0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অমিতাভ পুরকায়স্থ

Posted in








কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দুর্গোৎসবের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হচ্ছে যথাযোগ্য মর্যাদায়। আজ নবমী। পারিবারিক প্রথা মেনে মোষ বলি পর্ব মিটল নির্বিঘ্নে। মোষের রক্তে কাদা হয়ে যাওয়া মাটি গায়ে মাখামাখির আচারও শেষ হল ভক্তদের। সেই হুল্লোড় থিতিয়ে এলে নাটমন্দিরে নেমে এলেন স্বয়ং নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। হাতে এক গোছা কাগজ। মহারাজের পেছন পেছন যুবরাজ এবং অন্যান্য রাজকুমাররাও হাজির হলেন। ঢাকের বোল বদলে গেল, বলিদানের তীব্র গতিময়তা থেকে দুলকি চালের খেমটায়। এক পণ্ডিত গোছের মানুষ উপস্থিত সকলকে সচেতন করে ঘোষণা করলেন, ‘এ বার শুরু হচ্ছে কাদা খেউড়!’ 

একটু গলা সাফ করে সুরে ভেঁজে মহারাজ ধরলেন স্বরচিত গান। আদিরসাত্মক রচনা, কিন্তু খুব সাবলীল ভাবে গেয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসলেন তিনি। উপস্থিত শ্রোতাদের উচ্ছ্বাস ও উৎসাহ দেখলে বোঝা যায়, সবাই এই গান শোনার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন। এ বার যুবরাজ এবং তার পর একে একে সব রাজকুমাররা মহারাজ ও সমবেত শ্রোতাদের সামনে পরিবেশন করলেন নিজেদের রচনা, যার মধ্যে দেওর-বৌদির অবৈধ সম্পর্ককে উপজীব্য করে আখ্যানও পরিবেশিত হল। ‘কি হ’ল ওলো ঠাকুরঝি’ খেউড়টি রচনা করে পরিবেশন করলেন যুবরাজ শিবচন্দ্র। মহারাজের আদেশে এর পর খেউড়ের আঙ্গিকে দুই রাজকুমারকে প্রশ্নোত্তরে ছড়া-কাটাকাটিও করতে হল। উপস্থিত শ্রোতারা খুব খুশি হয়ে শুনতে লাগলেন সেই গান। তারিফ করলেন স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্রও। এ ভাবেই সম্পন্ন হল নবমীর অনুষ্ঠান। 

আমাদের আজকের রুচিবোধে একটু খারাপ লাগলেও, আঠারো শতকের শেষ পর্যন্ত এ ভাবেই উৎসবের অঙ্গ হিসেবে পরিবেশিত হয়ে এসেছে এই গ্রামীণ বিনোদন, যার নাম ‘কাদা খেউড়’। অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে এই গান আজ অন্ধকারে নির্বাসিত। শুধু সমাজ থেকে নয়, আমাদের স্মৃতি থেকেও। 

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তার ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ (পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ) ‘কাদাখেঁড়ু’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অর্থ বলেছেন, ‘স্ত্রীরজো জনিত উৎসব। স্ত্রীলোকের পুনর্ব্বিবাহের সময় কাদা মাখিয়া যে খেউড়, পাঁচালি গান হয়, তাহার নাম কাদাখেঁড়ু’। সঙ্গে দু’লাইন উদাহরণ দিয়েছেন ‘অন্নদামঙ্গল’ থেকে, সেটা তুলে দিলাম প্রসঙ্গটা বোঝাতে— “বিদ্যার হইল ঋতু সখীরা জানিল।/ বিয়া মত পুনর্ব্বিয়া সুন্দর করিল॥/ খুদমাগা কাদাখেঁড়ু নারিনু রচিতে।/ পুথি বেড়ে যায় বড় খেদ রৈল চিতে॥” উদাহরণে, উপরের দেওয়া উদ্ধৃতির শেষ দুই লাইন দিয়ে জ্ঞানেন্দ্রমোহন সরাসরি ‘অশ্লীল’ তকমা না দিলেও, ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সর্বসমক্ষে এমন গান গাওয়া হয় না। আদিরসাত্মক ‘কাদা খেউড়’ ছাড়াও আর এক ধরনের খেউড় প্রচলিত ছিল, যার নাম ‘সাদা খেউড়’। দ্বিতীয় ধরনের খেউড় মূলত রাধাকৃষ্ণকে উপজীব্য করে রচনা হত। তবে আজ কথা ‘কাদা খেউড়’ নিয়ে, যা এক সময় ছিল শারদোৎসবে নবমী উদ্‌যাপনের অঙ্গ। 

তা হলে কি কাদা খেউড় রাজবাড়ির নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিকৃতি? সেই সম্ভাবনা বাতিল করে কাদা খেউড়ের জনপ্রিয়তার কথা শুনিয়েছেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত। নিজের ছোটবেলা, অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষ অর্ধের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, সে সময় নবমীতে পাঁঠা ও মোষ বলি দিয়ে সেই রক্ত-কাদা গায়ে মেখে এবং মোষের মুণ্ড মাথায় নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা হত। মহেন্দ্রনাথ লিখছেন, “বৃদ্ধ পিতামহ তাহার সমবয়স্কিলোক, পুত্র, পৌত্র লইয়া হাতে খাতা লইয়া কাদামাটির গান করিত। সে সব অতি অশ্লীল ও অশ্রাব্য গান। বাড়ীর মেয়েদের সম্মুখেও সেই সব গাওয়া হইত এবং পাছে ভুল হয় এজন্য হাতে লেখা খাতা রেখে দিয়েছে, ইহাকে অপর কথায় খেউড় গান বলিত। তখনকার এ সবের প্রচল ছিল এবং লোকে বিশেষ আপত্তি করিত না বরং আনন্দ অনুভব করিত।’’ 

মহেন্দ্রনাথের সাক্ষ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে নবমীর দিন খেউড় গানের সামাজিক মান্যতা ছিল। কিন্তু তার পর কী এমন হল যে এই গান একেবারে হারিয়ে গেল? খুব ছোট করে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না। তবে মহেন্দ্রনাথ সেই কারণগুলির একটি দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘কিন্তু ইংরাজী শিক্ষা ও কেশব সেন মহাশয়ের অভ্যুদয় হইতে ধীরে ধীরে এ সব উঠিয়া যায়।’’ আসলে ইংরেজি শিক্ষা আর কেশব সেনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন সাংস্কৃতিক বোধ ও রুচির প্রকাশ দেখল কলকাতা শহর। পুরনো বিনোদনের খোলনলচে বদলে নতুন নতুন মাধ্যমের উদয় হল। শহরের বড়লোক ও তাঁদের দেখাদেখি মধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশ প্রগতির এই নতুন পথের যাত্রী হলেন। ‘অবক্ষয়ী’ রুচির প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাসনের সাজা পেল কাদা মাটির গান। অথচ এই গানের উৎস ও দুর্গোৎসবের সঙ্গে এর সম্পর্কের গভীরে গেলে, এক অন্য দৃষ্টিকোণের হদিশ মেলে। খুব সহজে ‘বাবু কালচারের অবক্ষয়’ বলে দেগে দেওয়ার আগে, ইতিহাসের সেই পাতা একটু উল্টে দেখা যেতে পারে। 

আমরা জানি যে ভারতে তন্ত্রের যে মূল চারটি সম্প্রদায় আছে (গৌড়ীয়, কেরলীয়, কাশ্মীরি ও বিলাসী) তার মধ্যে গৌড়ীয় সম্প্রদায় প্রাচীনতম ও প্রধান। অনেকে মনে করেন গৌড়েই তন্ত্রের উদ্ভব (গৌড়ে প্রকাশিতা বিদ্যা)। পাল বংশের সময়ও বাংলায় তন্ত্রের বেশ ভাল প্রভাব ছিল। প্রাচীন সতীপীঠগুলির অবস্থান লক্ষ করলেও দেখা যায়, বেশির ভাগই বাংলায় অবস্থিত। এই সমস্ত অঞ্চল এক সময় জঙ্গল ছিল এবং সেই বন্য ভূমির অধিবাসী ছিল ‘কিরাত’ বা ‘শবর’ নামের জনগোষ্ঠী। ‘কাদম্বরী’, ‘হরিবংশ’, ‘দশকুমারচরিত’, ‘ভবিষ্যোত্তরপুরাণ’, ‘কালিকাপুরাণ’ ইত্যাদি শাস্ত্রগ্রন্থের মতে শ্রীশ্রীচণ্ডীতে যে দেবীর উল্লেখ, তিনি কিরাত ও শবরদের উপাস্য ছিলেন। তাই চণ্ডীর আবির্ভাব এই বাংলায় বলে মনে করা হয়। 

আমরা দুই শ্রেণীর শবর জাতির কথা জানতে পারি। ‘নগ্ন শবর’ ও ‘পর্ণ শবর’। বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে ‘পর্ণশবরী’ নামের দেবীর কথা পাই, যিনি গাছের পাতা পরিধান করেন। এই ষড়ভুজ দেবীমূর্তিগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি বাংলার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবিষ্কৃত। পাল যুগের শিল্পকলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পর্ণশবরীর দুটি মূর্তি উদ্ধারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর নাম। অন্য দিকে বলা যেতে পারে হিন্দু পূজাপার্বণের আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ, জীমূতবাহন প্রণীত ‘কালবিবেক’-এর কথা (আনুমানিক সময় দ্বাদশ শতক)। সেখানে নবমীর কৃত্য হিসেবে শবরোৎসবের কথা বলা হয়েছে। তার সঙ্গে বিশেষ করে নির্দেশ করা হয়েছে কাদামাটির গানের কথা। সুতরাং এ কথা আমরা বলতেই পারি যে বাংলার দেবী-উপাসনার ধারাবাহিকতার উত্তরাধিকার আসলে সেই আদিম জনজাতির মাতৃকা পূজার উত্তরাধিকার। সেই উত্তরাধিকারেরই একটি নিদর্শন শবরোৎসব, যার অঙ্গ ছিল কাদা খেউড়। 

পুরাণ ও প্রচলিত লোককাহিনির পরিসরের বাইরে দুর্গাপূজার ইতিহাস ও বিবর্তনকে দেখার চেষ্টা হয়েছে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও। সেই সব অনুসন্ধান দুর্গাপূজার নানা আচার ও অনুষ্ঠানের মধ্যেও চেষ্টা করে বাঙালির মতো মিশ্র জাতির হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের নানা ইঙ্গিত খুঁজে পেতে। নানা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ঘটে চলা ক্ষমতার টানাপড়েন যেন প্রতিফলিত হয় উৎসবের বিবর্তনের ইতিহাসে। 

গবেষকদের একটা বড় অংশ এখন মোটামুটি ভাবে একমত যে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের বহু আগে থেকেই দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল। কংসনারায়ণ দেবী-আরাধনার মধ্যে একটা উৎসবের মেজাজ অবশ্যই নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আরও বহু আগে থেকেই (হয়তো ঠিক এই রূপে নয়) প্রচলিত ছিল দুর্গার (বা চণ্ডীর) আরাধনা। তবে সেটা কখনওই জনসাধারণের মধ্যে উৎসবের আকারে ও দেবীকে বর্তমান রূপে কল্পনা করে পালিত হত না। 

নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে পূজার আচার-অনুষ্ঠানের ‘সংস্কার’কে দেখা যায় সমাজ বিবর্তন ও ক্ষমতার টানাপড়েন হিসেবেও। এক সময় জনসাধারণের উৎসব বলতে বাংলায় প্রচলিত ছিল গাজন। এক শ্রেণিহীন ভ্রাতৃত্ববোধের আহ্বান থাকে গাজনে। আমরা সবাই জানি যে চৈত্রের শুরুতে যাঁরা গাজনের সন্ন্যাস নেন, তাঁরা নিজ গোত্র ত্যাগ করে শিব গোত্রে পরিচিত হন উৎসবের উদ্‌যাপন পর্যন্ত। সাধারণ মানুষের এই ঐক্য সব সময়েই ক্ষমতাবানরা সন্দেহের চোখে দেখেন। তাই গাজনের পরিবর্তে অন্য কোনও উৎসব খাড়া করার প্রয়োজন হয়। আরও একটা কারণেও দরকার হয়ে পড়ল নতুন উৎসবের। গাজনের মূল ভাব ত্যাগের। সেখানে বিলাসিতার কোনও জায়গা নেই। এ দিকে সাধারণের মধ্যে বিলাস-ব্যসন শৌখিনতা বিস্তার হলে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে থাকে দ্রুত। সুগম হয় অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের পথ। 

এই প্রেক্ষাপটে চৈত্র মাসে গাজন সরিয়ে উদয় হচ্ছে নতুন জাতীয় উৎসবের। দুর্গোৎসব। যার জন্য কৃত্তিবাস বাংলা রামায়ণে যোগ করছেন অকালবোধনের অধ্যায়, যা মূল রামায়ণ এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত মহাকাব্যে নেই। সেই উপাখ্যানের শক্তিতেই বলীয়ান হয়ে চৈত্র থেকে উৎসবের মরসুমকে আশ্বিনে সরিয়ে আনেন মনুসংহিতার টীকাকার কুলুকভট্টের পুত্র, রাজা কংসনারায়ণ। এখানে কৃত্তিবাসের সঙ্গে রাজার সম্পর্কটা বলে নেওয়া দরকার। রাজা সভাপণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শে দুর্গাপূজার সঙ্কল্প করেন, তখন প্রাথমিক প্রয়োজন হয় সাধারণের সঙ্গে দেবীর পরিচয় করানোর। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, ঠিক এই রূপে দেবী সাধারণ্যে পরিচিত ছিলেন না। সেই পরিচয় করানোর কাজটির দায়িত্ব পেয়ে কংসনারায়ণের সভাকবি কৃত্তিবাস ওঝা ‘রাম পাঁচালী’ নামে রামায়ণের এক অনুবাদে শ্রীরামকে উদ্ধার করার জন্য দুর্গার অকালবোধনের উপাখ্যান রচনা করলেন। তার ভিত্তিতে বাংলায় শুরু হল উৎসব, যার রূপায়ণে সে আমলেই কংসনারায়ণ খরচ করেছিলেন কয়েক লাখ টাকা। 

নতুন উৎসবে সকল শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে, এই পুরো প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য সফল হয় না। তাই উৎসবের মধ্যে নানা আচার-অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত করা হল, যাতে সমাজের সব স্তরের মানুষ এর সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন এবং নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণে উৎসাহিত হন। পুজোর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য পূজার উপচার ও আচরণের মধ্যে সেই তথাকথিত দুর্বলতর শ্রেণির জন্য কিছু অনুষ্ঠান আলাদা করে সংরক্ষিত হল। যেমন বেশ্যাবাড়ির মাটি অথবা হাড়ির বাদ্যির কথা আমরা সবাই জানি। এগুলি ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না পুজো। এ ছাড়াও পুজোর নানা কাজে নানা জাতের মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হল নানা আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। 

অনুষ্ঠানের জন্য অন্ত্যজ বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শ্রম নেওয়ায় সমস্যা ছিল না। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রের যে প্রতিনিধিরা পুজোর সংগঠন করতেন, তাঁদের অস্বস্তি শুরু হল সাংস্কৃতিক রুচির তারতম্য থেকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেই রুচি ছিল সরাসরি ব্রাহ্মণ্য রুচির বিরোধী। তাই উৎসবকে সংস্কার করে অনার্য প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য একটা চাপ তৈরি হল। এই চেষ্টার অন্য প্রাচীন উদাহরণ হিসেবে আমাদের সামনে আসে শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক (১৫০০- ১৫৭৫) স্মার্ত রঘুনন্দনের দুর্গাপূজা বিধি সংস্কারে। শবরোৎসবের অংশটিতে ব্যাপক কাটছাঁট করেন তিনি। 

তা সত্বেও শবরোৎসবের স্মৃতি জাগানো কাদা খেউড়ের মতো অনেক আচার টিকে ছিল বহু দিন। সেটাও ধীরে ধীরে লুপ্ত হয় গেল উনিশ শতকে এসে, যখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ‘কেন্দ্রগত’ সাংস্কৃতিক রুচির পার্থক্যকে ‘অশ্লীলতা’ বলে দাগানো শুরু হল। আর অশ্লীলতা মানেই ক্ষমতাশালী শ্রেণির চোখে সম্ভাব্য সমাজবিপ্লবের বারুদ, দেখামাত্র যা নিষ্ক্রিয় করতে হয়। এই মানসিকতা থেকেই শুরু হল এক আজব ‘উইচহান্ট’, যার থেকে রেহাই পেলেন না স্বয়ং কৃত্তিবাস বা কাশীরাম দাসও। সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ১৮২০ সাল নাগাদ কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারত অশ্লীলতামুক্ত করতে শুরু করলেন এক ধর্মযুদ্ধ। অথচ অশ্লীলতা বলতে যা বোঝানো হচ্ছিল, তা ভারতীয় শিল্পশাস্ত্রের পরম্পরার একদম বিপরীত। শরীরের বর্ণনা বা মিথুনমূর্তি কখনওই অশ্লীল মনে করেননি এ দেশের সৃষ্টিশীল কলাবন্তরা। বরং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কথাবার্তায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঢুকে পড়ত নব্য রুচিবোধে ত্যাজ্য শব্দ ও বাক্য। এ নিয়ে প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘কাব্যে অশ্লীলতা—আলংকারিক মত’ নিবন্ধে বামনাচার্যকে উদ্ধৃত করে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা মনে পড়ে। সেই সংজ্ঞা যদি মেনে চলা হয় তা হলে দেখব, কাদা খেউড়ে যারা গায়ক/রচয়িতা এবং শ্রোতা হিসেবেই অংশ নিতেন, তাঁদের মনে এই গান শুনে লজ্জা, ঘৃণা, অমঙ্গল ভাবনা বা আতঙ্ক সঞ্চার হত না মোটেই। তাই মনে হয় যে বিনোদনে অংশগ্রহণকারী নয়, সমাজের উঁচু তলার মানুষের সঙ্গে রুচিভেদের জন্যই নীতিবাগীশদের রোষানলে দগ্ধ হতে হয়েছিল সাধারণ মানুষের বিনোদনকে। 

উনিশ শতকের বাংলায়, বিশেষ করে কলকাতায় এই রুচিবোধ গঠনের ব্যাপারে ব্রাহ্ম সমাজ ও ইংরেজি শিক্ষার ভূমিকার কথা আগেও বলেছি, মহেন্দ্রনাথ দত্তকে উদ্ধৃত করে। কিন্তু এই তথাকথিত রুচির উৎস খুঁজতে গেলে আমরা ঔপনিবেশিক শাসন ও সাহেবদের প্রভাবের কথা বেশি শুনতে পাই। ব্রিটিশ সমাজের অশ্লীলতা ও রুচিবোধ নিয়ে উন্নাসিকতার শুরু শিল্প বিপ্লবের পর নতুন আর্থ-সামাজিক শ্রেণি গড়ে ওঠার সময় থেকে। সাধারণ জনগণের থেকে নিজেদের আলাদা বা উঁচু প্রতিপন্ন করার চেষ্টার একটি রূপ ছিল ভাষা ও আচার-আচরণে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করা। এই চেষ্টা থেকেই জন্ম নিল শরীর ও যৌনকর্ম নিয়ে আলোচনায় নিয়ন্ত্রণ। এই নীতিবাগীশ মানসিকতা গড়ে তোলার পেছনে ‘ইভানজেলিস্ট’ (Evangelist) খ্রিস্টধর্ম-প্রচারকদের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করতে হয়। 

এই ভিক্টোরীয় নীতিবাগীশ মানসিকতাই এক দিন গেড়ে বসল বাংলায়। আর সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের ভাষা এক কথায় হয়ে গেল অশ্লীল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের অনেক আগেই জয়গোপাল তর্কালঙ্কার রামায়ণ-মহাভারত সংস্কারের কাজ শুরু করেন। তবে সুপ্রিম কোর্টের জজ-পণ্ডিত হিসেবে তর্কালঙ্কার মহাশয়ের সঙ্গে সাহেবদের মেলামেশা ছিল। কেরি ও মার্শম্যান তাঁর কাছে সংস্কৃত শিখতেন। সংস্কৃত পণ্ডিত এবং ইংরেজ সাহেব ও মিশনারি— দুই সমাজই একযোগে এ দেশের সাধারণ মানুষের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করল। এই সহযোগিতা শুরু অবশ্য সেই ১৮১৭ সালে ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ স্থাপনের সময় থেকে। ইংরেজ কোম্পানির পরিচালনাধীন সোসাইটি এবং সেই সংগঠনের বেতনভুক পণ্ডিতকুল, সবাই মিলে আক্রমণের মূল লক্ষ্য করলেন বটতলার সহজলভ্য সাহিত্য থেকে শুরু করে হিন্দু পালাপার্বণের পৌরাণিক কাহিনিকে। সাধারণের কাছে যা কিছু জনপ্রিয়, তার মধ্যে বাদ গেল না কিছুই। 

এই ছুতমার্গ কোন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, তার উদাহরণ পাই বঙ্গদর্শনের পাতায়। সেখানে লেখা হচ্ছে: ‘‘অশ্লীলতা, বঙ্গদেশীয়দিগের জাতীয় দোষ বলিলে অত্যুক্তি হয় না।’’ এর পর অশ্লীলতার নিদর্শন কোথায় পাওয়া যায়, তার উদাহরণ দিতে গিয়ে লেখক বলছেন, ‘‘যাঁহারা ইহা অত্যুক্তি বিবেচনা করিবেন তাঁহারা বাঙ্গালির রহস্য, বাঙ্গালির গালি, নিম্নশ্রেনীর বাঙ্গালি স্ত্রীলোকের কোন্দল, এবং বাঙ্গালির যাত্রা পাঁচালী মনে ভাবিয়া দেখুন। মুহূর্ত জন্য বাঙ্গালি কৃষকের কথোপকথন শ্রবণ করিয়া দেখুন— বাঙ্গালির প্রণীত যে সকল কাব্যগ্রন্থ সর্ব্বোৎকৃষ্ট বলিয়া খ্যাত তাহা পাঠ করিয়া দেখুন।’’ অর্থাৎ পুরো লৌকিক বাংলার সংস্কৃতিকে এক কথায় অশ্লীল বলে ত্যাজ্য করা হচ্ছে। 

নীলকর সাহেবদের অত্যচারে সদর্থক ভূমিকা নেওয়া পাদ্রী জেমস লং থেকে দেশীয়দের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিখ্যাত বেথুন সাহেব— সকলের মত ছিল: সমস্ত জনপ্রিয় এবং লৌকিক সাহিত্য ‘সুস্থ রুচির পরিপন্থী’। পরবর্তী সময়ে নীতি-নৈতিকতার এই পতাকাটাই তুলে ধরে এগিয়ে নিয়ে গেলেন কেশবচন্দ্র সেন। 

তবে শুধু রুচিভেদ নয়। এর মধ্যে রাজনীতির একটা সূক্ষ্ম চালও ছিল। উনিশ শতকের জন-বিনোদনের মধ্যে দিয়ে শাসক ও শাসকদের নিকটজনের সমালোচনা করলেই তা অশ্লীলতার দায়ে বন্ধ করে দেওয়ার প্রবণতা চোখে পড়ে, যেমন ঘটেছিল কাঁসারিপাড়ার সঙ-এর ক্ষেত্রে। আর সেই সঙ-এর মিছিল থেকেই আওয়াজ উঠেছিল ‘অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই’। এই সরল স্বীকারোক্তি থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে বাংলার সাধারণ মানুষের শব্দকোষে এই শব্দের কোনও অস্তিত্ব ছিল না কোনও কালেই। অশ্লীলতার অভিযোগ এসেছে সব সময় ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে এবং প্রান্তিক মানুষের নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার অধিকারকে অবজ্ঞা করে। সে রঘুনন্দন-ই হোন বা জেমস লং! 

নবমীর দুর্গাপুজোর বলির সঙ্গে কাদা খেউড়ের সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি আমাদের বলেছেন কৃষ্ণযজুর্বেদ অনুযায়ী “সম্বৎসরব্যাপী সত্রের পর ঋত্বিকেরা হর্ষক্রীড়া করতেন আর তাঁদের সম্মুখে দাস জাতীয় বারাঙ্গনা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি নৃত্য ও অশ্লীল গান করত। ‘কাদামাটির গান’ আসলে সেই পরম্পরা।” প্রত্যাশিত ভাবেই তিনি বিষয়টি ব্যখ্যা করতে চেয়েছেন শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যা উচ্চবর্গীয় তথাকথিত ‘পরিশীলিত’ রুচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই দেশের আদি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রভাবের কথা হয়তো তিনি বলেননি। 

খেউড়ের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুর, শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ, রাজা গোপীমোহন দেব, জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবার, গরানহাটার কৃষ্ণমোহন বসাক প্রমুখ। পরবর্তী সময়ে অশ্লীলতার পৃষ্ঠপোষক বলে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে তাঁদের। কিন্তু এই বিচার শুরুর আগে ভাবার প্রয়োজন হয়তো ছিল যে সেই সময় কলকাতা শহর সবে গড়ে উঠছে। অন্যান্য জায়গা, মূলত গ্রাম থেকে মানুষ এসে বসতি তৈরি করছেন এখানে। তাঁরা নিয়ে আসছেন তাঁদের গ্রামের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। সেই সব গ্রামীণ সংস্কৃতির সমাহারেই গড়ে উঠছে নতুন শহর কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিচয়। সেই গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ ছিল খেউড় যা কলকাতার অনুকূল পরিবেশে নিজের শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছিল। 

এ প্রসঙ্গে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি উত্তরবঙ্গ এবং লাগোয়া আসামের লোকগীতি-পরম্পরার জাগ-গানের প্রতি। সাধারণত মদন চতুর্দশীর পার্বণ উপলক্ষ্য করে গাওয়া হয়। শ্রী যাদবেশ্বর তর্করত্ন মনে করেছেন যে ‘কামকে জাগ্রত করার গান’ বলেই এর নাম ‘জাগ-গান’। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে গাওয়া কৃষ্ণলীলা বিষয়ক এই লোকসঙ্গীতের একটি অংশ ‘কৃষ্ণ-ধামালী’। জাগ-গানের এই ধারার নাম ‘কৃষ্ণ-ধামালী’ কেন হল, সেই উত্তর খুঁজতে ‘দেশ’ পত্রিকায় এক নিবন্ধে যতীন্দ্র সেন লিখেছেন— “ধামালী শব্দে তরল ভাবে অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট গান বুঝায়।... জাগ-গানের অন্তর্গত কৃষ্ণ ধামালী পালাটি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়ক।” 

কৃষ্ণলীলা বিষয়ে একটি জাগ-গানের উদাহরণ দেখা যাক— 

“বাপের আগে কয় কানাঞি মাওয়ের আগত কান্দে। 
রাধা মামির জোড়া শ্রীফল আমার খাবার নাদে।। 
ডাঙর হ’ বোল ছাওয়াল কানাঞি ডাঙর হ’ বোল তুই। 
খাবার পাইলে সনতরা কিনিয়া আনিম মুই।।” 

উত্তরবঙ্গ ও সন্নিহিত আসামের রাজবংশী সমাজের এই গান । কিন্তু তার সংজ্ঞা নির্ধারণে ‘অশ্লীল’ বিশেষণটির ব্যবহার করতেই হয়েছে ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায়। কাদা খেউড়ের ক্ষেত্রেও একই জিনিস লক্ষ করা যায়। গ্রাম্য বা আদিবাসী সমাজের এই স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গিকে বদলে দিতে চেয়েছে ক্ষমতার সংস্কৃতি। তাই জাগ-গানের আয়োজন হয় লোকবসতি থেকে একটু দূরে। সেই সুযোগ আছে বলেই কোনও কোনও অঞ্চলে এখনও বেঁচে আছে জাগ-গান। কাদা খেউড় কলকাতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় সেই সুযোগ হয়তো ছিল না। তা ছাড়াও সমালোচনা ও নিন্দার ঝাপটাও অনেক বেশি পড়েছে তার উপর। সব মিলিয়ে উনিশ শতক পেরোনোর আগেও পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয় এই বিনোদনের। 

আমরা প্রায় দেড় শতক বা তারও আগের একটা সময় নিয়ে আলোচনা করছি। এই সময়ের মধ্যে নাগরিক রুচির বদল বয়ে গেছে যে খাতে, সেখান থেকে উজান যাওয়ার চিন্তাটাই পাগলামি। তবু আজ এই পুরনো কাসুন্দি আবার ঘাঁটতে বসেছি, কারণ এর মধ্যে আছে ইতিহাসের এক শিক্ষা। ঠিক যে ভাবে এক সময় শবরোৎসবের সংস্কৃতি ছেঁটে ফেলা হয় সাংস্কৃতিক দূষণের নামে, সে ভাবেই রুচি ও নৈতিকতার দোহাই দিয়ে বারংবার সমাজের ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী নিজেদের অনুমোদিত সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বাকি সমাজের উপর। আর সেই চেষ্টা ফলবতী হলে দেখা যাচ্ছে, নিজেদের সাংস্কৃতিক শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বহু সংখ্যক প্রান্তিক মানুষ আর হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে সম্পূর্ণ একটি কাদা খেউড় পদ খুঁজে পাওয়া আজ খুব কঠিন। খেউড় সম্পর্কেও শুধু উল্লেখ পাওয়া যায় আখড়াই ও হাফ-আখড়াই গানের ক্রমবিবর্তনের একটি ধাপ হিসেবে। অথচ মহেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্য অনুযায়ী তেমন হওয়ার নয়। কাদা খেউড় গানের খাতা থাকা উচিত ছিল পুরনো কলকাতার বহু পরিবারে। এই বিষয় নিয়ে কাজ করতে গবেষকরা এগিয়ে এলে আমরা আমাদের সামাজিক ইতিহাসের একটি কম-আলোচিত দিক সম্পর্কে আরও জানতে পারব। 

0 comments: