গল্প - সুদীপ ঘোষাল
Posted in গল্প১
শরৎশশী তাঁর স্বামী উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অসুস্থ অবস্থায় সেবা করে চলেছেন দিনরাত। স্বামী উমেশচন্দ্র বলছেন, শশী আমার সংসার তোমার হাতে থাকল। আমি আর বাঁচব না। তুমি সকলকে নিয়ে সাবধানে থেক।
দু চার দিনের মধ্যে উমেশচন্দ্র পরলোকগমন করলেন। শরৎশশী কান্নাকাটি করলেন। কিন্তু মানুষের শেষ পরিণতিকে মানতে হয় সকলকে।
চৈতন্যদেবের আমলে কুমারখালীর নাম ছিল তুলসী গ্রাম। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এ অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের জন্য কালেক্টর নিযুক্ত করেন কুমারকুলি খাঁ কে। তার নাম থেকে আঞ্চলিক সদরের নাম হয় কুমারখালী। সাবেক 'কমরখালীর' বিবর্তিত রুপ বর্তমান 'কুমারখালী'।ছোট থেকেই যতীন্দ্রনাথ গাছে চড়া, সাঁতার কাটায় বাহাদুর ছিল। তাঁর জননী শরৎশশী বলতেন, যাও পুকুরে গিয়ে সাঁতার কাটো। নিজের শরীর গঠন কর। শরীর ভাল না থাকলে মন ভাল থাকে না। বন্ধুদের সঙ্গে কবাডি খেল।যতীন বলে, আমি কবাডি খেলতে ভগালবাসি মা। বিপ্লবী এই বীর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। ভুলে যাওয়া বাঘা যতীনের জন্মদিনে প্রতিমুহূর্ত তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বাঘা যতীনের আসল নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তার জন্ম জন্ম কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়ায়। বাবার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম শরৎশশী। খুব ছোটবেলায় যতীন তার বাবাকে হারায়। যতীনের মা বিধবা শরৎশশী দেবী ছিলেন স্বভাবকবি। স্বামীর স্বর্গারোহণ, শ্মশান, সংসার প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই বাঘা যতীনকে সাহসী করে তোলার পেছনে তার মা শরৎশশীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।একদিন সকালবেলা যতীন্দ্রনাথ উঠে ব্যায়াম করছেন এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন প্রতিবেশিরা সকলে মিলে বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করছেন। তিনি খালি হাতে বেরিয়ে পড়লেন বাঘ দেখার জন্য। জঙ্গলের আসে পাশে বাঘ লুকিয়ে পড়ছে। সহজে দেখা যাচ্ছে না। হাতে একটা ছোরা নিয়ে তিনি দৌড়ে গেলেন ফাঁকা জায়গায়। মানুষের মাঝে বাঘ ধরা বিপজ্জনক। সঙ্গে বন্ধুরাও চারিদিক থেকে ঘিরে ধরল বাঘকে। তিনি তাদের নির্দেশ দিলেন,কে কোন দিকে যাবে। তারপর শেষে দেখা গেল বাঘের সঙ্গে তার লড়াই শুরু হলো। প্রচণ্ড লড়াই। কে জেতে কে হারে? সবাই উদ্বিগ্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। বাঘাযতীন কে মেরে ফেলবে বাঘে? বাঘের থাবার সঙ্গে কি মানুষ পেরে ওঠে? এই সব ভাবতে ভাবতে দেখা গেল, বাঘটি নিচে মরে পড়ে আছে। যতীন উঠে দাঁড়িয়ে আছে বাহাদুরের মত। যতীন ঘায়েল হয়েছে। সে আহত।আর এদিকে সকলে, বাঘা যতীন জিন্দাবাদ বলে সমস্বরে চিৎকার করে জয়ধ্বনি দিচ্ছে।ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বাঘা যতীনের আসল নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তার জন্ম জন্ম কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়ায়। বাবার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম শরৎশশী। খুব ছোটবেলায় যতীন তার বাবাকে হারায়। যতীনের মা বিধবা শরৎশশী দেবী ছিলেন স্বভাবকবি। স্বামীর স্বর্গারোহণ, শ্মশান, সংসার প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই বাঘা যতীনকে সাহসী করে তোলার পেছনে তার মা শরৎশশীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।বাঘ মারার পরে যতীন, বাঘা যতীন বলেই পরিচিত হলেন।তিনি ঝিনাইদহ জেলার অধিবাসী ছিলেন। তিনি কোন অস্ত্রের সাহায্য ছাড়াই খালি হাতে বাঘ হত্যা করার পর তাঁকে বাঘা যতীন নামে অভিহিত করা হয়। এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করার পর তিনি সাঁটলিপি ও টাইপ শেখেন এবং পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের স্টেনোগ্রাফার নিযুক্ত হন। যতীন ছিলেন শক্ত-সমর্থ ও নির্ভীকচিত্ত এক যুবক। অচিরেই তিনি একজন আন্তরিক, সৎ, অনুগত এবং পরিশ্রমী কর্মচারী হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন। তাঁর মধ্যে আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধ অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। অরবিন্দ ঘোষ এর সংস্পর্শে এসে যতীন শরীর গঠন আখড়ায় গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যুগান্তর দলে কাজ করার সময় নরেনের (মানবেন্দ্র নাথ রায়) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং অচিরেই তাঁরা একে অপরের আস্থাভাজন হন।তাঁর বন্ধু ছিলেন বারীন্দ্র কুমার ঘোষ,এম এন রায় প্রমুখ। যুগান্তর দলে কাজ করার সময় মানবেন্দ্র রায়ের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে।
২
যতীন ও তার বন্ধুরা ছোট থেকে বড় হয়েছিল পরাধীনতার গ্লানি মাথায় নিয়ে। তবু তার ছেলেবেলার কথা মনে পড়লে ভাল লাগে। সে মাঝে মাঝে হারিয়ে যায় ছেলেবেলার জীবনে। তার গণিতের শিক্ষকমশাই বলতেন, যোগ,বিয়োগ,গুণ,ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ,ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে,বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কতবড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এই রকম হন। ফোচন বললো।ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো,আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন,আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো,কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো,একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো। গ্রামে থাকতেই প্রাইমারী স্কুলে যেতাম।
মাষ্টারমশাই আমাদের পড়াতেন। পরের দিন আমরা দুই ভাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম। বড়দা গ্রামে কাকার কাছে আর ছোটো ভাই বাবু একদম ছোটো। স্কুলে মীরা দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন,এটা কি? আমি বললাম অ য়ে, অজগর আসছে ধেয়ে।
আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে বললেন,এটা কি?
আমি ভাবলাম,আমি তো বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। দিদি বাবাকে বললেন, এবছর ওকে ভরতি করা যাবে না
বারীন বলে, ছোড়দা ভরতি হয়ে গেলো। তারপর বাসা বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের খেলার সঙ্গি ছিলো অনেক। ধীরে ধীরে আমরা বড়ো হয়ে কুমারখালি হাই স্কুলে ভরতি হলাম। তখন লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার রাস্তা ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেতো তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া।এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই।মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। বড়দা ও ছোড়দা রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে।গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন।আবার বিল্বেশ্বর হাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম বাবার সঙ্গে। ভরতি র পরীক্ষা হলো। হেড মাষ্টারমশাই বললেন,বাঃ, ভালো পত্রলিখন করেছে। বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে। কজনে জানে।আমি প্রণাম করলাম স্যারকে। ভরতি হয়ে গেলাম।
সংসারে সং সেজে দিবারাতি
নিজেকে ঠকিয়ে কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমার।নিজেকে নিজের প্রশ্ন
কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন। জানি রাত শেষ হলেই
ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে। পাড়ার গরীব মাসিকে
টোন কেটে অনেকে অভিশাপ দিতো। আমি দেখেছি ধৈর্য্য
কাকে বলে। আজ কালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন। কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না। তাই তাঁর বিচারের
আশায় দিন গোনে শিশুর শব,
সব অবিচার ,অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে
আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি।
অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে। সাবধান খুনীর দল ,একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য
শান্ত পৃথিবী রেখে যা। ঋতু পরিবর্তন
কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ।শান্ত হোক হত্যার
শাণিত তরবারি।নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা। রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন
পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়। শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের
শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়।
তার কদর হয় ভাবি প্রজন্মের
হাতে। সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়। মানুষও একদিন ফুলের মত ঝরে যায়।। শুধু সুন্দর হৃদয় ফুলের কদর হয়। বিদেশে ষাট বছরেও মানুষ স্বপ্ন
দেখে। নিজেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরখ করার সুযোগ মেলে। কিন্তু আমাদের কয়েকজন বন্ধু
লোক ব্যাঙ্গের সুরে বলে,
বুড়ো ঢ্যামনার ভিমরতি হয়েচে। সখ দেখো এখনও রঙীন জামা পড়ে। ব্যায়াম
করে। মেয়েদের সঙ্গে কতা বলে।
একটু হাসি ঠাট্টা করলে বলবে, মিনসে, ঘাটের মরা এখনও দুধ তোলা রোগ গেলো না।
সব স্বপ্ন দেখা বন্ধ রেখে বুড়ো সেজে থাকলেই সম্মান পাওয়া যায় বেশি। নিজের মনে গুমরেওঠে যত স্মৃতি। শেয়ার করার কেউ নেই। তারপর মরে যাওয়ার পড়ে অন্তিম কাজ, নির্লজ্জ ভুরিভোজ।
তবু সব কিছুর মাঝেই ঋতুজুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি। সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই। তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা। সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে। সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে আমার দেশই আদর্শ।
সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক।
সব অভাব অভিযোগ মা শরৎশশীর কাছে এসে থমকে পড়ে অনায়াসে। আর অপরের উপকার করতে স্বপ্নার তুলনা মেলা ভার। রূপসী বাংলার রূপে ছুটে যাই। কিন্তু আমার চেনা পৃথিবীর সবটা হয়ে যা
অচেনা বলয়,মাকড়সার জালের মতো জটিল। সবাই এত অচেনা অজানা রহস্য ময়।বুকটা ধকধক করছে,হয়তো মরে যাবো, যাবো সুন্দরের কাছে,চিন্তার সুতো ছিঁড়ে কবির ফোন এলো। এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে, অভয়বাণী মিলেমিশে সৃষ্টি করলো আশা।আর আমি একা নই,কবির ছায়া তাঁর মায়া আমাকে পথ দেখায়...
যতীনের বন্ধু বলে, মনমতো
পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু
আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস
রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল
পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো
না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি
নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা।
আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই,
কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি
গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু
উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু
ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম
শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু
শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি
শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার
বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে।
আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো
বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে
কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম, বোধহয় পারবো।
তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না,
কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু
বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে
বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম
তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা
হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের। আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায়
গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু।
ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু ওই
সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে
অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেলেটো। বন্ধু বললো,আমাকে অত বোঙা
ভাবিস নি। তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা। আমি অভিনয়টো কেমন
করেছিলাম বল একবার। দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন। ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু।
দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো
হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার
ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পরেছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই।
পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতেএসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে
সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠিই প্রধান অস্ত্র। লাঠিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো
না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন,আমার মাথায় লাঠি মারতে
দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। পঁচিশজন ডাকাত সবকিছু ফেলে লাগালো ছুট। জমিদার
দাদুকে বললেন,আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো
করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টিজল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন।
দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত
সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো,আপনার মায়ের দুধের জোর বটে।
আপনাকে পেন্নাম।সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি
করবো না। দাদু বলেছিলে, ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে
ভালো কাজ দেবো। শেষে ওই ডাকাতদল জমিদারের লাঠিয়াল হয়েছিলো। ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলো।
এখন চোর ডাকাতগুলো চরিত্রহীন, দুর্বল,নির্গুণ।
সেই ডাকাত সর্দার সন্ধ্যা হলেই দাদু আর জমিদারকে শ্যামাংগীত শোনাতো।
কুমারখালী উপজেলা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার একটি প্রশাসনিক এলাকা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনের এক উল্লেখযোগ্য অংশ এই উপজেলার শিলাইদহ অঞ্চলে কাটিয়েছেন এবং এখানেই তিনি গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন।এই কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এই উপজেলায় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধক লালন সাঁই-এর সমাধি সৌধ এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন-এর বাস্তুভিটা রয়েছে।
মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়।গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে।তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে। একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না। আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে অভাবি বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো।আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি? বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়।বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এতবড় মন সে পেল কোথা থেকে? স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেড মাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস। রেজাল্ট ভালো হবে।ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশি বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলেুু উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল।বিশু বললো, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের।তার অভয় বাণী ভরসা করে আমরা মাল পত্তর নিয়ে ঢুকে পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে। ক্যাপটেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো, ভূতের শেষ দেখে ছাড়বো। জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো, যদি গলা টিপে ধরে ভূত। বিশু বললো, ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু হবে না। হলে আমার হবে।
এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো। ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পরলে বিকট আওয়াজ হয়। আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো।আজ আর কেউ স্কুল গেলাম না। একটা উত্তেজনা রাতে জাগিয়ে রেখেছে। এবার সেই বিকট শব্দ। বিশু বাঘের মতো লাফিয়ে লাঠি হাতে নিচের তলায় গিয়ে জলজ্যান্ত ভূতের পাছায় লাঠির আঘাতে ভূতকে কাবু করে ফেললো। ভূত বাবাজি জোড় হাতে বলছে, ছেড়ে দাও বাবা আমি আর ওসব করবো না। ভূতের সঙ্গিরা সব পালিয়েছে, আমাদের হাতে লাঠি দেখে। বিশু বললো, যাও, যেখানে বিশু আছে সেখানে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। বিপদে পড়বে।তারপর থেকে আর কোনোদিন ভূতের উপদ্রব হয়নি সেই বাড়িতে।বিশুর বাহাদুরি দেখেই আমরা সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বিশুর সঙ্গে আমরা বেরোলে সকলের চোখেমুখে একটা সাহসের,শান্তির ছাপ ফুটে উঠতো। পাড়ার কোনো মানুষ বিপদে পরলে বিপদের বন্ধু এই টাইগার বিশুকেই স্মরণ করতো। তার সঙ্গে আমরা তো থাকতাম অবশ্যই। রমেন, জীবন,বিশু,আমি একবার বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা,গুড়ের বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। বিশু বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানেআর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌ্কা ও খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো, কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে। গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেতো। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেতো। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম, তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে। মাঠেই পাওয়া যেতো বেশির ভাগ শাক, সব্জী। খলসে, ওআরও নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো। বেলে, তে চোখো,চ্যাঙ,ছিঙুরি,গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া তাল কাঁকড়া পাওয়া যেতো। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনরকবার তআল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে। পাঁকাল,গুঁতে,কৈ,মাগুর,ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে।বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল,পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী।। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরীবউ মুড়ি নিয় আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিতো জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণ যুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায়চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমার মা বলতেন,ছোটো থাকাই ভালো রে,সংসার অসার। মা বলতেন,এখন সংসাররূপ চিতায় জ্বলে মরছিমরণের পরে প্রকৃত চিতায় পুড়ে যাবে আদরের দেহ...স্বজন বন্ধুরা বলবে. আর কত সময় লাগবে শেষ হতে...একটু দ্রুত করো ভাই..তবে কিসের এত অহংকার...
কেন এত লোভ ... ভালোবাসায় কৃপণতা
কে ধনী... টাকায় চিতা
সাজালেও পরিণতি একই...
কৃষ্ণধনে ধনী যেজন
নিজ ধামে ফেরে সেজন...
লক্ষ্মীপুজো এলেই মা শরৎশশী বলতেন কোজাগরির অর্থ।মায়ের বান্ধবীদের দেখেছি। যতীন বলে, তাদের মধ্যে গীতা কাকিমাকে মা গীতু বলে ডাকতেন। তিনি বলতেন, কোজাগরি লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষী স্বয়ং বিরাজ করেন। কোনো অভাব, অনটন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে। কারণ সে সংসারী। ছেলে, মেয়ে, বাবা,মা, ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার। তাদের মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ। বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন। লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে শিল্প ভাবনা বিরাজ করে। তারফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে। প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর আদলে মন্দির বানানো হয়। যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোনারক প্রভৃতি। নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। মা আমাদের নিয়ে,কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রি পুজো, কাগ্রামের জগদ্ধাত্রি পুজো,শিবলুনের মেলা,উদ্ধারণেরপুরের মেলা দেখাতে নিয়ে যেতেন। পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত হয়ে যেতো। কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাজা নীচু করে আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা। পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকতো। ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে। সর্দার বুড়ি বেসকা দি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো। ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা,রুনু, শংকরী সকলে আসতো। মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে। গম্,গম্ করতো বাড়ি। মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য সুরে।পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো। মনেআছে আমার, খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস খবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা? তোর স্বামী মরে গেছে। দুঃখের কথা। তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক। আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না। আর মনে মনে স্বামীকে দোষ দিলো। সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে? ওদের হাত ওই মাংস অবধি। অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি।বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো। সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর। উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার। সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ করে না। যে যারইচ্ছেমতো খেটে খায়। কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালা সোনার দেকানে কাজ করে। বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায়। ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই পরকালের ডাকে ওপাড়ে চলে যায়। কাজই হলো আসল লক্ষ্মী। কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়ছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত,ভব,ভম্বল,বাবু বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়া তলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল,বেল, কুল,শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন। শুধু দুহাতের একটা দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে।শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউএলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছেউঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো। ভোরবেলা ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দোবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পরতো জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘনটার পর ঘনটা কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো ন।,ফেসবুক ছিলো না। কোনো পাকামি ছিলো না।সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লু হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়। আমাদের একটা বন্ধু দল ছিলো। পুজোর সময় রাত জেগে ঘুরতুম কোলকাতার অলিগলি। হাওড়া ব্রিজ থেকে শিয়ালদহ। পায়ে হেঁটে। গোল হয়ে প্রাচী পেরিয়ে হাঁটার নেশায় চলে আসতাম আবার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সোজা কলেজ স্কয়ার। জীবনের তিরিশটা বছর তিল তিল করে খরচ করেছি আনন্দের খোঁজে। অসীম বলে সীমাহীন আনন্দের ছেলেটা গান গাইতো সুন্দর। বিচ্ছু বলে বন্ধুটা ভালোবাসতো অপলক মায়া জড়ানো চোখের সুন্দরী কে। তাকে দেখলেই বিচ্ছু ওথেলো হয়ে যেতো।অমিত রান্না করতো খুব ভালো। পুরী আর দীঘাতে ওর হাতের রান্না খেয়ে আনন্দিত আমরা ওকে একটা জামা উপহার দিয়েছিলাম। ও শেফ হতে চেয়েছিলো। অনিন্দিতা বলে বান্ধবী টা আমাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। কিন্তু সব স্বপ্ন গুলো বিস্ফারিত চোখের কাছে থমকে গিয়েছিলো।অই বন্ধুরা একত্রে সমাজ সেবার প্রচেষ্টায় আছে। রাস্তার অভুক্ত মানুষের মুখে একটু নুনভাত জোগানোর জন্য ওরা ভিক্ষা করে, জীবনমুখী গান শুনিয়ে। অসীম গান করে,বিচ্ছু একতারা বাজায়। অমিত আর অনিন্দিতা সুরে সুর মিলিয়ে স্বপ্ন দেখে। ওরা এখনও স্বপ্ন দেখে। হয়তো চিরকাল দেখে যাবে থমকা লাগা স্ট্যাচুর পলক..ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে। এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে। ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে। হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা। কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি।এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে। রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে।ভালো থেকো বাল্য অনুভব। চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ।আমার স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু।দুদিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে। রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজি , শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু।.চেনা আত্মীয় র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা। হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া,বেনেপুকুর। ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া ,পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা। এখানেই আমার চোদ্দপুরুষের ভিটে। তারপর ষষ্টিতলা ,মঙ্গল চন্ডীর উঠোন , দুর্গা তলার নাটমন্দির। এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা। গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা। এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম। সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না।কেঁয়াপুকুর,কেষ্টপুকুরের পাড়। তারপর বাজারে পাড়া ,শিব তলা,পেরিয়ে নাপিত পাড়া। এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে। সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা ,তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা। কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা।এখন সব কিছুই যান্ত্রিক। মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয়। মুখে হাসি নেই। বেশ জেঠু জেঠু ভাব।সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে কুমারখালির কয়া গ্রাম। আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া , কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া। সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা , কলা বা গান, দুর্গা তলার নাটমন্দির সব কিছুই। পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই।শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ।
এই গ্রামে ই আমার সবকিছু , আমার ভালোবাসা, আমার গান।ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো। পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড়। বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল। তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর। পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে। কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত। একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব। তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না। মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না।তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ। মা বাবার সাবধান বাণী ,ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে , আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে। এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে। পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে। মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না। শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না। পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই। জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন। মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে। তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম। প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে।আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত ,ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম। সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ ,ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম। পরের দিন দধিকর্মা। খই আর দই। পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল। তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে।এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন। কাছেই একটা পুকুর। রাত হলে সিদ্ধিলাভ আনন্দিত হয়ে নাচ তে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো। মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন।তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনতো পড়ার ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে... পরোপকার, সত্যনিষ্ঠা, নির্ভীক চিন্তায় ও কর্মে অভ্যস্ত যতীন পড়াশোনা ও খেলাধুলার পাশাপাশি কৌতুকপ্রিয়তার জন্যও সমাদৃত ছিলেন। পৌরাণিক নাটক মঞ্চস্থ ও অভিনয় করতে তিনি ভালোবাসতেন এবং বেছে নিতেন হনুমান, রাজা হরিশচন্দ্র, ধ্রুব, প্রহ্লাদ প্রভৃতি চরিত্র।যাত্রা হলে রাত জেগে যতীনের সব বন্ধুরা যাত্রা দেখত। তখনকার ছেলেরা একভাবেই মানুষ হত। তখন মোবাইল গেম ছিল না। যতীনের বড় মামা বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় (বিপ্লবী হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের পিতা) ছিলেন কৃষ্ণনগরের আইনজীবি এবং আইনের অধ্যাপক। তার পরামর্শ নিতেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - পার্শ্ববর্তী শিলাইদহে তার জমিদারী সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনে। কৈশোর থেকে রবীন্দ্রনাথ যে অনুরাগ নিয়ে আন্দোলন চালিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয়দের প্রতি অবজ্ঞা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে, তারই প্রেরণায় শরৎশশী উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যতীনকে। রবীন্দ্রনাথের ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ইতিহাস-ভক্ত। যতীনের চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তিনি হাজির হতেন যতীনের ফুটবল ক্লাবে; সেখানে দামাল ছেলেগুলির সামনে সুরেন তুলে ধরতেন দেশপ্রেমের আদর্শ। গীতাপাঠের মধ্যে তাদের বুঝিয়ে দিতেন নিষ্কাম কর্মের উপযোগিতা। যতীন কৃষ্ণনগর শহরে এংলো ভার্নাকুলার (এ ভি) বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।১৮৯৫ সালে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে (বর্তমানের ক্ষুদিরাম বোস সেন্ট্রাল কলেজ) ভর্তি হন। কলেজের পাশেই স্বামী বিবেকানন্দ বাস করতেন। বিবেকানন্দের সংস্পর্শে এসে যতীন দেশের স্বাধীনতার জন্য আধ্যাত্মিক বিকাশের কথা ভাবতে শুরু করেন। এসময়ে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিবেকানন্দের আহবানে যতীন তার বন্ধুদের দল নিয়ে এই রোগে আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত হন।স্বামী বিবেকানন্দের পরামর্শে যতীন শরীরচর্চার জন্য অম্বু গুহের কুস্তির আখড়ায় যোগ দেন। সেখানে তার সাথে সেসময়ের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের দেখা হয়। এদের একজন শচীন বন্দোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয়ের সূত্রে তিনি শচীনের পিতা যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের সাক্ষাৎ পান। যোগেন্দ্রনাথ তখনকার ইউরোপের মাৎসিনি, গারিবল্ডি প্রমুখ ইতালীয় বিপ্লবীদের জীবনের আলেখ্য রচনা করেছিলেন।
কলেজ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে যতীন অ্যাটকিনসন সাহেবের স্টেনো টাইপিংয়ের ক্লাসে ভর্তি হন। সদ্য প্রচলিত টাইপরাইটার ব্যবহার করার এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মোটা মাইনের চাকুরি পাওয়া সম্ভব ছিলো। ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তিতে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠে ইস্তফা দিয়ে যতীন ১৮৯৯ সালে মজঃফরপুর চলে যান। সেখানে তিনি ব্যারিস্টার কেনেডীর সেক্রেটারি হিসাবে কাজে যোগ দেন। ভারতের জন্য মজুদ অর্থ দিয়ে ইংরেজ সরকার সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করছে সাম্রাজ্য রক্ষার স্বার্থে, তার বিরুদ্ধে কেনেডি কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে বক্তৃতা মারফৎ এবং তার সম্পাদিত ত্রিহুত কুরিয়ার পত্রিকায় প্রচারণা চালাতেন।[৩] কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিভোগী এই ভারত প্রেমিক ব্যারিস্টার কেনেডি ছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের উপরে মৌলিক গবেষণার জন্য বিখ্যাত। দুর্ভাগ্যক্রমে কেনেডি'র স্ত্রী ও কন্যার জীবননাশ ঘটে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর বোমায়। কেনেডির উৎসাহে মজঃফরপুরের তরুণদের জন্য যতীন ফুটবল ও অ্যাথলেটিক ক্লাব গড়ে তুলেন।এদিকে অরবিন্দ ঘোষ তাঁর শরীরচর্চা ও আধ্যাত্মিক সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন নিষ্ঠাভরে। ইতিমধ্যে তিনি তাঁর পিতা কৃষ্ণধন ঘোষের পরিকল্পনামাফিক লোরেট কনভেন্টে দুই বছর লেখাপড়ার পর ১৮৭৯ সালে দুই সহোদর সহ অরবিন্দকে বিলেতের ম্যাঞ্চেষ্টার শহরে পাঠান হয় ইউরোপীয় শিক্ষালাভের জন্য। জনৈক রেভারেন্ড এবং শ্রীমতি ড্রিয়ুইটের তত্ত্বাবধানে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। রেভারেন্ড ড্রিয়ুইট ছিলেন যাজক, রংপুরের ব্রিটিশ বন্ধুদের মাধ্যমে যার সাথে ড ঘোষের পরিচয় ছিল। ড্রিয়ুইট পরিবার তিন ভাইকে ব্যক্তিগত ভাবে শিক্ষাদান করেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ভারত ও তার সংস্কৃতির কোনরকম উল্লেখ না করার অনুরোধ ছিল।১৮৮৪ সালে অরবিন্দ লন্ডনের সেইন্ট পলস স্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকে গ্রীক, লাতিন এবং শেষ তিন বছরে সাহিত্য বিশেষত ইংরেজি কবিতা অধ্যয়ন করেন। ড কে,ডি, ঘোষ ভেবেছিলেন, তার তিন পুত্রই সম্মানসূচক ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করবেন, কিন্তু ১৮৮৯ সালে দেখা গেল একমাত্র সবার ছোট অরবিন্দই বাবার আশা পূরণ করতে পারবেন, বাকি ভাইয়েরা ইতোমধ্যেই ভিন্ন দিকে নিজ নিজ ভবিষ্যতের পথ বেছে নিয়েছেন। আইসিএস কর্মকর্তা হওয়ার জন্য ছাত্রদেরকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাশ করতে হত এবং ইংরেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর অধ্যয়নের অভিজ্ঞতাও প্রয়োজন ছিল। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে বৃত্তি অর্জন ছাড়া ইংরেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা অরবিন্দের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কিংস কলেজের বৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করায় তা সম্ভবপর হয়ে ওঠে।তিনি কয়েক মাস পর আইসিএস এর লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেন ২৫০ প্রতিযোগীর মাঝে ১১তম স্থান অধিকার করেন।বাঘা যতীন অরবিন্দ ঘোষের পরামর্শ মত শরীরচর্চা শুরু করলেন। গাছে চড়া,সাঁতার কাটা, ছোটাছুটি করে শরীরকে লোহার মত করে গড়ে তুললেন। তার সঙ্গে গড়ে উঠল মানসিক শক্তি ও দৃঢ়তা। অরবিন্দ বলেন ছেলেদের উদ্দেশ করে, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে হলে চাই শক্ত সমর্থ যুবকদের। দূর্বল,মেরুদন্ডহীন মানুষ স্বাধীনতা আনতে পারে না। তাই সংযম ও শরীরচর্চার মধ্যে গড়ে তুলতে হবে দেশের যুবকদলকে। বাঘা যতীনের আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধ অত্যন্ত দৃঢ় হয়েছিল অরবিন্দ ঘোষ এর সংস্পর্শে এসে। যতীন শরীর গঠন আখড়ায় গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যুগান্তর দলে কাজ করার সময় নরেনের (মানবেন্দ্র নাথ রায়) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং অচিরেই তাঁরা একে অপরের আস্থাভাজন হন।
৩
তখন কলেরা, প্লেগ রোগে মানুষ মরে যেত। বাঘা যতীন তার বন্ধুদের নিয়ে সমাজসেবা করতেন। একবার বন্যার সময় বাঘা যতীন সাঁতরে এক পরিবারকে রক্ষা করেন। বন্ধু বারীন বলল,সাবধানে কাজ করবি। নিজেকে বাঁচিয়ে।
যতীন বলল,আমি কখনও জীবনের তোয়াক্কা করি না। জীবন চলে গেলেও আমি থামব না। পরোপকার, সত্যনিষ্ঠা, নির্ভীক চিন্তায় ও কর্মে অভ্যস্ত যতীন পড়াশোনা ও খেলাধুলার পাশাপাশি কৌতুকপ্রিয়তার জন্যও সমাদৃত ছিলেন। পৌরাণিক নাটক মঞ্চস্থ ও অভিনয় করতে তিনি ভালোবাসতেন এবং বেছে নিতেন হনুমান, রাজা হরিশচন্দ্র, ধ্রুব, প্রহ্লাদ প্রভৃতি চরিত্র।
বারীন বলে, বিপ্লবীদের নজরদারির জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো সন্দেহভাজনের ওপর সরাসরি নজরদারি করা। তাদেরও গোয়েন্দা হতে হয়। ফোনে আড়ি পাতা হয় জেনে এখন আর সন্ত্রাসীরা ফোনে কথাবার্তা বলে না। তাই সন্দেহভাজন অপরাধী কখন, কোথায় গেল, সেগুলো উপস্থিত থেকে নজরদারি করলে ভালো ফল দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে জনবল প্রধান সমস্যা।ফ্রান্সের বিচারব্যবস্থার সন্ত্রাসবাদবিষয়ক প্রধান তদন্তকারী মার্ক ত্রেভিদিক নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ফোনে আড়ি পেতে কোনো লাভ হয় না। অপরাধী এখন ফোনে কথা বলে না। তবে সশরীরে উপস্থিত থেকে নজরদারি করা অর্থ ও জনবলের অপচয় এবং বিষয়টি ব্যয়বহুল বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফ্রান্সের সাবেক এক সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে একমত মার্কিন গোয়েন্দারাও।যতীন আর বারীন গ্রামের বুকে মানুষ হয়েছে। তারা প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে। তারা দেখে আর ভাবে প্রকৃতির বুকে কাশের কুঁড়ি রসদ মজুদ করছে ফোটা ফুলের সৌরভ বিতরণের। এরপরেই শুরু আনন্দে মাথা দোলানোর উৎসব। মননদীর গভীরে গাঁথা তার আগমনী সংগীতের মালা। সে যেন হাত নেড়ে বলছে, আসছে আসছে। দেবী কাশ ফুলের সংকেতে তাঁর আগমনী বার্তা পাঠান যুগ যুগ ধরে।
এবার শরতে কাশ ফুলের কারসাজি। তার মাথা দোলানো দেখে আমি দুর্গা পুজোর ঢাকী হয়ে যাই। আমার অন্তর নাচতে থাকে তালে তালে। মন বলে, মা তুই আসবি
কবে আর, নতুন জামায় নাচে মন সবার।যতীন বলে,
আমাদের শোভন কাকা কাশ ফুল দেখলেই কারণে অকারণে গলা ছেড়ে গান গাইতেন। সেই মধুর সুরেই শোভন কাকা কাশ ফুলের শোভা বাড়িয়ে সকলেরমনের
সংকীর্ণ বেড়া ভেঙ্গে দিতেন। যতীন বলে, আমরা সকলেই
প্রিয়জন মরে গেলে দুঃখ পাই। কিন্তু নিজের মরণ
বুঝতে পারলেও দুঃখ প্রকাশের সুযোগ পাই কি ? সেই শোভন কাকা গানে গানে কিন্তু
নিজের মরণের আগেই পরিণতির কথা শোনাতেন। অঘোষিত উঁচু পর্বে
নাম খোদাই হয়ে গিয়েছিলো তার। মৃৎশিল্পেও তার
দক্ষতা ছিলো দেখার মতো। প্রতিমা তৈরির
দায়িত্ব তার উপরেই দিয়ে নিশ্চিন্ত হতো পূজা কমিটি।শোভন কাকা এলেই
আমাদের পুজোর গন্ধ গ্রাম জুড়ে গানের সুরের সঙ্গে ভেসে বেড়াতো। তিনি ছিলেন প্রাণজুড়ানো শান্ত পালক নরম আনন্দের ফেরিওয়ালা।তিনি মাটি হাতে মায়ের সঙ্গে মন মাতানো মন্দাক্রান্তা গাইতেন।তার চলন বলন দেখে ভালোবেসে তাকে শোভনানন্দ বলতেন তথাকথিত
গুরুবৃন্দ। পুকুরের পাড়ে বসে যতীনের মন হারিয়ে যায় অজানা দেশে।যতীনের বড় মামা
বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন কৃষ্ণনগরের আইনজীবি এবং আইনের অধ্যাপক। তার
পরামর্শ নিতেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - পার্শ্ববর্তী শিলাইদহে তার
জমিদারী সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনে। কবি কৌতুক করে বললেন, জমিদারী
চালাতে গিয়ে সবকিছু নতুন করে শিখতে হচ্ছে,শালি,বাস্তু কিসব জমির নাম গো।তোমার মামার কাছে পরামর্শ নিয়ে থাকি নিয়মিত।কবি
একবছর সমস্ত কর মকুব করে দিয়েছিলেন প্রজাদের। তাই তো তিনি মহামানব। যতীন বলতেন
কৌতুক করে,জমিদারীটা আমাকে দিয়ে দেখুন,কেমন
প্রজাপালন করি। যতীন হাসতেন উদাত্ত কন্ঠে।কবি বলেছিলেন, আপনারা
হলেন সাধক পর্যায়ের লোক। আপনারা দেশ স্বাধীন করার কারিগর। আপনাদের আমি শ্রদ্ধা
করি।বাঘা যতীনও কবিকে শ্রদ্ধা করতেন খুব। শিলাইদহ এলেই কবির সঙ্গে তিনি দেখা
করতেন। কৈশোর থেকে রবীন্দ্রনাথ যে অনুরাগ নিয়ে আন্দোলন চালিয়েছিলেন ব্রিটিশ
শাসনে ভারতীয়দের প্রতি অবজ্ঞা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে, তারই
প্রেরণায় শরৎশশী উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যতীনকে।তিনি বলতেন, যতীন
কবিগুরুর সব লেখা অবশ্য পড়বি। তাঁর লেখা পড়লে কেউ মানুষ না হয়ে পারে না। রবীন্দ্রনাথের
ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ইতিহাস-ভক্ত। যতীনের চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তিনি
হাজির হতেন যতীনের ফুটবল ক্লাবে। সেখানে দামাল ছেলেগুলির সামনে সুরেন তুলে ধরতেন
দেশপ্রেমের আদর্শ। গীতাপাঠের মধ্যে তাদের বুঝিয়ে দিতেন নিষ্কাম কর্মের উপযোগিতা।
গীতাপাঠ শুনে যতীনের আত্মমশক্তি বৃদ্ধি হত।
৪
যতীন কৃষ্ণনগর শহরে এংলো ভার্নাকুলার বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।১৮৯৫ সালে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে ভর্তি হন। কলেজের পাশেই স্বামী বিবেকানন্দ বাস করতেন। তাঁর সংস্পর্শে এসে যতীন দেশের স্বাধীনতার জন্য আধ্যাত্মিক বিকাশের কথা ভাবতে শুরু করেন। এসময়ে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিবেকানন্দের আহবানে যতীন তার বন্ধুদের দল নিয়ে এই রোগে আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত হন। প্লেগ রোগের সময় ভগিনী নিবেদিতাও ভারতবর্ষে এসেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের পরামর্শে যতীন শরীরচর্চার জন্য অম্বু গুহের কুস্তির আখড়ায় যোগ দেন।অম্বু গুহ বলেন, এমনিতে তোমার শরীরের কাঠামো ভাল।মন দিয়ে শরীর আর মন গঠন কর। দেশমাতা তোমার দিকে তাকিয়ে আছেন।বাঘা যতীন বাঘের মত সাহসী ছিলেন। তিনি বললেন, বৃটিশদের আমি এদেশ থেকে তাড়াব। তবে আমি শান্তি পাব। সেখানে তার সাথে সেসময়ের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। এদের একজন শচীন বন্দোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয়ের সূত্রে তিনি শচীনের পিতা যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের সাক্ষাৎ পান। যোগেন্দ্রনাথ তখনকার ইউরোপের মাৎসিনি, গারিবল্ডি প্রমুখ ইতালীয় বিপ্লবীদের জীবনের আলেখ্য রচনা করেছিলেন।কলেজ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে যতীন অ্যাটকিনসন সাহেবের স্টেনো টাইপিংয়ের ক্লাসে ভর্তি হন। সদ্য প্রচলিত টাইপরাইটার ব্যবহার করার এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মোটা মাইনের চাকুরি পাওয়া সম্ভব ছিলো। ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তিতে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠে ইস্তফা দিয়ে যতীন ১৮৯৯ সালে মজঃফরপুর চলে যান। সেখানে তিনি ব্যারিস্টার কেনেডীর সেক্রেটারি হিসাবে কাজে যোগ দেন। ভারতের জন্য মজুদ অর্থ দিয়ে ইংরেজ সরকার সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করছে সাম্রাজ্য রক্ষার স্বার্থে, তার বিরুদ্ধে কেনেডি কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে বক্তৃতা মারফৎ এবং তার সম্পাদিত ত্রিহুত কুরিয়ার পত্রিকায় প্রচারণা চালাতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ পান তিনি। সেই সময় কেনেডি'র স্ত্রী ও কন্যার জীবননাশ ঘটে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর বোমায়। কেনেডির উৎসাহে মজঃফরপুরের তরুণদের জন্য যতীন ফুটবল ও অ্যাথলেটিক ক্লাব গড়ে তুলেন।জননী শরৎশশীর অসুস্থতার সংবাদে যতীন কয়াগ্রামে এসে দেখেন এক কলেরা রোগীর সেবা করতে করতে তার সংক্রমণে যতীনের মা মৃত্যুবরণ করেছেন। দিদি বিনোদবালার কাছে যতীন জানতে পারেন, তার প্রয়াত মা কুমারখালীর উমাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে ইন্দুবালার সাথে যতীনের বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন। ১৯০০ সালে যতীন ইন্দুবালাকে বিয়ে করেন। তাদের ৪টি সন্তান হয়।ইন্দুবালা বলতেন, এখন আমাদের সন্তান হয়েছে। সংসার হয়েছে। তুমি সাবধানে কাজ কারবার করবে।
যতীন বলতেন, আমার সন্তানের মত সহস্র সন্তানকে আমি স্বাধীন ভারত উপহারস্বরূপ দিতে চাই।ইন্দুবালা বলতেন, নিশ্চয় পারবে। তুমিই পারবে। একদিন ভারত স্বাধীন হবেই।পরশপাথরের স্পর্শে সবকিছু সোনা হয়ে যায় যে। যতীন মজঃফরপুরে আর ফিরবেন না - এই খবর পেয়ে কেনেডি একটি সুপারিশ দেন তার বন্ধু হেনরি হুইলারের নামে, যিনি তখন বাংলা সরকারের অর্থসচিব। যতীনকে হুইলার নিজের স্ট্যানোগ্রাফার হিসাবে নিয়োগ করেন। যতীনের পেশাগত নৈপুণ্যের সংগে তার আত্মসম্মানবোধ ও দেশপ্রেম মুগ্ধ করে হুইলারকে। ভারতীয় প্রজাদের উপরে ইংরেজ অফিসারদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তখন বিপিন চন্দ্র পাল নিউ ইন্ডিয়া পত্রিকায় প্রতিবাদ ছাপছেন।তারই প্রতিধ্বনি তুলে বংগদর্শনের পৃষ্ঠায় কবি লিখছেন মুষ্টিযোগের উপযোগিতা বিষয়ে - ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত ইংরেজের পক্ষ নিয়ে সরকার যেভাবে তার বদলা নেয়, সেবিষয়ে হুঁশিয়ার করে রবীন্দ্রনাথ ইঙ্গিত দিচ্ছেন ভারতীয়দের সংঘবদ্ধ হতে। এর পিছনে প্রচ্ছন্ন আছে বিপ্লবীদের গুপ্ত সমিতি গঠনের পরিকল্পনা ছিল।কবিগুরু সরাসরি বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও তার লেখনি বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করে। তিনি নিজে হয়তো হাতে অস্ত্র ১৯০৮ সালে যতীনসহ কয়েকজন বিপ্লবীকে আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়। এ মামলার বিচারে বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে যাবজ্জীবন নির্বাসন, অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে জেল এবং অনুশীলন সমিতিকে বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীন এবং নরেনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁরা উভয়েই হাওড়া-শিবপুর এলাকায় আত্মগোপন করেন এবং অন্যান্য বিপ্লবীর সঙ্গে গুপ্তভাবে বিপ্লবী কর্মকান্ড চালিয়ে যান।
যতীনকে পুনরায়
হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁর সঙ্গে অন্যান্য যাঁরা
গ্রেফতার হন তাঁদের ‘যতীন গ্যাং’ নামে অভিহিত করা হয়। অত্যাচারের শিকার
হয়ে তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যু হয় এবং অপর কয়েকজন পাগল হয়ে যান।
সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীন এ মামলা থেকে মুক্তি পেলেও তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত
করা হয়। জেলে থাকা অবস্থায় যতীন এবং নরেন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতা
দখলের এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁরা দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দলকে
ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা করেন এবং এ উদ্দেশ্যে নরেন সন্ন্যাসিরূপে ব্যাপকভাবে
সমস্ত ভারত ভ্রমণ করে বাংলাসহ বিভিন্ন এলাকার বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন। বিভিন্ন
দলের নেতৃবৃন্দ হুগলি এবং মেদিনীপুরের বন্যার ত্রাণকার্য উপলক্ষে একত্রিত হন।
তাঁরা যতীন মুখোপাধ্যায় এবং রাসবিহারী বসুকে যথাক্রমে বাংলা এবং উত্তর ভারতের নেতা
মনোনীত করেন।তুলে নেন নি। কিন্তু তার কলম ছিল মারাত্মক অস্ত্র। ব্রিটিশদের ভারত
ছাড়তে যাা বাধ্য করেছিল।
৫
যতীনের দেশাত্মবোধ গুণগ্রাহী
হুইলার যতীনকে গোপনে পরামর্শ দিতেন। তিনি একদিন বললেন, আমার
স্টেনোগ্রাফার তুমি। গর্বে আমি বুক ফুলিয়ে চলি। তোমার সাফল্য মানে আমার সাফল্য।
তুমি অনুশীলন সমিতির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ কর। তুমি সফল হবেই।
যতীন বললেন, আমি তাই করব। সমগ্র ভারতব্যাপী আমি জ্বলে উঠব। আমি বোমার কারখানা গড়ে তুলব।
তার বন্ধু বারীন কলকাতায় বোমা কারখানা গড়ে তোলে যতীনের দেখাদেখি। যতীন তখন দেওঘরে সপরিবারে আছেন। সেখানে যতীনের সঙ্গে তার মতবিরোধ হয়।
একবার ঘোড়ার গাড়ির ছাদে একদল ব্রিটিশ সৈন্য পা ছড়িয়ে বসে আছে এবং পা দোলাচ্ছে আর নিচে বসে আছে ভারতীয় মহিলারা।তাদের নাকের কাছে ব্রিটিশ সৈন্যদের বুট ঝুলছে। বাঘাযতীন এর তীব্র প্রতিবাদ করেন তিনি বলেন, তোমরা পা তুলে বস। ভদ্রতা শেখ। কিন্তু সৈনিকরা তাকে ঠেলে ফেলে দেয়।বাঘা যতীন তাদের চড় মারতে মারতে নিচে নামিয়ে আনেন।
তখনই তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন লন্ডনের যুবরাজ। যুবরাজ বিষয়টি দেখে এই বিষয়ে তিনি নিজের থেকে এই সৈন্যদের আচরণের প্রতিবাদ করেন।১৯০০ সাল থেকে মূল অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের সংগে হাত মিলিয়ে জেলায় জেলায় যতীন পত্তন করেন এই গুপ্তসমিতির শাখা। পথে-ঘাটে ভারতীয় নাগরিকদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদে সদা প্রস্তুত যতীনের এই দেশাত্মবোধ গুণগ্রাহী হুইলারের মনে কৌতুক জাগাত। যতীন জানতেন, নিয়মিত লণ্ডনে ভারত-সচিব মর্লি'র দফতরে অভিযোগ পুঞ্জীভূত হয় এইসব দুষ্কৃতকারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে। যুবরাজ দেশে ফিরে গিয়ে ১৯০৬ সালে দীর্ঘ আলোচনা করেন মর্লি'র সংগে এর প্রতিকার চেয়ে। তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। যতিনের যেমন দেহের জোর ছিল ঠিক সেইরকমই ছিল বুদ্ধির জোর। বিখ্যাত বিপ্লবী এমএন রায় মন্তব্য করেছিলেন, আমি বাঘা যতীন ও লেনিন দুজনকেই দেখেছি। এ দুজনের মধ্যে বাঘা যতীনই শ্রেষ্ঠ। বিপ্লবী এমএন রায় তার এই মন্তব্যের মাধ্যমে মহামতি লেনিনকে ছোট করেননি, বরং বাঘা যতীন যে একজন বিশাল মাপের মানুষ সেটিই তার এই মন্তব্যের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন।
১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এই অকুতোভয় মহাবিপ্লবী বাঘা যতীন মারা যান। বাঘা যতীনের চেতনায় লালিত হয়ে অসংখ্য বাঘা যতীনের জন্ম হয় এবং এক পর্যায়ে এই অসংখ্য বাঘা যতীনের আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
একবার ঘোড়ার গাড়ির ছাদে একদল ব্রিটিশ সৈন্য পা ছড়িয়ে বসে আছে এবং পা দোলাচ্ছে আর নিচে বসে আছে ভারতীয় মহিলারা।তাদের নাকের কাছে ব্রিটিশ সৈন্যদের বুট ঝুলছে। বাঘাযতীন এর তীব্র প্রতিবাদ করেন তিনি বলেন, তোমরা পা তুলে বস। ভদ্রতা শেখ। কিন্তু সৈনিকরা তাকে ঠেলে ফেলে দেয়।বাঘা যতীন তাদের চড় মারতে মারতে নিচে নামিয়ে আনেন।
তখনই তার পাশ দিয়ে
যাচ্ছিলেন লন্ডনের যুবরাজ। যুবরাজ বিষয়টি দেখে এই বিষয়ে তিনি নিজের থেকে এই
সৈন্যদের আচরণের প্রতিবাদ করেন।১৯০০ সাল থেকে মূল অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের
সংগে হাত মিলিয়ে জেলায় জেলায় যতীন পত্তন করেন এই গুপ্তসমিতির শাখা। পথে-ঘাটে
ভারতীয় নাগরিকদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদে সদা প্রস্তুত যতীনের এই দেশাত্মবোধ
গুণগ্রাহী হুইলারের মনে কৌতুক জাগাত। যতীন জানতেন, নিয়মিত লণ্ডনে ভারত-সচিব
মর্লি'র দফতরে অভিযোগ পুঞ্জীভূত হয় এইসব দুষ্কৃতকারী
ইংরেজদের বিরুদ্ধে। যুবরাজ দেশে ফিরে গিয়ে ১৯০৬ সালে দীর্ঘ আলোচনা করেন মর্লি'র সংগে এর প্রতিকার চেয়ে। তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। যতিনের যেমন দেহের
জোর ছিল ঠিক সেইরকমই ছিল বুদ্ধির জোর। বিখ্যাত বিপ্লবী এমএন রায় মন্তব্য করেছিলেন,
আমি বাঘা যতীন ও লেনিন দুজনকেই দেখেছি। এ দুজনের মধ্যে বাঘা যতীনই
শ্রেষ্ঠ। বিপ্লবী এমএন রায় তার এই মন্তব্যের মাধ্যমে মহামতি লেনিনকে ছোট করেননি,
বরং বাঘা যতীন যে একজন বিশাল মাপের মানুষ সেটিই তার এই মন্তব্যের
মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন।
৬
যতীনের মনে পড়ে ঋষি অরবিন্দ
বিপদে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মহামৃত্যুঞ্জয়
মন্ত্রঃ
এই মন্ত্রটি ভগবান মহাদেবকে
স্মরণ করে রচিত। একটি সর্বরোগ হরণকারী মন্ত্রঃ
"ওঁ ত্রম্বকং য্জামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্!
উর্বারূপমিব বন্ধনান মৃতৌমোক্ষীয় মামৃতাত!!"
সরলার্থঃ-হে রুদ্র, আমরা তোমার
বন্দনা করি। তুমি জন্ম,জীবন ও
মৃত্যুত্রয়ীর জ্ঞানদৃষ্টির
অধিকারী।
তুমি আমাদের বেঁচে থাকার
জন্য সুন্দর পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাদ্যের যোগানদাতা।
তুমি সকল ভয়ংকরব্যধি হতে
ত্রানকারী।
আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তিদান কর,অমৃতত্ত্ব থেকে নয়। শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়কর্তা- পরমেশ্বর।
শিবকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে ৷ অন্য সকল দেবতার মত তারও ১০৮ নাম রয়েছে ৷ এর মধ্যে অন্যতম হল – মহাদেব, শিব, নটরাজ, শম্ভু, পশুপতি, নীলকন্ঠ, চিন্তামণি, মহেশ্বর, সতীপতি, ত্রিপুরারি, তীর্থরাজ, যোগীশ্বর ইত্যাদি …কোথাও তিনি মূর্ত্তিরূপে পূজিত হন।
তার তৃতীয় নয়ন, গলায় বাসুকী নাগ, জটায় অর্ধচন্দ্র, জটার উপর থেকে প্রবাহিত গঙ্গা, অস্ত্র ত্রিশূল ও বাদ্য ডমরু। আবার তাকে মন্দিরে ‘শিবলিঙ্গ’ নামক বিমূর্ত প্রতীকে পূজা করা হয়। পরমেশ্বর শিবের ব্রহ্ম সত্বার একটি প্রতীকচিহ্ন। দক্ষিনেশ্বর কালীমন্দির প্রাঙ্গনের পশ্চিমদিকে অবস্থিত বারোটি শিব মন্দিরে অধিষ্ঠিত বারোটি শিবলিঙ্গ, ডানদিকে ছটি ও বামদিকে ছটি তাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম।
১) যোগেশ্বর ২) রত্নেশ্বর ৩)
জটিলেশ্বর ৪) নকুলেশ্বর ৫) নাকেশ্বর। ৬) নির্জরেশ্বর
৭) যজ্ঞেশ্বর ৮) জলেশ্বর ৯) নাগেশ্বর ১০) নন্দীশ্বর ১১) নরেশ্বর ১২) জগদীশ্বর
ভারতীয় আর্য ঋষিদের ভাবসাধক ছিলেন শ্রী অরবিন্দ ঘোষ। বারীন বলে, আমার তাই মনে হয়। ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বপরিবারে যতীন দেওঘরে বাস করতে থাকেন, বারীণ ঘোষের সংগে একটি বোমা কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। এই কারখানার অভিজ্ঞতা নিয়ে অবিলম্বে কলকাতার মানিকতলায় বারীণ আরো বড় করে কারখানা খোলেন। যতীন চাইতেন প্রথমে একদল একক শহীদ এসে দেশের লোকের চেতনায় নাড়া দেবে; দ্বিতীয় ক্ষেপে আসবে ছোট ছোট দল বেঁধে ইতস্তত খণ্ডযুদ্ধ; তৃতীয় পর্বে দেশব্যাপী এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণআন্দোলন। বারীণ চাইতেন আচমকা সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে হাউইয়ের মতো জ্বলে উঠে ফুরিয়ে যেতে। সংগঠনের দিক থেকে বারীণ তার একচ্ছত্র নেতৃত্বে বিশ্বাস করতেন। যতীন চাইতেন জেলায় জেলায় আঞ্চলিক নেতাদের অধীনে গুপ্তসমিতি শক্তিশালী হয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সহযোগিতা করবে। আপাতদৃষ্ট স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে বন্যাত্রাণে, কুন্তিমেলায়, অধোদয়যোগে, শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবে মিলিত হয়ে দলের ঐক্য ও শক্তি পরীক্ষার সুযোগ পেতেন তারা।
বাঘা যতীন বারীনকে বলতেন, তুমি আমি একই পথের পথিক। তাড়াহুড়ো না করে শান্তভাবে ওদের আক্রমণ শোনাতে হবে তা না হলে আমাদের আন্দোলন হয়তো থেমে যাবে। বারিন সে কথা শুনতেন না বাড়িতে নক্ষত্র অধিপতি। তিনি বলতেন আমরা এখনই এই বোমা কারখানা থেকে বোমা নিয়ে যুবকদের সংগঠিত করে এই ব্রিটিশ শাসন ধ্বংস করব। যতীন বলতেন এত সহজে এ কাজ হবার নয় এর জন্য সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন সেখানেই তাদের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। অতীন্দ্রের অকাল মৃত্যুর শোকে মুহ্যমান যতীন দিদি বিনোদবালা আর স্ত্রী ইন্দুবালাকে নিয়ে তীর্থভ্রমণে বের হন। হরিদ্বারে তারা স্বামী ভোলানন্দ গিরি'র কাছে দীক্ষা নিয়ে অন্তরের শান্তি ফিরে পেলেন। গিরিজি জানতে পারেন যতীনের দেশসেবার কথা এবং পূর্ণ সম্মতি জানান এই পন্থায় অগ্রসর হবার সপক্ষে।১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বপরিবারে যতীন দেওঘরে বাস করতে থাকেন, বারীণ ঘোষের সংগে একটি বোমা কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। এই কারখানার অভিজ্ঞতা নিয়ে অবিলম্বে কলকাতার মানিকতলায় বারীণ আরো বড় করে কারখানা খোলেন। যতীন চাইতেন প্রথমে একদল একক শহীদ এসে দেশের লোকের চেতনায় নাড়া দেবে; দ্বিতীয় ক্ষেপে আসবে ছোট ছোট দল বেঁধে ইতস্তত খণ্ডযুদ্ধ।তৃতীয় পর্বে দেশব্যাপী এক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণআন্দোলন। বারীণ চাইতেন আচমকা সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে হাউইয়ের মতো জ্বলে উঠে ফুরিয়ে যেতে। সংগঠনের দিক থেকে বারীণ তার একচ্ছত্র নেতৃত্বে বিশ্বাস করতেন। যতীন চাইতেন জেলায় জেলায় আঞ্চলিক নেতাদের অধীনে গুপ্তসমিতি শক্তিশালী হয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সহযোগিতা করবে। আপাতদৃষ্ট স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে বন্যাত্রাণে, কুন্তিমেলায়, অধোদয়যোগে, শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবে মিলিত হয়ে দলের ঐক্য ও শক্তি পরীক্ষার সুযোগ পেতেন তারা
বাঘাযতীন বলতেন, আমরা জেলায় জেলায় দল গঠন করব। তাদের এক একজন নেতা থাকবে এবং তাদের নেতাদের হাতে সেই অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে এবং সংঘটিত হবে জেলায় জেলায়। তার ফলে প্রত্যেক জেলা থেকে আক্রমণ শাণিত হলে ব্রিটিশরা ভয় পাবে।বারীন বলেন,, কিন্তু সেই পদ্ধতি দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলবে। ফলে সময় নষ্ট হবে। আমরা চাই সশস্ত্রভাবে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। এই খানেই দুইজনের সঙ্গে মতবিরোধ হয় এবং তাদের মতবিরোধ কিছুদিনের মধ্যে মিটেও যায়।
৭
চাকরির সূত্র ধরে এবার বাঘাযতীন গেলেন দার্জিলিং দার্জিলিং থেকে যাওয়ার সময় শিলিগুরি স্টেশনে একবার সামরিক অফিসারদের সঙ্গে তাঁর বছর হয় সেই বচসায় মারামারি পর্যন্ত গড়ায় বাঘাযতীন বাঙ্গালীদের অমর্যাদাকর তীব্র প্রতিবাদ করেন।
চারজন সামরিক অফিসারের মুখে ঘুসি মেরে তিনি চোয়াল ভেঙে দিয়েছিলেন।
বাঘা যতীনের পৃষ্ঠপোষক হুইলার ঠাট্টা করে বলেছিলেন আপনি একসঙ্গে কতজনকে মারতে পারেন? বাঘাযতীন বলেছিলেন ভালো লোক হলে একটাও না।
আর যদি দুর্বৃত্তরা হয়
যতগুলো খুশি তাদের সঙ্গে লড়তে পারি। পরেরদিন কাগজে কাগজে ছেড়ে যায় বাঘাযতীন এর
এই বৃদ্ধ কাকা কাহিনী তিনি গ্রেফতার হন কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে ছাড় পেয়ে যান।
বাঘা যতীনের দৃঢ় মনোভাব দর্শন করে হাজার হাজার বাঙালি যুবক তার মতো হতে ইচ্ছে করতো
এবং সকলেই বাঘাযতীন এর মত শরীরচর্চায় নেমে পড়েছিল। এক যুগান্তকারী আন্দোলনের ভয়ে
ব্রিটিশরা সিঁটিয়ে পড়ে ছিল। বাঘাযতীন এ পথ চলায় অনুসরণ করতো ব্রিটিশরা তাদের
যতীন অনুগামী বা যতীন পার্টির লোক বলে অভিহিত করতো।
৮
সমাজসেবা ও দৃঢ় মনোভাবের জন্য বাঘা যতীন যুবকদের শিরোমণি হয়ে উঠলেন। বন্যা,প্লেগ,কলেরা হলেই বাঘা যতীনের দল ঝাঁপিয়ে পড়ত তাদের সর্বশক্তি দিয়ে।
১৯০৬ সাল থেকে স্যার ডেনিয়েল হ্যামিলটনের সহযোগিতায় যতীন একাধিক মেধাবী ছাত্রকে বৃত্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। শুরু হয় তারকনাথ দাসকে দিয়ে; পরপর তার পিছু পিছু রওনা হন গুরনদিৎ কুমার, শ্রীশ সেন, অধর লস্কর, সত্যেন সেন, জিতেন লাহিড়ি, শৈলেন ঘোষ। এদের কাছে নির্দেশ ছিল, উচ্চশিক্ষার সংগে সংগে আধুনিক লড়াইয়ের কায়দা ও বিস্ফোরক প্রস্তুতের তালিম নিয়ে আসতে এবং বিদেশের সর্বত্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে। ভারতবর্ষের বাইরেও বিপ্লবীদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। সানফ্রানসিসকো শহরে যুগান্তর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং শিখ সম্প্রদায় এ সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপে অবস্থানরত ভারতীয় বিপ্লবীরা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি গঠনের উদ্দেশ্যে বার্লিনে সমবেত হন এবং তাঁরা এতে জার্মানির সাহায্য কামনা করলে জার্মান সরকার সম্মত হয়। কলকাতাস্থ জার্মান কনসাল জেনারেলের সঙ্গে আলোচনার জন্য ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি যতীন মুখোপাধ্যায়ের নিকট একজন দূত পাঠান। ইতোমধ্যে যতীনকে বিপ্লবী দলসমূহের কমান্ডার-ইন-চিফ করা হয়। যতীনকে বালেশ্বরে (উড়িষ্যা) গুপ্ত অবস্থায় রেখে নরেন বাটাভিয়া যান এবং সেখানে জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাহাজে অস্ত্র প্রেরণ ও অর্থনৈতিক সাহায্য বিষয়ে আলোচনা করেন। ১৯০৮ সালে বারীণ ঘোষের প্রথম প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন গোপনে শ্রী অরবিন্দের ঘনিষ্ঠ দুই প্রধান বিপ্লবী কানে কানে রটিয়ে দিলেন, "ওরে, হতাশ হস্নে! যতীন মুখার্জি হাল ধরে আছে!" বাঘাযতীন বাঘের মত তখন আন্তর্জাতিক সব ব্যবস্থাগুলো করছে কি করে জাহাজ ভর্তি অস্ত্র আসবে তার পরিকল্পনা করছে বাঘাযতীন গোপনে। ইংরেজরা তার পরিকল্পনা বিন্দুমাত্র টের পায়নি। বাঘাযতীন বাড়ির উদ্দেশ্যে পত্র পাঠালেন বললেন ভয় নেই এখনও বাঘাযতীন জীবিত আছে সুমন তোমার প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও আবার আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়বো। এই দু'জনের নাম অন্নদা কবিরাজ ও মুন্সেফ অবিনাশ চক্রবর্তী। বাস্তবিক সভা-সমিতি যখন বেআইনি, সারাদেশ যখন ধড়-পাকড়ের আতঙ্কে বিহ্বল, যতীন তখন স্যার ডেনিয়েলের কাছ থেকে জমি লীজ নিয়ে গোসাবা অঞ্চলে পত্তন করলেন Young Bengal Zamindari Cooperative : পলাতক কর্মীদের গ্রাসাচ্ছাদনের সংগে তিনি সোদপুরের শশীভূষণ রায় চৌধুরী'র দৃষ্টান্ত অনুযায়ী শুরু করলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য নৈশ বিদ্যালয়, ছোট ছোট কুটির শিল্পের প্রতিষ্ঠান, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। গ্রামাঞ্চলের সংগে বিপ্লবীদের এই প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয় অত্যন্ত সুফল আসলো।
বারীন ও যতীনকে পুনরায়
হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁর সঙ্গে অন্যান্য যাঁরা
গ্রেফতার হন তাঁদের ‘যতীন গ্যাং’ নামে অভিহিত করা হয়। অত্যাচারের শিকার
হয়ে তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যু হয় এবং অপর কয়েকজন পাগল হয়ে যান। সাক্ষ্য-প্রমাণের
অভাবে যতীন এ মামলা থেকে মুক্তি পেলেও তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। জেলে
থাকা অবস্থায় যতীন এবং নরেন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের এক
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁরা দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দলকে ঐক্যবদ্ধ করার
পরিকল্পনা করেন এবং এ উদ্দেশ্যে নরেন সন্ন্যাসিরূপে ব্যাপকভাবে সমস্ত ভারত ভ্রমণ
করে বাংলাসহ বিভিন্ন এলাকার বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন। বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ হুগলি
এবং মেদিনীপুরের বন্যার ত্রাণকার্য উপলক্ষে একত্রিত হন। তাঁরা যতীন মুখোপাধ্যায়
এবং রাসবিহারী বসুকে যথাক্রমে বাংলা এবং উত্তর ভারতের নেতা মনোনীত করেন। বাঘা
যতীনের দৃঢ়তায় যুবক তথা পুলিশের দলের পুলিশ পর্যন্ত অনুগত হয়ে পড়েছিল।
৯
ভারতবর্ষের বাইরেও
বিপ্লবীদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। সানফ্রানসিসকো শহরে যুগান্তর
আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং শিখ সম্প্রদায় এ সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপে অবস্থানরত ভারতীয় বিপ্লবীরা ইন্ডিয়ান
ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি গঠনের উদ্দেশ্যে বার্লিনে সমবেত হন এবং তাঁরা এতে জার্মানির
সাহায্য কামনা করলে জার্মান সরকার সম্মত হয়। কলকাতাস্থ জার্মান কনসাল জেনারেলের
সঙ্গে আলোচনার জন্য ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি যতীন মুখোপাধ্যায়ের নিকট
একজন দূত পাঠান। ইতোমধ্যে যতীনকে বিপ্লবী দলসমূহের কমান্ডার-ইন-চিফ করা হয়।
যতীনকে বালেশ্বরে (উড়িষ্যা) গুপ্ত অবস্থায় রেখে নরেন বাটাভিয়া যান এবং সেখানে
জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাহাজে অস্ত্র প্রেরণ ও অর্থনৈতিক সাহায্য বিষয়ে
আলোচনা করেন।১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে সানফ্রান্সিসকো থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন 'গদর'-নেতা সত্যেন সেন; সংগে এলেন বিষ্ণুগণেশ পিংলে,
কর্তারসিং সরাংগা ও বিরাট একদল 'গদর'-কর্মী। সত্যেন জানালেন যে, বার্লিনে বীরেন চট্টোপাধ্যায়
পরিচালিত বিপ্লবীরা খোদ কাইজারের সংগে চুক্তি সই করেছেন ভারতে অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ
পৌঁছে দেবে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পাঠানো কয়েকটি জাহাজ; এর
দায়িত্ব নিয়েছেন ওয়াশিংটনে জার্মান রাষ্ট্রদূত ব্যার্নস্টর্ফ ও তার মিলিটারী
আতাশে ফন্পাপেন। কাইজারের সনদ নিয়ে একটি বিপ্লবী মিশন রওনা হচ্ছে কাবুল অভিমুখে;
পথে তারা জার্মানির হাতে বন্দী ব্রিটিশ সৈন্যবহরের ভারতীয়
জওয়ানদের নিয়ে গড়ে তোলা বাহিনী নিয়ে কাবুল থেকে কুচকাওয়াজ করে হাজির হবে
দিল্লীতে, যোগ দেবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে। বার্মা সীমান্তেও
সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত থাকছে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে
বলে। দূরপ্রাচ্যে বিভিন্ন জার্মান দূতাবাস ও কনস্যুলেট সহযোগিতার জন্য
প্রস্তুত।যতীনের চিঠি নিয়ে পিংলে ও কর্তারসিং গেলেন রাসবিহারী'র সংগে দেখা করতে। টেগার্টের রিপোর্টে দেখা যায়, এই
সময়ে সত্যেন সেনকে নিয়ে যতীন কলকাতার বিভিন্ন রেজিমেন্টের অফিসারদের সংগে
আলোচনায় ব্যস্ত।[১৩] ভারতের এই যজ্ঞ-অনলে ইন্ধন দেবার জন্য সাজসাজ পড়ে গেল
দূরপ্রাচ্যে আমেরিকায়, ইউরোপে, মধ্যপ্রাচ্যে।
ভূপতি মজুমদার স্পষ্ট লিখে গিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক এই
সহযোগিতার উদ্ভাবন করেন স্বয়ং যতীন মুখার্জি। ইতিহাসে একে অভিহিত করা হয়
"ভারত-জার্মান ষড়যন্ত্র" নামে।
১০
যতীন বলে,আমি বিপ্লবী কাজকর্ম ভালবাসতাম ছোট থেকে। কিন্তু একটা সাধারণ জীবন ছিল। আমার শৈশব আমার কৈেশোর কেটেছে গ্রামের বন্ধুদের নিয়ে। বিশু আর আমি বন্ধুদলের নেতা ছিলাম। আমার সাহসে বিশু যে কোন কাজে পিছুপা হত না। সে জানত, সকলে পালিয়ে গেলেও যতীন পালাবে না
যতীন সমাজসেবক।গ্রামের আশেপাশের খেটে খাওয়া মানুষরের সুখদুখের সাথী যতীন আর তার বন্ধুরা। যতীন বন্ধুদের বলে আমাদের এলাকায় কত রকমের অভাবি লোক আছে তার কাহিনী বলি শোন। তারপর সে বলতে শুরু করে, হাতে একটা ময়লপড়া ঝোলা হাতে শিলকোটানি হেঁকে চলত, শিল কোটাবে গো শিল, শিল কোটাও গো শিল...বাড়ির বৌ ঝি রা ত্রস্ত হয়ে বেরিয়ে আসত বাইরে। বাইরে এসে বলত, এসো গো আমার দ্বারে আমার শিল একবার কোটাতে হবে। শিলকোটানি লোকটা ময়লা ঝোলা থেকে বের করত ছেনি, হাতুড়ি। তারপর পাথরের শিলের উপর নক্সা ফুটিয়ে তুলতো ঠকঠক শব্দে। আশেপাশে কচিকাঁচা ছাড়াও প্রতিবেশিদের বৌরা দেখত আগ্রগভরে এই শিলকোটা। কিভাবে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে নক্সা হাত ও হাতুড়ির যুগলবন্দীতে।
তারপর একজনের দেখে প্রতিবেশিদের দশজন কুটিয়ে নিত শিল। পাশের বাড়ির অনিতা বললো, আমাদের বাঁটনা বাঁটা শিলটাও কেমন সমান হয়ে গেছে। ফুটো ফুটো না থাকলে মশলা ভালো করে বাঁটা যায় না।
শিলকোটানি লোকটা বলে, নিয়ে এসো গো মা। কুটে দিই শিলটা। আবার কবে আসব জানা নাই।
তারপর দশ বারোটা শিল কুটে রোজগার করে শিলকোটানি চলে আসত তার বাড়ি।
ছেনি, হাতুড়ির সব সময় ঠিক রাখত। অনেকে পাথরের শিল মাথায় করে নিয়ে আসত তার কাছে। কত যত্নে সে শিল কুটতো। তখন তার শিল্পীহৃদয় নিয়ে যেত কল্পনার জগতে। সেখানে রঙ আর রঙীন মেঘের আনাগোনা। সেই মেঘের আশীর্বাদ পেয়ে সে বোধহয় এই কাজ পেয়েছে। সে এই কাজ পেয়ে খুব খুশি।
অবসর সময়ে বাগানে গাছ লাগাতেন। আবার সকাল হলেই বেরিয়ে পড়তেন শিকোটানোর কাজে। এখন আর শিলকোটানোর যুগ নেই। মিক্সির চাপে পেশাই হয়ে গেছে প্রচলিত এই পেশা। সেই শিলকোটানোর লোকটির বাড়িতে এখন নাতিদের মিক্সির বাজার। হারিয়ে গেছে পুরোনো সেই শিলের কথা।
আর এক সম্প্রদায়ের মানুষ
ছিল তারা হাবু গান গাইতো সাথে লাঠি দিয়ে পিঠে আঘাত করত। এইসব আঘাত দেখে সহ্য
করতে না পেরে বেশি টাকা দিয়ে তাদের এই খেলা দেখাতে বারণ করত। এইভাবে হাবুগান চলত
কিন্তু তার প্রচলন এখনো দু-এক জায়গায় রয়ে গেছে।
হাবু গানে প্রচলিত গান গুলো ছাড়াও কাউকে ব্যঙ্গ করে বা কোন সমাজের অত্যাচার কে ব্যঙ্গ করে গান গাওয়া হতো।
কয়া গ্রামে বহুরূপী সম্প্রদায় এখানে এসে অন্যরকম সাজে অভিনয় করে দেখাতো বহুরূপী রাম সীতা হনুমান এইভাবে তারা বিভিন্ন রকম সাজে সজ্জিত হয়ে আনন্দিত এবং তার বদলে টাকা-পয়সা উপার্জন করে তাদের সংসার চলত। বহুরূপী সম্প্রদায় এখনো অনেক জায়গায় আছে শহরের বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মাঝে দেখা যায় হনুমান সেজে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউ রাবণ সেজে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তারা বিভিন্ন জায়গায় ভান করে বা মজার ছড়া বলে না কিছু উপার্জন করছে এবং এই উপার্জিত টাকা পয়সা তাদের জীবন নির্বাহ হয়। প্রচণ্ড গরমে তারা সারা দেহে রং মেখে এইভাবে পরিশ্রান্ত হয়ে দিনের পর দিন অর্থ উপার্জন করে এবং দিন চলে গেলে তখন তাদের আর কাজ থাকেনা তখন তারা অন্য কাজ করে।
আমরা ছোটবেলায় দেখেছি ভুলো
লাগা ব্রাহ্মণ এসে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে তারা ছড়ার মত করে বলতো না বিভিন্ন গ্রামের
নাম করত এবং বলতো যেসব গ্রাম ঘুরে এসে শেষে আপনাদের বাড়ি এলাম। হয়তো গ্রামগুলো
আশপাশের গ্রামগুলোর নাম বলতো, মেলে পোশলা কোপা ভুলকুরি হয়ে তারপর মুলগ্রাম
শিবলুন তাড়াতাড়ি হয়ে তারপর আমাদের গ্রামে এসেছে। দিক দিয়ে ভুলো লাগা ভূত নাকি
তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শেষে এইগ্রামে এনেছে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে রাস্তা ধরে প্রচন্ড
গরমে মালিকের বাড়িতে এলাম বাড়িতে এসে দাঁড়াতেই কথা বলতেন একথা শুনে শিশু থেকে
বৃদ্ধ এবং তাকে বসিয়ে হয়তো তার উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার চলতো সংসার চলত।তারপর
এক ধরনের ব্যবসাদার ছিল তারাও সরু লিকলিকে বাসের উপর সেই বোম্বে মিঠাই মিঠাই নানান
রঙের মিঠাছড়ি এনে বাচ্চাদের বিভিন্ন রকম পুতুল তৈরি করে দিতে হতো বলতো আমাকে সাপ
তৈরি করেছে মিঠাই মিঠাই দিয়ে তৈরি করে দিত আর আমাকে পুতুল বানিয়ে দাও বিভিন্ন
নতুন নতুন ছোটদের মনভোলানো আর দেখা যায় না এর অর্থ উপার্জন করত।এই বোম্বাই লাঠি
বানানোর জন্য প্রথমে নিজেকে ফুটিয়ে ফুটিয়ে হাজারের মতো তৈরি করা হতো আটা লেগে
গেলে বিভিন্ন রঙে রঙিন করা হলুদ নীল সবুজের জরিনা জরিনা হতো প্রথমে তারপর যদি না
হতো এবং তাতে প্লাস্টিক জড়িয়ে রাখো ধুলোবালি যাতে না পড়ে তারপর শিশুদের
চাহিদামত পুতুল তৈরি করা হতো।তাছাড়া একটা টিনের বাক্স নিয়ে শনপাপড়ি বিক্রেতা
শোনপাপড়ি বিক্রি করত। তারা একটা চাকা ঘোরাতো টিনের বাক্সের মধ্যে থাকা এবং তাতে
চিনির জল বিভিন্ন রং মিশিয়ে চাকা ঘুরিয়ে দিলে মাকড়সার জালের মত মিঠাই তৈরি হত।
সেটাকে এক জায়গায় করে শোনপাপড়ি বিক্রি হতো। এক টাকায় হয়তো একটা দেখা গেল একটা
বড় ফুটবলের মত শোনপাপড়ি। অনেকে এর নাম দিয়েছিল দিল্লিকা লাড্ডু। এখনো অনেক
জায়গায় দেখা যায় ঘটিগরম বলে একটা জিনিস যেটা ভুজিয়া জাতীয় জিনিস দিয়ে মিশিয়ে
দেওয়া হয়। সেই হাতেধরা জায়গায় থাকে একটা উনুুন এবং সেই উনুনে গরম করে পিঁয়াজ ও
নানারকম মশলা মিশিয়ে ঘটিগরম তৈরি করা হয়। কয়া গ্রামের এইসব খেটে খাওয়া,গরীব মানুষদের যতীনের দল সাহায্য করত অর্থ দিয়ে, সেবা
দিয়ে। তারাও তাকে যতীনদা বলে ডাকত। যতীনদা, বিশু ছিল তাদের
ভগবান। সমাগত 'গদর' কর্মীরা কাজে নামতে
চান, জার্মান অস্ত্র আসার জন্য তাদেঁর তর সইছে না। যতীনের
সঙ্গে পরামর্শ করে রাসবিহারী দিন ধার্য্য করলেন ২১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের জন্য।
মিঞাসির (মহীসুর), লাহোর, ফিরোজপুর,
রাওয়ালপিণ্ডি, জব্বলপুর, বেনারস-সর্বত্র তেরংগা ঝাণ্ডা উড়িয়ে দেওয়া হবেঃ নীল হবে মুসলমান
কর্মীদের প্রতীক; হলদে শিখ; লাল
হিন্দু। কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে সমস্ত রেলপথ উড়িয়ে দেওয়া হবে, যাতে করে সরকার পক্ষ প্রত্যুত্তরের জন্য সৈন্যবাহিনী না আনাতে পারে।
ইতিমধ্যে ২৬ আগস্ট ১৯১৪ সালে কলকাতার রডা কোম্পানী থেকে বিপ্লবীরা যথেষ্ট
শক্তিশালী মাউজার পিস্তল সংগ্রহ করেছেন, প্রয়োজনমতো যা
দূরপাল্লার রাইফেলের মতো ব্যবহার করা চলে। রাসবিহারী'র
অনুরোধে অর্থ সংগ্রহ করতে যতীন নতুন একপ্রস্থ হিংসাত্মক অভিযানের শরণ নিলেন-
মোটরচালিত ট্যাক্সির সাহায্যে অভিনব এই ডাকাতির পদ্ধতি অবিলম্বে ফ্রান্সে দেখা
যাবে, প্রখ্যাত নৈরাজ্যবাদী সর্দার "বোনো"র
পরিচালনায়। পরিশীলিত, শৃংখলাবদ্ধ দুঃসাহসিক এই কীর্তির
সামনে মুগ্ধ আতঙ্কে ইংরেজ সরকার হতবুদ্ধি হয়ে রইল।[১৪] আর পুলকে মুগ্ধ দেশবাসী
প্রত্যয় ফিরে পেল বিপ্লবীদের কর্মক্ষমতায়। ১২/২/১৯১৫, ২২/২/১৯১৫
- দুই দু'টো চোখ ধাঁধানো ডাকাতির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল
সারাদেশে। ২৪/২/১৯১৫ যতীন এক গুপ্ত বৈঠকে কর্মসূচী নির্ধারণ করছেন, এমন সময়ে এক সরকারী গোয়েন্দা সেখানে উপস্থিত দেখে নেতার ইংগিতক্রমে
চিত্তপ্রিয় তাকে গুলি করেন। গুপ্তচরটি তখনো মরেনি। মরার আগে সে যতীনকে তার
হত্যাকারী বলে সনাক্ত করে।
১১
যতীন ও তার বন্ধুরা কবিগুরু,স্বামিজী, যিশুর জীবনী ও আদর্শ আলোচনা করেন। যতীন বলে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক পরে, রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে"।স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, "বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"। এখানে দেখা যাচ্ছে দুই মহাপুরুষের একই বক্তব্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ভজন পূজন সাধন আরাধনা বাদ দিয়ে যেখানে সমস্ত শ্রমিক কাজ করছেন তাদের মধ্যেই ঈশ্বরের বাসস্থান। আবারো স্বামীজী বলেছেন শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে।বহুরূপে, মানুষের মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ধর্ম জীবনেরই অংশ বলা হয়ে থাকে। অবশ্য পাশ্চাত্ত্য দেশে ধর্ম শব্দটি দ্বারা বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার বাইরের অনেক কিছুকে বোঝানো হয়ে থাকে। যেমন, ‘ধ্যান’ অধ্যাত্মসাধনার অংশ হলেও এর দ্বারা শরীরের সুস্থতার ধারণা যুক্ত হয়েছে।একাগ্রতার কথা বলা হয়েছে। ঈশ্বর বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী যেকোনো ব্যক্তি ধ্যানের মাধ্যমে শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে পারেন।
বারীন বলে, এ ধরনের দৃষ্টিকোণে ধর্ম বিশ্লেষণে গুরুত্ব পায় মানবতাবাদ, প্রেম, সমবেদনা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, পরিতৃপ্তি, দায়িত্ব, সংগতি, অপরের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখা প্রভৃতি। কেউ অস্বীকার করবে না এই যুগে যুবসমাজ জ্ঞানী ও কর্মে অনেক অগ্রসর। কিন্তু তাদের মূল্যবোধের অভাব নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতি অবজ্ঞা তাদের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকার আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কে তাদের সতর্ক করে দেবে কেউ দেবে না। কারণ কেউ তাদের আত্মীয় হতে চায় না কি বাড়ির অভিভাবক শিক্ষক সংবাদপত্র কেউ সবাই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যুব শক্তিকে কাজে লাগাতে ব্যস্ত। যুব শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য স্বামী বিবেকানন্দের এবং তার কর্মময় জীবন তার প্রমাণ রেখেছে। স্বামীজি দেশপ্রেমিক ছিলেন এটুকু বললে তাকে ছোট করা হবে।। তিনি তো সন্ন্যাসী ছিলেন। সন্ন্যাসী হিসেবে তার আবার দেশকি? সমাজ কি সন্ন্যাসী তো দেশকালের ঊর্ধ্বে বস্তুত তিনি ভালবাসতেন মানুষকে। মানুষের মধ্যেই তিনি ঈশ্বরকে দেখেছিলেন সব দেশের মানুষকে শ্রদ্ধা করতেন যারা দুর্বল অক্ষম নিপীড়িত তারাই ছিল তার বিশেষ প্রীতিভাজন। যে দেশের মানুষ তারা হোক। নিগ্রো মনে করে আমেরিকার এক হোটেলে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু তিনি বলেন নি যে তিনি নিগ্রো নন। প্রতিটি নিগ্রো, কালো, অসুন্দর মানুষ তার ভাই। মিশরের তথা বিশ্বের না খেতে পাওয়া,কষ্ট পাওয়া প্রতিটি পতিতা তার বোন। অনেকে মনে করেন এসব বিবেচনা কোনো ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ধারণার সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং পৃথিবীর প্রতিদিনকার বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।মানুষকে খেটে খেতে হয়।নানা ঝামেলার মাঝে প্রতিদিনের কাজের সঙ্গে প্রার্থনা ও ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে স্মরণ করছি আমরা মানুষ। যে বিশ্বে আমরা বাস করি তার আশ্চর্য ক্রিয়াকাণ্ড দেখে অভিভূত হই। আমরা কেন এখানে কিংবা আমাদের মৃত্যুর পরে কী হবে, এসব ভাবনাই অধ্যাত্মতত্ত্বের অংশ। আমরা তখনই আধ্যাত্মিক মানুষ হিসেবে পরিচিত হই যখন সুন্দর, প্রেম অথবা সৃষ্টিশীলতায় নিজেকে খুঁজে পাই।বাস্তব পৃথিবীতে জীবন পরিচালনায় আমাদের প্রত্যাশা প্রকাশিত হয় সূক্ষ্ম সম্পর্কের সুতোয়। সেই সম্পর্কের মধ্যে পরমার্থ-জীবন আমাদের প্রশান্তি দান করে। আধ্যাত্মিক জীবনের পথ বিচিত্র। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নিজেকে তৈরি করা, নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি জগতের সঙ্গে মিলতে চাওয়ার জন্য সুশৃঙ্খলভাবে ধ্যান, প্রার্থনা, নৈতিকতার উন্নতি সাধন, ধর্মীয় গ্রন্থে নিমগ্ন হওয়াকে চিহ্নিত করা হয় এর অন্যতম পথ হিসেবে। এসবই অনেক সময় একজন ধর্মতাত্ত্বিকের মাধ্যমেও সম্পন্ন হতে পারে। আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্য হচ্ছে ভেতরের জীবন ও বাইরের জীবনের উন্নতি। প্রেম ও করুণা ধারায় সিক্ত হলে আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি ঘটে।
যতীন আরও বলে, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার যোগাযোগটা কী রকমের? পরমের সন্ধানে নিয়োজিত আধ্যাত্মিকতার উদ্দেশ্য পরমের সন্ধান। তবে আমাদের মতে আধ্যাত্মিকতা ধর্মেরই একটি অংশ। ধর্মের বাইরে একজন ব্যক্তি তার আধ্যাত্মিক জীবন খুঁজে পেতে পারেন। শূদ্রের সেবার জন্য এক লক্ষ যুবককে স্বামীজি চেয়ে ছিলেন। তারা সমস্ত শক্তি নিয়ে দেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এই ছিল তার আশা। কিন্তু সর্বাগ্রে চেয়েছিলেন তারা মানুষের মত মানুষ হবে, বুদ্ধির উদয় কর্মশক্তি এবং তার সঙ্গে নিঃস্বার্থ সেবার মনোভাব নিয়ে তারা কুটিরে কুটিরে গিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করবে। এই সেবা পেতে নিশ্চিতভাবে, শিবজ্ঞানে জীব সেবা বলে অভিহিত করেছেন।তিনি বলেছেন এই হচ্ছে যুগধর্ম এর মধ্যে আমি নেই। তুমি শুধু তুমি আছো। অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রীতি, স্মৃতি নিয়ে সেবা। সেবা বুদ্ধি না থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহার অবশ্যম্ভাবী। তাই বারবার বলেছিলেন দেশ স্বাধীন হবেই। কিন্তু জাতি স্বার্থান্বেষীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে সেজন্য আমাদের কর্তব্য, ধর্মের উচ্চতম চিন্তা দিয়ে সে সময় একটা প্লাবন ঘটানো উচিত এতে চিন্তার একটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু যিশু খ্রিস্টের জীবনের প্রসঙ্গ আলোচনা করলে ধর্ম ও মানবতা একই জিনিস মনে হওয়াই স্বাভাবিক। অপরের জন্য নিজেকে আত্মোৎসর্গ করা, নিজের শান্তি, নিজের তৃপ্তি, সুখী হওয়ার প্রচেষ্টায় দান-ধ্যান-প্রার্থনায় নিয়োজিত থাকা এসবই আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে বিজড়িত থাকলে নিজের ভালো লাগে।এ ক্ষেত্রে নিজের অন্তরের উপলব্ধি গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও জড়িত অপরের উপকার প্রসঙ্গ।সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন অন্তরের আকুতি ও নিবেদিত নৈবেদ্যের মধ্যে সেই ভালোলাগা লুকিয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে সার্বজনীন চেতনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে সামাজিক উপকারের বিষয়টি। সর্বধর্মের দৃষ্টিতে সমগ্র মানব সমাজ এবং সৃষ্টির সব কিছু ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।তিনি সকল মানুষের প্রতিপালক। তিনি সকলকে ভালোবাসেন। মানবতার দিশারি হিসেবে ভগবান বুদ্ধ, যিশু, রসুল আল্লা আমাদের পরিত্রাণকর্তা। মানবাত্মা সম্পর্কে ধারণা একটি মানবিক ধারণা।
বারীন বলে, বিশ্বজুড়ে মানুষে মানুষে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আধ্যাত্মিক সত্যকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এসব থেকে মুক্তির জন্য সার্বজনীন চেতনার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষে মানুষে মৈত্রী, সাম্য, ঐক্য ও পারস্পরিক বিশ্বাস এই চেতনার প্রধান দিক। স্বামী বিবেকানন্দ শুধু বাঙালির জীবনের এক আদর্শ মহামানবই নন, তিনি যুগাবতার। তাঁর দেখানো আদর্শের রাস্তা যুক্তিবোধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। আধ্যত্মকে এক অন্য পর্যায়ে উন্নতি করে স্বামীজী সকলের জীবনকে আরও বেশি করে আলোর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। নেতিবাচক ভাবনার অন্ধকার দিকটির পর্দা সরিয়ে তিনি বাঙালির জীবনবোধকে আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করেছেন। উদ্বুদ্ধ হয়েছে যুব সমাজ, আর সেজন্যই তার জন্মদিন ১২ই জানুয়ারি যুব দিবস বলে খ্যাত। স্বামীজির কিছু অমর বাণী মনে দাগ কাটে। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন তোমরা হৃদয়বান হও প্রেমিক হও। তোমরা কি প্রাণে প্রাণে বুঝেছ যে কোটি কোটি দেবর্ষি র বংশধর পশুর মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমরা কি প্রাণে প্রাণে অনুভব করেছো, কোটি কোটি লোক অনাহারে মরছে। কোটি কোটি লোক শতাব্দী ধরে অনেক আছে, তোমরা কি মনে প্রাণে বুঝেছ অজ্ঞতার কালোমেঘ ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এই সব ভাবনা কি তোমাদের অস্থির করে তুলেছে তোমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তিনি বলেছেন আমি বিশ্বাস রাখি আধুনিক যুব সমাজের উপর আমার কর্মীরা তাদের মধ্য থেকেই আসবে। সিংহের মত যে তারা দেশের সব সমস্যাগুলির সমাধান করবে। গীতা পড়ার থেকে ফুটবল খেললে ঈশ্বরের সন্ধান তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়।একথা তিনি বলেছেন যুবদের। তিনি বলতেন তোরা মানুষ হ। তিনি বলতেন আমি এমন মানুষ চাই যাদের মাংস পেশি লোহা দিয়ে তৈরি। আর এই দেহের মধ্যে এমন মন থাকবে যা নরম উপাদানে গঠিত। অনেকে আমিষ, নিরামিষ খাওয়া নিয়ে খুব গর্ব করতেন তিনি বলতেন আমার ছেলেরা যত খুশি আমিষ খাবে।পাপ আমার হোক। কারণ তিনি চাইতেন দেশের ছেলেমেয়েরা বলিষ্ঠ ও দৃঢ় হোক। শুধু দেহ শক্ত হলে হয়না। মন শক্ত হওয়া চাই। সর্বাগ্রে চাই আত্মবিশ্বাস।যাকে তিনি শ্রদ্ধা বলতেন, কে নাস্তিক? স্বামীজি বলতেন পুরোনো মতে যাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই তারা নাস্তিক। কিন্তু আধুনিক মতে যাদের নিজেদের উপর বিশ্বাস নেই তাই নাস্তিক। স্বামীজি পাশ্চাত্যে সংঘ শক্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এই সংঘ শক্তি আমাদের দেশে আসুক আর সঙ্গে সঙ্গে আসুক পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার সহায়তায় আমরা নতুন ভারত গড়ো কিন্তু তা বলে আমাদের আর্থিক সম্পদ হারাবো না সামাজিক নেতৃত্বে আমাদের দেশের তরুণরা নতুন ভারত এগিয়ে আসুক এই আশার আলো জর্জরিত ভারতের জনসাধারণ অপেক্ষা করছে।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ভারতের প্রাচীন আদর্শ অনুশাসনের প্রতি ছিলেন পরম নিষ্ঠাবান। এমনকি চল্লিশ বছর অবধি তিনি ভারতবর্ষের সনাতন সারল্য, স্নিগ্ধতা ও অনাড়ম্বর পুজোআচরণের প্রতি ছিলেন অনুরক্ত। সংযম, বিশ্বাস, ধ্যান, মৃত্যুভয়হীন, আত্মসমাহিত শক্তি, কোমলতা ও স্বধর্ম রক্ষায় দৃঢ়তা এবং শান্তির মর্মগত বিষয়ে তিনি ছিলেন প্রাচীন বিশ্বাসী। দীর্ঘদিনের প্রথাগত সংস্কার-বিশ্বাস ও শিক্ষায় বেড়ে ওঠা হিন্দুসমাজে জন্মেছিলেন বলে কবি তার যা কিছু শ্রেষ্ঠ তাকে সমস্ত সমাজের বলে ভেবেছেন। তবে যে ধর্মসমাজে তার জন্ম তার অতিরিক্ত অর্জন আছে তাঁর পরমার্থচেতনায়। জন্মগত আর বংশগত ধর্ম তাঁর শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি ও চিন্তার ভেতর দিয়ে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তরিত হয়েছে; পেয়েছে পরিপূর্ণতা। তিনি একসময় হিন্দু সম্প্রদায় ও হিন্দু আদর্শ নিয়ে প্রশস্তি গেয়েছেন (যেমন, ১৩২৪ সালে ‘আত্মপরিচয়’ রচনায়)। পরে আবার এর বিপরীত কথাও বলেছেন (যেমন, ১৩৩৯ সালে ‘কালান্তর’ গ্রন্থে)। হয়ে উঠেছেন ‘গোরা’ উপন্যাসের গোরা চরিত্রের মতো ভারতবর্ষের দেবতার পূজারি।যতীন বলে, রবীন্দ্রনাথ উদার বিশ্বমানবিকতার কবি। বিশ্বমানব ও বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল সংস্কারমুক্ত ও ভেদাভেদশূন্য। প্রথমদিকে সমাজ ও ধর্মের সংস্কার ও বিশ্বাসের বেড়াজাল সৃষ্টি হলেও সেই উচ্ছ্বাস ও আবেগ থেকে তিনি মুক্ত হয়ে মানবিক সত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। তিনি যেমন ব্রাহ্মণের মিথ্যা গরিমাকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন তেমনি হিন্দুদের দ্বারা কথিত ম্লেচ্ছ মুসলমানকে সম্মান করেছেন। কাহিনী কাব্যের ‘সতী’ কবিতায় আছে :‘বৃথা আচার বিচার। সমাজের চেয়ে হৃদয়ের নিত্য ধর্ম সত্য চিরদিন।’ মানুষের জয়গান ছত্রে-ছত্রে। সংস্কারমুক্ত কবি সাম্প্রদায়িক জাতিভেদের ভেদবুদ্ধিকে পরিহার করেছেন। জাতপাতের বিরুদ্ধে উঠে তাঁর কণ্ঠস্বর তীব্র হয়েছে। পত্রপুট কাব্যের পনের সংখ্যক কবিতায়। যেখানে গরীব,সমাজের নিচুতলার পক্ষে কবির চেতনা। তিনি সহজ ভক্তির আলোকে দেবতাকে পেতে চেয়েছেন। আচার সংস্কার মন্ত্র ও মন্দিরের ভেতরে নয়। এ জন্য গীতাঞ্জলির অসংখ্য কবিতায় দেখা যায় দেবতা বদ্ধ ঘরে নেই, তিনি আছেন রৌদ্র ধূলায় চাষা আর শ্রমিকের মাঝে। অবজ্ঞাত, হীন, পতিত অন্ত্যজের মধ্যে কবি দেবতা খুঁজেছেন। গীতাঞ্জলির কবিতায় কবি সব হারাদের মাঝে দেবতাকে পেয়েছেন আমরা দেখতে পাই।
"যেথায়
থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
সেইখানে যে চরণ তোমার বাজে
সবার পিছে, সবার নিচে
সব হারাদের মাঝে।"
কবিগুরু সকল গণ্ডি, সমস্ত সম্প্রদায় বিভেদ বৈষম্যের ঊর্ধ্বে মানুষের ঈশ্বরের সাধনা করেছেন, আরাধনা করেছেন। মানুষের মাঝে দেবতাকে পেয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে নিজের সাধনা সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার মন যে সাধনাকে স্বীকার করে তার কথাটা হচ্ছে এই যে, আপনাকে ত্যাগ না করে আপনার মধ্যেই সেই মহান পুরুষকে উপলব্ধি করবার ক্ষেত্র আছে, তিনি নিখিল মানবের আত্মা। এই বিশ্ব মানবের আত্মাকে উপলব্ধি করার সাধনাই কবির ধর্মসাধনার পরিণাম। মানবের আত্মার স্বরূপ হচ্ছে সর্বজনীন মানব বা পরম পুরুষ। যিনি সব মানুষের হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট থেকে মহত্ত্বের শ্রেয়োবোধের প্রেরণা দিচ্ছেন। চিত্রার ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় তার পরিচয় আছে।‘কে সে? জানি না কে? চিনি নাই তারেশুধু এইটুকু জানি— তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে, ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে। অন্তরপ্রদীপখানি।... মানুষের অন্তরে এক মহামানবত্বের প্রেরণা, যা তাকে অনুপ্রাণিত করে মহত্ত্বের পথে নিয়ে যায় তাকে অনুভব করেন কবি। তবে মহামানবের কর্ণে তার আহ্বান পৌঁছায় সবার আগে। তাঁরা সংসারের সীমা ছেড়ে ছুটে আসেন। নতুন নতুন ত্যাগ ও দুঃখ বোধ প্রকাশিত হয়। মানুষের অন্তর্নিবিষ্ট মহামানবই কবির ‘সদা জনানাং হৃদয়ে আছে। মহামানবকে লাভ করার সাধনাই কবির ধর্ম সাধনা। এর নাম মানবধর্ম। কবিগুরুর আত্মদর্শন বিভিন্ন কবিতায় রূপায়িত হয়েছে। গীতমাল্যের কবিতায় মহামানবকে লাভ করার জন্য ত্যাগ ও দুঃখবরণ করে মানবাত্মার অভিসারের কথা বলা হয়েছে। দুঃখকে আত্মসাৎ করার আনন্দের কথা ‘আত্মপরিচয়ে’ বলেছেন তিনি। দুঃখের মধ্য দিয়ে সুন্দরের পরমসত্তার আবির্ভাব ঘটে। মানবাত্মা পরিশুদ্ধ হয়। গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের গানে আছে, "দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে। / বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে। ...মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে দে একেবারে/ তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে।" কবির দেবতা রুদ্র, শান্ত, শিবম। দুঃখ আঘাতে তাঁকে পাওয়া যায়। খেয়ার ‘আগমন’-এ আছে সেই রুদ্র রূপ। ‘এই করেছ ভালো নিঠুর’/ কিংবা ‘আরো কি বাণ তোমার তুণে আছে’- দুঃখকে আহ্বান করার গান। দুঃখ ও কঠোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মহামানবের সাধনা পূর্ণ হয়। তবে তাঁর সাহচর্য কখনো কখনো আনন্দময়। বিভিন্ন কবিতায় ব্যক্ত ‘খেলার সঙ্গিনী’, ‘নর্মসহচরী’, ‘মানসসুন্দরী’ কবির জীবনের নিয়ন্ত্রণকর্ত্রী জীবনদেবতায় পরিণত। চিত্রা কাব্যের জীবনদেবতা, রাজা, অরূপরতন নাটকের রাজা এবং খেয়া কাব্যের দুঃখরাতের রাজা ও রাজার দুলাল একই সত্তার ভিন্ন রূপ। একই দেবতা বিচিত্র রূপে কবির কাছে দেখা দিয়েছে। গীতাঞ্জলির গানে আছে প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্যে কবি তার অমৃত স্পর্শ লাভ করেছেন। হৃদয়দেবতার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বভুবনের প্রতি কবির ছিল বিস্ময়। গীতাঞ্জলির গানে আছে ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি/ বাজাও আপন সুর/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ/ তাই এত মধুর।’ জগতের সামান্য বস্তুর মধ্যেও অপরিমেয়তার অশেষ ব্যঞ্জনা আছে। কবি বিশ্বপ্রকৃতিতে নিসর্গ সৌন্দর্যে মানব সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে সীমাহীন অনির্বচনীয়তা লক্ষ্য করেছেন। অনন্ত অসীম পরম রহস্যময় প্রকাশ, ‘যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’ গীতাঞ্জলির ৩০ নম্বরে সৃষ্টির সকল আনন্দময় প্রকাশ আছে। অন্তর অনুভূতির গভীর আকুতি মিশেে আছেে,
এই তো তোমার প্রেম ওগো হৃদয়
হরণ
এই যে পাতায় আলো নাচেসোনার
বরণ।।
এই যে মধুর আলস বরে, মেঘ ভেসে
যায় আকাশ পরে
এই যে বাতাস দেহে করে অমৃত
ক্ষরণ।।"
মানুষ ও মানব সংসারের মধ্য দিয়ে কবি তাঁর পরমেশ্বরের আনন্দরূপ দেখেছেন। কবিতায় তিনি অমৃতময় ভূমাকে পরমানন্দময় জীবনদেবতাকে লাভ করেছেন।
‘এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানা বর্ণগন্ধময়।...
যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে
গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।’
"তিনি
গেছেন সেথায়, যেথায় করছে চাষা চাষ
পাথর ভেঙে কাটছে যারা পথ
খাটছে বারোমাস,
রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে
ধুলা তাহার লেগেছে দুই হাতে,
তারি মতন শুচি বসন ছাড়ি, আয়রে ধুলার 'পরে "।
আবার তিনি বলেছেন কবিতায়," মুক্তি ওরে মুক্তি কোথায় পাবি, মুক্তি কোথায় আছে, আপনি প্রভু সৃষ্টি বাঁধন 'পরে বাঁধা সবার কাছে"।আবার স্বামী বিবেকান্দ বলেছেন, 'কেবল শারীরিক সাহায্য দ্বারা জগতের দুঃখ দূর করা যায় না। যতদিন না মানুষের প্রকৃতি পরিবর্তিত হইতেছে, ততদিন এই শারীরিক অভাবগুলি সর্বদাই আসিবে এবং দুঃখ অনুভূত হইবেই হইবে। যতই শারীরিক সাহায্য কর না কেন, কোনমতেই দুঃখ একেবারে দূর হইবে না। জগতের এই দুঃখ-সমস্যার একমাত্র সমাধান মানবজাতিকে শুদ্ধ ও পবিত্র করা। আমরা জগতে যাহা কিছু দুঃখকষ্ট ও অশুভ দেখিতে পাই, সবই অজ্ঞান বা অবিদ্যা হইতে প্রসূত। মানুষকে জ্ঞানালোক দাও, সকল মানুষ পবিত্র আধ্যাত্মিক-বলসম্পন্ন ও শিক্ষিত হউক, কেবল তখনই জগৎ হইতে দুঃখ নিবৃত্ত হইবে, তাহার পূর্বে নয়। দেশে প্রত্যেকটি গৃহকে আমরা দাতব্য আশ্রমে পরিণত করিতে পারি, হাসপাতালে দেশ ছাইয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু যতদিন না মানুষের স্বভাব বদলাইতেছে, ততদিন দুঃখ-কষ্ট থাকিবেই থাকিবে।'যতীন স্মরণ করে, স্বামীজি বলতেন ভারতের জাতীয় অপরাধ সে তার জনসাধারণকে অবজ্ঞা করে এসেছে। এই পাপের ফলে ভারত এত দুর্বল। বার বার বিদেশি শক্তির কাছে পদানত হয়েছে। জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ হচ্ছে শূদ্র। খেটে খাওয়া মানুষ যারা মাঠে চাষ করে কলকারখানায় হাতুড়ি পেটায়। এরা দেশ গড়ে কিন্তু এরা সে ধন থেকে বঞ্চিত। আবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই কথা বলেছেন তিনি বলেছেন যারা মাঠে ঘাটে খাটে তারাই তো আসল দেবতা। তাদের মধ্যেই দেবতা বিরাজ করে। তুমি রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন ভগবানকে খোঁজো। সেখানে ঈশ্বর নেই। সেখানে ঈশ্বর নেই, যেখানে শুধু ধর্মের আড়ালে ক্ষমতার বড়াই করে গরীবের ঘাম কেড়ে খাওয়া লোভি হায়েনার দল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, গ্রেট মেন থিংকস আ্যালাইক।যারা বিদ্বজ্জন যারা মহাপুরুষ, জ্ঞানী তারা একই রকম চিন্তা করে থাকেন এটাই আমাদের প্রবন্ধের মূল বক্তব্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একই সুরে সুর মিলে যায়। তারা মানুষের জয়গান করেছেন চিরকাল। মানুষের জয়গান করেছেন ভগবান যিশু, বুদ্ধ সকলে। আমরা তো সামান্য লোক।তাই তাঁদের পথ ধরে চিরকাল অনুসরণ করে যাই আলোপথ।কবির ভাষায় বলি, " মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন, হয়েছেন চিরস্মরণীয়, সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে আমরাও হব বরণীয় "।আর্মি ট্রেনিং এ যেমন পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেওয়া হয় জলে, সাঁতার কাটা হয় এবং লাফিয়ে ডিঙোনো হয় ব্যারিকেড প্রভৃতি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় শরীরচর্চার জন্য। সেরকমই সৈন্য বিভাগের প্রধানের মত নানা রকম শরীর চর্চা করাতেন বিপ্লবি অরবিন্দ। তিনি গাছে ওঠা, সাঁতার কাটা প্রভৃতির মাধ্যমে বাংলার ছেলেদের চর্চা করেন। ঋষি অরবিন্দ ছিলেন ফাউন্ডার, ফিলজফার। কি করে বৃটিশদের ভারতছাড়া করা যায় তার ব্লুপ্রিন্ট বাংলার বিপ্লবীদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতেন বিজ্ঞ অধ্যাপকের কায়দায়। তাঁকে শতকোটি প্রণাম জানায় ভারতবাসী। দেশ বিদেশের শরীরচর্চার পদ্ধতিতে ধৈর্য, শক্তি এবং সংযমের সঙ্গে শারীরিক সক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। এখন জিম বা লোহার সাহায্য নিয়ে করেও অনেকে শরীরচর্চা করেন। ক্যারাটে,কুংফু এগুলো বিদেশের শরীরচর্চার পদ্ধতি। আমাদের ভারতবর্ষের যোগাসন বহু পুরোনো শরীরচর্চার পদ্ধতি। ভারতীয় ঋষিরা শরীরচর্চার সঙ্গে সাধনার মাধ্যমে মনকে নিয়ন্ত্রণ করার কথাও বলেন। ঋষি অরবিন্দ বাংলার দামাল ছেলেদের শরীর ও মন গঠন করে দিতেন তার মানসিক দৃঢ়তা ও যোগাসনের দ্বারা। তাছাড়া কবাডি,কুস্তি,গাছে চড়া, সাঁতার প্রভৃতি দেশীয় পদ্ধতি তো আছেই। বিপ্লবী বাঘা যতীন ঋষি অরবিন্দের কাছে শিখেছিলেন অনেককিছু। সেখানেই তার মনে আসে জার্মানের জাহাজভর্তি অস্ত্রের স্বপ্ন। বিদেশ থেকে প্রচুর অস্ত্র আসবে আর তার দ্বারা আমাদের দামাল ছেলেরা ইংরেজ তাড়াবে ভারতবর্ষ থেকে। অত্যাচারের শিকল ছিঁড়ে মুক্ত করবে দেশমাতার বন্ধন। তাঁর জাহাজের আশা পূর্ণ হয়েছিল অচিরেই কিন্তু সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে নি দেশিয় কয়েকজন বেইমানের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য। থরহরিকম্পা পুলিশ রিপোর্টে অসহায় টেলিগ্রাম দেখা যায় "চড়া ইনাম ঘোষণা করেও যতীনের হদিশ মিলছে না। এখনো তিনি ছদ্মবেশে কলকাতায় বহাল তবিয়তে যাতায়াত করছেন, কিন্তু তাঁর মতো উগ্র চরিত্রের নাগাল পাবার যোগ্য চর পাওয়া দূর্লভ, বিশেষত সর্বদাই তিনি সশস্ত্র থাকেন"। যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় তার আত্মজীবনীতে লিখেছেনঃ "কলকাতায় Flying Squad, Armoured Car-এর সশস্ত্র পাহাড়ার ব্যবস্থা হল। বড় রাস্তাগুলিতে ড্রপ-গেট করা হল - রেললাইন বন্ধ করার যেরূপ লোহার পাল্লা খাড়া রাখা হয়, ঠিক তেমনি। থানায় সাইরেন বসানো হল। কলকাতা থেকে উত্তর ও পূর্বদিকে খাল পার হবার যত পোল আছে - চিৎপুর, টালা, বেলগেছে, মানিকতলা, নারকেলডাংগা ও হাওড়ার পোলে সশস্ত্র প্রহরী দেওয়া হল। যাকে-তাকে এবং যে-কোনও গাড়ীকে ধরে তল্লাশ করা হতে লাগল কলকাতা থেকে খবর এল, একের পর এক বিপ্লবীদের কেন্দ্রগুলিতে তল্লাস চালাচ্ছে পুলিশ। বালেশ্বরের সন্ধান পেতে দেরী নেই। দুর্গম ডুভিগর পর্বতশ্রেণী দিয়ে গা ঢাকা দেবার উপযোগিতা নিয়ে কেউ কেউ যখন জল্পনা-কল্পনা করছেন, যতীন দৃঢ়স্বরে জানালেন, "আর পালানো নয়। যুদ্ধ করে আমরা মরব। তাতেই দেশ জাগবে।৭ সেপ্টেম্বর গভীর রাত্রে যতীন নিজের সাময়িক আস্তানা মহলডিহাতে ফিরে এলেন। সঙ্গে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। ৮ সেপ্টেম্বর সারাদিন কেটে গেল গভীর জংগলে। সারারাত পায়ে হেঁটে ৯ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা পৌঁছলেন বালেশ্বরের নদী বুড়ি বালামের উপকণ্ঠে। সাঁতার কেটে নদীর ওপারে গিয়ে যুদ্ধের পক্ষে মোটামুটি উপযুক্ত শুকনো এক ডোবার মধ্যে আশ্রয় নিলেন। বিপরীতপক্ষে চার্লস টেগার্ট, কমান্ডার রাদারফোর্ড, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলভি অসংখ্য সশস্ত্র পুলিস ও সামরিক বাহিনী নিয়ে হাজির হয়েছিল। পরীখার আড়ালে বাঘা যতীনের নেতৃত্বে মোট পাঁচজন, হাতে মাউজার পিস্তল। যুদ্ধ শুরু হলে পুলিসের গুলিতে ঘটনাস্থলে শহীদ হলেন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী।[১৮][১৯] এই যুদ্ধের এমন নজির ইতঃপূর্বে দেখেননি বলে মেনে নিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ কুশীলবেরা। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ সালে সূর্যাস্তের সংগে অবসান হল এই যুদ্ধের। পরদিন বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালে যতীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তখনো রক্তবমি হচ্ছে। হেসে বললেন:"এত রক্ত ছিল শরীরে।আমি তা ভারতমাতাকে দান করে গেলাম "।
বাঘা যতীন মৃত্যুবরণ করার
আগে দেখলেন, জার্মান থেকে জাহাজ ভরতি অস্ত্র এসে পৌঁছে গেছে। কেউ নেবার নেই। একজন
ইংরেজ অফিসার গেল সেখানে আর বাঘা যতীনের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ দেখে তাঁকে বারবার স্যালুট
জানালেন।
১২
ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র
সংগ্রামের মহানায়ক বাঘা যতীনের আসল নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তার জন্ম জন্ম
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়ায়। বাবার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম
শরৎশশী। খুব ছোটবেলায় যতীন তার বাবাকে হারায়। যতীনের মা বিধবা শরৎশশী দেবী ছিলেন
স্বভাবকবি। স্বামীর স্বর্গারোহণ, শ্মশান, সংসার প্রভৃতি
কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই বাঘা যতীনকে সাহসী করে তোলার
পেছনে তার মা শরৎশশীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।বিখ্যাত বিপ্লবী এমএন রায় মন্তব্য
করেছিলেন, আমি বাঘা যতীন ও লেনিন দুজনকেই দেখেছি। এ দুজনের
মধ্যে বাঘা যতীনই শ্রেষ্ঠ। বিপ্লবী এমএন রায় তার এই মন্তব্যের মাধ্যমে মহামতি
লেনিনকে ছোট করেননি, বরং বাঘা যতীন যে একজন বিশাল মাপের
মানুষ সেটিই তার এই মন্তব্যের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন।১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এই
অকুতোভয় মহাবিপ্লবী বাঘা যতীন মারা যান। বাঘা যতীনের চেতনায় লালিত হয়ে অসংখ্য বাঘা
যতীনেরজন্ম হয় এবং এক পর্যায়ে এই অসংখ্য বাঘা যতীনের আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশরা
এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।বাঘাযতীন চেষ্টা করছিলেন জার্মানির কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ
করতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এক বিপ্লবী যোগাযোগ করেন জার্মান
সরকারের সঙ্গে। জার্মান প্রশাসন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য
করতে রাজি হয়েছিল। বাঘাযতীনের সহযোদ্ধা নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ভারতীয় বিপ্লবীদের
জন্য বিদেশ থেকে অস্ত্র আনতে সিআর মার্টিন নাম নিয়ে বাটাভিয়া যান। সেখানে জার্মান
দূতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন জার্মানির প্রশাসনের সঙ্গে। তাঁকে জার্মান সরকার
জানায়, অস্ত্র বোঝাই দুটো জাহাজ ভারতের উপকূলে পাঠাবে তারা। সেই অনুযায়ী, ম্যাভেরিক, অ্যানি লার্সেন
ও হেনরি-এস নামে তিনটে জাহাজ রওনা দেয়। কিন্তু ইংরেজদের কাছে সেই খবর ফাঁস হয়ে
গিয়েছিল। তিনটি জাহাজের একটি হাতিয়ায়, একটি সুন্দরবনের
রায়মঙ্গলে এবং একটি ওড়িশার বালেশ্বর উপকূলের পৌঁছনোর কথা ছিল। ইংরেজ সরকার আটক করে তিনটে জাহাজকেই। বালেশ্বরে বাঘা যতীনের গোপন
আস্তানাতেও হানা দেয়।পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে
বাঘাযতীন ও তার সঙ্গী বিপ্লবীদের পিছু নিয়েছিলেন। বিপ্লবীরা অনাহারে-অর্ধাহারে এক
জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে যেতে লাগলেন। বাঘাযতীন ভীরু কাপুরুষ ছিলেন না।
পাল্টা আক্রমণের জন্যেও প্রস্তুত হচ্ছিলেন তিনি। এদিকে ব্রিটিশ পুলিশরা
বাঘাযতীনদের দলবলকে ডাকাত বলে গ্রামে গ্রামে প্রচার করেছিল। তাই স্থানীয় মানুষদের
কেউ কেউ ভয় পেয়ে এবং ডাকাত ধরানোর পুরস্কারের লোভে বাঘাযতীনের গতিবিধির খবর জানিয়ে
দিচ্ছিল পুলিশকে। একদিন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বুড়িবালাম নদীর তীরে দোকানে চার
সঙ্গীদের নিয়ে খেতে বসেছিলেন বাঘাযতীন। সেই খবর পুলিশে কাছে পৌঁছয়। তখনই পুলিশবাহিনী
নিয়ে বালেশ্বরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি ও মিলিটারি লেফটেন্যান্ট রাদারফোর্ড চলে
যান সেখানে। বাঘাযতীনও বিপদ আঁচ করে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হলেন। আশ্রয় নিলেন
পরিখার আড়ালে। ইতিমধ্যে বহু প্রতিক্ষিত তিনটি অস্ত্রভর্তি জাহাজ তীরে এসে লেগেছে।
বাঘা যতীন দেখলেন জাহাজগুলি কিন্তু চারদিকে পুলিশের বন্দুকের নল।এগোনো ঠিক হবে না
ভেবে সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
পুলিশের সঙ্গে তাঁদের গুলির যুদ্ধ শুরু হল। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা সংগ্রামের এক পবিত্র রণক্ষেত্রে পরিণত হল বুড়িবালামের তীর। গুলির যুদ্ধে সেখানে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী শহিদ হলেন। গুরুতর আহত হলেন বাকি তিন জন। তাঁদের গুলির সব ফুলিয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় ব্রিটিশ পুলিশ তাঁদের বাগে পেল। পরের দিন বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালে মারা গেলেন বাঘাযতীন। বিচারে তাঁর সঙ্গী জ্যোতিষ পালের ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের হল ফাঁসি।পাঁচজন সশস্ত্র বিপ্লবী প্রায় পাঁচহাজার বৃটিশ সৈন্যের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।বাঙালী তথা দেশ কোনদিন এই আত্মত্যাগ ভুলবে না, ভুলতে পারে না।
রতবর্ষের বাইরেও বিপ্লবীদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। সানফ্রানসিসকো শহরে যুগান্তর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং শিখ সম্প্রদায় এ সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপে অবস্থানরত ভারতীয় বিপ্লবীরা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি গঠনের উদ্দেশ্যে বার্লিনে সমবেত হন এবং তাঁরা এতে জার্মানির সাহায্য কামনা করলে জার্মান সরকার সম্মত হয়। কলকাতাস্থ জার্মান কনসাল জেনারেলের সঙ্গে আলোচনার জন্য ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি যতীন মুখোপাধ্যায়ের নিকট একজন দূত পাঠান। ইতোমধ্যে যতীনকে বিপ্লবী দলসমূহের কমান্ডার-ইন-চিফ করা হয়। যতীনকে বালেশ্বরে (উড়িষ্যা) গুপ্ত অবস্থায় রেখে নরেন বাটাভিয়া যান এবং সেখানে জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাহাজে অস্ত্র প্রেরণ ও অর্থনৈতিক সাহায্য বিষয়ে আলোচনা করেন।অবশ্য পুলিশ ধানক্ষেতে যতীনের গুপ্ত আশ্রয়ের সন্ধান পায়। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক গুলি বিনিময়ের পর দু’জন বিপ্লবী আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশ আহত অন্য দু’জনের সাথে যতীনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। আহত দুজনের একজন ছিলেন মাদারিপুরের চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, যার কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যু হয়।১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এই অকুতোভয় মহাবিপ্লবী বাঘা যতীন মারা যান। বাঘা যতীনের চেতনায় লালিত হয়ে অসংখ্য বাঘা যতীনের জন্ম হয় এবং এক পর্যায়ে এই অসংখ্য বাঘা যতীনের আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। অফিসার স্বীকার করলেন, আর বেশিদিন বৃটিশ সরকার এখানে টিকবে না। ইংরেজ ভারত ছাড়তে বাধ্য হবে। তিনি বাঘা যতীনকে সম্মান জানিয়ে বললেন, জয় হো বাঘা যতীন, বাঘা যতীনের জাহাজ। বাঘা যতীন বেঁচে থাকলে জাহাজ দেখে তিনি আবার লড়াই করতেন নব উদ্যমে।
0 comments: