দরজা খুললেন। ক্রিসমাস-ট্রি সাজানোর মালা আর বলগুলো খুব সহজেই পেয়ে গেলাম আমরা। বৃদ্ধাবাসে ফেরার পথে আমি বাবাকে তাঁর শেষবার হাসপাতালে থাকার ব্যাপারে কিছু কথা জানতে চাইলাম। 
“ওটার কোনও দরকার ছিল না।” 
“দরকার ছিল না? এন্ডোস্কোপির রিপোর্ট কী বলছে?”
“একটা ছোট আলসার পাওয়া গেছে পেটে, আবার ঠিক হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িটা বিক্রি করতে হবে।”
“ঠিক হয়ে গেছে? কিন্তু তুমি…”
“আর্কিটেক্টরা এই বাড়ির মূল্যায়নের ব্যাপারে কবে জানাবে?”
“নতুন বছরে। মা কেমন আছেন?”
“ও তো প্রায়ই কাঁদে। ওর পক্ষে খুব অপমানজনক, হঠাৎ সঠিক কথা মনে করে বলা। আমিও অনেক সময়েই ওকে বুঝে উঠতে পারি না। ওর একদিকের এই পক্ষাঘাত চিকিৎসায় খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। রিহ্যাব স্ট্রোকের পরে ওকে যে কীভাবে সুস্থ করে তুলেছে, সেটা দেখার মতন বিষয়। আমরা দুজনে একসঙ্গে অসাধারণ সময় কাটিয়েছি, খুবি অসাধারণ। এখন আমরা কোনোরকমে মানিয়ে নিচ্ছি আজকের এই দিনগুলোর সঙ্গে।”
কাফেটারিয়াতে বসে থাকা বেশিরভাগ দলগুলোই চলে গিয়েছিল। বড়দিনের দেবদূতটি আমাদেরকে মা-বাবার ঘরে অভ্যর্থনা জানাল। টেবিলের ওপরে গেলাসগুলো রাখা ছিল। একটা দক্ষিণ ফ্রান্স-এর ওয়াইনের বোতল খুললাম আমি আর গেলাসে ঢাললাম। ছোট ক্রিসমাস-ট্রি-টা সাজাতে লাগলাম। পক্ষাঘাতে বেঁকে যাওয়া মুখে মা টেবিলের দিকে হাত দেখিয়ে বললেনঃ
“চিনিটা ওখানে আছে।” 
“তুমি কি ক্রিসমাস কুকিসগুলোর কথা বলছ?”
“হ্যাঁ, ঠিক। কিসের জন্য তোমাদের একটা সন্তান?”
আমি মায়ের গেলাসে আবার ওয়াইন ঢাললাম আর হাসলামঃ “না মা আর নয়। কিসের জন্য আমাদের আরও সন্তান দরকার? তোমার জন্য?”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই।”
আরেকটা ক্রিসমাস কুকিসের প্যাকেট খুলে আমি তার গন্ধ শুঁকতে লাগলাম।
“গির্জায় বয়স্কদের প্রার্থণাসভা কেমন হলো?”
“খুব সুন্দর”, বাবা বললেন। কিছুক্ষণ আগে ওয়াইনে চুমুক দেওয়ার পড় থেকেই বাবা তাঁর দুই চোখ আধখোলা অবস্থায় রেখেছেন। “কিন্তু বাড়ির পিছনে আমরা রাখতে বাধ্য হয়েছি যে রাস্পবেরি ইয়াহেব(১) এখনাটনের(২) সঙ্গে হেজেল গাছ এমুনার(৩) বাচ্চা সন্ন্যাসীরা…”
“কী বিড়বিড় করছ তুমি? মার্টিন, তুই কি কিছু বুঝতে পারছিস?”
“আমার নাম উর্স, মা। মার্টিন তোমার ভাই- যাই হোক। বাবা, তোমার শরীর ভাল লাগছে না? আমিও তো তোমার কথা বুঝতে পারছি না।” বাবার চোখের দৃষ্টিতে ভ্রান্তি-, “না? আমি ভাবছিলাম পুরো ব্যাপারটা আর রাস্পবেরি- মরুভূমি, ব্যাবিলনের পিছনে সেই তেরছা পুলটা সিঁড়ির কাছে ঈশ্বর মধু পাথর বেদি জানালা, বুঝতে পারছ না তুমি?” 
বাবার গলার আওয়াজে এই পীড়াদায়ক দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটল। “এইবার তুমি বুঝলে মাঝে মাঝে আমার কি অবস্থা হয়, মা!” মুচকি হেসে বাবা মায়ের কপালে চুমু খেলেন। মা-ও হাসলেন, তারপর আমরা সবাই হাস্তে লাগলাম। অপূর্ব লাল ওয়াইনের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই উর্স”, বাবা আমার গেলাসের সঙ্গে নিজের গেলাসটা ঠেকালেন।
“এই অপূর্ব লাল ওয়াইনের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই, উর্স”, বাবা আমার গেলাসে সঙ্গে নিজের গেলাসটা ঠেকালেন।
“এখন আমি তোমাকে আবার ঠিকঠাক বুঝতে পারছি, বাবা। কী হয়েছিল…?”
“তুমি মনে করো, তোমাদের ঠিকঠাক চলবে, তুমি, এলসাবেট আর ছোট্ট ডিটার-এর, যখন একদিন আমরা আর থাকব না, উর্স?”, মা হটাৎ স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করলেন। আমি দারুচিনির গন্ধলাগা তারার মতন দেখতে একটা কুকি তুলে নিলাম। “সেটা এখনও অনেক দেরি আছে, মা। তবে আমাদের ঠিক চলে যাবে।”
দেবদূতটি ঘরে ঢুকল। সে আমাদের জিজ্ঞেস করল, আমরা কফি খেতে চাই কিনা।

_____________
নীচে দ্রস্তব্যঃ 
(১) ইয়াহেবঃ ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী ঈশ্বরের একটি নাম, যেটা হিব্রু ব্যঞ্জনবর্ণ YHVH থেকে অনুদিত। যাভে, জিহভা, JHVH, ইয়াভে, ইত্যাদি।
(২)এখনাটনঃ আখনাতন, আখেনাতন, ইখনাতন বা এখনাটন ছিলেন মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও, যিনি সতেরো বছর রাজ্য শাসন করেছিলেন এবং ১৩৩৬ বা ১৩৩৪ খ্রিষ্টপূর্বে মারা যান। তাঁর নামের অর্থ, ‘আতেন-এর প্রভাবশালী আত্মা’।
(৩) এমুনাঃ এটি একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ হল ‘বিশ্বাস’। 

অনুবাদঃ সুলগ্না মুখোপাধ্যায় 
মুল গল্পঃ Der Engel

0 comments: