বিশেষ ক্রোড়পত্র - অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
Posted in বিশেষ ক্রোড়পত্রসূচী
আমার অলোকরঞ্জনদা - নাসের হোসেন
অনন্য ভাষাশিল্পী অলোকরঞ্জন - জয় গোস্বামী
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র কবিতা : ‘কোটি বছর আমার বাড়ির বয়স’ - হিন্দোল ভট্টাচার্য
একুশে আশ্বিন - অরুণ দে
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র ভাষা - হান্স্ হার্ডার
কোনও এক বই সম্পাদকের অলোকদা - শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
স্তিমিত সিংহাসন – অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত(অনুবাদ)
নাট্যকোলাজ, অন্যধারার নাটক – সুনীল দাশ
আমার অলোকরঞ্জনদা
নাসের হোসেন
তাঁর সঙ্গে যখনি ফোনে কথা হয়, প্রথমেই তাঁর জিজ্ঞাস্য
থাকে, তাঁর অতুলনীয় স্নেহার্দ্র কণ্ঠস্বরে :
'নাসের,তুমি একটা ভালো সংবাদ শোনাও।'
আমি তৎপর হই,চেষ্টা করি কোনো একটা ভালো
সংবাদ শোনাবার, এবং প্রত্যেকবারই যে- কথাটা প্রথমেই
বলে থাকি তাঁকে : 'অলোকরঞ্জনদা এখন এই যে
ফোনে আপনার স্নেহার্দ্র কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম
এর থেকে বড়ো সুসংবাদ এই মুহূর্তে আমার কাছে
সমগ্র পৃথিবীতেই নেই।' তিনি তারপর সেই
একই স্নেহার্দ্রতায় আচ্ছন্ন করে জিজ্ঞাসা করেন :
'আচ্ছা আচ্ছা,তা তো বটেই, তা তো বটেই,
আচ্ছা নাসের, আর- একটা সুসংবাদ দাও এবার।'
তারপর, এবং এইভাবে, চলতে থাকে আমার সুসংবাদ
সংগ্রহের পালা।এবং তা চলতেই থাকে।
[নাসের হোসেন : জন্ম ১৯৫৭। আশির দশকের উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবি। একাধিক কবিতা – গ্রন্থের লেখক।]
কোনও এক বই সম্পাদকের অলোকদা
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্প্রতি হঠাৎ একদিন চিন্তা করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, বই-সম্পাদকের পেশায় আমার সাতচল্লিশ বছর কেটে গেল। পাশাপাশি কিছু মাস্টারি করেছি, খুবই সামান্য কিছু অকিঞ্চিৎকর লেখালিখি, বক্তৃতা দিয়েছি নানা বিষয়ে, ব্যস। বই-সম্পাদকের পেশায় কর্তব্য-করণীয় ঠিক কি, সে বিষয়ে বই পড়ুয়াদের বা বইউদাসীন ‘সাংস্কৃতিক ‘আড্ডাবীরদের’ ধারণা অতিক্ষীণ, নেই বললেই চলে। খুবই কম সংখ্যক কিছু লেখক যাঁরা এই অদ্ভুত পেশাটির সমঝদার, তাঁদের সঙ্গে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ যখন পেয়েছি, তার আনন্দ স্বর্গসুখ বোধ হয়েছে – সেই স্বর্গ যা মানুষের কল্পনার পরম আস্বাদ।
পনেরো বছর এই পেশায় কাজ শিখে কিছুটা দক্ষতা আয়ত্ত করে প্রথম যখন স্বাধীনভাবে ঘনিষ্ঠ কায়েকজন বন্ধুর সঙ্গে একত্রে একটা মনোমত প্রকাশনা সংস্থা তৈরি করার সুযোগ হল, তখনই অলোকরঞ্জনের শরণার্থী হই। তাঁর দাক্ষিণ্যে ও প্রশ্রয়ে তাঁর পাঁচটি বই প্রকাশ করার সৌভাগ্য হয়। আরও একটি বইয়ে আমার সম্পাদকীয় আগ্রহে তিনি অমূল্য সহযোগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আমায় কৃতার্থ করেন। এই সম্পাদকীয় সাহচর্যেই তাঁর সঙ্গে আমার অসমবয়সী বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তিনি নিজে তাঁর ‘দুই বন্ধু’ নামে দীর্ঘ কবিতায় আমায় এই ‘বন্ধু’ স্বীকৃতি না দিলে এই দাবী করবার স্পর্ধা আমার হত না।
যে বন্ধুতাকে মন্থন করে তাঁর ওই অসামান্য বন্ধুতার কবিতা, সে-বন্ধুতা কথার কারিগরিতে খাড়া করে তুলবার সাধ্য আমার নেই। বরং কবির সঙ্গে নিতান্তই একজন বই-সম্পাদকের সখ্যবৃত্তির একটা কাহিনি নথিবদ্ধ করে রাখতে চাই। অলোকদার কাছে যাতায়াতের শুরু হয়েছিল জর্মন সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রশ্ন বা সংশয় নিরসনের তাড়নায়, কখনও বা জর্মন থেকে কোনোকিছু চট করে নিখাদ অনুবাদ করিয়ে নেবার তাগিদে।
স্বাধীন প্রকাশনায় এসে থীমা থেকে সরাসরি তিনটি যে অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ করি, তার মধ্যে গ্যুন্টার গ্রাস- এর কবিতা ও কোলরিজ-এর রাইম অভ দি এনশেন্ট ম্যারিনার থেকে বুড়ো নাবিকের উপকথা হয়তো প্রত্যাশিতই ছিল। অপ্রত্যাশিত ছিল ভিলহেল্ম্ বুশ-এর মাক্স ও মোরিৎস এবং আরও চিত্রকথা। অলোকদাই প্রথম পরিচিত করালেন আমাদের মাক্স ও মোরিৎস নামে এই দুই খুদে ডানপিটের সঙ্গে। কৌতুকী ছড়ার পরম্পরায় সুকুমার রায় ও খাপছাড়া-র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লিউইস ক্যারল, এডওয়ার্ড লিয়র ও অগ্ডেন ন্যাল মিলিয়ে বাঙালি পাঠকের যে রসাস্বাদন তাতে অন্য এক মাত্রা এল অলোকরঞ্জনের অনুবাদে, ভিলহেল্ম্ বুশ-এর সংযোজনে। পরে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছি হিটলার ও আনতোনিও গ্রামশি দুজনেই ছিলেন মাক্স ও মোরিৎস-এর ভক্ত! সাহিত্যে, চিত্রকলা ও সঙ্গীতে অলোকরঞ্জনের সমান টান লক্ষ করেই তাঁর প্রতিটি বইকেই বিশেষভাবে চিত্রমণ্ডিত করার লক্ষ্য ছিল আমাদের। গ্রাস ও বুশ-এর নিজস্ব চিত্রকলা তো সহজেই বই-এর অঙ্গ হয়ে গেল। কোলরিজ-এর অলংকরণে শিল্পী বন্ধু রবিন মণ্ডল আমার সহায় হলেন; শর্ত ছিল, মূল কবিতাটি তাঁকে পড়ে শোনাতে হবে, ব্যাখ্যাসহ! আমার পাঠ ও অলোকরঞ্জনের ভাষান্তরণ থেকে সৃষ্টি হল রবিনবাবুর চিত্রসম্পদ।
এই বইগুলির নির্মাণকালেই অলোকদার মনে ওই যৌথ শিল্পকল্পনার হদিশ পাচ্ছিলাম। সেই সূত্রেই, অলোকদার তুলনারহিত বয়ানে তাঁর একটি লেখার সূত্রপাত – লেখার নাম ‘শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়–কে লেখা একটি চিঠি’- ‘সেই যে পড়ন্ত দুপুরে উৎফুল্ল উদাসীনতা নিয়ে আমাকে নির্দেশ দিলেন স্বরচিত কবিতার মধ্যে কোথায় কোথায় মিশ্র মাধ্যমের আদল ধরা পড়েছে সেই মর্মে একটি নিবন্ধ লিখতে হবে, তারপর থেকেই আপনার হদিশ নেই আর।’ এই খোলা চিঠিটিকে কেন্দ্রে রেখেই তৈরি হয় আরেকটি বই সমবায়ী শিল্পের গরজে, যার ভূমিকায় অলোকরঞ্জন লেখেন : ‘কবিতাকে আজ আর একচোরা হয়ে ভাবের ঘরে চুরি করা মানায় না। তাকে থেকে থেকেই চিত্রকলা, সঙ্গীত বা ফিল্মের কাছ থেকে আঁজলা ভরে রসদ নিতে হয়। অন্যদিকে, মিশ্র শিল্পের গূঢ় যন্ত্রণায়, সৃষ্টির নানামুখী প্রকাশচর্যারও কি এখন কবিতার কাছে শরণার্থী হওয়ার কথা নয়?’ এই বইটিতে মিশ্র-শিল্পের সেই সূত্রটি বই-সম্পাদকের ভূমিকায় আমি বিস্তৃত করে নিয়েছিলাম পাণ্ডুলিপি, চিত্রণের দুর্লভ অনুষঙ্গের গবেষণাজারিত চয়নে। অলোকরঞ্জনের ভাষা সেই দৃশ্যকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে যে অন্য ভাষা সৃষ্টি করেছিল, তারই যেন অবশ্যম্ভাবী উত্তরবয়ন তাঁর পরের বই – ২০০০-এর পর ২০০৩ – যুদ্ধের ছায়ায়, নিজেই যাকে বর্ণনা করেন ‘কোলাজ’ বলে; কবিতা, সমকালের ভয়ংকর ইতিহাস, চিত্রকলা – চলচ্চিত্রকলার অমোঘ অনুষঙ্গের অনিবার্য ক্রমান্বয়তায় সভ্যতার সংকটের এই সমতাময় উচ্চারণ বাংলা সাহিত্যে এক পরিপূর্ণ অন্য ভাষার জন্ম দিয়েছিল। লজ্জা আমাদের, পাঠকেরা লক্ষ করলেন না, তাঁর অনন্যসাধারণ সেই ভাষাবৈভব যার বিবেকী অভিঘাতও যেন অধরা থেকে গেল বাঙালি সাহিত্যপাঠকের উদাসীনতায়। দুই মহাযুদ্ধকালীন জর্মন চিত্রকরদের ছবি; পিকাসোর ‘গ্যোর্নিকা’র প্রস্তুতিতে আঁকা ছবি; কলকাতার শিল্পী তপন ভট্টাচার্যের ছবি; অলোকরঞ্জনের মৌলিক ও অনুবাদিত কবিতা; গাদামার ও ইঙে বাখমান–এর সঙ্গে তাঁর কথোপকথন; এ কালীন অন্তহীন যুদ্ধে মৃতের হিসেব, ধ্বংসের নির্মম তথ্যাবলি; ঘৃণার আঁচে দেশচ্যুত শরণার্থীদের সঙ্গে কথোপকথন হয়ে উঠেছে সমকালের এক চেতনাগভীর মহাকাব্য, যার রূপ হতে পারে কেবল ‘কোলাজ’ই। সেই কোলাজের গভীরে অন্তঃশীলতা অলোকরঞ্জনের একান্তই নিজস্ব মিশ্রকাব্য।
বই-সম্পাদকের দুঃখ, এ বই তেমন বিক্রি হয়নি। সতেরো বছরেও শেষ হয়নি প্রথম সংস্করণ। যেমন হয়নি, আগের বইটিও। সমবায়ী শিল্পকে অলোকরঞ্জন নিতান্ত একটা শৌখিন শিল্পসাধ বিবেচনা করেননি, বরং সভ্যতার সংকটে সভ্যতার রক্ষাকবচ বলেই তাকে মেনেছিলেন। যুদ্ধের ছায়ায় বইটির সূচনায় তিনি লিখেছিলেন, ‘কীভাবে কেন ঠাণ্ডা ইতিহাসের একটা বই পড়ছি, এমন সময় শমীক এলেন। শমীকের সঙ্গে দেখা হলেই এক একটি প্রকল্পের বোধন হয়। সেদিনও ঠিক হল, যুদ্ধ নিয়ে, অর্থাৎ যুদ্ধ ব্যাপারটার বিরুদ্ধে একটি কোলাজ তৈরি করতে হবে।’ যুদ্ধের ছায়ায় আমাদের নিজ অবস্থানে মিশ্র শিল্পের ভাষাতেই কেবল আমরা পেতে পারি মুক্তদৃষ্টি জীবনের অধিকারটুকু। সেটা বুঝতে তাঁর সমভাষী কবিতাপাঠকেরা নারাজ বলেই কি কবি তাঁর বড়ই নিঃসঙ্গ স্বেছানির্বাসন বেছে নিয়েছেন? তাঁকে সুখী দেখিনি হির্শবার্গ-এ। সেখানেও তাঁকে তাড়া করে ফেরে তাঁরই নিজের কবিতার ছত্র :
কিন্তু আমি হঠাৎ ঈশ্বরিত
হয়ে-ওঠার দুঃসাহসে তরান্বিত একখানি ত্রিপদী
লিখতে গিয়ে দেখেছি আজ হয়নি কোথাও
যুদ্ধের বিরতি–
সাদীর ছিল যোজনব্যাপী গুলবাগিচা, আমার তকদির :
বিবদমান বন্ধুদের গুলিগালাজ, জম্মু ও কাশ্মীর।
[শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় : জন্ম ১৯৪০। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নাট্য ও চলচ্চিত্র সমালোচক এবং তাঁর নিজের ভাষায় ‘বই – সম্পাদক’। অসংখ্য সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে ‘আনতোনিও গ্রামশি নির্বাচিত রচনাসমগ্র’ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।]
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র কবিতা : ‘কোটি বছর আমার বাড়ির বয়স’
হিন্দোল ভট্টাচার্য
বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বিশ্বে ভ্রমণ শুরু করেছিল। বিশ্ব সেই প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিল, অনুবাদের মাধ্যমেই, বাংলা কবিতার ভুবন কেমন মায়াবী দার্শনিক সংলাপ হয়ে উঠতে পারে কবিতার সামগ্রিকতা বজায় রেখেই। কিন্তু সেই কাব্য কতটা আধুনিক, সে বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। এই সন্দেহ প্রকাশের কারণ হিসেবে আমরা যদি ভাবি অনুবাদের দেওয়াল, তাহলে, তা যেমন সত্য, তেমন এ কথাও বলতে হবে হয়ত রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার থেকে একটু দূরেই ছিলেন। যদিও এ অনেক তর্কের বিষয়, কারণ রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ উঠলেই, আধুনিকতার সংজ্ঞাকে অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করে দেন। অবশ্যই এ কথা স্বীকার্য যে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক ছিলেন না, ছিলেন সনাতন, ছিলেন চিরকালীন। তিনি যে আধুনিক ছিলেন না, তা আমাদের কাছে বরং স্বস্তির বিষয়। কিন্তু চার এবং পাঁচের দশকের বাংলা কবিতা আধুনিকতার সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করল শুধু নয়, আধুনিকতাকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে শুরুও করে দিল। তার রক্তমাংসের প্রমাণ হল জীবনানন্দের, সুধীন্দ্রনাথের, বিষ্ণু দে, সমর সেন, অরুণ মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী এবং সর্বোপরি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা। এক আশ্চর্য বিষয় হল এই, যে, প্রায় রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশিই জীবনানন্দ লিখে গেলেন আধুনিকতার যন্ত্রণার কবিতা। বোদলেয়রের অশুভ ও অমঙ্গলবোধের দুনিয়াই না, বা কাফকা- দস্তয়ভস্কির দুনিয়াই না, তাঁর কবিতায় একসঙ্গে মিশে গেল দালির সুররিয়ালিজম, ইয়েটসের একাকীত্ব, মৃত্যুচেতনা এবং এডগার অ্যালান পো-এর যন্ত্রণাদগ্ধ সৌন্দর্যচেতনা। পো যে অন্ধকার এবং মরমীয়া চেতনার সন্ধিক্ষণের রঙ লিখে গেছেন, তা জীবনানন্দের কবিতায় হানা দিল যেমন হানা দিয়েছিল বোদলেয়ারে। এলিয়টের পো সংক্রান্ত ভাবনাগুলি এখানে স্মরণ করার মতো। একদিকে জীবনানন্দের যুগ, অন্যদিকে সুধীন্দ্রনাথের ধ্রুপদ, একদিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতাদর্শ, অন্যদিকে সারা বিশ্ব জুড়েই বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বেড়ে ওঠা অস্তিত্ববাদের প্রেক্ষাপটে লেখা হতে শুরু করল আমাদের পাঁচ-এর দশকের কবিতা। দেখতে পেলাম সুনীল, প্রণবেন্দুর হাত ধরে একদিকে এল ব্যক্তিগত চৈতন্য এবং বিষাদের এক বিশ্ববীক্ষা। দেখলাম বিনয়ের হাত ধরে ধ্বনিত হল আধুনিক রোমান্টিকতার এবং শাশ্বতের প্রতি অন্বেষণের এক নতুন অধ্যায়। এলেন শক্তি ও উৎপলকুমার বসু। বাংলা কবিতার মানচিত্র-ই যেন বদলে গেল। শক্তি যেমন নিয়ে এলেন প্রকৃতির সঙ্গে আধুনিক ব্যক্তি মানুষের চিরবাউলের সম্পর্ককে, তেমন-ই উৎপল বাংলা কবিতায় হাজির করলেন সমগ্র বিশ্বকেই, সমগ্র সময়প্রবাহকেই। এক নতুন চৈতন্যের সঙ্গে উৎপলের দেখা হতে লাগল। সেই সঙ্গেই তিনজন কবি, শঙ্খ, আলোক সরকার এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত একমুঠো ধুলোর মধ্যে বিশ্বকে এবং বিশ্বে একমুঠো ধুলোকে প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। এই শেষ তিনজনের সম্পর্কে হয়ত আলাদা আলাদা করে ভাবনা বিনিময় করাই ভালো। কিন্তু এই লেখাটির ক্ষেত্রে কথা বলা যাক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পর্কে, যাঁর কাছে ভাষাই হল দেশ ও বিশ্ব, যিনি অনবরত এই বিশ্বকে খুঁজে চলেছেন কখনও নিজের দেশের বিভিন্ন ভাষার কবিতার মধ্যে তো কখনও বিশ্বের কবিতার ভুবনের মধ্যে। অনবরত নিজেকে যে কবি ভাঙেন, তাঁকে ধারাবাহিক পড়তে হয়, তাঁর অভিযাত্রার বাঁকগুলিকে ধরতে গিয়ে। কবি অলোকরঞ্জনের কবিতার যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল যৌবন বাউলের ঈশ্বরের সঙ্গে মৃত্তিকার কথোপকথনের মধ্যে, সেই সংলাপ তাঁকে করে তুলেছিল বাংলার শিকড়ের সহযাত্রী। সেই প্রথম কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দিয়ে যখন আমরা যাই প্রকাশের পাঁচ দশক পরে, তখন বুঝতে পারি, কী নিপুণ অন্তর্ঘাত ঘটে গেল বাংলা কবিতায়। অথচ কী সুন্দর সেই অন্তর্ঘাত! যৌবন বাউল কাব্যগ্রন্থটি আমার কাছে অন্তত, কবির কৃশ বেদনার সাধনা। যে সাধনার কথা তিনি তাঁর কবিতায় বলছেন- “ একটি কিশোর মাঠের কিনারে, একটি অতীত/ বুকে করে আছে, এখুনি তো পায়ে/ ঠেলে দিতে পারে, ও তবু কেন যে সেদিনের শীত/ বুকে ধরে আছে/ ও কি মনে করে অরূপরতন/ গড়বে শীতের কৃশ বেদনার সাধনার বলে?
এখানে এই কবিতাটিতে এসে আমি থমকে যাই বারেবার। কী ভাবছেন কবি এখানে? আমি তো অন্য একটা ভাবনা ভাবছি। ভাবছি একজন কাফকা বা একজন র্যাঁিবো কি পারবেন তাঁদের কৃশ বেদনার সাধনায় রিলকে বা রবীন্দ্রনাথা বা গ্যয়টে যে অরূপরতনকে পেয়েছিলেন তাকে স্পর্শ করতে? বিষাদের এই যে শীতার্ত হিম বেদনার কুয়াশার ভিতরে আমাদের আধুনিকতা ডুবে গেল অস্তিত্ববাদে, সেখানে কি অলোকরঞ্জনের যৌবন বাউল পারল লালনের ভাবনার শীর্ষকে ছুঁতে? তা কি আদৌ সম্ভব? এখানেই কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আলাদা হয়ে গেলেন তাঁর সমসাময়িক কবিদের চেয়ে। তাঁর কবিতা শুধু অনুভূতিমালার প্রসারণ হয়েই রইল না, মেধার সঙ্গে, ভাবনার সন্দর্ভের সঙ্গে মিশে গেল অভিজ্ঞতার বোধ। মানসিকতাতেই তিনি অন্য একরকম ঘরানার জন্ম দিলেন। তিনি আধুনিকতাকেও প্রশ্ন করলেন, যখন আধুনিকতা তার ডালপালা বিস্তার করছে সারা বিশ্বেই। এ পর্যায়ের অনেক কবিতাতেই তাঁর এই ঔপনিষদিক অন্ধকার প্রত্যক্ষ করি আমি, যেখানে তিনি গভীর বিশ্বাসে সেই আলোর সন্ধান করছেন, অপেক্ষা করছেন তার জন্য। যৌবনবাউলের দর্শনের একটি টুকরো অংশ হয়ত এখানে পড়ি আমি-
দ্বিতীয় ভুবন রচনার অধিকার
দিয়েছ আমার হাতে—
এই ভেবে আমি যত খেয়া পারাপার
করেছি গভীর রাতে,
প্রতিবার তরী কান্নায় শুরু হয়
কান্নায় ডোবে জলে,
হাসিমুখে তবু কেন হে বিশ্বময়
তোমার তরণী চলে?
(অপূর্ণ)
কিন্তু এই কবিতাগুলির দর্শনের সঙ্গে যে ব্যক্তিত্ব তিনি অর্জন ও প্রতিষ্ঠিত করলেন বাংলা কবিতায় তা এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নিয়ে তো এলই, সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এল এক ভিন্ন দার্শনিক যাপন। তিনি যেন দান্তের ইনফের্নোর মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন রবীন্দ্রগান গাইতে গাইতে। তিনি জানেন ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে/ যাহা কিছু ছিল আছে আছে আছে’, কিন্তু তিনি এও জানেন, তাঁকে এক অন্ধের মতো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। তিনি জানেন যে এ জন্মে তিনি সুগতর কেউ না। তিনি জানেন, তিনি বহুবছর ধরে হাঁটছেন এই অন্ধকারে। হাজার শুধু না, সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তাঁর এই হেঁটে আসা, তাঁর এই থাকা। আর তিনি যে বাড়িতে থাকেন, সেই বাড়িটাও বহুবছরের। যেন আবহমান অবচেতনার অংশ হয়ে তিনি কথা বলে উঠছেন, যে আবহমানতার শুরু কোথায় তিনি জানেন না।
কবে প্রথম কার কাছে এই মাটি
কিনেছিলাম, তার আগে এই মাটি
কার ছিল, আর কাদের-কাদের ছিল?
ভগবানের স্বত্বাধিকার প্রথম কবে গেল?
কোটি বছর আমার বাড়ির বয়স।
(আমার বাড়ির বয়স)
কোন কবিতা কী কারণে লেখা হয়, আর সেই কবিতা কতবছর পরে কীভাবে আবিষ্কৃত হয়, তা নিয়ন্ত্রণ করতে কবি পারেন না হয়ত। কারণ কবিতা হল সেই আবহমানতার প্রতিনিধি, যার মধ্যে দিয়ে শুধু কবি নন, প্রকাশিত হয় অনেক গূঢ় ভাবনা। যে ভাবনাগুলি হয়ত সচেতন ভাবে কবি ভাবেন না। কিন্তু অবচেতনে কবি সেই ভাবনার ধারক হয়ে ওঠেন। এই কথা বলার উদ্দেশ্য হল, কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এভাবেই আধুনিকতার সঙ্গে আবহমানতার বিবাহ সম্পন্ন করেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই। আবহমানতা, সূর্যের মতোই এমন এক অদৃশ্য ভর,যার কাছে এলে আধুনিকতাও তার দিক পরিবর্তন করে। কিছুটা তো নিজেকেও বদলায়। অস্তিত্ববাদ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর কবিতার কাছে এসে নিজেকেও খানিকটা পরিবর্তন করে। ঠিক সেই বিষয়টিই ঘটে অলোকরঞ্জনের শিল্পিত স্বভাবে, যখন তিনি আধুনিকতাকেও যেমন তার অন্ধকার শুদ্ধ গ্রহণ করেন, তেমন তিনি আধুনিকতাকেও ফিরিয়ে দেন আবহমানতার কিছু অংশ। যেন একজন বিষ গলাধঃকরণ করে ফিরিয়ে দিচ্ছেন সামান্য অমৃত।
যেমন বলা যায় যৌবন বাউল কাব্যগ্রন্থের মৌলকণ্ঠ নামক কবিতাটি।
মৌল কণ্ঠ কেঁদে উঠল পথের অন্ধকারে;
দরজা খুলে কেঁদে উঠলাম : ‘মাগো
তুমি আমার ঘরের বাইরে থেকে
ডেকে উঠলে? তুমি আমায় ঘরের বাইরে নিয়ে যাবে
তুলসীতলায়?’
--ঘুমন্ত মা-র মুখে দেখলাম শান্ত স্বপ্ন-প্রদীপ।
মৌল কণ্ঠ কেঁদে উঠল পথের অন্ধকারে;
দরজা ভেঙে কেঁদে উঠলাম : ‘অরুণিমা, অরুণিমা,
তুমি আমার শয্যা ছেড়ে ঘরের বাইরে থেকে
ডেকে উঠলে? তুমি আমায় ঘরের বাইরে নিয়ে যাবে
প্রথম কুঁড়ির স্বর্গীয় সেই প্রতিশ্রুতির স্মৃতির বাগানে?’
অরুণিমার মুখে দেখলাম শান্ত স্বপ্ন-প্রদীপ।
মৌল কণ্ঠ কেঁদে উঠল ঘরের অন্ধকারে।।
‘সুন্দর ও কার্ল মার্ক্স’ প্রবন্ধে অলোকরঞ্জন লিখছেন- ‘ আজ যখন লুকাচ প্রমুখ নন্দন্তাত্বিকদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরেও মার্ক্সীয় সমালোচনা, বিশেষত বাংলা দেশে, প্রগতির নামে একটি কূপমাণ্ডুক্যের অভিসন্ধিচর্চায় অবসিত হয়েছে, তখন একবার অন্তত মুমুক্ষু মার্ক্সের প্রাথমিক ও মানবিক অভিপ্রায়ের সেই ব্যাপ্তির কথা মনে রাখা ভালো যিনি সুন্দরের প্রয়োজনকেই ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলেন, প্রয়োজনের সুন্দরকে নয়’। দেখা যাচ্ছে, এই ভাবনায় উপনীত হওয়ার আগেই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত অন্ধকারের সঙ্গে এক গভীর দার্শনিক নান্দনিক অভিযাত্রায় মেতেছেন। কারণ তিনি জানেন যে নশ্বর ব্যথা এবং যন্ত্রণার বিশ্বে আমাদের যাপন করতে হয়, তা নরকের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। কিন্তু ঈশ্বর এর মধ্যেই রয়েছে। ঈশ্বরের জন্য বা সুন্দরের জন্য, সত্যের জন্য, সে সত্য এক না বহু, তা নিয়ে সংশয় আমাদের থাকলেও, তার জন্য আমাদের যেতে হবেই, রাধা যেমন কণ্টকজর্জরিত পায়ে ছুটে গিয়েছিলেন অভিসারের নিয়তিনির্দিষ্ট পথে। এই অভিযাত্রার শেষ নেই কোনও কিন্তু অভিযাত্রার শেষে সেই সুন্দর যে রয়েছে, তার জন্য কবির মননে এবং মেধায় রয়েছে গভীর বিশ্বাস। রাত্রির মন্দির শীর্ষক কবিতাটি এক্ষেত্রে তাঁর সেই সময়কার ভাবনার প্রাণভোমরা বলতেই পারি আমরা। কারণ যে পটভূমিকা অন্ধকার বলে কবি শুরু করেন তাঁর প্রথম অভিযাত্রার শিলালিপিলিখন, সেই অন্ধকারের স্বরূপটি কী, আর তা কতটা সুন্দর, সে সম্পর্কে কবির কৌতূহল থাকাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে কৌতূহল তাঁকে নিয়ে গেছে এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে হয়ত আর ফিরে আসা যায় না।
কার ভয় কর? স্থির খদ্যোতের সবুজ তর্জণী
রাত্রির মন্দিরে জ্বলছে। অন্ধকার নিভছে। একদিন
যারা ছিল, যারা নেই, তারা এই মন্দিরে সবাই;
কেউ দেবদারু, কেউ তমাল, কারো বা রুগ্নদেহ
নশ্বরতাশেষে দিব্য চন্দনের সুস্থতরু হয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছে। সব সেরে গেছে, সকলের ব্যাধি
আরোগ্য হয়েছে; এই রাত্রির মন্দিরে তুমি ছাড়া
কেউ তো অসুস্থ নেই ওরে অন্ধ মরণবিলাসী,
ঈশ্বর তোমার বুকে তুমি বুঝি তাকিয়ে দেখবে না?
(রাত্রির মন্দির)
এই মহৎ চিরায়ত কবিতাটির সামনে এসে সমস্ত নশ্বর অস্তিত্ববাদ যেন হোঁচট খায়। যেন অজস্ব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। যেন নিজের কাছেই নিজে আশ্বস্ত হয়। যেন আজীবন বয়ে নিয়ে যাওয়া নিরাশ্রয় একাকীত্ব শেষে একফোঁটা কান্নার জন্য জায়গা খুঁজে পায়।
চিত্রকল্পের সন্ধানে নামক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- “ জর্জিয় কবিয়ালেরা অতিকথনে বিশ্বাস করতেন। তার ফলে তাঁদের কবিতা পরবর্তীদের কাছে অসত্যপ্রতিম বলে মনে হয়েছিল। হিউম বিরক্তিভরে বলে উঠেছিলেন রোমান্টিক কবিদের গোঙানি অসহ্য, এখন চাই অনার্দ্র কবিতা। ধ্রুপদী কবিতার সপক্ষে ইমেজবাদী কবিরা বাক্যময় কবিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন, কবিতায় প্রত্যাশিত হল বাঙ্ময় বিভূতি। প্রশ্ন জাগে, বাংলা কবিতা কেন আজও এই প্রত্যাশা যথাযথ জাগ্রত হল না?’ প্রতীক যেখানে বিষয় ও বিষয়ীর মধ্যে সমান্তর সম্পর্ক নির্দেশ করে, চিত্রকল্পের সন্ধান সেক্ষেত্রে বিষয় বিষয়ীর অন্তর্বয়ন। এই অন্তর্বয়নের রূপ ও অরূপ অলোকরঞ্জনের প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থে এক ভিন্ন ভাষায় রূপব পরিগ্রহ করেছে বলা যায়। যৌবন বাউলের আধুনিকতা ও আবহমানতার অন্তর্বয়নের পাশাপাশি আমরা এখানে সন্ধান করতে পারি নিষিদ্ধ কোজাগরী ও রক্তাক্ত ঝরোখাতে। স্মরণ করতে পারি নিষিদ্ধ কোজাগরী গ্রন্থের পথের মন্ত্র কবিতাটিকে-
পান্থশালার বারান্দায়
বসব না।
সূর্য
অরুণ বরুণ নিয়ে যখন
দিনান্ত।
চন্দ্র
কিরণমালা নিয়ে যখন
নিভন্ত।
আমরা
পান্থশালার বারান্দায়
বসব না।
আমুরা
দ্বিতীয় চুম্বনের আশায়
থাকব না।
খুলল
মেঘের দুয়ার
ঐ আমাদের সিংহাসন।
নামল
বোশেখি ঝড়, বৃষ্টি ভেজায়
সিংহাসন;
আমরা
দ্বিতীয় চুম্বনের আশায়
থাকব না।
নিষিদ্ধ কোজাগরী কাব্যগ্রন্থটিতে যেন মিতকথনের বিস্তার এক অনবদ্য অন্তর্বয়নের রূপ পায়। যৌবন বাউলে তবু অন্ধকার অস্তিত্ববাদের প্রেক্ষাপট ছিল, তা যেন এখানে নেই। এখানে কি কবি আরও গভীর অন্ধকারে গেছেন? না কি সেই আলোর কাছাকাছি পৌঁছেছেন, যার কাছাকাছি গেলে মানুষ অনেক শান্ত হয়ে যায়, অনেক কম তুলির আঁচড়ে এঁকে ফেলে মহাকাব্যিক ক্যানভাস। অলোকরঞ্জনের কবিতার এই আরেক বৈশিষ্ট্য। এক মহাকাব্যিক ক্যানভাস থেকে যায় তাঁর সৃষ্টিগুলির মধ্যে। যেন তিনি আঁকছেন একটি ছোট্ট ফুলদানী। কিন্তু তার প্রেক্ষাপটে আছে হয়ত সুদূর দিগন্ত বা যুদ্ধক্ষয়ী, রক্তক্ষয়ী বর্তমান। কিন্তু সেই ফুলদানীতে আঁকা আছে শান্ত এক পৃথিবীর সংসার। তবু এই শান্ত পৃথিবীর সংসার যেন ব্যাহত হচ্ছে ক্রমশ। তিনি নিজেকে আটকাচ্ছেন বারবার। কিন্তু যে অরূপরতনের সন্ধান একবার পেয়েছে, সে চরম অন্ধকারের মধ্যেও আলোর লীলা দেখতে পায়। ফলে, নিষিদ্ধ কোজাগরীতে আমরা এক অনবদ্য অলোকরঞ্জনীয় ভাষাপ্রবাহে দেখতে পাই তাঁর কবিতা অনেক বেশি রহস্যময় হয়ে গেল। আধুনিকতা কি অনেক বেশি সুললিত আচ্ছাদনে মুড়ে ফেললেন কবি? কিন্তু সুললিত এই আচ্ছাদনের ভিতরে আধুনিকতার নগ্নতা দেখতে পেলাম আরও বেশি করে।
আত্মনিহত দুটি মৃতদেহ
রাঢ়ভগবতীপুরে
দুপুরবেলায় পৌঁছিয়ে গেল
নদীর উজান ঘুরে।
একটি পুরুষ, তার চোখে তবু আক্রোশ, রুক্ষতা
অন্যটি নারী, তার চোখেমুখে অটুট স্বর্ণলতা।।
(নারীশ্বরী)
মনে রাখতে হবে এই কবিতাগুলি প্রকৃতপক্ষে সামাজিক রাজনৈতিক ভাবে আমাদের এক সন্ধিক্ষণের সময়। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর কবিতার অভিযাত্রাকে আমরা যদি দুই ভাবে ভাগ করি, তবে তার একভাবে পড়বে এই প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থ। আরেক ভাব শুরু হয় গিলোটিনে আলপনা থেকে। তার কারণও রাজনৈতিক। কিন্তু রাজনৈতিক সন্দর্ভের যে আকাশ লুকোচুরি খেলছিল এতক্ষণ ধরে, রক্তাক্ত ঝরোখায় এসে সেই সন্দর্ভ যেন নিজের অন্তরের ভিতরে থাকা দ্বন্দ্বগুলি নিয়ে হাজির হল নিশ্চিন্তে। যেন, দ্বন্দ্বই প্রধান বিষয়। আধুনিকতার বহিরঙ্গ কিন্তু তখন প্রবেশ করে গেছে তাঁর ভাবনায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রখর আন্তর্জাতিকতা। একপাশে রয়েছে নিজস্ব শিকড়ের পুরাণের রক্তমাংস। এর আগে আমরা বিশ্বকবিতায় ইয়েটস এবং বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। পেয়েছি সাতটি তারার তিমির-এর মতো কাব্যগ্রন্থ। অলোকরঞ্জনের রক্তাক্ত ঝরোখা, সাতটি তারার তিমিরের সঙ্গে গল্পগাছা করতে পারে। ‘ওসব ছলনা রেখে কবি/ উচ্চারণ কর, যথা ইস্পাতের দৃপ্ত জাহ্নবী/ ধরে জ্যোৎস্না, কিংবা খর সূর্যের অমিত স্বেচ্ছাচার/ শুধু জেন একমাত্র মানদণ্ড নয় প্রতিচ্ছবি/ নিদারুণ গহবরগুলিকে ঢাকে অরণ্যঅটবী/ মূমুর্ষুকে যে বলে অপ্রিয়্ সত্য, সে অতি নচ্ছার’। এমন এক আধুনিক মহাকাব্য বাংলা ভাষার আধুনিকতম সময়ে যে লেখা হয়েছে, তা আমাদের বড়ই ভাগ্যের বিষয়। কারণ এই কাব্যগ্রন্থটি তার মহাকাব্যিক বিস্তার নিয়ে ফিরে এসো চাকার আলোর ঔজ্জ্বল্যে চাপা পড়েই আছে, হয়ত বর্তমানেও ততটা জনপ্রিয় নয়। কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থটিকে বাংলা কবিতার এক মাইলস্টোন বললেও মনে হয় কম বলা হল।
ধানক্ষেতে এসেছিল বেড়াতে দু-জন
ধানক্ষেতে শিশু রেখে পালাচ্ছে দু-জন;
‘এবার স্টেশনে চল’, বলল একজন।
‘এবার স্টেশনে চল’, বলল একজন।
‘সাঁকো বেয়ে নীচে এস’, এ ওকে বলল।
‘সাঁকো বেয়ে নীচে এস’, এ ওকে বলল।
আর নেমে এসে দেখে সুন্দর কাঁথায়
রক্তমাখা শিশু নিয়ে ধানী নৌকো যায়।
সুন্দর কাঁথায় ধানী নৌকো যাচ্ছে রক্তমাখা শিশু নিয়ে। এই আপাত সুন্দর অথচ ভয়ংকর দৃশ্যের মধ্যে যেন প্রতফলিত হল নীরব এক হিংসা। তার পর থেকে ক্রমশ যে হিংসার দিকে সারা পৃথিবী চলেছে, হিংসা যে আরও বেশি সাম্রাজ্যবাদী, সূক্ষ্ম, ঠাণ্ডা এবং নীরব, চকিত হয়ে উঠেছে, তা আর অবিদিত নেই। অবিদিত নেই এ কথাও যে, সাত-এর দশকে এক রাতে হত্যা করা হয়েছিল তিনশো তরুণকে। হত্যা করা হয়েছিল নতুন পৃথিবীর স্বপ্নকে। এই অন্ধকারকে প্রত্যক্ষ করে লিখে রাখাও তো এক কবির-ই কাজ। তিনি তো কেবলমাত্র সেই মহাজাগতিক দর্শনের প্রতিনিধি নন। তিনি যেমন একহাতে সত্যের সঙ্গে শাশ্বতের, আবহমানের সঙ্গে আধুনিকতার বিবাহ দেন, তেমন-ই তাঁর রক্তপাত হয়, তাঁর সময়ের হিংসায়। তিনি নিজের চোখে দেখতে থাকেন ইতিহাস কীভাবে নিজের মর্মান্তিক ইতিহাস লিখে চলেছে। বিশেষ করে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যেমন দেখেছেন কমিউনিস্ট আন্দোলন, যেমন প্রত্যক্ষ করেছেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্বর্ণযুগ, তেমন তাঁর চোখের সামনেই দেখেছেন নকশাল আন্দোলনের উদ্ভব, তাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং নৃশংস ভাবে তাদের যে হত্যা করা হয়েছিল সেই সব ইতিহাস। আবার তাঁর সামনেই হয়েছে জরুরি অবস্থা, হয়েছে বিশ্বায়ন, হয়েছে সোভিয়েতের পতন, ভুবনায়নের বিষাক্ত সাম্রাজ্যবাদ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। ফলে রাজনীতি-লোকনীতির সংজ্ঞাগুলির যে ক্রম আধুনিকীকরণ ও ক্রম উত্তর-আধুনিকীকরণ হল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে মানুষের অস্তিত্ববাদ, সুররিয়ালিজম, দাদাইজমের সঙ্গে যে পরিবর্তন হতে হতে মানুষ আরও বেশি নিঃসঙ্গতায় চলে গেল, আরও ভোগ এবং আরও সংযমহীন এক সংকর প্রজাতির সমাজকে দেখলেন। অবক্ষয় বা অন্ধকার যে কত বিচিত্র সজ্জায় নিজেকে হাজির করতে পারে, তা তাঁর কাছে অনুপস্থিত থাকল না। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ২০০৭ সালে এই বাংলায় নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর কাণ্ডের পর তাঁর গোলাপ এখন রাজনৈতিক কাব্যগ্রন্থের কথা। শুরু করেছিলাম আধুনিকতা দিয়ে। কিন্তু আধুনিকতা তো নিজের নিয়মেই আর থাকল না। অলোকরঞ্জনের ভাবনার জগতে পাশাপাশি যেমন ছিল সুরদাস, কবীর, দাদূ সহ ভারতের মরমীয়া কবিতার জগত, তেমন ছিল ইউরোপীয় কবিতার উত্থ্বানের সম্পূর্ণ জগত। যেমন ছিল ইউরোপীয় ধ্রুপদী কবিতার আবহমানতার সম্পূর্ণ মানচিত্র, তেমন ভাবেই ছিল মার্ক্সীয় এবং উত্তর-মার্ক্সীয় ইউরোপীয় সাহিত্যজগত, প্রাচ্য নাটক, কাব্য চিত্রকলা এবং সঙ্গীতের জগত। তিনি প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বনাগরিক। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে কয়েকদিন আগে এই অধমের নেওয়া অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত=র একট সাক্ষাৎকার, যেখানে তিনি বলেছেন-
( বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আপনার প্রত্যক্ষ সহবাস। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের এবং বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের যোগাযোগ কি একটু ক্ষীণ হয়ে আসছে না? অল্পকয়েকজন ছাড়া কাজ সেভাবে হচ্ছে না বলেই মনে হয়।
অলোকরঞ্জন: তুমি একটা কথা ভাবো। প্রুস্তের লেখা বাংলায় অনুবাদ করতে পারবে না। দম বেরিয়ে যাবে। তেমনি কমলকুমার মজুমদারের লেখা তুমি অনুবাদ করতে পারবে না। ইংরাজিতেও খুব অসুবিধে হবে। আমাদের একটা অনুবাদের আকাদেমি নেই সেই অর্থে। তবে বিশ্বের কবিতার বাংলায় অনুবাদ করে তার একটা প্রতিমান দেখানো। এবং সেগুলো যে একেবারে নিরর্থক নিরীক্ষা হয়েছে তা কিন্তু নয়। এই জায়গাতে আমাদের একটা অভাব রয়েছে। একটা গ্যাপ। মাঝখানে একটা ভাসাভাসা বিরতির কাজ চলছে যেটা খুব ক্ষতিকারক বলে মনে হয়। এই জায়গায় সরকারের একটা ভূমিকা আছে বলে মনে করি। দিল্লির সরকারের। সাহিত্য অকাদেমিকে তো সরকার বলে দেবে না। সাহিত্য অকাদেমি থেকেও অনুবাদের কাজ হয়েছে। কিন্তু আরও বেশি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টে আরও যে কাজগুলো হওয়া উচিত ছিল ততটা এগোয়নি। গুন্টার আইশ বা গুন্টার গ্রাসের মতো কবি বাংলায় নেই। কিন্তু এটা ঠিকই যে একই আদর্শে প্রাণিত হয়ে যারা লিখছেন, আলাদা করে বলা যাবে না অঙ্গীকারের কবি, হাতের কর গুনে বলাটা খুব মুশকিল হবে, দ্বিতীয়ত এটা তো ঠিকই যখন কোনও গদ্য লেখা হবে, যে গদ্যটা আজকে কেউ লিখছেন তা তিনি দশ পনেরো বছর আগেও লিখতে পারতেন না। সময় তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে। কবিতার ক্ষেত্রেও এটি সমান সত্য। বিশ্বে বাংলার ভুবন এবং বাংলায় বিশ্বের ভুবন যত বিস্তৃত হবে, ততই মঙ্গল।
শুধু বাংলা বা ভারত নয়, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে এই হারিয়ে যাওয়ার এক ভিন্ন ভাষ্য দেখি আপনার নব্বই পরবর্তী কবিতায়…
অলোকরঞ্জন: আমি বলছি জীবনানন্দ যখন ইয়েটসের হাত ধরে এগিয়ে যান, বা মালার্মে যখন ডেলামেয়ারের হাত ধরে এগিয়ে যান, তার কথা। সমস্ত পৃথিবীর সমস্ত কবিদের মধ্যে একধরনের স্বগোত্রিতা থাকে। কিন্তু এটাও ঠিক যে দেশে যদি তার শিকড়টা না থাকে, এমন যদি হয় অধমর্ণ হয়ে শিকড় থেকে আমি লিখে যাচ্ছি তাহলে সেটা খুব আপত্তির ব্যাপার হবে। তুমি যে কবিতাটার কথা প্রথমেই উল্লেখ করলে, তার কী কোনও পূর্বসূরি কবিতা তুমি পেয়েছ? আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও পেয়েছ কী? পাওনি। কবিদের সমস্ত জায়গায় একটা সমান্তরাল এবং আদিগন্ত রাখীবন্ধনের ব্যাপার আছে। সেই জায়গাতে আমাকে শনাক্ত করার কাজটা কিন্তু তোমাদেরই করতে হবে।
(ফোনের মধ্যেই শোনা যাচ্ছিল চারপাশের কিছু গলার আওয়াজ)
এই যে শোনা যাচ্ছে তোমাদের আশেপাশে গলার আওয়াজ, একটু অসহিষ্ণু, এই চিৎকারটা আমি আমার কবিতার মধ্যে অন্তর্গত করে নিতে চাই, এবং একটু বলতেও পারো যে এখানে একটা আত্মদেবায়নের অভাব আছে। আমার মধ্যে একটা খুব ভয়ংকর অনপরিমেয় অতৃপ্তির অস্বস্তি আছে, আর সেটা না থাকলে আমি লিখব কী করে?
মনে পড়ছে একবার কথা হয়েছিল আপনার সঙ্গে সরল এবং তরল কবিতা নিয়ে। একই ছন্দে সরল এবং গভীর কবিতা যেমন হয়, তেমন আবার তরল ও লঘু কবিতাও। কিন্তু অনেকেই দেখি তার জন্য ছন্দকে দোষারোপ করে। আবার ছন্দকে বর্জনও করে। আবার অনেকের ধারণা ছন্দের দিন ফুরিয়েছে। আপনার কী মনে হয় এ প্রসঙ্গে?
অলোকরঞ্জন: একটা জায়গায় ছন্দ থাকবেই। রবার্ট ফ্রস্ট বলতেন না, যে যেমন জাল না টেনে ব্যাডমিন্টন বা টেনিস খেলা সম্ভব নয় তেমন সরবৃত্ত বা তানপ্রধান বা মাত্রাবৃত্ত তাতে সরাসরি না লিখলেও যে কবিতার মধ্যে ছন্দ নেই সেইরকম কোনও কবিতাকে আমি কিছুতেই অভিনন্দিত করতে পারব না। এটা তুমি লক্ষ্য করবে যে অরুণ মিত্রের পরে গদ্যছন্দটা অনেকটাই এসেছে। তার মাঝামাঝি, তার পাশাপাশি, তার আড়াআড়ি তাঁর কোণাকুণি যদি ছন্দ থেকে যায় তাহলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না বলে আমি মনে করি। আমি জানি অনেকেই বিশ্বাস করেন না এটা। কোন ঠাকুর? অবন ঠাকুর ছবি লেখে। এটাও তো একটা ছন্দ। এটাকে তো স্ক্যান করা যায়। যে গদ্যকে আমি স্ক্যান করতে না পারি সেই গদ্যকে কবিতার রাজকিরিট পরানোর আগে মাথা নত করে ভাবব যে তাহলে কি এতকাল আমি ভুল ভেবেছি?
(কিছুক্ষণ চুপ)
দ্যাখো, কবিতা একটা হাতের কাজ। সুভাষদা যেটা ভাবত। কিন্তু সেই সুভাষদার কবিতা – ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ সেখানেও কিন্তু স্বরবৃত্ত ছন্দ এসে যাচ্ছে। সুভাষদা এগুলোকেই এমন ভাবে এক একটা কবিতায় ব্যবহার করছেন যে সেইগুলো মিছিলের মন্ত্র হয়ে উঠছে। সেইগুলো, আমরা যাকে মেমোরেল স্পিচ বলি, স্মৃতিধার্য বাগ্মীতা, তার চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে উঠছে। এটাও কিন্তু এক ধরনের হাতের কাজ। উনি কবিতাগুলোকে সেইভাবে দাঁড় করিয়েছেন। অন্যদিকে দেখো, কাগজ ভাঁজ করার খেলা, অরিগ্যামি যেটাকে বলে। অনেক কবিরা সেটা খেলেন। এটা খুব স্বগত খেলা। তুমি তাকে দিঘির মধ্যে ভাসিয়ে দিতেও পা্রো একটা নৌকোর মতন। আবার তুমি তাকে পরমুহূর্তে ঘুড়ি করে আকাশে উড়িয়ে দিতে পারো। এটাও একটা হাতের কাজ হচ্ছে। এই হাতের কাজ করতে করতে কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রায় চোদ্দ পনেরো শতক থেকে অরিগ্যামি চলছে। এখন যারা অরিগ্যামির কাজ সারা জগত ধরে করছেন। হাতের কাজ। সেখানে একটা অদ্ভুত ধরনের সময়ের পর্ব বিভাগ আছে। কতক্ষণের মধ্যে সেটাকে করে মাটি থেকে আকাশের দিকে উড়াল দিয়ে দেওয়া যায়। এটাও একটা হাতের কাজ। এই হাতের কাজটা যদি না থাকে, বিশেষ করে আজকের ডিজিটাল যুগে, তাহলে তো আমার বাঁচার এবং বাঁচাবার কোনও মানদণ্ড থাকবে না।
আরেকটা কথা আমি তোমাকে বলি। সেটা খুব জরুরী। মনে রেখো। ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের একটা সূত্র ছিল যে পৃথিবীর সব যুগেই এমার্জেন্সি ছিল। পৃথিবীর সব যুগে। কিছুটা এমার্জেন্সি কবির নিজের বাঁচার মধ্যে থাকে। যেমন ধর বিনয় মজুমদার। এখন বিনয় মজুমদারকেও পয়ারের দিকে একটু ঝুঁকতে হয়েছে। শক্তিকেও ঝুঁকতে হয়েছে একটু স্বরবৃত্তের দিকে। তার মানে আবার একদম শাক্তপদাবলীর মতো এমনও নয়। সেভাবে হবেও না। এখন ধরো ইন্দিরা গান্ধীর এমার্জেন্সির সময় লোকে ভয়ে ভয়ে লিখছে।এখন হয়ত সেই ভয়টা কেটে গেছে। কিন্তু এমার্জেন্সি সম্পর্কে একটা চেতনা না থাকলে এটা একটা আত্মপ্রসাদের ক্ষীণ অনুবাদ হবে। কবিতা কবিতা হয়ে উঠবে না।
এমার্জেন্সি সত্ত্বেও কবিতার এই কাজটি কিন্তু চলছে…
অলোকরঞ্জন: এখনও নিশ্চয় একটা এমার্জেন্সি চলছে। এখন বিশ্ব জুড়েই একটা এমার্জেন্সি চলছে। বার্মাতে দেখছি সাংবাদিকদের মুখ চেপে ধরা হচ্ছে। তবে আমি শুধু সরকারি প্রশাসনের দিক থেকে বলছি না। এমন একটা জায়গা তো এসেছে যেখানে মানুষ প্রশ্ন করতে শিখেছে। প্রশ্ন করছে। আর কলকাতায় যত কবিতার পত্রিকা এমন কি পৃথিবীতে কোথাও আছে? নেই তো! তুমি যদি সেগুলো পড়ো তাহলে দেখতে পাবে, কেউ কেউ করছেন ওই হাতের কাজ সুভাষদার ধরনের। আর কেউ করছেন ওই অরিগ্যামির খেলা। তার মধ্যে দিয়ে ওই কবিতার কাজটা কিন্তু চলছে। এটা আমি বলব। কবিকে আমি দেখব না। আমি দেখব কবিতা থেকে কবিতায় বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেটা চলছে সেটা কিন্তু বাংলা ভাষার মতো ভারতীয় সবকটা ভাষায় চলছে বলে আমার মনে হয় না। এখন দেখো এমন বিবর্তন মারাত্মক ধরনের কিছুটা মারাঠি কবিতায় গেছে। কিন্তু দিলীপ চিত্রের মৃত্যুর পর সেদিকে আর এগোয়নি। কবিতার এই যে বিচিত্র পথসঞ্চার, আমি সেইদিকে খুব আশা রাখি। আর এইখানে একজন তরুণ কবি, রাজাধিরাজের মতো কলকাতার পথে পথে হেঁটে চলেছেন।)
অলোকরঞ্জনের এই কথাগুলির মধ্যে থেকেই স্পষ্ট, তিনি কীভাবে গিলোটিনে আলপনার সময় থেকে নিজেকে বদলে প্রায় একটি কুঠারের মতো করে তুললেন। কারণ এ কথা সত্য, হয়ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকেই সত্য, যে আমরা বসবাস করছি একটি নিয়ত জায়মান এমার্জেন্সির মধ্যে। একজন জায়মান কবি বা শিল্পীর মতোই তিনি নিজেকে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলির নিরাপদজনক পরিসরে আটকে রাখলেন না। দার্শনিক অন্ধকারের পাশাপাশি তাঁর রচিত আলোর কথা বলতে শুরু করল সময়ের মধ্যে থাকা অসুখ। যখন সময় নিজেই সেই অসুখের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে শুরু করল, তখন তিনিও সেই প্রতিরোধের সাক্ষী হিসেবে থাকলেন। একজন প্রকৃত কবি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলেও গতানুগতিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন না। বরং তিনি স্রোতটিকে লক্ষ্য করেন। সমগ্র ইতিহাসবোধের আবহমানতায় দেখেন তাঁর সমসময়কে। অর্থাৎ আজ যে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, তা বহুবছরের ইতিহাসযানের প্রেক্ষিতে তিনি দেখতে থাকেন। গিলোটিনে আলপনা এমন একধরনের কবিতা, যেখানে আধুনিক একজন ব্যক্তির মধ্যে দিয়েও আবহমান মানুষের যন্ত্রণাবোধের জায়গাটির কথা তিনি লিখে যাচ্ছেন। তাঁর কাব্যজীবনের সেই প্রথম পর্যায়ের যৌবন বাউলের বাউল এখানে যে রয়েছে, তা বলা বাহুল্য। কিন্তু সেই বাউল এখন শুধুই একতারাতে রাত্রির মন্দিরের অপূর্ব অন্ধকারের সঙ্গে যাপন করতে পারে না। যে আঁধার আলোর অধিক যেমন তিনি প্রত্যক্ষ করেন, তেমন প্রত্যক্ষ করেন যে আলো আঁধারের চেয়েও অন্ধকার, তাকে।
ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল অস্থাবর পোকামাকড়
সাঁওতালডির আলোকমালায় অতীন্দ্রিয় ছল
কেউ বলেছে এবারে খুব ফসল হবে না-ই বা হলো ফসল
ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ুক দুর্ভিক্ষের অকূল চরাচর
আমি তবু এই শরীরের খড়
সংকলিত সত্তা আমার একাগ্র পবিত্র করে রাখি
‘আমাকে ভোগ করবে তুমি’- বলে জ্বালাই শেষদুটি জোনাকি!
( জ্বর)
ভয়ংকর এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভিতরের বিশ্বাস কিন্তু ভাঙেনি। এইটাই আধুনিকতার সামনে এক বিরাট বড় দেওয়াল হয়ে রইল। মঙ্গলের প্রতি বিশ্বাসের জায়গা থেকেও অলোকরঞ্জন সুন্দরের গা থেকে যে রক্ত পড়ছে, যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে ঘাসের উপর পড়ে থাকছে মাংসের টুকরো, বাতাসে মিশে যাচ্ছে পারমাণবিক ভস্ম, তা প্রত্যক্ষ করছেন। তিনি দেখছেন একটা অ্যাপোক্যালিপ্টাস পৃথিবীর দিকে আমরা সকলেই এখন এগিয়ে চলেছি। এই প্রত্যক্ষ করাটাকে তিনি লিখে রাখছেন। একজন বিশ্বনাগরিকের মতোই তিনি দেখছেন যে ধ্বংসস্তূপের কোনও কাঁটাতার নেই, দেশ নেই। যে ভাষা তাঁর দেশ বলে তিনি গর্ববোধ করেন, সেই ভাষাও ক্রমশ বিপন্নতায় ডুবে যাচ্ছে। গত কুড়ি বছরের কবিতা অলোকরঞ্জনের এই ক্রমশ বিপন্নতাকে ধরার কবিতা, তাঁর কষ্টযাপনের কবিতা, তাঁর অসহায় ভাবে এক অসুস্থ পৃথিবীকে প্রতি মুহূর্তে আরও অসুস্থ হয়ে চলতে দেখার কবিতা। কারণ এই বিপন্নতা তো শুধু একটি বিশেষ এলাকার নয়, সমগ্র বিশ্বের। এই বিপন্নতার মধ্যে যেমন মিশে আছে ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক সন্ত্রাসের পৃথিবী, তেমন আছে বিশ্বায়িত অর্থনীতির ফাঁদ, যেমন রয়েছে মৌলবাদের রাজনীতির পৃথিবী, হিংসায় ক্রমশ উন্মাদ পৃথিবী, তেমন রয়েছে একটা নীতিহীন পৃথিবী। পরিবেশ বিপন্ন, মানবতা বিপন্ন, সুন্দর বিপন্ন। এই গভীর রাজনৈতিক অবস্থা কীভাবে তাঁর কবিতা থেকে আলাদা থাকবে? তাই, আমার মনে হয় গত কুড়ি বছরের অলোকরঞ্জনের প্রতিটি শব্দ রাজনৈতিক, যদিও তাঁর অন্তর্বয়ানে রয়ে যায় সেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব, যাঁর সঙ্গে কথোপকথন সেই যৌবন বাউল লেখার সময় থেকেই শুরু করেছিলেন তিনি। ভালো হত, খুব ভালো হত, যদি কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত একটি সুন্দর পৃথিবীতে চলে যেতে পারতেন। আমরা দুর্ভাগা, কারণ তিনি এখন বিয়াত্রিচেকে খোঁজেন না, খুঁজতে পারেন না, তিনি এখনও হেঁটে চলেছেন ইনফের্নোর আগুনের মধ্য দিয়ে। বরং দান্তের চেয়েও তাঁর যাত্রাপথটি একটু আলাদাই হয়েছে। পুরগেতোরিওর থেকে তিনি শিকড় সন্ধানে এসেছেন ইনফের্নোর মধ্যে। এই ইনফের্নোও তো তাঁকে পেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তাঁর আশ্রয় কখনওই তাঁকে ছেড়ে যাননি। সেই আশ্রয়ের সঙ্গে তাঁর যাপন-ই তাঁকে করে রেখেছে এক শান্ত পর্যটক। তিনি অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন সুন্দরের খুঁটিনাটি, যার গায়ে লেগে আছে বোমার টুকরোর বিষাদ। আর তার হাত ধরেছে তার নিজস্ব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভাষাবিশ্ব। যা সম্পর্কে তাঁর এক প্রবন্ধ থেকে আভাস পাওয়া যায়-‘ ভাষা এবং শব্দ এক নয়। ভাষার মধ্যে ধ্বনি আছে, অনেকখানি জায়গা জুড়ে। তা নাহলে অর্থহীন বৈদিক স্তোভধ্বনি ঐ মর্যাদা পেত না, ব্রজবুলির মতো আবেগনিয়ন্ত্রিত, ব্যাকরণবিস্মৃত ভাষা পেতাম না আমরা। আধুনিক কবিতায় শব্দই সমগ্র ভাষাকে কোণার্ককিন্নরীর চিবুকে ক্ষোদিত করে তুলে ধরেছে। অনন্ত শূন্যের দিকে মালার্মে শাদা কাগজ মেলে রেখেছিলেন, ভাষার ভাষা পরম শব্দকে অভ্যররথনা করে নেবেন বলে। বাঙ্ঘলা কবিতায় এই মুহূর্তের শব্দৈষণা বিশ্লেষণ করলে দেখবো মালার্মের নিরঞ্জন সেই শব্দসন্ধানে এসে মিলেছে জীবনানন্দের শব্দব্যক্তিত্ব”।
অলোকরঞ্জনের কবিতা, সেই ব্যক্তিত্বকেই ধারণ করে চলেছে। শূধু তিনি এক বিষাদের মন নিয়ে চেয়ে দেখছেন কীভাবে এই পৃথিবী আত্মঘাতী হয়ে উঠল! কীভাবে আধুনিকতা নিজেই নিজের আয়না ভেঙে ফেলল। কীভাবে প্রকৃতির ভিতর জন্ম নিল প্রকৃতিকে ধ্বংস করার কীট। যে সুললিত অন্ধকারের সাধনায় তিনি রাত্রির মন্দিরে ঈশ্বরকে অন্তরে নিয়ে উপাসনায় বসেছিলেন, সেখানে তিনি আজও বসে আছেন। কিন্তু তিনি জানেন, সব অন্ধকার এক অন্ধকার নয়। এখন অন্ধকার বড় অচেনা। বড় হিংস্র। বড় বেশি ধ্বংসাত্মক।
অলোকরঞ্জনের কবিতা এক নিঃস্বার্থ আরুণির মতো এই ধ্বংসের স্রোতের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি জানেন, একার পক্ষে হয়ত এই স্রোত আটকানো সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি এও জানেন, একমাত্র সুন্দর দিয়েই এই অসুন্দরকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
[লেখক পরিচিতি - জন্ম ১৯৭৮। পেশায় বিজ্ঞাপনকর্মী৷ সমসময়ের একজন উল্লেখযোগ্য কবি, গদ্যকার, অনুবাদক।]
একুশে আশ্বিন
অরুণ দে
কলকাতার জাতক সে। পিতামহের প্রয়াণের পর তাকে চলে যেতে হল গ্রামের পরিবেশে। যাবার সময় তার কোনও কষ্ট হয়নি। বেশ কয়েক বছর পর পারিবারিক বিপর্যয়ে আবার তাকে ফিরতে হল কলকাতার কাছেই। আসার সময় তার মন কেমন করছিল বন্ধুদের জন্য। স্টেশন প্ল্যাটফর্মের সেই গাছটার জন্য, যার কাছে সন্ধেটা তারা কাটিয়ে দিত দিনের পর দিন। তার মন-কেমনের মধ্যে বাসা বেঁধে নিল অনিশ্চয়তা। সে জানত না ঘর যে ছাড়ায়, হাত সে বাড়ায়। একে একে সে অনেক কিছু পেল। অনেকই। তাকে ঘিরে থাকে কত স্নেহ, ভালোবাসা। শুভ ইচ্ছা। এমন করেই একদিন সে পেয়ে গিয়েছিল একুশে আশ্বিন। তারপর সেই একুশে আশ্বিন একটু একটু করে ডালপালা মেলে বিশাল মহীরুহ হয়ে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। চোখ বুজলে এখন সে দেখতে পায় ঝলমলে আকাশ। শুনতে পায় আকাশ জুড়ে বাজছে এক আনন্দগান।
[অরুণ দে : জন্ম ১৯৫৪। সাহিত্য অকাদেমির প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক। ছড়াকার। রম্য রচনা লেখক।]
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র ভাষা
হান্স্ হার্ডার
সম্প্রতি প্রকাশিত “বাস্তুহারার পাহাড়তলি” কবিতা সংকলনে মার্টিন হাইডেগার (Martin Heidegger) – এর নামে একটা কবিতাতে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বিংশ শতাব্দীর এই অস্তিত্ববাদী জার্মান চিন্তকের সঙ্গে তাঁর একটা নিবিড় যোগাযোগ-সূত্র স্থাপন করেছিলেন।
কবিদের সর্বাগ্রণী দার্শনিক তুমি, তুমিই তো শিখিয়েছ, ‘মানুষের অস্তিত্বের আবাসন ভাষা’।
ভাষাই যেন আমাদের বাড়ি - হাইডেগার-এর এই মন্ত্রটি অলোকরঞ্জন-এর খুব প্রিয় একটি উদ্ধৃতি, এবং এমন হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক : ভাষাকে নিয়ে ভাষার মধ্যে থাকা, প্রতি মুহূর্তেই সেই ভাষাকে ভালোবাসা, বিদ্রূপ, আরও কত রকমের খেলা করার প্রবণতা অলোকরঞ্জন-এর কবি আর ব্যক্তিচরিত্রের এক অবিছেদ্য লক্ষণ।
সেই মার্টিন হাইডেগার একথাও বলেছিলেন যে, গ্রীক আর জার্মান ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় দর্শনশাস্ত্র নেই; আর এটাও জানা কথা যে হাইডেগার হিটলার এর আমলের প্রথম পর্যায়ে হিটলারপন্থী ফ্যাসিবাদীদের পক্ষে ছিলেন; ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে কর্মরত থাকাকালীন ইহুদি অধ্যাপকদের পদচ্যুত করার ব্যাপারে ক্ষেত্র-বিশেষে তাঁর ভূমিকা ছিল যাকে বলা যায় সক্রিয়। ভাষার সীমানা যিনি অতটা অনির্বচনীয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, সেই দার্শনিক যে সঙ্কীর্ণ জাত্যাভিমানে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেটা ঘটনা - সঙ্কীর্ণতা যেন ব্যাপ্তিকে নিজের সীমানায় আটকে রেখেছিল।
হাইডেগার-এর ভাষা-প্রেমে প্রভাবিত হয়েও অলোকরঞ্জন হাইডেগার-এর একদেশদর্শিতা (বা দ্বিদেশদর্শিতা)-র ঠিক উলটো দিকে অবস্থান করেন। তাঁর কবিতায় তিনিও বাংলা ভাষার সীমান্তরেখাগুলো নিয়ে অনেক রকম নিরীক্ষা করতেই থাকেন। কিন্তু অলোকরঞ্জন-এর মতো একজন তুলনামূলক সাহিত্যতাত্বিক – সহজলভ্য ব্যাপ্তি যাঁর ক্ষেত্রে সর্বদা কার্যকর – কথায় আর তাত্বিক লেখায় যেমন, কবিতায়ও তেমনই।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জিগ্যেস করতে পারি যে ভাষা যদি মানুষের একটা আবাসন হয়, তাহলে অলোকরঞ্জন-এর কবিতা কিরকম বাসস্থান? ব্যাতিক্রমী নিশ্চয়ই - এই গৃহে দশটি দরজা, সাতটি তলা, ত্রিবেণী আর মালকোঠা সুনির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করে না; বসার ঘর বা শয়নকক্ষের মধ্যেকার দেওয়ালগুলো নেই। আমি মনে করি এটা একটা কল্পগৃহ, যেখানে দেওয়ালগুলো সুবিধামতো তৈরি করা যায়। সার্বজনীন আর ব্যাক্তিগত স্তরগুলো আলাদা না থেকে অনেক সময় মিশে যায়। সেই বাড়ির খোলা ছাদের ওপর ভাষার সঙ্গে, ভাষার মাধ্যমে এক খেলা চলতে থাকে।
কিন্তু কবিতার ওস্তাদের কবিতার বর্ণনা কবিতার ভাষায় করাটা আসলে হাস্যকর একটা চেষ্টা। কবিতা নিয়ে ভাষা, ভাষা নিয়ে অলোকরঞ্জন, আর মাঝে মাঝে তাঁর কবিতা আমারও মুখের ভাষা। যেমন বৃষ্টির সময় ছাদের নিচে আমার পড়ার ঘরে বসে থাকলে জলের ফোঁটা যখন টপটপ করে ছাদের ওপর পড়তে থাকে, তখন অলোকরঞ্জন-এর ‘প্লাবনের রাজগৃহে’ মনে পরে। তাঁর পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কবিতায় প্লাবন যতই প্রলয়ধর্মী হোক না কেন, সেই রাজগৃহ যেন হয়ে যায় আমার আপন বাসস্থান, মিশে যায় দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের সঙ্গে। পৃথিবী টলমল করছে করুক, আমি আপন গৃহে সুরক্ষিত। এভাবে একটা বাংলা কবিতা জার্মান এক চিলেকোঠাকে রাজগৃহে পরিণত করতে থাকে।
গ্রীক-জার্মান বা বাংলা সংস্কৃতির সীমানাগুলো না মেনে তাঁর আরও অনেক কবিতা চারদিকে ভেসে যাক আর আমাদের পরিণতি ঘটাক, এটাই তাঁর অষ্টআশিতম জন্মদিনে আমার কামনা।
[হানস হার্ড।র : জন্ম ১৯৬৬। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’ – এর অধ্যক্ষ। একাধিক বই-এর লেখক এবং বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় পারদর্শী।]
অনন্য ভাষাশিল্পী অলোকরঞ্জন
জয় গোস্বামী
সহজাত কবিত্বপ্রতিভার নক্ষত্রদীপ্তি নিয়ে অলোকরঞ্জন আবির্ভূত হন বাংলা কবিতার আকাশে। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘যৌবন বাউল’ প্রকাশমাত্র কাব্য পাঠকরা বিমোহিত হয়ে যান এই কবির অসামান্য প্রকরণ-দক্ষতা ও কবি হৃদয়ের মাধুর্যস্পর্শে। সেই প্রথম কাব্য-পুস্তক থেকে আজ পর্যন্ত কখনও এই কবির অবিরল অগ্রসরমানতার পথে কোনও বাধার পাথর এসে দাঁড়াতে পারেনি। আজ পর্যন্ত তিনটি কবিতা-সমগ্র বেরিয়েছে অলোকরঞ্জনের। আরও তিনখণ্ড সমগ্র এক্ষুনি বেরোতে পারে তাঁর কবিতার পরিমাণ এতই অধিক।
আশির দশকে একটি অধুনালুপ্ত লিটল ম্যাগাজিন অলোকরঞ্জনের মাতৃদেবী নীহারিকা দাশগুপ্তের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে অলোকরঞ্জনকে বিষয় হিসাবে কেন্দ্রে রেখে। অলোকরঞ্জনের মা সেই সাক্ষাৎকারে একটি কথা বলেছিলেন, যেকথা আমার আজও মনে আছে। সেই কথা থেকে জানা যায় অলোকরঞ্জন যখন মাত্র ছয় বছরের শিশু, তখন তিনি মুখে মুখে দুটি কবিতার লাইন তৈরি করে তাঁর মাকে বলেন। সেই লাইনদুটি হল, ‘হরিণগুলো চরে বেড়ায় বনে বনে/তারা কথা বলে মনে মনে’। ছয় বছরের শিশু একথা ভাবতে পারল কিভাবে যে, নীরব হরিণেরা মনে মনে কথা বলে চলেছে? এই হল অলোকরঞ্জনের কবিত্বের প্রথম প্রকাশ। এই দুটি লাইন থেকেই বোঝা যায় ভবিষ্যতে এক বড় কবির উন্মেষ ঘটতে চলেছে।
আজ অলোকরঞ্জন এক আন্তর্জাতিক কবি ও চিন্তকরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর একের পর এক কাব্যগ্রন্থে আমরা যেমন দেখতে পাই ভারতবর্ষের চিরকালীন রূপ – তেমনই সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দেশ হারানো, ভিটেমাটি হারানো যেসকল শরণার্থী ও উদ্বাস্তুরা রয়েছেন, তাঁদের নিয়ে কবির একান্ত উদ্বেগ ও চঞ্চলতা।
অলোকরঞ্জনের কবিতায় আমাদের এই বঙ্গদেশ যেমন ধরা পড়ে, তেমনই প্রকাশ পায় সারা পৃথিবীর বিপন্ন মানুষের কথা। অলোকরঞ্জন শুধু বাঙালির কবি নন, তিনি তাঁর কবিতায় ধারণ করেন সমস্ত বিশ্বের দুর্দশাগ্রস্ত জনসাধারণের জন্য এক আকুল সমবেদনা। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর শেষতম কাব্যগ্রন্থ ‘পাহাড়তলির বাস্তুহারা’–র মধ্যেও সেই চিত্র জাজ্জ্বল্যমান।
তবে অলোকরঞ্জন শুধু কবিতাই লিখেছেন সারা জীবন ধরে, তাই নয়; তাঁর প্রবন্ধের বইগুলিও গদ্যরচনার একেবারে স্বতন্ত্র একটি ভাষা ও দৃষ্টিকোণকে বাঙালি পাঠকের সকাশে নিয়ে এসেছে। কে ভুলতে পারে অলোকরঞ্জনের প্রবন্ধ-গ্রন্থ ‘শিল্পিত স্বভাব’- এর কথা? কার মনে পড়বে না ‘স্থির বিষয়ের দিকে’ নামক তাঁর অতুলনীয় গদ্য গ্রন্থটিকে? এখন তাঁর কবিতার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গদ্যসংগ্রহ কলেজ স্ট্রিট থেকে কিনে নিয়ে যান পাঠকরা। তাঁরা পড়েন এবং আবিষ্ট হন। তাঁর গদ্যসংগ্রহের অন্তত আরও দুটি খণ্ড প্রস্তুত করা যায় এই মুহূর্তেই, সেকথা তাঁর পাঠকমাত্রেই বুঝতে পারেন। অলোকরঞ্জনের মৌখিক বাংলা ভাষাও এক অলৌকিক ঔজ্জ্বল্য বিকিরণ করে। এবং সর্বদা সেই ভাষাজ্যোতি বিচ্ছ্যুরিত হয় তাঁর মুখের সামান্য–সাধারণ কথা থেকেও।
আমি অনেক সময় অলোকরঞ্জনকে ভাষণ প্রদান করতে শুনেছি। এমন আশ্চর্য সেই ভাষণের প্রতিটি বাক্যগঠন এবং এত অপূর্ব সেই ভাষণকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শৈলী, এত নিখুঁত সেইসব ভাষণকে তার নিজস্ব গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার যুক্তি-পরম্পরা, যে সকল শ্রোতাই সেসব ভাষণে মুগ্ধ না হয়ে পারেন না।
সেই কারণে প্রত্যেক বছর দু’মাসের জন্য যখন তিনি জার্মানি থেকে কলকাতায় এসে বাস করেন, তখন প্রায় প্রত্যেকদিন তাঁকে এক বা একাধিক সভায় গিয়ে ভাষণ পেশ করতে হয়। অনুরাগীদের হৃদয় তিনি এমনভাবেই জয় করে চলেছেন পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময় ধরে।
অলোকরঞ্জন সাতাশি বছর বয়স পূর্ণ করলেন সদ্যই। এত দীর্ঘকাল ধরে লিখে চলার ক্ষেত্রে, ভাষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ভাষার ইন্দ্রজাল রচনার ক্ষেত্রে তিনি আজও এক অদ্বিতীয় সিদ্ধপুরুষ। নিজে পঞ্চাশ দশকের কবি হয়েও নবীন প্রজন্মের কবিতা লেখকরা তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। আশি দশকের কবি নাসের হোসেন যেমন তাঁর স্নেহধন্য, তেমনই এই একবিংশ শতকের প্রথম দশকে সদ্য লিখতে আসা কবি ও সম্পাদক জিৎ মুখোপাধ্যায়ও তাঁর স্নেহাশ্রয় লাভ করেছে। নিজের বিষয়ে এটুকু বলতে চাই, এই কবির স্নেহস্পর্শ আমিও পেয়েছি। এবং সেই স্নেহ অলোকরঞ্জনের হৃদয়ের কত গভীর থেকে উৎসারিত হয়েছে, তার একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে আমার এই সংক্ষিপ্ত প্রণাম নিবেদন আমি সম্পূর্ণ করতে চাই।
সকলেই জানেন, অলোকরঞ্জনের স্থায়ী বাসস্থান জার্মান দেশে। ইতিমধ্যে তিনি বিদেশে থাকাকালীন আমাকে একবার চাকরি ছাড়তে হল। সে খবর প্রবাসে বসেও অলোকরঞ্জনের কাছে কিভাবে পৌঁছল, সেকথা আমি জানি না। কিন্তু অলোকরঞ্জন, একদিন রাত সাড়ে দশটায় আমার স্ত্রী কাবেরির ফোনে ফোন করে কথা বলতে চাইলেন।
কি বললেন তিনি আমাকে? এমন একটি কথা বললেন, আমি সারা জীবন মনে রাখব। অলোকদা বললেন, তোমার যদি কোথাও দরকার হয়, তাহলে আমাকে অবশ্যই জানিও। জানবে আমি সর্বক্ষণ আছি তোমার পাশে। কোনও প্রয়োজনের কথা আমাকে জানাতে বিন্দুমাত্র সংকোচ কোরো না।
এতবড় কথা কে বলতে পারে? যাঁর হৃদয় দিগন্ত-প্রসারিত, তেমন মানুষের কাছেই এমন কথা শুনতে পাওয়া যায়। অলোকদা বুঝতে পারেননি, কিন্তু ফোন ধরা অবস্থায় আমার চোখ দিয়ে জল ঝরছিল। ফোন যখন কাবেরিকে ফেরৎ দিতে গেলাম, তখন কাবেরি বলল, একি! তোমার চোখে জল কেন?
কাবেরিকে বললাম আমার এই অশ্রু সংবরণ করতে না পারার কাহিনী। আজ পাঠকদেরও জানালাম।
অলোকরঞ্জন শতায়ু হন, ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনাই করি।
[জয় গোস্বামী : জন্ম ১৯৫৪। এই প্রজন্মের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি কবি। অসংখ্য জনপ্রিয় কবিতার জনক।]
স্তিমিত সিংহাসন
ফ্রীডরিশ এঙ্গেলস
একটি ক্রান্তিসঞ্চারী কাব্যনাট্য। তথ্যগ্রন্থি ও জার্মান থেকে অনুবাদ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
প্রস্তাবনা
গত শতাব্দীর সাতের দশকে কলকাতায় বইমেলা শুরু। প্রথম কয়েক বছর মেলার শেষ দু’দিন বইবাজার হতো। সেইরকম এক বইবাজারে হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ পেলাম ‘কার্ল মার্ক্সের প্রেমের কবিতা’। ভারি অবাক হয়েছিলাম। একইরকম অবাক হলাম যখন শুনলাম ফ্রীডরিশ এঙ্গেলসের লেখা নাটকের কথা। বন্ধু রাজা মুখোপাধ্যায়ের কল্যাণে ‘স্তিমিত সিংহাসন’ হাতে পেয়ে তো আরেক চমক। মূল জার্মান থেকে অনুবাদ করেছেন আমাদের প্রিয় অগ্রজ কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।
‘ফ্রীডরি ওসভাল্ড’ ছদ্মনামে প্রথম জীবনে নাকি লিরিকধর্মী কবিতা লিখতেন এঙ্গেলস – ভাবা যায়? আনুমানিক ১৮৪১ সাল নাগাদ এই কাব্যনাটকটি লেখেন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা ও পতন পরিণতির কাহিনী বলেছেন। বুর্জোয়া অভিজাতশ্রেণী অথবা স্বৈরতন্ত্র, সে যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত এরা কেউই যে সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক নয় – বরং ক্ষমতা দূষণের ফলে সমাজের কী ভয়ঙ্কর ক্ষতিসাধন করে –এই সতর্ক বার্তা এঙ্গেলসের এই কাব্যনাটকের মাধ্যমে এই সময়ের প্রাসঙ্গিকতায় আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে – পাঠকমাত্রই তা উপলব্ধি করবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
কবি পল্লববরন পাল
২০ অক্টোবর, ২০২০, কলকাতা
প্রথম অঙ্ক। প্রথম দৃশ্য
পটভূমি রোম।
দৃশ্যাভাস : নগরদুর্গ
(কোলোনা ও অন্যান্য অভিজাত নাগরিকদের প্রবেশ।।
ঈষৎ পরেই বাতিস্তার নেতৃত্বে এগিয়ে আসে জনতা)।
অভিজাতবৃন্দ ॥ কোলোনা, পালানো যাক, ভিড়ের চাপে মারা পড়বার দশা। ক্ষিপ্ত জনতার উগ্ৰায়ণ থেকে সরে পড়া যাক।
কোলোনা ॥ পালানো? যেটার কাঁধে পা রেখেছি একাধিকবার
সেই আবর্জনতার থেকে বুঝি পালাবে কোলোনা ?
পালাতে হয় তো ধাও কাপুরুষ। আমিই সামলাব ঐ ক্রোধ।
অভিজাতবৃন্দ ॥ দেখছ না কীরকম ফেঁপে-ফুলে রাস্তা জুড়ে যায়।
শুনছো না ওদের দাপ? সঙ্গে চলে এসো
(জনতা, বাতিস্তা তার চুড়োয়। ভিতরে ঢুকে পড়ে)
বাতিস্তা ॥ ব্যাপারটা তাহলে ঠিক কী দাঁড়াচ্ছে? শহুরে বাবুরা।
আমাদের ছেড়ে যাবে এত কেন ত্বরা? |
অথচ থাকতেও চাও সেটা বেশ বুঝেছি আমরা।
কোলোনা ॥ (অভিজাতবৃন্দকে) বেশ তো সইছো তোমরা
নিজেদের নিয়ে এ মস্করা?
বাতিস্তা ॥ চেয়ে দেখো সাধারণ মানুষের আর্তিময় মুখ
থাকো আমাদের দেশ, এই শুধু প্রার্থনা আমাদের।
কোলোনা ও অন্যান্য।
অভিজাতবৃন্দ ॥ ভেগে যা নির্বোধ যতো, এ তল্লাট থেকে।
বাতিস্তা ॥ আমরা তো তোমাদের সেবাদাস হতে দিব্বি রাজি।
কোলোনা ॥ (অভিজাতবৃন্দকে) ছুরি বিচ্ছুরিত করো-
বাতিস্তা ॥ শিশুর সোহাগে তোমাদের খুব করব যতন
বিদ্রোহে আর যাব না রইব সন্তর্পণ
বাকস্বাধীনতার দিয়ে দেব বলি বি-লক্ষণ।
ভার্যা ও শিশু দেব তোমাদের উৎসর্জন।
বাড়িঘরদোর লুটে-পুটে করো রমণ-বমন
আমাদের নিয়ে চাও যদি করো অবলুণ্ঠন
চাপ দাও, হানো, পরাও-না বেড়ি শেকলভূষণ
পাপ তাপ যতো করেছি দহন মোচন
শুধু কাছে থাকো, শুধু করি এই নিবিড় ভজন
কোলোনা ॥ ধীমানগণ, কী মনে হয়!
অভিজাতবৃন্দ ॥ পালাক, নির্বোধ যতো - এ তল্লাট থেকে –
কোলোনা ॥ পালাও, নির্বোধ পামর যতো
স্বরধ্বনি এই চেনো না আর।
বজ্রে বিঁধেছিল চমৎকার।
তোদের, আর এই পায়ের লাথি
তোদের শিরোদেশে – হা বজ্জাতি -
আপন প্রভুকেই বেবাক ভুলে গেলি পরিষ্কার!
জনতা ॥ নিপাত যাও!
কোলোনা ॥ (অভিজাতবৃন্দকে) নিষ্কোশিত করো অসি অন্তর আত্মরক্ষায়
জনতা ॥ চুলোয় যাও! আজ মুক্তি আমাদের!
বাতিস্তা ॥ মিনতি, আমাদের সঙ্গে রয়ে যাও।
অভিজাতবৃন্দ ॥ রোষ থেকে প্রস্থান, ফেরা তারপর
যেই না ঘটবে প্রতিস্পৃহাপ্রহর
কোলোনা ॥ অগত্যা এই নরমপন্থা
দুরন্ত হোক, বিদায়, জনতা আসবে যখন আমাদের শাহী।
কাঁপবে তোমরা ত্রাহি ত্রাহি ত্রাহি
জনতা ॥ নিপাত যাও!
(কোলোনা এবং অভিজাতবৃন্দের প্রস্থান। জনগোষ্ঠী নিজেকে দুটি কোরাসদলে বিভক্ত করে নেয়। দ্বিতীয়টি প্রথম দলের চেয়ে জোরালো)।
বাতিস্তা ॥ দেখো : সজ্জন মহাশয়গণ।
কাঁপেন কেমন, অবরোধে রন, ভূস্বামী, ভূপ, কাউন্ট-ব্যারন রণভঙ্গুর কী উদাহরণ।
যদি দশজন খুদে বদমাস দেয় পিটটান, সেই অবকাশে। স্বয়ং নরক-শয়তান আসে আমাদের ঠিক অন্তরদেশে? তাতে আমাদের লাভ কী বলুন,
রুষ্ট রহেন যদি ট্রিবিউন?
প্রথম কোরাস ॥ জয় ট্রিবিউন, জনতামুক্তিদাতা
তাঁকে হেলা করে কার ঘাড়ে কটা মাথা!
দ্বিতীয় কোরাস ॥ যাক সে-ও রসাতলে।
বাতিস্তা ॥ সে বেশ মন্দ সে বড়োই সজ্জন।
বনেদীশোণিত মহিষেরা যেরকম।
বলে তোমাদের উদ্দেশে সুবচন। লোকের কথায় দেয় না মেলে শ্রবণ কুশাসক যায়, স্বৈরাচারীরা আসে,
আখেরে এই তো ঘটমান ইতিহাস।
প্রথম কোরাস ॥ মিথ্যাপবাদ ছড়িয়ো না আর, থামো।
দ্বিতীয় কোরাস। না হে না, চালিয়ে যাও।
বাতিস্তা ॥ সে বেশ মন্দ সে বড়োই সজ্জন।
বনেদীশোণিত মহিষেরা যেরকম।
প্রথম দল ॥ মুক্তিদাতার মানহানি থেকে থামো।
জয় রিয়েন্ৎসি ট্রিবিউন। বাঁদরামো
ছাড়ো দূর হও, মারো এ বদনামীকে –
দ্বিতীয় দল ॥ স্বেচ্ছাচারীরা রসাতলে যাক। রিয়েন্ৎসি যমালয়ে।
ট্রিবিউন হোক খুন।
বাতিস্তা, তুমি আমাদের আশ্রয়।
বাতিস্তা ॥ বলে তোমাদের উদ্দেশে সুবচন।
লোকের কথায় দেয় না মেলে শ্রবণ – কুশাসক যায়, স্বৈরাচারীরা আসে, আখেরে এটাই ঘটছে ঐ ইতিহাসে। (দ্বিধাময় পরিবেশ। জয়ধ্বজ শোভাযাত্রার সংগীত দূর থেকেশোনা যায়। সেই সঙ্গে গোলগুলির শব্দ। সবাই থমকে দাঁড়িয়ে)।
দুই কোরাসদল ॥ (একসঙ্গে) ঐ এল, চলো তার মুখোমুখি দাঁড়াই।
প্রথম কোরাসদল ॥ মুক্তিদাতার জয়।
দ্বিতীয় কোরাসদল ॥ যতোই দাঁড়াক শক্তির গৌরবে
আমাদের প্রতিশোধের শিকার হবে।
যেমনটা আরো পাঁচজন তারা কবেই...
দুই কোরাসদল ॥ (একসঙ্গে) চলো যাই তার মুখোমুখি মোকাবিলায়!
(সমবেত প্রস্থান)।
প্রথম অঙ্ক। দ্বিতীয় দৃশ্য
(কোলোনার প্রাসাদ, কামিলার ঘর)।
কামিলা ॥ এ কি রলরোল পথে-পথে!
এ কি ভিড়, না বিড়ম্বনা
এই দুর্মর দাপাদাপি। এ যে রক্তনিশানলহর!
শুনি প্রাসাদসোপান বেয়ে। আসে বন্য জনধ্বনি।
ওরা আমার পিতার নামে দেয় ধিক্কার রীতিমতো
বাবা, তুমি এই ক্রোধবিকৃত
গণশক্তির সামনে যেয়ো না।
শিরোদেশ ঘিরে বাঁচাবে তোমায়
জননী মেরীর করুণ চাহনি।
প্রদোষপ্রতিম অকথ্য ভয়
ঘিরেছে আমায়, কী হবে তোমার!
বাঁচাও আমাকে দুর্বহ এই জ্বালা থেকে পড়ি তোমার দু'পায়ে
সকল সেবক কাপুরুষতায় আমাকে একলা রেখে পালিয়েছে।
আমি এ প্রাসাদে ভয়পাংশুল।
একাকী দাঁড়িয়ে আছি একঠায়!
হায় ভগবান! ও বুঝি আমার
দয়িত এসেছে— ভাষার অতীত -
এল বলে, রাখি নিজেকে কোথায় –
দোর দুরুদুরু আমার দয়িত!
(মন্ট্রিয়ালের প্রবেশ)
কামিলা ॥ একি এ দৈবের লীলা, কেন তুমি এই ঝুঁকি নিলে?
মন্ট্রিায়াল ॥ (নতজানু) কামিলা! কামিলা!
কামিলা ॥ বাবা যে-দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছেন ঠেলে ফেলে
কেন তুমি এলে!
তুমি তার বধ্য প্রাণী এইখানে,
তার ছুরি থেকে
ভেবেছ কি বাঁচাবে নিজেকে?
মন্ট্রিয়াল ॥ সুতনুকা, সেই সেতুপারাপার
ভুললে কী করে শপথ,
সন্ধ্যাতারা দ্যোতনার।
সম্মুখে সেই অক্ষিলহরী!
কামিলা ॥ পথ ছাড়ো! হায় বিধাতা, আমার
হৃদয়ের দ্বারে একি হাহাকার!
মন্ট্রিয়াল ॥ প্রিয়তমা দেখো বন্য আগুন
রক্তাভ, মুখে প্রতিচ্ছুরিত।
তোমার দরদী অচেনা এখন।
যে তোমার বুকে আশ্রয় নিত?
কামিলা ॥ তাকাব না, নেই সেই অধিকার আর
তাহলেই হবে প্রত্যয় সংহার
হা এই হৃদয়, বিচুর্ণ তার দশা।
কখনো হব না, তোমার দৃক-পরশ।
মন্ট্রিয়াল ॥ দেখছো না পায়ে বিনতি রেখেছি এই,
দুর্গত দিনমণি, ফেরাবে যখন ও হৃদয়, ও আকাশ।
আমাকে ফিরিয়ে দেবে ঠিক তক্ষুনি।
কামিলা ॥ এ হৃদয় একাকার,
অচেনার মতো রইতে পারিনে আর,
প্রেমিক আমাকে জয় করে নিল আবার,
আমি চিরদিন তোমার।
দু’জনে ॥ জয় প্রত্যয়, জয় সংরাগ জয়।
থাকুন না ঘিরে ষড়যন্ত্রের গতি
আকাশ ধূসর, তাতে কিবা আসে যায়,
একজন হয় অন্যজনের যদি।
এমন কি গোটা এই দুনিয়াটা যদি
আমাদের নিয়ে অকথা-কুকথা বলে
আমরা যখন দু’জনকে ঘিরে থাকি
আমাদের তারা তলাবেনা ঘোলাজলে।
কামিলা ॥ দয়িত আমার, পথে-পথে এত লোক।
মেতেছে কীসের টানে?
দয়িত আমার, আমার জনক
— বলে দাও— কোন্খানে?
মন্ট্রিয়াল ॥ হও ভয়হীন, তাঁর কিছু ঘটবে না!
অভিজাত বন্ধুদের সঙ্গে তিনি।
শলা আঁটছেন কী করে পালানো যায়,
ট্রিবিউন হানে, গণসংকীর্তন।
তঁকে ঘিরে খুব।
তিনি বিদ্যুৎগতি,
সতীর্থজন ঠাহর করার আগেই
এসে দাঁড়ালেন নগরতোলা মুখে।
পরিকর নিয়ে তিনি এক্ষুনি এসে
নিরাপত্তায় তোমাকে নিয়ে যাবেন।
হেরো, দলবল উতরোল উল্লাসে,
মন্দ্র বিষাণ, নিশান ওড়ে আকাশে,
তিনি নিজে তার স্মিতকেশ নিয়ে আসেন।
তোমার সকাশে— এইবারে আমি যাই!
কামিলা ॥ পালাও পালাও সেই ভালো দরদিয়া,
দুরুদুরু কেন কাঁপাবে তোমার হৃদয়,
তোমাতেই আমি সঁপেছি আমার হিয়া
বাসনা আমার তোমাতেই এসে জিরোয়।
মন্ট্রিয়াল ॥ শুভ প্রস্থান! বিদায়! সুকল্যাণী!
সাক্ষী থাকুন ঠাকুর-দেবতা যতো,
একবার ফিরে আসবই, তোমাকেও
রাজ্ঞী, বাড়িতে নিয়ে যাব রীতিমতো।
আমারে ঘিরেছে মহাকল্পনা যতো
নিজেরে করেছি অর্পণ তারি মোহে,
তুমি বসে রোম-রাণীর সিংহাসনে
করেছি তোমাকে নিজ হাতে উথিত।
কামিলা ॥ আমি তো তোমার রমণী নিঃসহায়,
এই ভেবে তবু পুলক জেগেছে চিতে
আত্মা শরীর যদি সঁপে দিতে পারি।
সেই তো আমার ভাগ্য এ ধরণীতে দু’জনে
জয় প্রত্যয় জয় সংরাগ জয়।
(জনতা মঞ্চের দিকে বাহিত হয়ে পটভূমিতে নিজেকে বিন্যস্ত করে নেয়। সামনে ক্ষুব্ধ কোরাসদল নিয়ে বাতিস্তা। জয়যাত্রার দৃশ্য)।
গণকোরাস ॥ জয় রিয়েন্ৎসি, পিতৃভূমির পিতা।
জয় ট্রিবিউন! জনতাকে দিলে মুক্তি!
(মিছিল গড়ে উঠতে থাকে)
বাতিস্তা ॥ এল পরদেশী ফৌজ সঙ্গে নিয়ে।
হতে চায় গণজনক! বাঁদরামি এ
আপন দেশের মানুষকে যে-বা ডরায়।
তার কৌতুক নিছক ক্ষণস্থায়ী।
গণকোরাস ॥ জয় ট্রিবিউন! জনতাকে দিলে মুক্তি!
জয় রিয়েন্ৎসি! পিতৃভূমির পিতা।
বাতিস্তা ॥ মজা গড়াবে না আজ বেশি দূর।
ভাঙন ঘনালে হবেন চতুর!
ক্ষুব্ধ কোরাসদল ॥ পরদেশী ফৌজ, নিপাত যাও
ট্রিবিউন যাও নিপাত যাও।
জননীপীড়ক তোকে শাপ দিই
দেবলাঞ্ছক, কলঙ্কমতি!
ভিনদেশী দল সাথে নিয়ে ধাও উধাও হও।
গণকোরাস ॥ জয় ট্রিবিউন জয়
জাতির জনক হোক পরমায়ুময়!
বাতিস্তা ॥ দেখো কী রকম উৎফুল্ল সে তাকায়
মজাখানা তার উৎরেছে ভেবে ডগমগ
অহংকারে পড়ে না মাটিতে
এ এক আজব রগড়;
ফাঁসিকাঠে দেবে ঝুলিয়ে সে আমাদের –
তবু জেনে রেখো
জনতার ঘটে বুদ্ধি ঘনালে শেষে
ও গর্ব যাবে ভেসে!
গণকোরাস ॥ জয় ট্রিবিউন জয়
জাতির জনক হোক পরমায়ুময়!
(রিয়েন্ৎসি মঞ্চবেদীর উপর)
রিয়েন্ৎসি ॥ আবার তোমাদের নিকটে চলে আসি,
মহান্ রোমবাসী! আবার চোখে দেখি।
শুদ্ধিময় যতো নগর রাজধানী।
মঞ্চ শাশ্বত! ধন্য মানি এই অভিবাদনে আমি
কৃতজ্ঞতা আমি ফিরিয়ে দিতে জানি।
ঈশ্বরের নামে –
চক্ষু মুখে রেখে-
আমার পণ
মুক্তি তোমাদের আমার জীবনের সাধনধন।
মুক্ত সে মহান্ প্রাচীন রোম তার
চূর্ণশেষ থেকে পুনর্জন্মের লভুক সম্ভার
রোমের দ্যুতি যতোদিন না ফিরে আসে
ঘেন্না ততোদিন আমার অবকাশে আমার অভিলাষে
ধ্রুপদী সেই শোভা জগজ্জনতার
সামনে উজ্জ্বল হোক পুনর্বার!
ফিনিক্স যেরকম দীপ্যমান
ভস্ম থেকে জাগে,
জাগুক সেই মতো রোমের প্রাণ,
প্রাচীন যুগ যেন আবার জেগে ওঠে অনশ্বরতায়
বিশ্ব তাকে দেখে চম্কে যেন যায়।
(গণকোরাস আগের মতোই স্তুতিময়)
(পর্দা নামে)
দ্বিতীয় অঙ্ক। প্রথম দৃশ্য।
(রোমের দক্ষিণে পালেস্তিনা শহর। কোলোনার কক্ষ। দৃশ্যের সূচনায়, থেকে-থেকে দূর থেকে গোলাবর্ষণের শব্দ। কোলোনা, কামিলা)।
কামিলা ॥ দোহাই বাবা জানাও সব ভিতরকার খবর,
তোমার যতো বন্ধুজন শঙ্কাহত মুখ। পালায় কেন?
শত্রুপক্ষের
ঘনানো অবরোধের অধীর বারুদ বাড়ে আরো —
আমরা বুঝি বিজিত আজ? সত্যি করে বলো।
কোলোনা ॥ কামিলা শোন উতলা হোস কেন?
নামমাতাল ওর্সিনি চায় আমার জায়গা নিতে
নির্বাচিত নেতাকেই সে মানতে চায় না আর
আমার কাছে দাঁড়িয়ে চায় আমরা মতো করবে হুকুম জারি
আমিও কেন আমার দাবি ছাড়ি-
তার ফলে এক ফারাক বাড়ে, মিটিয়ে নেওয়া যাবে না
বুঝি আর।।
ওর্সিনির ছেলেটি এসে মিনতি করে : ‘জনকবন্ধুরা,
বিভেদ ভোলো, এবং বিশেষত
বৈরী-ঘেরা এই মুহূর্তে সংহতিই জরুরি আমাদের।
ঘটাব আমি মৈত্রী তোমাদের।
কোলোনা, তোমার সুকন্যা সুন্দরী।
দয়িতা আমার আমার ভার্যা হোক
এ-এক অটুট পবিত্র বন্ধনী
জাতকদের গড়া — এক করে দিক আবার তোমাদের,
তাহলে আর পরস্পরের মধ্যে কোনো লড়াই বাধবে না।
ওর্সিনি এই শুনে বলল : ‘আমি নারাজ নই, কিন্তু তুমি, কোলোনা, তুমি পিছিয়ে যেন যাচ্ছ মনে হয় –
তাহা আমি নাচার কাল সদলবলে আমি,
ট্রিবিউনের সকাশে গিয়ে মিটিয়ে নেব বিসংবাদ যতো!
আমি দেখব কী করে তুমি টিকিয়ে রাখো তোমার
নিজের ঘাঁটি।
– বলে খালাস। এবার আমার কথা।
কামিলা, তুই সূর্য ডুববার
আগেই যেন ওর্সিনির সন্তানের বধূ
হতে পারিস, তৈরি হয়ে নে,
আমিও তাকে জানাই সম্মতি!
কামিলা ॥ হা ঈশ্বর, কী করব এখন!
কোলোনা ॥ মনে হচ্ছে ব্যাপারটাতে তেমন যেন তৃপ্ত নোস তুই
আমিই কি খুব তুষ্ট, ভাবছিস!
মহত্তর অলঙ্কারে সাজাব তোকে, ছিল এ-অভিলাষ
খুদে কাউন্ট ওর্সিনির চেয়েও।
যোগ্যতার রাজকুমার ভালোবাসায় তোর
সত্যি যদি নিতে পারত ঝুঁকি,
সেটাই হত আনন্দের – কিন্তু সেটা ঘটেনি, সুতরাং
এ ছাড়া আর উপায় দেখছি না।
কামিলা ॥ তবে তো সবি ধার্য হয়ে আছে,
উৎসর্গের শিকার আমি একা,
তোমরা পাবে শান্তি, সেই ধাঁচে
শান্তি আমার চূর্ণ একাকার।
ব্যাপারটা এই রকম দাঁড়াচ্ছে
যে লোকটাকে ঘেন্নার চেয়েও
ঘেন্না করি তাকেই বরসাজে
দেখব আর দেব আমার দেহ।
দোহাই পিতা, হয়ো না গররাজি
তোমার জন্যে আমি
জীবন দিতে রাজি
ওর্সিনির ছেলেকে আমি কোনো শর্তেই মানব না স্বামিন্!
কোলানা ॥ তোর কি আর বুদ্ধি নেই ঘটে?
আমার রীতিনীতির।
করিস্ বিকৃতি?
এত সাহস! পাপিষ্ঠা! আমার আদেশ নে তুলে তোর মাথায়।
কালিমা ॥ খবরদারি মন যা চায় করতে পারো জারি
আমি আমার প্রতিজ্ঞার কাছে
(আমার মনোনীত আমায় যাচে)
বাগ্দত্তা নারী।
কোলোনা ॥ স্বপ্নে ভেবেছিস আমি মন্ট্রিয়ালের হাতে তোকে
দেব সঁপে? তাকে
পাবার দুরাশা আজো মন থেকে দিসনি সরিয়ে?
আমার জামাতা হবে মন্ট্রিয়াল! ভেবে যদি থাকিস তো ভুল! নারীঘাতী দস্যুকে কখনো
চায়নি কোলোনা-কুল।
কামিলা ॥ আমার প্রতিজ্ঞা।
হয় যদি মিথ্যা
তার আগেই আমাকে মৃত্তিকা
অন্ধকারে লুপ্ত করে নিক। দয়িত আমাদের
ছিন্ন করে এমন শক্তি কার
দুঃখে যার প্রত্যয়ের ঘের।
দেখবে সে ঠিক হাসির ঝিলিক অরুণরক্তিমায়!
কোলোনা ॥ দেখেও দেখবি না তুই আমাদের জরুরি এ দশা?
লৌহ পিণ্ডগুলি
সমস্ত প্রাচীর উপড়ে ফেলে
শত্রুদল আমাদের ঘিরে ধরে আরো,
দেখেও দেখবি না তুই আমাদের নিয়তি প্রগাঢ়,
যখন চুড়োর পরে চুড়ো
শিখরশীর্ষের শেষে শিখরশীর্ষেরা গুঁড়ো-গুঁড়ো
ঝড়ের সুযোগ নিয়ে অমিত্র সহসা ঢুকে পড়ে,
কে তোকে বাঁচাবে বল্ শক্তির লাঞ্ছনা থেকে ওরে,
বুনো সৈনিকের থাবা ছিঁড়ে-ছিঁড়ে নেবে তোকে নিষ্ঠুর নখরে।
কামিলা ॥ মন্ট্রিয়াল — আমার প্রেমিক – সে-ই বাঁচাবে আমাকে, আসবেই।
সে না এলে হাতে এই ছুরি আছে-
বাঁচাবে আমাকে সব কলঙ্কের হাত থেকে।
কোলোনা ॥ ওরা কি মন্ট্রিয়ালের লোক নয় যারা
ট্ৰিব্যুনের কাছে গিয়েছিল?
যারা আমাদের এই ঘোর বিপদের মধ্যে ঠেলে দিল
চোখ থেকে অহরহ বিরতির শান্তি কেড়ে নিল —
তুই সেই মন্ট্রিয়াল ছাড়া।
নিবি না কারুক্কে মনে, এ কেমন অবাধ্য বেয়াড়া!
কামিলা ॥ আমি তার কাছে রব চিরপ্রত্যয়িনী!
কোলোনা ॥ তার মানে ভালো-মন্দ ভেদ ভুলেছিস।
কামিলা ॥ যে কথা দিয়েছি আমি তার কাছে ঋণী।
কোলোনা ॥ অলক্ষ্মী, এখান থেকে এখুনি চলে যা
এই দর্প চূর্ণ করা সে দারুণ সোজা।
কামিলা ॥ আমাকে শপথ ছেড়ে যেতে বলো নাকি।
কোলোনা ॥ জেনে রাখ্, এই দিন যাবার আগেই —
কামিলা ॥ নিছক ছলনা হবে আমার কথা কি?
কোলোনা ॥ অচিরে বানাব তোকে শমিত জোনাকি।
কামিলা ॥ এ অঙ্গার – কোলোনা।
নির্বাপিত হতে নেই বাকি।।
কামিলা ॥ এই ভালোবাসা –
কোলোনা || দেবে নিজেকে বিলিয়ে।।
কামিলা ॥ বিশ্বস্ততা এই— তার সঙ্গে যোঝা
কোলোনা ॥ আমার পক্ষে তা ছেলেখেলা।
কামিলা ॥ তেমনি আমার কাছে অসম্ভব আমার বিশ্বাস ভেঙে খেলা।
কোলোনা ॥ যদি তার ফলে তোকে প্রাণ দিতে হয়।
কামিলা ॥ জানি প্রাণ যাবে তাই এত নিঃসংশয়।
ঘটে যা ঘটুক আমি বিশ্বাসের কাছে
শাশ্বতী রয়েছি এই নিশ্চয়তা আছে।
তার জন্যে মেনে নেব সব বিপর্যয়।
কোলোনা ॥ জানি তোর প্রাণ যাবে, নেই পরিত্রাণ।
কামিলা ॥ যায় যদি যাক যায় যদি যাক প্রাণ।
কোলোনা ॥ সাঙ্গ করে দিবি তোর বিশ্বাসের পালা।
কামিলা ॥ চিরদিন রবে এই প্রতীতি উজালা।
কোলোনা ॥ আমার অনুজ্ঞা সে-ই অলঙঘ্য বিষয়।
কামিলা ॥ আমার বিশ্বাস সে-ও লঙঘনীয় নয়।
(গৃহভৃত্যের প্রবেশ)
ভৃত্য ॥ প্রভু এক আগন্তুক এসেছেন।
কী যেন জরুরি-কিছু কথা বলবেনই।
নাম শুধু আপনাকেই জানাবেন তিনি।
কোলোনা ॥ তাকে আসতে দাও।
(ভৃত্যের প্রস্থান। মন্ট্রিয়াল টুপি আর ওভারকোট নিয়ে প্রবেশ করে।
টুপিটাকে খুলে ওভারকোটটাকে পিছনে একপাশে সরিয়ে রাখে)
কমিলা ॥ হা ঈশ্বর! দয়িত আমার!
কোলোনা ॥ মন্ট্রিয়াল! কোত্থেকে পেলে এ ভবনে ঢোকার সাহস!
তোমার সৈন্যরা আজ আমাদের বেষ্টন করেছে,
আমাদের শত্রুদের সঙ্গৎ দিয়েছ বেশ জানি
আমার কন্যাকে দিলে আরেক রাস্তায় হাতছানি
কী চাও এখানে?
মন্ট্রিয়াল ॥ কেন এত ধৈর্যহীন, অধমের বক্তব্য শুনুন।
মনে পড়ে কীরকম অপমান করেছিলেন আমি যখন
কামিলার করভিক্ষা করেছিলাম?
এখন আমার এই প্রতিশোধ, যা মানায় বীরপুরুষেরে,
যা তোমায় চারদিক থেকে ঘিরে আছে সৈন্যেরা আমার,
তাদের বর্ষিত অগ্নি কাঁপায় তোদের এ নগরী।
একবার তাকাই যদি বন্য গণজনতার তোড়ে ঠিক ভেসে যাবি তোরা,
অবিশ্যি বাঁচাতে পারি যদি চাও, পালেস্ত্রিনা-র
পতন হবে না তবে, তোমাদের নিয়ে যাব আমি
প্রাচীন রোমের সেই দ্যুতিময় গরিমা সমীপে!
কোলোনা ॥ তার মানে ট্রিবিউনকেই অস্বীকার,
বিশ্বাসহনন। সেটা কোনো বীরোচিত কাজ নয় -
এ ব্যাপারে আমার সামান্যতম মদৎ পাবে না।
মন্ট্রিয়াল ॥ এখানে বিশ্বাসভঙ্গ কোথায়?
আমি তো নেই, আমার ভাইয়েরা
ট্ৰিব্যুনের অভিমুখে সেনানী পাঠিয়ে দিয়েছিল।
তাদের এ কর্ম আমি সমর্থন করিনি কখনো!
সেটা করব না আমি শর্ত এই :
আমাকে দাও যা আমি অনায়াসে জিনে নিতে পারি!
কোলোনা ॥ কোন্ শর্ত?
মন্ট্রিয়াল ॥ রোমের সমস্ত জুড়ে হাজারো মানুষ যারা আমার।
নির্দেশ শুনবে বলে আজ উৎকর্ণ হয়ে আছে।
আমার জমিন নেই, তবু আমি ইতালি দেশের
সবচেয়ে শক্তিশালী আজ।
এসেছি তোমার কাছে, এই দাবি, রোমের প্রধান মঞ্চে
যবে উদ্দীপিত যাব, তোমার কন্যাকে
সিংহাসনে নীত করে নিয়ে যাব ভার্যা-ভূমিকায়!
(কোলোনা-র দুশ্চিন্তিত পদচারণা)
কামিলা ॥ বাবা আমি তোমাকে কি আগেই বলিনি
আমার দয়িত এসে আমাদের বাঁচাবেই বাঁচাবে?
আমি কি জানিনি, ও যে আমার দুর্দিনে
অংশ নেবে আমার দুরূহ ভাবনায়?
মন্ট্রিয়াল ॥ আমিই বা কী করে বলো তোমার দুর্দিনে
ছেড়ে যাই তোমাকে ও তোমার পিতাকে!
কোলোনা ॥ তবে তাই হোক। আমি ওর্সিনিকে ছেড়ে দিই,
স্পর্ধা তার আমাকেই ঈর্ষা করে ভাব!
ঘরবাড়ি নিয়ে সে ডুবুক; আমি উঠবই উঠব!
পুত্র, নাও আমার কন্যাকে! হোক সে তোমারই হোক!
রোমের মঞ্চটি তুমি তুলে আনো ভবনে তোমার।
কামিলা, এবার অপগত হোক
ক্রোধ কর্কশ ঘৃণা
আকাঙ্ক্ষা তোর সুতৃপ্ত হোক -
এখনো কি তুই চোখ মেলে তাকাবি না?
কামিলা ॥ এভাবেই যতো যন্ত্রণা সন্ত্রাস
থেকে কীরকম সংরাগ সঙ্কাশ।
আমার হৃদয়ে স্ফুরিত এ অধিবাস
অবিশ্বাস্য ভাগ্যের ইতিহাস!
মন্ট্রিয়াল ॥ এতদিন ধরে ধিকিধিকি হায়।
প্রত্যাশাহীন নির্ভরসায়
ঘটে গেছে ক্ষতি, সেই অধ্যায়
স্মরণ করতে কার মন চায়?
কামিলা ॥ একি আনন্দস্পন্দিত দিন।
মন্ট্রিয়াল ॥ একি উপহার বিস্ময়লীন!
কামিলা ॥ দুঃখদিনের মহার্ঘ দান!
কোলোনা ॥ পরস্পরের এ সম্প্রদান :
হোক তোমাদের জীবন মহান্!
(তিনজন সমবেত)
হোক অপগত নিয়তির দিন
প্রতিশ্রুতির আলোয়
মহা-আগামীর দীপ্তি নবীন
জানুক দৃঙ্খলয়!
দীর্ঘদিনের এই সংগ্রাম।
সন্তাপলাঞ্ছিত :
শুদ্ধ প্রণয়বহ্নি জ্বলুক
শাশ্বত শিখায়িত!
দ্বিতীয় অঙ্ক। দ্বিতীয় দৃশ্য
(রিয়েন্ৎসির বাড়ির একটি ঘরে। তার হাতে একটি কাগজ)
রিয়েন্ৎসি ॥ ধিক্, বিশ্বাসঘাতী! জনতাকে আমার রাস্তা
থেকে ভিন্পথে নিয়ে গিয়ে এই খল প্রতারণা
বাহু থেকে স্বেদ বিদায়ী যেমন ঠিক সেই মতো
ধিক্, বিশ্বাসঘাতকসমিতি! জনতা আমাকে
মানলে তবেই ভবিষ্য হবে সমৃদ্ধ খুব;
আমার জনতা, কতো না সয়েছি তাদের জন্যে,
অভিশাপ, কারাযাতনা, নির্বাসনের জ্বলুনি,
স্বেচ্ছাচারীর মাঝখানে গিয়ে তাদেরই জন্যে
‘এইবারে থামো’, আমি — এই আমি — ব’লে কি উঠিনি?
আমার জনতা, যতো হোক শাপমন্যি ঘনানো
খারাপ সময়, কাপুরুষতাও, তুমি রবে ঠিক, তোমার হবেই দুর্দমনীয় পুনরুত্থানও,
দৃপ্ত বিজয়ী তোমরা অনমনীয় নাগরিক!
জানো না কি কতো পীড়ন কতোই
যন্ত্রণা আমি তোদের জন্য
বহন করেছি, আর সেই কথা
তোদের এখন জানা বুঝি নেই?
দীর্ঘ দীর্ঘ বছর কেমন
কাঁটার ভিতরে অটুট পা রেখে হাঁটলাম,
কোনো অভিনন্দন কখনো পাইনি তোমাদের থেকে!
চেয়েছি রোমকে মুক্ত করব
বিবাদের সেই বিজিত শিকার :
নতুন রাঙাব প্রাচীন গর্ব
অর্থহীন কি এ অঙ্গীকার?
দেখাও প্রাচীন রোম নিজস্ব
গরিমায় নিজ মূর্তি
তুমি তো সমাধি রাত্রে পরমতৃপ্ত
দেখেছি, এবার উত্তিষ্ঠত
দ্বিতীয় অঙ্ক। তৃতীয় দৃশ্য
(কোলোনার প্রাসাদ। নৈশভোজের বর্ণাঢ্য আয়োজন।
মন্ট্রিয়াল, বাতিস্তা, অতিথিদের কোরাসদল)
মন্ট্রিয়াল ॥ আসুন, শুরু হোক আকাঙ্খার
ট্রফি, এ রজনী অন্ধকার! সময় নিয়ে এই দুর্ভাবনা
পাত্রে যতোক্ষণ সুরা-বাহার!
কক্ষ ঘুরে-ঘুরে ধ্বনিত হোক সুর।
যতোক্ষণে ভোর রঙোৎসার!
কোলোনা ॥ আসুন, হাতে-হাতে সুরা-আধার।
স্বর্ণাসব এই পান করুক
পাত্র ভরে আছে প্রান্ত ছুঁয়ে
হৃদয়ে এনে দেবে তেজি আগুন!
কক্ষ ঘুরে-ঘুরে ধ্বনিত হোক সুর
যতোক্ষণ খোলে ভোরের দ্বার!
বাতিস্তা ॥ আহা, এ যেন গান, কে গায় গান!
মন্ট্রিয়াল ॥ ওরে কিশোর, দে তো ঈষৎ সুর।
অনুমতি করুন, একটি প্রোভোশাল-গানের ধুয়ো
আমার উপভাষার ঢঙে আপনাদের গেয়ে শোনাই
মহান ত্রুবাদুর রচিত এই গান।
(একটু পরেই একটু প্রণয়গীতি শোনা যায়)
বাতিস্তা ॥ আসুন নারীদের স্বাস্থ্য পান করি!
কোরাস ॥ বাঁচুন রমণীরা পরমায়ুষ্মতী! সুরার ঝলকানি
তাঁদের মোহ যেন সরিয়ে নেয় না হে,
বাঁচুন রমণীরা আয়ুর ঈশ্বরী!
মন্ট্রিয়াল ॥ ওহে সেবক ঢালো এখানে মদ আরো
যীশুর নামে সেই পাহাড়ি-মদ জানো?
তাহলে আনো তার সারাৎসার
এখানে পান হবে, পানের গানও
কোরাস ॥ বাঁচুন রমণীরা পরমায়ুষ্মতী! সুরার ঝলকানি
তাঁদের মোহ যেন সরিয়ে নেয় না হে,
বাঁচুক রমণীরা আয়ুর ঈশ্বরী!
(নগরতোরণ থেকে জুপিটার মন্দিরের ঘণ্টা বেজে ওঠে)
বাতিস্তা ॥ হঠাৎ কী ব্যাপার। ঘণ্টা বাজে কেন?
মন্ট্রিয়াল ॥ কিছু না, ধুত্তোর, মিথ্যে পাতো কান।
জমুক ধুমধাম খুশির কলতান।
বাতিস্তা ॥ মান্যবর, এই মদ্য আপনার এবং যতো
মানীর উদ্দেশে এবার পান করি বশংবদ
অচিরে ভবদীয় প্রচেষ্টায়
ট্ৰিব্যুন-প্রভু যেন অক্কা পায়
ধ্বনিত হোক আজ আমার এই ধ্বনি কক্ষময়।
মন্ট্রিয়াল জয়-দিগ্বিজয়!
কোরাস ॥ ধ্বনিত হোক আজ বৈতালিক যতো কক্ষময়
যাঁর এই ভোজসভা সেই
মন্ট্রিয়াল জয় বিজয় জয় জয় দিগ্বিজয়!
(বাইরে সন্ন্যাসীদের স্তোত্রগান)
প্রভু দাও ওদের অনন্ত স্থৈর্য
পড়ুক ওদের ঘিরে
চিরন্তনের রশ্মি!
মন্ট্রিয়াল ॥ বন্ধুগণ! থমকে গেলেন কেন?
সন্ত ওরা, ইনিয়ে-বিনিয়ে মরে মৃত্যু আর গোরস্থান নিয়ে,
আমাদের ঘিরে তবু জীবন রয়েছে ঝলমলিয়ে -
(সন্ন্যাসীদের স্তোত্রগান। মাঝে-মাঝেই ‘ক্রোধের এই দিন’
‘শোকের এই দিন’ ইত্যাদি অংশ শোনা যাচ্ছে)
ধন্যবাদ বন্ধুগণ
সমবেত আনন্দের বানে
নিমজ্জিত করে দিন সন্ন্যাসীদের আর্তনাদ
শাশ্বত নগরী রোম দীর্ঘজীবী হোক
কোরাস ॥ শাশ্বত নগরী রোম দীর্ঘজীবী হোক
পান করা যাক।
(বাইরে সন্ন্যাসীদের স্তোত্র চলতে থাকে। ‘প্রভু তুমি পুণ্যময়/
লুপ্ত করে দিয়ো না আমাকে/ ঐ দিনে’ ইত্যাদি অংশ শোনা যায়)
মন্ট্রিয়াল ॥ ট্রিবিউনের ধ্বংস হোক উপলক্ষ্য এই পানীয়ের।
বিশ্বাসঘাতী সে, ও যে জনতার ঘাম
খরচ করেছে তার প্রাকারের স্বার্থের শোভায়!
ঘনাবে প্রতিশোধে প্রহর সে জানবার আগেই
ঘটুক পতন তার!
কোরাস ॥ সিংহাসন থেকে তবে যাক খসে যাক ট্রিবিউন
বিশ্বাসভঙ্গের মাইনে অর্জন করুক।
(দরোজায় তিনবার করাঘাত। সবাই শঙ্কিত)
মন্ট্রিয়াল ॥ ঢুকে পড়বি যদি পড়্, অবাঞ্ছিত অতিথির দল
(রাজবেশে ট্রিবিউনের প্রবেশ। সশস্ত্র পরিকরবর্গ পিছনেই)
রিয়েন্ৎসি ॥ বাহবা, বাহবা মন্ট্রিয়াল,
নগরমন্দিরে ঘণ্টা, পুরোহিতদল এসে স্তোত্রগানে মেশায় তোমার
ভাইদের হত্যার খবর, আর উৎসব তখনই,
তাহলে সবাই শোনো, শোনো ওই তীব্র সমাচার!
কোরাস ॥ এখন বিচারকের বিবমিষা শুরু হল ব’লে।
রিয়েন্ৎসি ॥ তোমাদের ঘনাল প্রহর
ও নির্ধারিত বিশ্বাসহত্যার জন্যে মাইনে পাবে কে কতো মোহর। (মন্ট্রিয়াল আর বাতিস্তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল। পর্দা নেমে আসে)
তৃতীয় অঙ্ক। প্রথম দৃশ্য
(নিনা রুদ্ধশ্বাসে ঢুকে পড়ে)
নিনা ॥ মাতা মেরী, বাঁচাও আমাকে,
ত্রাণ করো স্বর্গের জনক,
উত্তেজিত জলোর্মি কেমন
পথে পথে হন্যে হয়ে ধায়
গরগর গর্জন-তর্জন।
হরবোলারা নাম ধরে হাঁকে
এদিকে এগিয়ে আসতে চায়,
আমাদেরই প্রাসাদের দিকে
পথ করে নিয়েছে ওরা দেখো!
বন্য এক আক্রোশের বশে
আমাদের হানে ঘূণ্য দশা।
ঘটাবেই বিষম সংহার
পাকে পাকে ফেনিল জনতা
আমাদের দিকে ধেয়ে আসে!
মাতা মেরী পারমিতাময়ী
করো ত্রাণ করো আমাদের।
ছায়াঘন ডানার বিথারে
আবৃত করুন আমাদের
যতো দেবদূত শঙ্কাহত।
এ মিনতি, ওই কুঁড়েঘরে
নামো আমাদের ত্রাণ করো
জনতার অন্ধ ক্রোধ থেকে
ক্রমেই সমীপে ছুটে আসে
জনতার ঘূর্ণীস্রোত ঐ
উঠে যায়, উঠে ঘুরে যায়,
চতুৰ্ধারে অসি ঝল্কায়
একরাশ বর্শার ফলক
ঝলে ওঠে রশ্মির আভায়।
ক্রমেই ঘনায় শক্তিশালী
মৃত্যুবাহু আমাদের ঘিরে,
মেরীমাতা! ভুবনদেবতা!
বাঁচাও এ গ্লানির তিমিরে।
(রিয়েন্ৎসির প্রবেশ)
রিয়েন্ৎসি ॥ যা হবার তাই হল, আগে কিন্তু এমন ভাবিনি!
জনতা উদ্যত আজ বিপক্ষে আমার,
মন্ট্রিয়ালের আর বাতিস্তার মৃত্যুর সংবাদে
প্রতিস্পৃহাতুর!
নিনা ॥ হারিয়েন্ৎসি, মহার্ঘ্য-আমার!
আমাদের চতুৰ্ধারে ঘনাল আঁধার।
রক্ষা করো তোমাকে-আমাকে।
রিয়েন্ৎসি ॥ শান্ত হও, রমণী আমার!
এখনো সংকট ততো ব্যাপ্ত নয়;
আমার তারুণ্যশক্তি অটুট এখনো
দৃপ্তধী, দাঁড়াব আমি জনতার ঐ
অগ্নিবর্ষী প্রবৃত্তির মুখোমুখি গিয়ে
অহংকারের স্পন্দে, দ্বিধা করব না!
এখনো আমার চোখ অশনি-অসিত
নির্মল ললাটে কোনো ভাজ পড়েনি তো
আমার ভাষার শক্তি তীক্ষ আর দ্রুতগ এ অসি –
আমি অশঙ্কিত! আসে তো আসুক ঝড়—
আমি ঠিকই আছি,
বসিয়েছি নিজেকেই রাজসিংহাসনে,
এবং আসীন আজো, যদি কেউ বাদ সাধে।
আমি তার উষ্মা খুব প্রশমিত করে দিতে জানি!
নিনা ॥ এখনি চলো পালিয়ে যাই, তোমাকে অনুরোধ,
তবেই শুধু পরিত্রাণ ওদের ক্রোধ থেকে
এবার শুধু একটিবার, রিয়েন্ৎসি আমার
মিনতি শোনো, পালিয়ে যাই চলো নিরুদ্বেগে।
রিয়েন্ৎসি ॥ কাপুরুষের মতো আমি পালাব কখনো? কখনো না।
নিনা ॥ এখনো আছে সময় চলো পালিয়ে যাই, শোনো।
রিয়েন্ৎসি ॥ মৃত্যু যদি আমাকে এসে ভয় দেখায় তবু
সুদৃঢ় আমি দাঁড়াব তার বিরোধীপক্ষেই!
নিনা ॥ চলে এসো মূর্খ মূঢ় জনতা কখনো
এত বড়ো উৎসর্জনের যোগ্য নয়।
রিয়েন্ৎসি ॥ যদি-বা নিয়তি নামে আমার উপরে
আমার মরণ যেন জগতের কানে
শোনায় : রোমের অনন্য পরমতা
ধ্রুব লক্ষ্য ছিল রিয়েন্ৎসির ধ্যানজ্ঞানে
নিনা ॥ তাহলে যাবে না তুমি, স্বামিন্ আমার
আমিও তোমাকে ছেড়ে যাব না, সংসারে
যেমন সৌভাগ্য দিনে পাশে দাঁড়িয়েছি
সঙ্গ দেব দুর্ভাগ্যের করাল আঁধারে।
রিয়েন্ৎসি ॥ ঘরণী আমার এসো হৃদয়ে আমার
যদি জীবনের লক্ষ্য অকৃতার্থ থাকে
উদ্যমের পুরস্কার স্বর্গীয় আনন্দ
তোমার ভালোবাসায় ছুঁয়েছে আমাকে!
নিনা ॥ আমার মহার্ঘ্য, দৃঢ় শক্তিশালী তুমি।
সকলের মাঝখানে আশ্চর্য অপার,
তোমার বাহুর ঘেরে বুঝেছি এখন
কী-এক সৌভাগ্য কাঁপে সত্তায় আমার।
দ্বৈত ॥ আমরা দু'জনে দৃষ্টির উদ্ভাসে
পরস্পরের স্পন্দে ওতপ্রাতো
যথার্থ ভালোবাসায় অনুসৃত
এড়াব সকল নিয়তির দুর্দশা!
বাহিরে যখন মৃত্যুর সন্ত্রাস
অসি-ছুরিকার আগুনের খুব ভয়
আমাদের ওই সংহতি দৃঢ় করে
প্রতিটি সুদিন, প্রতিটি দুঃসময়।
তৃতীয় অঙ্ক। দ্বিতীয় দৃশ্য
(নগরতোরণের মুখোমুখি, কামিলা, খোলা তার চুল, হাতে ছুরিকা)
কামিলা ॥ তাহলে তাকে আসতে হল ঠিকই
দীর্ঘায়ত প্রতীক্ষার ধন
প্রতিশোধের প্রহর ঝিকিমিকি
করেছি যাকে হৃদয় নিবেদন!
প্রতিশোধের প্রহর ধিকিধিকি!
নিহত প্রেম সেদিন হায় তোমার
রক্ত যেমন অঝোরে ঝরেছিল,
সেইভাবে আজ ঝরবে তার শোণিত
এবং আমিই কারয়িত্রী, সেটা
আপন হাতে করব চিহ্নিত
নিহত আজ আমার প্রেমিক, জানি
জ্বলুক তবে ঘৃণা আমার খুব,
স্বেচ্ছাচারীর রক্ত পিপাসায়
আমার ওই শুষ্ক তরবারি
রক্তঘামে উঠুক আজ নেয়ে
ভার্যা নই, করাল নারী আমি
ওটাই হোক, আমার পরিচয়
এবার আমি লৌহ ছুরিকায়
ছিন্ন করে দেবই তার শিরা
বিশ্বাসের ঘাতক যে আমায়
প্রেমকে কেড়ে ঘা দিল আমাকেই!
পালাক যতো মেদুর মমতার
নারীত্বের কোমল সংস্কার
এবার শুধু শাস্তি, এইবার
প্রতিশোধের আস্পৃহা আমার!
হয় যদি তোক আমার খুব পাপ
উত্তেজিত জনতা রীতিমতো
মেতে রয়েছে,
করব তাকেই রূপায়িত আগুনে একাকার
এই তো আজ আকাঙ্ক্ষা আমার!
সিংহাসন থেকে রিয়েন্ৎসির
পতন হোক, সমাধি আছে স্থির
তোমার জন্যে, তুমি আমার প্রেমিক
কেড়ে নিয়েছ, মুক্তি নেই তোমার!
(সমবেত জনতার উদ্দেশে)
প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ!
স্বৈররাজ শেষ হয়ে যাক,
তার কর্ম শুধে দিতে হও
বুরুজের চৌদিকে চড়াও
মুঠোয় পেয়ে ছেড়ে দিয়ে না তাকে
সজ্জিত ভবন থেকে ছিড়ে
এইখানে আনো রুধিরাক্ত
শেষ তার হোক শোচনায়!
কোরাস ॥ প্রতিশোধ চাই প্রতিশোধ!
কামিলা ॥ ঝরুক তার পাপবোঝাই মাথায়
শাপ-শাপান্ত, মৃত্যু এখন তবে —
স্বাধীনতা সে হরণ করেছিল
এবার তাকে হিসেব দিতে হবে।
শঙ্কাহত বিশ্বাসঘাতক
আছড়ে মরুক সবার পদতলে
তার কুকাজের অন্ত নেই কোনো
রাঙা রক্ত বহাক তার ফলে।
কোরাস ॥ প্রতিশোধ চাই প্রতিশোধ!
(রিয়েন্ৎসির প্রবেশ, পিছনে নিনা)।
রিয়েন্ৎসি ॥ রোমের সুভদ্র নাগরকিবৃন্দ, আপনারা কেন
এভাবে সশস্ত্র হয়ে এসেছেন
দুর্গের তোরণমুখে?
আমি তো আপনাদেরই নির্বাচিত,
আমাকে বিশ্বাস নেই আর?
এই রাজপ্রতীক তো আপনারা
সবাই আমাকে দিয়েছেন!
কী অন্যায় করেছি, বলুন।
আমার কর্মের বৃত্ত পূর্ণায়ত করার সময়
দিন আমাকে; রোমের প্রাচীন কীর্তি পুনরুদ্ধারের ভার;
আপনারা যেন স্বরচিত আইনের অধিকারে
তামাম দুনিয়াটার মালিক হতে পারেন, তাই
আমি চাই। তবে কেন শোনেন অলীক অপবাদ,
আমার কাজেরই মূল্যে আমার বিচার করবেন।
কামিলা ॥ কান দিয়ো না মিথ্যাবাদীর ভাষায়।
লক্ষ্য যেন ছলকিয়ে না দেয়।
স্বাধীনতার গরজে প্রতিশোধ
নিতেই হবে স্বাধীনতার দায়ে
(জনতা রিয়েৎসর দিকে এগিয়ে যায়)
নিনা ॥ ঈশ্বর! ঈশ্বর!
রিয়েন্ৎসি ॥ শয়তানেরা, দূর হয়ে যাও চোখের সামনে থেকে!
নিনা ॥ আমার চোখের জল তোমাদের স্পর্শ করছে না!
কামিলা ॥ এই তো বিজয়! প্রতিশোধের নেশায়
আগুন উঠল হিলহিলিয়ে জ্ব’লে।
কোরাস ॥ স্বাধীন সত্তা হরণ করেছিলে
এবারে তাই প্রতিশোধের পালা
নিনা ॥ যাকে ভাঙিয়ে সুদিন তোমাদের
তোমরা আজ ঝরাবে লোহ তার?
চাও যদি তো আমার রক্ত নাও
আমারি হোক শুদ্ধি-অনুতাপ!
কামিলা ॥ এখন শুধুই প্রতিহিংসা, দয়া
নিজেকে ক’রে নিয়েছে প্রত্যাহার!
নিনা ॥ একবার দেখো আমার দারুণ দশা।
ভাবো কী করেনি তোমাদের জন্যে সে!
কামিলা ॥ রোমের মানুষ, কী করে ভুলবে বলো।
কতো যন্ত্রণা তোমাদের দিয়েছে সে!
কোরাস ॥ যতো যন্ত্রণা আমাদের দিয়েছে সে।
সমস্ত কিছু মনে আছে আমাদের!
নিনা ॥ করুণা! করুণা!
কামিলা ॥ প্রতিশোধ! খুন!
নিনা ॥ ঐ শিরোদেশ ক্ষুন্ন কোরোনা।
কামিলা ॥ স্বৈরী ছিনিয়ে নিয়েছে মুক্তি
নিজের রক্তে শোধ করে দিক।
কোরাস ॥ মুক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে স্বৈরী
প্রতিশোধ নিতে আমরা তৈরি!
নিনা ॥ উন্মাদ এই আগুনের দাহ।
শুভবুদ্ধিকে এখনো বাঁচাও!
কামিলা ॥ জনতার ক্রোধ জুলন্ত অঙ্গার
তারি দাহে হবে জীবন সাঙ্গ তার।
নিনা ॥ করুণা! করুণা!
কামিলা ॥ প্রতিশোধ! খুন!
নিনা ॥ মমতা! মমতা!
কামিলা ॥ শুনো না এ-কথা।
কোরাস ॥ বিশ্বাসঘাতী, প্রতিশোধে রাজি নোস?
কী করে এড়াবি আমাদের আক্রোশ?
(সমাপ্তি)
নাট্যকোলাজ, অন্য ধারার নাটক
সুনীল দাশ
গত শতাব্দীর আটের দশক সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের কাছে ছিল নাট্য কোলাজের দশকের সূচনা। আলোকরঞ্জনদা - কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সেদিনের কলকাতা তথা বাংলা থিয়েটারের বহতা ধারায় নতুন এক নাট্য প্রযোজনা ঘারানার গোড়াপত্তন করেছিলেন 'নাট্যকোলাজ'।
গদ্য ও পদ্য সংলাপ উচ্চারণ, আবৃত্তি, অভিনয়, একক, দ্বৈত এবং সমবেত কণ্ঠে গান ও বাদ্য সংগীত, আলোক চিত্রের স্থির ও চলচিত্রের ব্যঞ্জনা বা বিভাবিত দেহছন্দের সুষমা, নৃত্য নির্মাণ, ভাষ্য এবং কোরাস বলয়ের আবর্তন - আঠা দিয়ে কেটে কেটে ছবি জোড়ার মতো এক শিল্পায়িত মঞ্চ সঞ্চালন - নাট্য অভিঘাতে - হল নাট্যকোলাজ-অলোক রঞ্জন দাশগুপ্তের রচনা 'আলো, আরো আলো' নাট্য প্রযোজনায়, যার উদবোধন জাতীয় গ্রন্থাগারে। য়োহান হ্বোলফ্গাঙ ফন গ্যোয়েটের লেখা 'ফাউস্ট' নাটকের আদ্যপ্রান্ত জার্মান থেকে বাংলায় ভাষান্তর নয়, 'আলো আরো আলো' ফাউস্টের নির্বাচিত অংশের অনুসৃজন।
১৯৮২তে একটি নয়, দুটি নাট্যকোলাজ সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের প্রযোজনার জন্য লিখেছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। প্রথমটি তিন চরিত্র- ফাউস্ট, গ্রেটশেন বা মার্গারেট এবং মেফিস্টোফিলিস-কে নিয়ে 'আলো আরো আলো'। দ্বিতীয় নাট্যকোলাজটির নাম 'গ্যোয়েটের জীবনশিল্প'। প্রথমটিতে শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায়, সুদেষ্ণা রায় আর অনিমেষ গঙ্গোপাধ্যায় অভিনয় করলেন এবং দ্বিতীয়টিতে সৌমেন ভট্টাচার্যের সঙ্গে সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের অন্যান্য অভিনয় শিল্পীরা। দুটি নাট্যকোলাজ প্রযোজনাতেই আবহ সঙ্গীত রচনা করেছিলেন সেই সময়কার কলকাতা গ্যোয়েটে ইন্স্টিটিউট ম্যাক্স ম্যূলার ভবনের ডিরেক্টর হান্স্ য়্যুর্গেন নাগেল।
শ্রীযুক্ত নাগেল আমার সামনে দ্রুপদী জার্মান সঙ্গীতের অনন্ত ভুবনের প্রবেশ দ্বার খুলে দিয়েছিলেন সেই দশক জুড়ে একের পর এক প্রতিভাদীপ্ত জার্মান কবি, নাটককার ও বিপ্লবীদের জীবন ও শিল্প নিয়ে নাট্য কোলাজের সুরের ভুবন গড়ে তুলতে। বেটোফেন, মোৎসার্ট; হ্বাগনার শুলৎস্, হেন্ডেল, প্রমুখ সুর সাধক থেকে শুরু করে একালের যশস্বী জার্মান সঙ্গীতবিদ্ অবধি সঙ্গীত ঐশ্বর্যের নিরন্তর নির্যাস অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রতিটি নাট্যকোলাজ পাণ্ডুলিপির অনিবার্য অন্তরং হয়ে উঠেছিল। প্রচলিত থিয়েটার স্টেজে নয়, আলো আলো আরো আলো'র উদ্বোধনী অভিনয় জাগীয় গ্রন্থাগারের মতো 'গোয়েটের জীবন শিল্প এর প্রথম অভিনয় হয়েছিল কলকাতার শেক্সপিয়র সরণীর অরবিন্ধ ভবনে শ্রোতা দরসসশক পরিপুর্ন সমাবেশ। ১৯৮২ এর ২৩ আগস্ট ছিল নাট্যকোলাজ ' আলো আর আলো সুচনা অভিনয়। এর এগারো দিন পড়ে, বারো দিনের মাথায় ৪ সেপ্টেমব্র ১৯৮২ তে প্রযোজনা শুরু হলো গ্যোয়েটের জীবন ও রচনা নিয়ে ভিন্ন ধারার নাট্য নিবেদন' গ্যোয়েটের জীবনশিল্প।
ওই সময় প্রতি বছর নিয়ম করে প্রায় জার্মানির হির্শবার্গ থেকে বেশ কিছুদিন সময় হাতে নিয়ে অলোকদা সস্ত্রীক আসতেন কলকাতায়। তখন মাঝে মধ্যে কলকাতার ম্যাক্স ম্যূলার ভবনের ৮ নম্বর প্রমথেশ বড়ুয়া সরণীর তিন তলার অডিটোরিয়ামে সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের নাট্যকোলাজের মহড়ায় অলোকরঞ্জনদার পাশে আমাদের নিরন্তর প্রেরণাদাত্রীর ভুমিকায় উপস্থিত থকতেন ট্রুড বার্টা বৌদি। ট্রুড বার্টা বৌদির ভূমিকা নিছক নিস্ক্রিয় নীরব দর্শক শ্রোতার ছিল না, নাট্য কোলাজগুলোর জার্মান চরিত্রদের রূপারোপের পোশাক বিন্যাশ থেকে শুরু করে দৃশ্য রচনায় নানান সরঞ্জামের ড্রয়িং, পেপার কাটিং, ফোটোগ্রাফ, টুপি, ছড়ি ইত্যাদি হরেক রকমের টুকিটাকি দিয়ে পাশ্চাত্য পরিমনণ্ডল গড়তে ট্রুড বার্টা বৌদির আগ্রহ ছিল আমাদের ভরসা।
পরের বছর, ১৯৮৩-এর সেপ্টেম্বরে প্রথম দিনেই এম.এম.বি. মঞ্চে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের পাণ্ডুলিপি থেকে নিবেদির হল কেবল মাত্র কবিতা দিয়ে বোনা নাট্যকোলাজ- হাইনরিশ হাইনের কবিতার দৃশ্যময় মঞ্চায়ন - 'প্রেমে পরনা সে'। এই নাট্য কোলাজে নৃত্যরূপকে পরিপূর্ণ প্রয়োগ না করে আবৃত্তির ছন্দময়তার সঙ্গে সংগতি রেখে অভিনয় শিল্পীর সেই ছন্দ বিজ্ঞানকে বাঙ্ময় করে তোলা লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল এর খণ্ড খণ্ড দৃশ্য বিভায়। ‘দাঁড়িয়ে ছিলাম মাস্তুলে দিয়ে ভর। এবং প্রতিটি প্রহর গুণ ছিলাম'-এর কবির জীবনরেখার চলন এগিয়ে শুভাশিস ভট্টাচার্যের কোরিওগ্রাফি হয়ে উঠেছিল 'প্রেমে পরবাসে' প্রযোজনার অন্যতম সম্পদ।
একই বছরে অর্থাৎ ১৯৮৩-তে দ্বিতীয় যে পাণ্ডুলিপিটি সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটার পেয়েছিল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কাছ থেকে সেটি কোনো নাট্যকোলাজ নয়। সেটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জার্মান নাটকের পূর্ণাংগ অনুবাদ। ফ্রীডরিশ এঙ্গেল্স (১৮২০-১৮৯৫)-এর লেখা একমাত্র নাটক - একটি কাব্য নাটক 'কোলা দি রিয়েনৎসি (১৮৪১)। কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩)-এর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব নিবিড় হওয়ার আগে একুশ বছর বয়সে এই নাট্য সৃজনের নিদর্শন রাখেন। বহুকাল নাটকটির খসড়া সাহিত্যানুরাগীদের দৃষ্টির আড়লে ছিল। ১৯৭৪-এ কাব্যনাটকাটির খসড়া পুনরুদ্ধার হওয়ার এক দশকের মধ্যেই ত্রিভাষী কবি (বাংলা, জার্মান, ইংরেজি) সেটির ভাষান্তর করেন বাংলায় এবং অন্যত্র মঞ্চায়িত হওয়ার আগেই সংবর্ত নাট্যগোষ্ঠী কলকাতার মঞ্চে 'রিয়েনৎসি’র অভিনয় করে। প্রথম অভিনয় ২৬ নভেম্বর ১৯৮৩, ম্যাক্স ম্যূলার ভবন মঞ্চে।
এই নাটকাভিনয়ে সংবর্তের পূর্ববর্তী নাট্য কোলাজের অভিনয় শিল্পীদের সঙ্গে ক্রমে যোগ দিলেন চিত্রলেখা বসু উইলিয়ামস, সুদর্শন রায়, সৈকত সেনগুপ্ত, বিমল দাশ প্রমুখ। বাংলা ভাষান্তরে নাটকটি 'স্তিমিত সিংহাসন' নামে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়েছে পয়লা মাঘ, ১৪০৬ সালে।
জনতার থেকে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে আসা রিয়েনৎসি রোমে জনতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বৈরাচারি হয়ে ওঠার পর জনতারই প্রবল আক্রোশে নিহত হয়। বাংলা অনুবাদের ভূমিকায় লেখা হয়েছে, 'অপেরার জন্য নির্ণীত হলেও প্রথাধার্য গীতিনাট্যের কাঠামোয় না সাজিয়ে বিষয়বস্তুটি বৈপ্লবিকভাবে বিন্যস্ত করতে চেয়েছিলেন এঙ্গেলস। এবং এই রূপকল্পটির নাম কাব্যনাট্য। তাঁর কাব্যনাট্যের অনেকখানি জায়গা জুড়ে কবিতার অন্ত্যমিল/অন্ত্যমিল/ পর্বন্যাস প্রভৃতি সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়েছে। চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুহূর্ত আঁকতে গিয়ে এই উপরকরণগুলিও তিনি সরাসরি বিসর্জন দিয়েছেন।’ তার আগে অনুস্রষ্টার বিশ্লেষণ, '…ঐ নাটক অন্তত শিল্পের বিচারে, চিরায়ত নাট্যদর্শ লঙ্ঘন করেছে। দ্বিতীয় অঙ্কে দ্বিতীয় দৃশ্যে ভোজনসভার মত্ততার পাশাপাশি সন্ন্যাসীদের উচ্চারিত লাতিন মন্ত্রে ধ্রুপদী পরিবেশের ঘণীভবন স্পষ্টই চোখে পড়ে। কিন্তু এঙ্গেলস সেই ট্রাজিক সম্ভাবনাকে কোনো একাগ্র পরিণতি দিতে চাইনি, শেক্সপিয়র হাতছানি দেওয়া সত্ত্বেও শেক্সপীরিয়তা বর্জন করেছেন।
আমাদের গ্রুপ থিয়েটারের অভিনয়ে বিভিন্ন চরিত্রে একক অভিনয়ের পাশপাশি সংলাপ উচ্চারণে কোরাসের ভূমিকা ক্রমশঃ অধিক থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সম্মিলিত অভিনয়কে শ্রুতিমোহন ও ছন্দবিতানে বিচ্ছুরিত করে তোলার শিল্পপ্রীতি ক্রমিক সংবর্তের অনুশীলনে আরো শানিত হয়ে উঠেছে। 'রিয়েনৎসি' প্রযোজনাতেও 'অভিজাতবৃন্দ', 'জনতা' প্রথম কোরাস'; দ্বিতীয় কোরাস’, ‘দুই কোরাস দল’, ‘গণ কোরাস’, ‘কোরাস’ প্রমুখ বিভিন্ন জোটে সমবেশ কন্ঠের ঐকতান অভিনয়ের ঐশ্বর্য হয়ে উঠেছে। 'রিসেনৎসি’ কাব্যনাটকটি শেষ হয়েছে এইভাবে-
কোরাস ।।
প্রতিশোধ নিতে আমরা তৈরি!
নিনা ।।
উন্মাদ এই আগুনের দাহ
শুভ বুদ্ধিকে এখনো বাঁচাও!
কামিলা।।
জনতার ক্রোধ জ্বলন্ত অঙ্গার
তারই দাহে হবে জীবন সাঙ্গ তার।
নিনা।।
করুণা করুণা!
কামিলা।।
প্রতিশোধ! খুন!
নিনা।।
মমতা! মমতা!
কামিলা।।
শুনো না এ কথা।
কোরাজ।।
বিশ্বাসঘাতী, প্রতিশোধে রাজি নোস্?
কী করে এড়াবি আমাদের আক্রোশ?
(সমাপ্তি)
গত আটের দশকের গোড়া থেকে সংবার্ত গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় অনুশীলনের জন্যে ক্রমাগত এসে যোগ দিচ্ছে তরুণ ও তরুণতররা, তাদের কণ্ঠর খজুতা ও প্রগাঢ় উচ্চারণের সমলয়ে ছন্দবোধ জাগিয়ে তোলা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। রাজা মুখোপাধ্যায়, সঞ্জয় ঘোষ, সোমনাথ রায়, বিদ্যাভূষণ শর্মা, অমিতাভ বসু প্রমুখ এক ঝাঁক নাটক নিবেদিত প্রাণের উদ্দীপনা সংবর্তকে প্রচলিত মহড়া ঘরানা ছেড়ে নিরীক্ষা নিমগ্নতায় ব্রতী করেছে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নাট্য পাণ্ডুলিপির মতই তা স্বাতন্ত্রে সমুজ্জ্বল।
ওই আটের দশকের ১৯৮৪-এর বছরটা ছিল সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটাররের অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নাট্য পাণ্ডুলিপি নিয়ে মহড়া ও মঞ্চায়নের সবচেয়ে বেশি কাজের বছর। ১৯৮৪-তে একটা বা দুটো নয়, তিনটি নাট্য পাণ্ডুলিপি সংবর্তের জন্যে আমাকে দিয়েছিলেন আলোকদা। ‘নিয়তি ও দেবযান’, ‘নিয়তি ও বিপ্লব’ এবং ‘ড্রাগন বধের পালা’। প্রথম দুটি নাট্যকোলাজ এবং তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ নাটকের ভাষান্তর।
কবি হ্যোল্ডারলীনের জীবন ও রচনা নিয়ে এই কোলাজ কবি জীবনের দিব্য ট্রাজিডির নাট্যরূপ। কবি (১৭৭০-১৮৪৩) অস্তিত্বের মাধ্যমে মানুষের জীবনের চূড়ান্ত বোধ অর্জন করতে চেয়েছিলেন। কবির এই অর্জনের দাবী ছিল এতই তীব্র যে তিনি ঈশ্বর বা প্রেমিকার সঙ্গেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি।
হান্স্ য়্যুর্গেন নাগেল সংযোজিত আবহে 'নিয়তি ও দেবযান’ প্রযোজনায় স্লাইড নির্বাচন ও সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন বৌদি - ট্রুড বার্টা দাশগুপ্ত। আলোর দায়িত্বে ছিলেন জয় সেন। এই প্রযোজনায় দুর্গা শঙ্কর ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নির্মাণ একটি ফিল্মভাষ্য সংযুক্ত হয়েছিল 'আপন স্বদেশ’। ‘নিয়তি ও দেবযান’ নাট্যকোলাজে সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারে নতুন যে সব নাট্য শিল্পীদের আমরা পেয়েছিলাম তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুলগ্না মুখোপাধ্যায়, চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত, লিপিকা ভট্টাচার্য, দেবকল্পা দাশ, বিজয় দত্ত, শুভাশিস পাল, ধীমানকিশোর ঘোষ, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, মলয় নন্দী, পবিত্র নন্দী, শুভাশিসরঞ্জন দাশ প্রমুখ। সংবর্তের যাবতীয় মঞ্চ প্রযোজনার নেপথ্য কাজে প্রদীপ কর, সোমেন ঘোষ, কুমকুম দাশেদের সহযোগিতা তো থাকেই।
আগস্ট মাসের পয়লা তারিখেই ম্যাক্স ম্যূলার ভবন মঞ্চে প্রথম অভিনয় 'নিয়তি ও দেবযান' নাট্যকোলাজের। এর ২৯ দিন পড়ে, ৩০ আগস্ট ১৯৪৮-তে এম এম বি অডিটোরিয়ামে প্রযোজিত হয়েছিল নাট্যকোলাজ ‘নিয়তি ও বিপ্লব'। গেয়র্গ বুশনার-এর জীবন ও রচনা নিয়ে 'নিয়তি ও বিপ্লব' নাট্যময় কোলাজটি লিখেছিলেন অলোকদা তাঁর অন্যধারার কলমে। মাত্র তেইশ বছরের জীবনে গেয়র্গ বুশনার (১৮১৩-১৮৩৭) 'দান্তনের মৃত্যু', 'লিয়ঁ ওলেনা এবং হ্বয়েৎসেক-এর মতো তিনটি আসামান্য নাটকের রচয়িতা। মাতৃভূমি হেসেন। লাইপৎসিগের যে যুদ্ধে হেরে যান নেপোলিয়ন গেয়র্গ বুশনারের বাবা ছিলেন সেই যুদ্ধের সেনাবাহিনীর ডাক্তার। গেয়র্গ ফরাসী শাসনাধীন স্ট্রার্সবুর্গের বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছিলেন ডাক্তারি পড়তে। বিপ্লবের প্রতি তার আকর্ষণ অল্প বয়স থেকেই। ‘হেসিয়ান মেসেঞ্জার’ ইস্তাহার লেখেন তিনি ১৮৩৪-এ। বলা হয় ওই ইস্তেহার কাল মার্ক্সের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর এক আদিম সংস্করণ।
সংবর্ত গ্রুপ থিয়টারের গেয়র্গ বুশনারের চরিত্রাভিনয় দিয়ে শুরু শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের। এসেছেন আরও অনেকেই - শান্তনু লাহিড়ী, শুভ কুমার বসু, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঊর্মিলেন্দু মুখোপাধ্যায়, শম্ভু চক্রবর্তী, রাজা মজুমদার, ঈশিতা মিত্র, বাণী পাল, পদ্মিনী লাহিড়ীরাও। কিছু সময়ের মধ্যেই সংবর্তের অভিনয় ধারায় সংযুক্ত হয়েছেনে। 'নিয়তি ও বিপ্লব’-এর উদ্বোধনী অভিনয়ের পাঁচ দিন পরে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪ সংবর্তে নতুন নাটক 'ড্রাগন বধের পালা' অভিনীত হল প্রথম সন্ধ্যায়। দুই জার্মানির লোকপ্রিয় কবিয়াল হ্বোল্ভ্ বীয়ারমানের নাটক 'ড্রা ড্রা' থেকে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভাষান্তর 'ড্রাগন বধের পালা'।
দীর্ঘ পালা জুড়ে মোট একুশটি চরিত্র। এর আগে একসঙ্গে এত চরিত্র নিয়ে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের গ্রুপ থিয়েটারের ছিল না। পালার প্রতিটি অঙ্ক সূচনায় গান বা ছড়া। এই প্রযোজনায় সংবর্তের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিলেন ভারতীয় থিয়েটারের দুই শীর্ষচূড় নাট্য-পুরুষ। আলোকসম্পাতে তাপস সেন আর মঞ্চ পরিকল্পনায় খালেদ চৌধুরী। এর পাশে হলো আরও সমুজ্জ্বল সংযোজন। দৃশ্য মুখে মঞ্চে ব্যালাড আবৃত্তির জন্য আমাদের যথসময়ে আবৃত্তি উপহার দিতে থকলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
নগরী জুড়ে ড্রাগন ছিল শুয়ে
দীর্ঘ কাল সে এক পরমাদ
ভয়ংকর জন্তুটারে দেখে
ঘুচলো আমার গান গাওয়ার সাধ
সংলাপের দীপ্ত দোলায় শ্লেষের সন্দীপন তো পরতে পরতে -
হংসী।। এ আবার কেরে এখানে হল হাজির?
গাধা।। পুচ্ছটি কাটা গিয়েছে মার্জারীর
(হাস্যরোল)
বেড়াল।। আমি কিবা একা সটান বাজারে গিয়ে
যুদ্ধের পোজ-এ অযথা রই দাঁড়িয়ে…
সবাই।। আর তারপর?
বেড়াল।। আমাকে দেখেই দৌড় দিল ড্রাগন
প্রাসাদের দিকে ভয় পেয়ে বাছাধন
ফলে আমি কিনা যুদ্ধের শেষ অংশটা মিস করি
[অন্যান্য সবার তীব্র হাস্য]
শুয়োর।। গা গতর থেকে কিছু কি খুইয়েছিস?
কুকুর।। মনে পড়ে যেন আর কিছু ছিল তোর এই কলেবরে!
বেড়াল।। বাসি যত সব রসিকতা লজ্ঝড়ে।
[অস্ফূট স্বরে] ডাইনিটা কিনা আমাকে পাকড়ে
ছুরি বার করে
লেজটাকে দিল ছারখার করে
ভিড়ের মধ্যে করল রে প্রস্থান।
গাধা।। কী আর করবি সকলেরই কিছু রয়েছে ক্ষতস্থান।
[হাস্যরোল]
পরের বছর অলোকদা সংবর্তকে দিলেন আর একটি নাট্যকোলাজ 'মৃত্যুমদির হ্বান্সি হ্রদের তীরে’। মহাকবি গ্যোয়েটে যাঁর প্রতিভাকে ঈর্ষা করতেন সেই কবি, নাট্যকার ও কাহিনী লেখক ক্লাইস্টের জীবন ও রচনা নিয়ে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নাট্যকোলাজ 'মৃত্যু মদির হ্বান্সি হ্রদের তীরে’। ১৯৮৫-এর ২৩ আগস্ট প্রথম অভিনয় হয়েছিল এই নাট্যকোলাজের কলকাতার এম.এম.বি অডিটোরিয়ামে।
প্রযোজনাটি দিল্লিতে নিবেদিন হওয়ার পর The States Man পত্রিকার নাট্য সমালোচক লিখেছিলেন 'The ambience is sombre, the best slow is keeping with inherent ‘pessimism’ of the grey manuscript of k’eist of concept that the beauty of the human soul, its simplicity and purity have been lost due to submission to string-pulling fate which may be overcome by death?
১৯৮৫-তে অলোকদার তিনটি ভিন্ন গোত্রের নাট্যলেখ মঞ্চায়ন করে সংবর্ত। এর পরের বছর – ১৯৮৬-র ৯ আগস্ট আর একটি অপ্রতিম নাট্যকোলাজ, যার সৃষ্টি ওই প্রচল পরিহারী নাট্য ধারার 'অতন্দ্র গোলাপ’ মঞ্চস্থ করেছিল। কবি রাইনার মারিয়ারিলকের জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে নাট্যকোলাজ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের।
‘অতন্দ্র গোলাপ’-এ কবি রিলকের প্রেমিকা লু সালোমে আন্দ্রেয়ার চরিত্রে অভিনয়ে এলেন স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। শুরুর থেকেই অরুণ মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রাণাঘাট থেকে আসা তরুণ কবি, জয় গোস্বামীর পাশাপাশি কবি পত্নী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের আশেষ প্রেরণা উদ্দীপক দর্শক ছিলেন। এই নাট্যকোলাজ প্রযোজনা থেকে তিনি হয়ে উঠলেন নিয়মিত অভিনয় শিল্পী। আরও কিছু নতুন নাট্যকর্মী মুনমুন দত্ত, দেবাশিস ভট্টাচার্য, সন্দীপ পাল, দেবপ্রসাদ রায় চৌধুরী, অনিরুদ্ধ পুততুণ্ড, মধুলীনা সরকার প্রমুখ সংবর্তের অভিনয় ধারার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন।
পরের বছর ১৯৮৭-তে আমরা নাট্যকোলাজ নির্মাণ করলাম আটের দশকে লেখা অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের শেষ নাট্যকোলাজটির পাণ্ডুলিপি থেকে। গেরহার্ড হাউপ্টমানের জীবন ও সৃষ্টি ধারা সংকলিত নাট্যকোলাজ 'পান্থশালায় জন্ম নিল পথিক’। ১৫ মে-র সন্ধ্যায় উদ্বোধনী অভিনয় হলো।
আরও একটি বড় মাপের কাজ সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের নাঠ্য প্রযোজনার বাংলা অনুবাদ নাটকের ইতিহাসে সংযোজন করেছে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত - গ্যোয়েটের এপিক কাব্য নাটক রাইনিকে ফুক্স-এর ভাষান্তরে। এম.এম.বি-এর সহযোগিতায় এই প্রযোজনায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন প্রবীণ জার্মান নাট্য নির্দেশক হ্বোল্ফরাম মেরিং যৌথ নির্দেশনায় থাকলেন সংবর্ত গ্রুপ থিয়েটারের নির্দেশক অভিনেতার সঙ্গে। দিল্লিতে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার প্রথম ভারত রঙ্গোৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে ‘শেয়াল পণ্ডিত’-এর প্রযোজনা আলাদা মাত্রা পেয়েছিল। ‘যৌবন বাউল’ (১৯৫৯) থেকে ‘মরমী করাত’ (১৯৯০) অলোকরঞ্জনী কবিতা পরিক্রমায় সংবর্তের কবি প্রণতির কোলাজটি স্মৃতি ধার্য হয়ে আছে।
[সুনীল দাশ : জন্ম ১৯৪৩। ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার – নির্দেশক এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। আশির দশকে তারই নির্দেশনায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত রচিত একাধিক নাট্য – কোলাজ মঞ্চস্থ হয়।]
সমৃদ্ধ হলাম।এভাবে উনাকে চিনতাম না।
ReplyDeleteঅত্যন্ত সমৃদ্ধ এক ক্রোড়পত্র। এর মুদ্রণ প্রয়োজন।
ReplyDelete