0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in




 



প্রামাণ্য যুক্তি না থাকলে তর্কে বিপক্ষকে সহজে দাবিয়ে দেবার অভিনব পন্থা হল তাকে কোনো অবাঞ্ছিত গোষ্ঠীভুক্ত বলে দাগিয়ে দেওয়া। গত তিন-চার দশক ধরে বিজ্ঞানেও এই ধরণের একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা কিছু অতিমাত্রিক প্রাকৃতিক ঘটনা সবই সাম্প্রতিক কালে বহু প্রচারিত বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। এতে অনুসন্ধান ও গবেষণার পরিশ্রম কমে, বিজ্ঞান মার খায়। 

পৃথিবীতে প্রায় প্রতিনিয়তই কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে চলেছে, সে সমুদ্রতলে হোক বা পৃথিবীপৃষ্ঠে। ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিক্ষয়, সুনামি, ঝড়, তাপপ্রবাহ এসব আবহমানকাল ধরে কম-বেশি হয়ে চলেছে। দুর্যোগ যখন প্রাণি ও মানবসম্পদকে আঘাত করে, মনুষ্য-ব্যবহৃত ভূসম্পদের ব্যপক ক্ষতি করে তখন তা বিপর্যয়ের পর্যায়ে চলে যায়। জনমানবহীন জায়গায় ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, ধস-এর মত দুর্যোগ হলেও বিপর্যয়ের কারণ হয় না, আবার ১৯৯৯-এ ফাইলিন ঘুর্ণিঝড়, ২০০৪-এর ভারত মহাসাগরে সুনামি, ২০০৫-এ কাশ্মীর ভূমিকম্প, ২০০৮-এ চিনে ভূকম্প, ২০০৯-এ আয়লা ঘুর্ণিঝড় এবং সাম্প্রতিক আমপান বহু প্রাণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করেছে এবং তার জন্যে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। একসময় এইসব বিপর্যয়কে দেবতার রোষ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চল ছিল, আধুনিক কালে বলা হয় প্রকৃতির রোষ আর কিছু বিজ্ঞানী বলেন মানুষের জন্যে পৃথিবী গরম হয়ে যাচ্ছে বলে। এই তিনটেই বিশ্বাসজাত। সাম্প্রতিক ঘুর্ণিঝড় আমপান বিপর্যয়কে এই তিন কারণেই অভিযুক্ত করেছেন বিভিন্ন মানসিকতার লোক। 

ঘুর্ণিঝড় কেন হয়

একটা নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে পৃথিবীর ঘুর্ণনের পথে যে-কোনো তরল পদার্থের ঘুর্ণায়মান অবস্থাকে সাইক্লোন বলে। উত্তর গোলার্ধে এই ঘুর্ণন ঘড়ির কাঁটা ঘোরার দিকে আর দক্ষিণ গোলার্ধে বিপরীত দিকে। প্রতিটা সাইক্লোনের কেন্দ্রে একটা ঘুর্ণি হাওয়া তৈরি করে বলে এর নাম ঘুর্ণিঝড়। ক্রান্তীয় থেকে মেরুপ্রদেশে যে কোনো জায়গায় ছোট থেকে বড় নানা মাত্রার ঘুর্ণিঝড় হতে পারে কিন্তু এর প্রস্তুতিতে চাই গরম বাতাস। সূর্যের বিকিরণ রশ্মি সরাসরি সমুদ্রের জল গরম করে। ক্রান্তীয় অঞ্চলে সূর্যের তাপ সর্বাধিক হওয়ায় কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখাদ্বয়ের অন্তর্বর্তী অঞ্চলে অর্থাৎ ২৩.৫ ডিগ্রি উত্তর এবং ২৩.৫ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষরেখার মধ্যে ঘুর্ণিঝড় তৈরি হয়। তবে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলেই জল গরম হয় এবং গরম বাতাস অপেক্ষাকৃত হালকা বলে ওপরের দিকে উঠে গিয়ে নিম্নচাপ তৈরি করে। ভেতরের দিকে চাপ থাকে সবচেয়ে কম, বাইরের চাপ বেশি। এইবার বাইরের থেকে বায়ু নিম্নচাপের কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসে কিন্তু কেন্দ্রে কিছুতেই পৌঁছতে পারে না। মাঝখানের বেশ কিছুটা জায়গাকে ঘিরে তৈরি হয় ঘুর্ণিপাক, পাগলের মত হাওয়া ঘুরপাক খেতে খেতে তোলে ঘুর্ণিঝড়। একেবারে কেন্দ্রে ঘুর্ণিঝড়ের চোখ। বাতাস আবার সোজা চলতে পারে না, কাঁকড়ার মত পাশের দিকে সরতে থাকে, তাই আস্তে আস্তে চলে আসে ডাঙার দিকে। অনেক সময় ঘুর্ণিঝড়ের প্রবল বেগ ডাঙায় আসার আগেই তার তেজ কমে যায়। ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় হয় বলে ভারত মহাসাগর, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, মেক্সিকো উপসাগর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ঘুর্ণিঝড় প্রবণ। প্রতিবছরই একাধিক ঝড়ের মুখোমুখি হতে হয় এসব দেশে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার মানুষদের। 

সূর্যের অবস্থানের সাথে এই ঝড় তৈরি হবার সম্পর্ক আছে বলে উত্তর গোলার্ধে আগস্ট থেকে নভেম্বর আর দক্ষিণ গোলার্ধে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে এই ঝড় হয়। কিন্তু উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নের জন্যে ক্রান্তীয় অঞ্চলে ভারত মহাসাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরে মে-জুন ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সাইক্লোন হয়। ভারতে সাইক্লোন তৈরি হয় উত্তর ভারত মহাসাগরে। বঙ্গোপসাগর ও আরবসাগরে বছরের দুটো ভিন্ন সময়ে ঘুর্ণিঝড় হয়। বঙ্গোপসাগরে মে-জুন ও সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর এবং আরবসাগরে এপ্রিল-জুন ও সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর মাসে। বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি, গড়ে ছ’টা প্রতি বছরে, আরবসাগরে গড়ে দেড়। 

ভারতে ঘুর্ণিঝড়

ভারতে (বর্তমান বাংলাদেশ সমেত) ১৫৮৪ সাল থেকে রেকর্ডে দেখা গেছে অন্তত আঠারোটা বেশ বড় ধরনের ঘুর্ণিঝড় হয়ে গেছে যার ফলে প্রতিটিতে কমপক্ষে দশ হাজার মানবসম্পদ নষ্ট হয়েছে। বাংলা খাড়িতে ১৭৩৭ সালে তিন লক্ষ এবং ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। গত আড়াইশো বছরে ভারতে বড় ধরনের সাইক্লোনে প্রায় বারো লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণ নষ্ট হয়েছে। ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়ে যেসব বছরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা হোল [স্থান, মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা] – ১৫৮৪ (বাকেরগঞ্জ, বরিশাল, ২ লক্ষ), ১৬৯৯ (সুন্দরবন, ৫০ হাজার), ১৭৩৭ (হুগলি নদী, ৩.৫ লক্ষ), ১৭৬৭ (বরিশাল, ৩০ হাজার), ১৭৮৯ (করিঙ্গা, ২০ হাজার), ১৮২২ (বরিশাল, ৫০ হাজার), ১৮৩১ (বরিশাল, ২২ হাজার), ১৮৩৯ (করিঙ্গা, ৩ লক্ষ), ১৮৬৪ (কলকাতা, ৬০ হাজার), ১৮৭৬ (বাকেরগঞ্জ, ২ লক্ষ), ১৮৮২ (মুম্বাই, ১ লক্ষ), ১৮৯৭ (চট্টগ্রাম, ১.৭৫ লক্ষ), ১৯১২ (বাংলাদেশ, ৪০ হাজার), ১৯১৯ (বাংলাদেশ, ৪০ হাজার), ১৯৪২ (কলকাতা, ৪০ হাজার; বাংলাদেশ, ৬১ হাজার), ১৯৭০ (ভোলা, বাংলাদেশ, ৫.৫ লক্ষ), ১৯৭৭ (দেবী তালুক, ২০ হাজার), ১৯৯১ (বাংলাদেশ, ১.৪ লক্ষ)। [সূত্রঃ Encyclopedia of hurricanes, Typhoons and Cyclones (1999) by David Longshore; Deadliest Tropical Cyclones in History, www.wunderground.com]। উনিশ শতকে মৃত্যুর সংখ্যা আনুমানিক আট লক্ষেরও বেশি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি এবং তার যথাযথ ব্যবহার করে ১৯৯৯ সালে ওডিসায় ফাইলিন, ২০০৯ সালে আয়লা ও এ বছর আমপানের আগে সতর্কতামূলকভাবে দুর্যোগ সম্ভাব্য এলাকা থেকে মানুষ সরিয়ে ফেলার জন্যে ব্যাপক মানবসম্পদহানি রোখা সম্ভব হয়েছে যদিও চাষ-আবাদ, নদীর বাঁধ ও সম্পত্তিহানি হয়েছে প্রভূত।

আমপান

সাইক্লোনের নামকরণ করা হয় সারা পৃথিবী জুড়ে। সাধারণত এলাকা-ভিত্তিক নামের ব্যাঙ্ক করা হয় এবং সেখান থেকে নাম বাছা হয়। এবারের আমপান ঘুর্ণিঝড়ের নাম নেওয়া হয়েছে থাইল্যান্ডের প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকে। আমপান মানে আকাশ। বিশাখাপত্তনম থেকে ২০০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং শ্রীলঙ্কার ৩০০ কিলোমিটার পূর্বে ১৩ই মে ২০২০ তারিখে উত্তর ভারত মহাসাগরে জলের তাপমাত্রা অত্যন্ত গরম হয়ে যাওয়ায় একটা নিম্নচাপ তৈরি হয় ও উত্তরপূর্ব দিকে সরতে থাকে এবং ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। নিম্নচাপ আরও গভীর হয় এবং ঘুর্ণিঝড় প্রবল আকার নিয়ে কলকাতার দিকে এগিয়ে আসে। ১৮ই মে এই ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ হয় ঘন্টায় ২৬০ কিলোমিটার। তারপর উপকূলের দিকে এগিয়ে এলে বাতাসের গতিবেগ কমতে থাকে এবং ২০শে মে ১৫৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিবেগে দুপুর আড়াইটেয় পশ্চিমবাংলার উপকূলে আছড়ে পড়ে। বিজ্ঞানীদের মতে বঙ্গোপসাগর এলাকায় ১৫৮২ সালের পর রেকর্ড অনুসারে ১৭৩৭, ১৮৩৩, ১৯৯৯ এর পর আমপান চতুর্থ সুপার সাইক্লোন। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা এবং পূর্ব মেদিনীপুর সমেত বিস্তীর্ণ এলাকা ঝড়ে আক্রান্ত। এছাড়াও ওডিসা ও বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। কোভিড-১৯ এর জন্যে সামাজিক দূরত্বের সতর্কতা মেনেও প্রচুর উপকুলবাসী লোকেদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মৃত্যুর হার অনেক কম। পশ্চিমবঙ্গে ৯৮ জন মানুষের মৃত্যুর খবর নথিভুক্ত হয়েছে। তবে কলকাতা সহ জেলাগুলোতে প্রচুর বাড়িঘর ভেঙে, গাছ উপড়ে, ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে চাষআবাদের ফসল ও জমি সব ব্যাপক নষ্ট করে দিয়েছে। দু লক্ষ একর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। 

বিশ্বাস বনাম বিজ্ঞান 

উত্তর ভারত মহাসাগরে ঘুর্ণিঝড় বাৎসরিক প্রাকৃতিক ঘটনা। কখনও ঝড়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে। বিপর্যয়ের আবার অন্য কারণও আছে, যেমন প্রকৃতি ও পরিবেশের তোয়াক্কা না করে যেখানে সেখানে মানুষের বসবাস যার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব বেশি আর তার সাথে যুক্ত হয় আর্থ-সামাজিক দিক। সুন্দরবন অঞ্চলে মানুষের বসবাস প্রাকৃতিক নিয়মবিরুদ্ধ এবং তাই বারবার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। সুন্দরী গাছ ও বাঁধ জলপ্লাবনের মাত্রা কমাতে পারে কিন্তু নির্মূল করা যাবে না। এছাড়াও ভূগাঠণিক দিক দিয়ে এলাকার অনেকটাই অধোগমনে ক্ষয়ের মুখে যার জন্যে সমুদ্রের জলের মাত্রা আপেক্ষিক বৃদ্ধি পাওয়ায় নোনা জল ঢুকে আসছে। ক্ষতিগ্রস্তরা বেশিরভাগই গরীব মানুষ। দেবতা বা প্রকৃতির রোষ এখানে কাজ করে না, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও মানবিকতার অভাবই প্রধান দায়ী। সেভাবেই, বিশ্ব উষ্ণায়ন, এল-নিনো এগুলো সবই বাস্তব, আন্তর্হিমবাহ যুগে, যখন পৃথিবীর তাপমাত্রা গত বারো হাজার বছর ধরে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, এবং মাঝেমাঝে হঠাৎ বেশি গরম বা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, এগুলোকে অস্বীকার করা যায় না। আট হাজার বছর আগে পৃথিবী খুব গরম হয়ে গেছিল আবার সাত শো বছর আগে ছিল ক্ষুদ্র বরফ যুগ। পৃথিবী স্বাভাবিক নিয়মেই গরম হয়ে যাচ্ছে, এর জন্যে মানুষের অবদান যৎসামান্য। যদি ধরেই নেওয়া যায় গত একশো বছরে জ্বালানি ব্যবহারের জন্যে পৃথিবী গরম হয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়িয়ে দিয়েছে, যেমন এক্ষেত্রে ঘুর্ণিঝড়, তাহলে তার আগের দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বিজ্ঞান বিশ্বাসের থেকে বিশ্লেষণে আস্থা রাখে তাই অনুসন্ধান ও গবেষণা চলতে থাকে। 

(লেখক ভূবিজ্ঞানী এবং জিএস আই-এর প্রাক্তন অধিকর্তা)

0 comments: