ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক৩
সুরেন-গজেন দুই ভাই
ওরা এসেছিল উড়িষ্যা থেকে। প্রথমে সুরেন, তারপর ভাই গজেন। বেঁটেখাটো, বলিষ্ঠ চেহারার সুরেনের ঠোঁটদুটো পানের রঙে সবসময়েই লাল হয়ে থাকত। ছোটভাই গজেনের চেহারা ছিল রোগাপাতলা। যেটা চোখে পড়ত, তা হল গজেনের তীক্ষ্ণ নাসিকা আর একজোড়া উজ্জ্বল চোখ। সুরেন ছিল হালুইকর। কারো বিয়ে ঠিক হলে আমাদের সাবেকি দুই বাড়ির মাঝখানে তৈরি হত নহবতখানা। সেখানে বিয়ের দিনদুয়েক আগেই পৌঁছে যেত বাজিয়ের দল আর সেইসঙ্গে শুরু হত আমাদের সেই বয়সের সবচেয়ে আকর্ষণীয় নৈশ ঘটনা, যার নাম ভিয়েন।
আমাদের শৈশব-কৈশোরের রংমাখা সেই সময়টায় বিয়েবাড়িতে মিষ্টান্ন প্রস্তুত করার এই ঘটনাটি ভীষণভাবে টানত। এর অনেকগুলি পর্ব ছিল। প্রথমত তালিকা তৈরি। তারও অন্তত দুটো ভাগ থাকত। একটা মূল অনুষ্ঠানের আর অন্যটি উৎসবের দিনগুলিতে প্রাতরাশের জন্য। এবং এই পুরো ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করতেন একজন। মিষ্টি তৈরি হওয়ার পরে নৌকোর মধ্যে তাদের রাখা হত যেখানে, তাকে ভাঁড়ার ঘর বলা হত। এই ভাঁড়ার ঘর অবশ্য সেইসময় প্রতিটি একান্নবর্তী পরিবারের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। যাই হোক সেই ভাঁড়ারের দায়িত্বে যিনি থাকতেন, তাঁর ক্ষমতা ছিল বিশাল। কারো সাহস ছিল না তাঁকে অগ্রাহ্য করে কিছু করার। আমাদের মত চুনোপুঁটিরা তো কোনও পাত্তাই পেত না।
তা সেই ভিয়েন শুরু হত গভীর রাত্রে। আমাদের তখন জেগে থাকার কথা নয়। কিন্তু ওই কয়েকটি দিনের জন্য ছাড় পেতাম আমরা। মনে আছে উঠোনে জ্বলে উঠত উজ্জ্বল আলো। বাবা-কাকারা চেয়ার নিয়ে বসতেন ইতি-উতি। হাসিঠাট্টায় সরগরম হয়ে উঠত জায়গাটা। হালুইকররা মিষ্টি তৈরির প্রস্তুতির মধ্যে চা-ও করে দিত মাঝে মাঝে। সে এক এলাহি ব্যাপার। রসগোল্লা তৈরির জন্য ছানা এসে গেছে ইতিমধ্যে। তাতে জাঁক দেওয়াও শুরু হয়েছে। আমরা ভাইবোনেরা তখন দোতলায়, উঠোনকে ঘিরে থাকা ছাদের আলসেতে, এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি, ভাবছি কত কি ঘটতে চলেছে!
এই যে বিপুল আয়োজন, এর একটা নির্দিষ্ট ক্রমবিন্যাস ছিল। আর ছিল নিখুঁত পরিকল্পনা। এত বছর পর বিষয়টা নিয়ে লিখতে বসে সেটা আরও বেশি উপলব্ধি করছি। আগেই বলেছি যে এই কর্মযজ্ঞের দুটো মূল ভাগ ছিল। অনুষ্ঠানের দিন সকালের জন্য তৈরি করা হত বোঁদে। বেসন, চিনি, চালের গুঁড়ো আর সামান্য রঙের মিশ্রণে যে এরকম অপূর্ব একটি বস্তু সৃষ্টি হতে পারে, আস্বাদন না করলে তার হদিশ পাওয়া অসম্ভব। আবার এই বোঁদে থেকেই জন্ম নিত দরবেশ। খোয়া ক্ষীর, কিসমিস, কাজু আর গব্য ঘৃতের মিশেলে যে বস্তুটি আত্মপ্রকাশ করত, তাকে দেবভোগ্য বললে অত্যুক্তি হবে না। এ তো গেল প্রাতরাশ। সান্ধ্য, মূল আপ্যায়নের জন্য নিশ্চিতভাবেই তৈরি হত রসগোল্লা আর পান্তুয়া। এর মধ্যে নবীনচন্দ্র দাসের অনবদ্য সৃষ্টি রসগোল্লা (যা নিয়ে এই সেদিনও পশ্চিমবঙ্গ আর উড়িষ্যার মধ্যেকার বিবাদ গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্ত) নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। কিন্তু পান্তুয়া? লুপ্তপ্রায় এই মিষ্টান্নটি বাঙালি মিষ্টান্ন-শিল্পীর এক অসামান্য আবিষ্কার। আর এই পান্তুয়ার আরেক রূপান্তর কালো জাম এখন লুপ্তই বলা যায়। সন্দেশ আমাদের বাড়িতে বড় একটা তৈরি হতে দেখিনি, তার একটা কারণ হয়ত এই যে সেই বস্তুটি হাত বাড়ালেই অনেক পাওয়া যেত। ওই অঞ্চলটির সন্দেশ ছিল অতি বিখ্যাত। বিয়ের পরদিন, বাসি বিয়ের দিন, ভোরবেলা একটি চমকপ্রদ ব্যাপার ঘটতে দেখতাম। রসগোল্লা, পান্তুয়ার বেঁচে যাওয়া রস দিয়ে সুরেন তৈরি করত গজা আর লবঙ্গ লতিকা। লবঙ্গ লতিকা। অপূর্ব সুন্দর এই নামটি ময়দার খোলের মধ্যে নারকোলের পুরভর এই মিষ্টান্নটি খাওয়ার আকর্ষণ যেন অনেক গুণে বাড়িয়ে দেয়। এই বস্তুটি নির্মাণের আসল ওস্তাদের খেল হল পুর ভরে খোলটির চারপাশ মুড়ে বন্ধ করার সময় একটি লবঙ্গর ব্যাবহার। আর শুধুমাত্র গজা তৈরি যে একটা শিল্পের পর্যায়ে যেতে পারে তা সুরেনের তৈরি গজা খাওয়ার সৌভাগ্য না হলে জানতে পারতাম না কোনদিনই। একটি আপাতসাধারণ খাদ্যবস্তু কেবল হাতের গুণে কত অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে একাধিক এজাতীয় অনুষ্ঠানে সুরেনের তৈরি গজা খাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছিলাম। অমন গজা আর পরে কখনও কোথাও খাইনি।
এই সময়টায় গজেনের ভূমিকা ছিল মূলত দাদাকে সাহায্য করার। পরে যখন সে পাকাপাকিভাবে আমাদের পাচকের ভূমিকায় নিযুক্ত হল, তখন তার রান্না বহু পদই আমাদের মুগ্ধ করেছিল। তবে রান্নার পাশাপাশি গজেনের আরেকটি গুণ ছিল। প্রত্যুতপন্নমতিত্ব। একটি ঘটনার কথা বললে ব্যাপারটা পরিষ্কার হাবে। একবার আমরা মধুপুরে বেড়াতে গেলাম। বিরাট পারিবারিক দল। গজেনকেও নিয়ে যাওয়া হল। একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল থাকার জন্য। একদিন সেখানে যখন সবাই রাত্রে খেতে বসেছে, বাড়ির আলো গেল নিভে। খাওয়া তখন মাঝপথে। ঘটনাচক্রে আবার সেদিন রান্নার হিসেবে সম্ভবত কোনও গোলমাল হয়ে থাকবে, যার ফলে মুরগির ঝোলে টান, যা অবশ্যই রান্নার দায়িত্বে থাকা গজেনের জানা ছিল। এইসময় পংতিতে বসা কেউ একজন আরেক টুকরো মাংস চেয়ে বসলেন। ততক্ষণে রান্না মাংস শেষ। স্পষ্ট মনে পড়ে আমার পাশে বাবা। বাবার পাতে তখনও এক টুকরো মাংস। ‘ছোটবাবু (বাবাকে এই সম্বোধনই করত গজেন) এটা দিন তো’। বাবা কিছু বোঝার আগেই মাংসটা চালান হয়ে গেল হাঁড়িতে আর সেখান থেকে অন্য আরেক জনের পাতে, যে মাংসের জন্য অপেক্ষা করছিল।
এই গজেন আমরা যখন সেই পুরনো সংসারের পাট চুকিয়ে পাকাপাকি কলকাতায় চলে এলাম, তখন আমাদের সঙ্গে এসেছিল। একবার ছুটি নিয়ে গেল উড়িষ্যা, গ্রামের বাড়িতে। আর ফিরে আসেনি।
0 comments: