0

বইঘর - সৌমিত্র বসু

Posted in


বইঘর


মনোজ মিত্রের 'গল্পনা'
সৌমিত্র বসু



গল্পনা 
মনোজ মিত্র 
দেজ পাবলিশিং 
 দাম ২০০ টাকা

কত কতদিন পরে যে একটা বইয়ের শেষ পাতা বন্ধ করে মুখ দিয়ে 'বাঃ' বেরিয়ে এল, মনেও পড়ে না। লেখাগুলো যখন আজকালের পাতায় ধারাবাহিকভাবে বেরোচ্ছিল তখনই প্রায় পাত পেড়ে বসে থাকতাম সে সপ্তাহের কিস্তিটা শেষ করার জন্য। এবারে গোটা বইটা একসঙ্গে, সেই লেখাগুলোর সঙ্গে আরও কিছু লেখা যোগ করে সামনে দাঁড়িয়ে, ফেলে ছড়িয়ে মহাভোজ যাকে বলে। 

ফেলে ছড়িয়ে কথাটা এসে গেল বটে, কিন্তু লেখাগুলোর একটাও, কোনও টুকরো অংশও ফেলবার ছড়াবার মতো নয়। মনোজ মিত্র এ বইয়ের নাম দিয়েছেন 'গল্পনা'। একটি অসামান্য কাহিনিবৃত্ত থেকে গল্প গড়ে কেমন করে তাঁকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিলো কোনও এক অধ্যাপকের, নাম না করে তার বিবরণ দিয়েছেন তিনি। প্রথম জীবনে গল্প লেখার চেষ্টা করে হার মেনে মনোজ মিত্র চলে গেছেন নাটক লেখার দিকে, এ বইকে বিশেষ করে 'গল্প না' -বলে দাগিয়ে দেবার পেছনে তাঁর সেই অভিমান চোরাপথে ঢুকে পড়েছে কিনা বলতে পারব না। 

গল্পনা-র সঙ্গে চমৎকার মিলে যায় কল্পনা। গল্প না যদি হয়, তবে কি কল্পনা? তাও তো পুরোটা নয়, তবে অনেকখানি। ভারী চমৎকার একটি মুখবন্ধে মনোজ মিত্র উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, একজন শিল্পী কেমন করে নানা অভিজ্ঞতাকে জুড়ে জুড়ে একটি শিল্প তৈরী করেন, স্বপ্নে যেমন নানা ছড়ানো অভিজ্ঞতা একটা কাঠামোর মধ্যে ঢুকে পড়ে ঘুমের মধ্যে, খানিকটা সেইরকমই। নিজের ছোটবেলার কথাই লিখেছেন তিনি। চোখে দেখা অথবা গল্প শোনা সব অভিজ্ঞতার কথা। কিন্তু নিছক বিবরণ বা এমনকি স্মৃতিকথা হয়ে থাকার থেকেও মুক্তি পেয়েছে তারা। আখ্যানগুলোর মধ্যে মনোজ ভরে দিচ্ছেন তাঁর নিজের জীবনদৃষ্টি, দেখিয়ে দিচ্ছেন কেমন করে, কোন কোন উপাদানের সমবায়ে আজকের মনোজ মিত্র তৈরী হয়ে উঠলেন। এই প্রতিবেদকের বিশ্বাস, মনোজ মিত্রের সমস্ত সৃজনকাজের কেন্দ্রীয় শব্দটি হলো 'মায়া'। যে অপরিসীম 'মায়া'য় বাঞ্ছাবুড়ো তার বাগানকে আগলায়, অলকানন্দা আগলায় পরের সন্তানকে, সেই 'মায়া'ই   অবুঝ লতার মতো পাকে পাকে জড়িয়ে রেখেছে এই 'গল্পনা'কে।

মায়া তো জড়ানো থাকবেই, ফেলে আসা দিনের দিকে ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে থাকা যে। ছোটবেলায় লেখা চমৎকার একটি গল্প, নানা জনে যার নানা দিক থেকে প্রশংসা করে লেখককে বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দিয়েছেন, অন্যজনের আঁকা তার প্রচ্ছদের ছবিটির জন্যে বাবার হাতে মার খাওয়ার আখ্যানে হঠাৎ করে এসে পড়েন মা, তাঁর 'অশ্রুহীন কান্না'র অসামান্য ছবি নিয়ে। থিয়েটার করার নেশায় পণ্ডিতমশাইকে ঠকানোর গল্প বলতে গিয়ে সেই পণ্ডিতমশাইয়ের টাকার গায়ে বুড়ো আঙুলের মাথা ঘষার ছবিটা যখন তুলে অনেন মনোজ মিত্র, বুকের ভেতর হঠাৎ ফাঁপা হয়ে যায়। ভোলা কি যাবে বগা আর তার দুগ্‌গি বৌয়ের কথা, যাদের নিয়ে গল্প লিখে তিরস্কৃত হয়েছিলেন মনোজ, সে গল্পে কোনও 'উত্তরণের বাণী' নেই বলে। হেমনলিনী বা তরুবালাকেই বা কে ভুলতে পারবে! যেন আলগোছে কী সব চরিত্র তৈরী করেছেন।   

গ্রাম থেকে শহরে আসার পর কত মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, আবার সম্পর্ক তৈরী না হওয়ায় হয়তো টুকরো স্মৃতি হয়ে আছে কোনও ঘটনা। শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কোনও সেতু তৈরী হতে পারেনি তাঁর, কিন্তু নাট্যাচার্যের অভিমানাহত মন্তব্যটি একজন বিরাট মানুষের অভিজ্ঞান হয়ে থেকে যায়। কখনও কখনও দেখি, কয়েকটা টুকরো জড়ো হয়ে একটা বড় গল্প হয়ে উঠল, 'গল্পনা' সংকলনে না রেখে আলাদা করে তাদের ছাপলে বড় গল্প হিসেবেই তারা নিশ্চিত সম্মানের যোগ্য। সে সব গল্পে মনোজ নিজে হয়তো প্রত্যক্ষত নেই, কিন্তু অন্যের মুখে শোনা সেই আখ্যান তাঁর নিজের হয়ে গেছে। আবার কখনও ইতিহাসের তথ্য চলে আসে লেখার মধ্যে, মায়ার চাদরটি তাতে জড়ানোই থাকে। কিন্তু এমন করে বলতে থাকলে তো এ লেখা শেষই করা যাবে না, মণিমুক্তায় ভরে রেখেছেন তিনি 'গল্পনা'র পাতাগুলিকে।

আর ভাষা। এ লেখা পড়তে পড়তে রাগ হতে থাকে লেখক মানুষটির ওপর। কেন তিনি ধারাবাহিকভাবে কবিতা লিখলেন না, অন্তত গল্প বা উপন্যাস! কেন তাঁকে সারা লেখক-জীবন নিজেকে লুকিয়ে শুধু চরিত্রের স্বভাবমতো সংলাপ লিখে যেতে হবে! শব্দ ব্যবহারে যে কী অসামান্য দক্ষতা মনোজ মিত্রের, কত অনায়াসে যে তিনি মেলে দিতে পারেন অবিস্মরণীয় সব উপমা, এ বই না পড়লে তা বুঝতে পারা যাবে না। 

সাধ মিটল না। এমন মন খারাপ আর মন ভালো করে দেওয়া লেখা আরও চাই, পাঠক হিসেবে এই দাবিটুকু করার বাইরে আর কিছু বলবার নেই।       



**আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত

0 comments: